ট্রাম্প পানামা খাল দখল করতে চায় কেন

ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে দখলদারী মনোভাব পোষণ করে আসছিল। ক্ষমতা গ্রহণের দিন উদ্বোধনী ভাষণেই ট্রাম্প পানামা খাল দখেলে নেওয়ার বিষয়ে জোড়ালো মন্তব্য করেন। এছাড়ও গ্রীনলান্ড দ্বীপ বা কানাডার মত দেশ দখল করে যুক্তরাষ্ট্রের মানচিত্রে অন্তর্ভূক্ত করার মত নানা বিষয়ে ট্রাম্প একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করেই চলেছে।

পানামা খাল কিভাবে তৈরী করা হয়েছিল, এই খাল কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ট্রাম্প কেন পানামা খাল দখল করতে চায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।

পানামা খালের গুরুত্ব

বিশ্ব বাণিজ্য ও রাজনীতিতে পনামা খাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই খালটি একই সাথে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে পৃথক করেছে এবং আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। সমগ্র বিশ্ব বানিজ্যের প্রায় ৫ শতাংশ সম্পন্ন হয় পানামা খাল দিয়ে। 

অতীতে আর্জেন্টিনার কেপ হর্ণের জলপথ ঘুরে, আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে নৌযানভেদে সময় লাগত প্রায় ২ থেকে ৬ মাস। পরবর্তীতে পানাম খাল তৈরী হবার পর মাত্র ২০-৩০ ঘন্টার মধ্যেই আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাতায়াত করা যায়।

১৫৩৪ সালে সর্বপ্রথম স্প্যানিশ প্রকৌশলীরা একটি জরিপ করে, আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর জন্য পানামায় একটি খালের প্রস্তাব দেন। তৎকালীন সময়ের নির্মান পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতার কারনে এই প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। 

প্রথম খাল খনন চেষ্টা

তৎকালীন সময়ে পানামা ছিল কলম্বিয়ার অংশ। ১৮৫৯ সালে মিশরের মরুভূমির মধ্য দিয়ে সুয়েজ খাল নির্মাণ প্রকল্প সম্পন্ন হবার পর পানামা খাল নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু মরুভূমির মাঝে সুয়েজ খাল খনন আর, পানামার পাহাড়ি জঙ্গলে খাল নির্মাণ এক বিষয় নয়। সেই সাথে পানামার এই জঙ্গলে ছিল আগ্নেয় শিলার স্তুপ, দুরারোগ্য ব্যাধির সংক্রমন, হিংস্র বন্যপ্রাণী এবং বিষাক্ত পোকামাকড় সহ নানা রকমের প্রতবন্ধকতা। তাই পানামা খাল খনন করাটা, সুয়েজ খাল খননের চেয়েও অনেক বেশি কঠিন ছিল। 

১৮৮১ সালে একটি ফ্রেঞ্চ কোম্পানি ক্যারিবিয়ান ও ইন্ডিয়ান শ্রমিকদের দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করার মাধ্যমে পানামা খাল খননের কাজ শুরু করে। জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে ইয়েলো ফিভার আর ম্যালেরিয়া সহ বিষাক্ত পোকামাকড়, আর সাপের কামড়ে প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়ার মারা যায়। সেসময় গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন শ্রমিক মারা যেতে থাকে। এছাড়া পানামার পর্বতময় এলাকার ভেতর দিয়ে খাল খনন করতে গিয়ে নিয়মিত ভূমি ধ্বস হতে থাকে। ফলে এক পা আগালে তিন পা পিছিয়ে আসতে হচ্ছিল। ম্যালেরিয়ার বিস্তার আর মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতির কারনে ১৮৮৯ সালে, ২০ হাজারেরও বেশী কর্মীর লাশ পেছনে ফেলে, ফ্রেঞ্চ কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পানামা খাল খননের কাজে ইস্তফা দেয়। সেই বিশাল ব্যর্থতায় ফ্রান্স সরকারের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়।

পানামা খাল খনন

১৮৯৮ সালে স্প্যানিশ আমেরিকান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হলেও, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৈন্য পরিবহণ ও রসদ সরবারাহের ক্ষেত্রে আমেরিকানরা বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিল। সেকারণে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট নতুন করে পানামা খাল খনন করার পরিকল্পনা করেন।

তখনও পর্যন্ত কাগজে কলমে পানামার মালিক ছিল কলম্বিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কলম্বিয়ার সাথে কোন চুক্তি না করে, পানামার বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনা করতে থাকে। ১৯০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র পানামার বিদ্রোহী গোষ্ঠী কে প্রস্তাব দেয়: তারা যদি যুক্তরাষ্ট্রকে পানামার উপর খাল খননের অনুমতি দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র পানামা কে কলম্বিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করবে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ খবরদারিতে রক্তপাত বিহীন এক বিদ্রোহের মাধ্যমে পানামা স্বাধীনতা লাভ করে। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পানামা খাল এলাকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখানে একটি মার্কিন ছিটমহল গড়ে তোলে। এবং ১৯০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র পানামা খাল খননের কাজ শুরু করে।

পানামা খালের প্রযুক্তি

আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর কে সংযুক্ত করার জন্য পানামা খাল খনন করা হলেও, পানামার এই অঞ্চলের ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত। সেকারণে পানামার দুই প্রান্তে বেশ কিছু লক বা জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এগুলো অনেকটা পানি দিয়ে তৈরী জাহাজের লিফটের মত কাজ করে। এগুলোর মাধ্যমে জাহাজগুলোকে পর্যায়ক্রমে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৬ মিটার বা প্রায় ৭ তলার সমান উঁচুতে তোলা হয়। 

তবে পানামা খালের সমস্ত অংশই খাল খননের মাধ্যমে তৈরী করা হয়নি। এই অঞ্চলে প্রবাহিত চার্গেস নদীতে বাঁধ দিয়ে, গাটুন নামে এখানে একটি কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করা হয়। বাঁধের পানি দিয়ে প্লাবিত ১৬৪ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত গাটুন হ্রদ; তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম হ্রদ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। এই হ্রদ থেকে আবারো বেশ কিছু জলকপাটের মাধ্যমে, জাহাজগুলোকে প্রশান্ত মহাসাগরের জলের স্তরে নামিয়ে আনা হয়।

পানামা খাল তৈরী করতে এখানকার কুলেবড়া পর্বতকে ৮ মাইল লম্বা, ৩০০ ফিট চওড়া ও ৫০ ফিট গভীর করে খনন করা হয়। দুসাধ্য এই কাজ সম্পন্ন করতে প্রায় ২৭ হাজার শ্রমিক মারা যায়। অবশেষে ১৯১৪ সালের ৩ অগাস্ট, পানামা খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয়।

পানামা খালের বাণিজ্যিক এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পানামার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র পানামায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে, পানামাবাসী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে।

এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পেলে, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পানামা খাল হস্তান্তর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এবং তার প্রায় ২২ বছর পর ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পানামাবাসী পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তখন থেকে দেশটির সরকারী প্রতিষ্ঠান পানামা ক্যানাল অথরিটি খালটি ব্যবস্থাপনার দ্বায়িত্ব পালন করে আসছে।

ট্রাম্প দখল করতে চায় কেন

যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু পানামা খাল খনন করেছিল, তাই বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন পানামা খাল আবারো যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আসা উচিত। তাছাড়া ট্রাম্পের যুক্তি হল, পানামা খালে মার্কিন জাহাজ চলাচলে অধিক শুল্ক আরোপ করা হয়, এবং পানামা সরকারকে হাত করে, চীন কৌশলে এই খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। সেকারণেই ট্রাম্প আবারো পানামা খালকে মার্কিন সরকারের দখলে আনতে চায়। ট্রাম্প তার উদ্বোধনী ভাষণেও এ বিষয়ে হুমকি দিয়েছেন।

ট্রাম্প শুধু মৌখিক হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সে অনেকটা পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছে। সাধারণত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রথমে বড় বড় মিত্রদেশগুলোতে সফর করেন। তবে ট্রাম্পের পররাস্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিও তার প্রথম সফরেই পানামায় গেছেন। 

বর্তমানে বছরে প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি নৌযান পনামা খাল দিয়ে যাতায়াত করে। যা পানামার জাতীয় অর্থনীতির ৬ শতাংশের জোগান দেয়। পানামা খাল দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের ৭৪ শতাংশই মার্কিন জাহাজ। এরপরই রয়েছে চীনের অবস্থান। পানামা খালে চলা প্রায় ২১ শতাংশ জাহাজ চীনের। 

পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো বলেছেন, ‘খালটির ওপর চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তিরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ সকল ধরনের নৌযান, এমনকি যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন এই খাল দিয়ে চলাচল করতে পারে।

পানামার সাথে চুক্তির মাধ্যমে খাল নির্মাণের সময় থেকে প্রায় ১০০ বছর যুক্তরাষ্ট্র এখানে এক ধরনের ছিটমহল তৈরী করে রেখেছিল। পানামার মধ্যে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সেই ছিটমহলে, মার্কিন সামরিক ঘাঁটি, পুলিশ, এমনকি মার্কিন আদালত পর্যন্ত কার্যকর ছিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ আগ্রাসনের মাধ্যমে, পানামা খালে চীনের দখলদারির কাল্পনিক অভিযোগ তুলে, বিশ্ব বানিজ্যের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পানামা খাল আবারো দখল করতে চাইছে।

সম্পর্কিত পোস্ট

ভারত বনাম পাকিস্তান সামরিক শক্তিতে কে এগিয়ে

ভূমিকা ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার মধ্যেই রয়েছে। কাশ্মির ইস্যু, সীমান্ত সংঘাত এবং পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা উভয় দেশের সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন যে, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে কে জিতবে? এর উত্তরটা আসলে বেশ জটিল। দুই দেশের সামরিক জনবল, অস্ত্রশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বাজেট, পারমাণবিক ক্ষমতা, এবং কৌশলগত নীতি ও অবস্থান সহ আরো বেশ কিছু বিষয়ের উপর যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে। ভারত-পাকিস্তানের তুলনা সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনকি সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সামরিক শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের পরেই ভারতের অবস্থান। ২০২৫ সালের গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃত। এই সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান ১২ তম। তারমানে সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে ৮ ধাপ এগিয়ে। তবে সেই অর্থে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি ভারতের তুলনায় একেবারেও দুর্বল নয়। ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট মাত্র ৭.৬৪ বিলিয়ন ডলার। তারমানে ভারতের প্রতিক্ষা বাজেট পাকিস্তানের প্রায় ১০ গুণ বেশি। তবে ভারত বনাম পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজর্ভের দিকে তাকালে বিষয়টি খুব বেশি অস্বাভাবিকও লাগবে না। কারণ ভারতের রিজার্ভ ৬২৭ বিলিয়ন ডলার অন্যদিকে পাকিস্তানের রিজার্ভ আছে মাত্র ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার। জনসংখ্যার দিক থেকেও ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ভারতে জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। ২০২২ সালে, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি।  । সামরিক শক্তির তুলনা আধুনিক সামরিক শক্তি মূলত প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, কৌশল এবং অস্ত্রের মানের ওপর নির্ভর করে। সেনা সদস্যের সংখ্যা একটি দেশের সামরিক সক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি সামগ্রিক সামরিক শক্তি নির্ধারণের একমাত্র সূচক নয়। ভারতের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ ৫৫ হাজার, অন্যদিকে পাকিস্তানের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ ৫৪ হাজার। ভারতের রিজার্ভ সৈন্য ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার এবং পাকিস্তানের রিজার্ভ সৈন্য ৫.৫ লক্ষ। ভারতের আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লক্ষ ২৭ হাজার এবং পাকিস্তানের আধা-সামরিক বাহিনীতে প্রায় ৫ লক্ষ সদস্য রয়েছে। ভারতের ট্যাংকের সংখ্যা ৪ হাজার ২০১টি, পাকিস্তানের ট্যাংক আছে ২ হাজার ৬২৭টি। ভারতের সাঁজোয়া যান আছে ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৯৪ টি, পাকিস্তানের সাঁজোয়া যান আছে ১৭ হাজার ৫১৬টি। ভারতের বিমান বাহিনীতে মোট বিমানের সংখ্যা ২ হাজার ২২৯ টি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মোট বিমান ১ হাজার ৩৯৯টি। ভারতের যুদ্ধ বিমান আছে ৫১৩টি; পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমান ৩২৮টি। এট্যাক হেলিকপ্টার সহ ভারতের মোট হেলিকপ্টার আছে ৮৯৯ টি, পাকিস্তানের আছে ৩৭৩টি হেলিকপ্টার। এছাড়া ভারতের পরিবহন বিমান ২৭০ টি এবং পাকিস্তানের পরিবহণ বিমান ৬৪ টি। ভারতের কাছে ফ্রান্সের তৈরী রাফাল যুদ্ধবিমানের মত আধুনিক বিমান আছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে থাকা সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান হল, চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত JF-17 Thunder যুদ্ধবিমানের সর্বশেষ সংস্করণ Block III। তবে ভারতেও নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত তেজস সিরিজের বেশ কয়েকটি মডেলের উন্নত যুদ্ধবিমান রয়েছে। লজিসস্টিকসের দিক থেকে ভারতের বিমানবন্দর আছে ৩১১টি আর পাকিস্তানের আছে ১১৬টি। ভারতীয় নৌ বাহিনীতে মোট নৌযানের সংখ্যা ২৯৩ টি। পাকিস্তান নৌ বাহিনীর মোট নৌযানের সংখ্যা ১২১টি। ভারতের ফ্রিগেট যুদ্ধ জাহাজ আছে ১৪ টি, পাকিস্তানের ৯টি। ভারতের ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধ জাহাজ আছে ১৩ টি। কিন্তু পাকিস্তানের কোন ডেস্ট্রয়ার নেই। ছোট আকারের করভেট যুদ্ধ জাহাজ ভারতের আছে ১৮টি আর পাকিস্তানের ৯টি। ভারতের সাবমেরিন আছে ১৮টি, পাকিস্তানের ৮টি। এছাড়া ভারতের টহল নৌযান আছে ১৩৫টি এবং পাকিস্তানের টহল নৌযান আছে ৬৯টি। এসবের বাইরে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই পারমানবিক অস্ত্রভান্ডার আছে। ভারতের কাছে আনুমানিক ১৭২টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে ১৭০টি। ভারত “No First Use” অর্থাৎ প্রথমে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার নীতিতে অটল। তারমানে ভারত শুধুমাত্র আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। কিন্তু পাকিস্তান “No First Use” নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়; তারা অস্তিত্বগত হুমকির মুখে প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য ভূমি-ভিত্তিক Agni সিরিজ, সমুদ্র-ভিত্তিক Arihant শ্রেণির সাবমেরিন, এবং বিমান-ভিত্তিক একাধিক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য Shaheen ও Ghaznavi সিরিজের ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। তবে পাকিস্তান এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যেই পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ২০০-২৫০ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। উপরের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয় যে সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে রয়েছে। তবে পাকিস্তান পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পারমানবিক অস্ত্রের ব্যবহারের নীতিমালার দিক থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। কে এগিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বারবার গণতন্ত্রের ব্যাঘাত ঘটেছে। দেশটি বেশিরভাগ সময়ই সামরিক বাহিনীর শাসনে পরিচালিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশের রাজনীতি, প্রশাসন এমনকি অর্থনীতির একটি বড় অংশও নিয়ন্ত্রণ করে। সেনাবাহিনীর রয়েছে নিজস্ব ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, ব্যাংক, আবাসন প্রকল্প, এমনকি খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণনেও তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে যুদ্ধ বা সংঘাতের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা একটি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরী। অন্যদিকে, ভারত অন্তত কাগজে কলমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই যুদ্ধের নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে, এবং সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণে বিভিন্ন স্তরের পর্যালোচনা দরকার হয়। ভারতের একটি জটিল চ্যালেঞ্জ হল তাদের সামরিক শক্তির বড় একটি অংশ চীন সীমান্তে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশ এলাকায় ভারত চীনের দিক থেকে বরাবরেই চাপের মধ্যে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশাল স্থল সীমান্ত, সেটিও কৌশলগতভাবে অনেকটাই সংবেদনশীল। গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে, কারণ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশকে “মিত্র” রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করলেও, এখন ভারত নীতিগতভাবে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার সেভেন সিস্টার্স সম্পর্কিত বক্তব্যের পর থেকে। অন্যদিকে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের আরো এটি বড় সুবিধা রয়েছে। আর তা হল পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন। ভারত-চীন সম্পর্ক বরাবরই টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীন ও পাকিস্তানের দ্বৈত চাপ ভারতের কৌশলগত অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে। এছাড়াও, পাকিস্তান তুলনামূলক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও, তারা দীর্ঘদিন ধরে সামরিক খাতে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করে চলেছে শুধুমাত্র ভারতকে মোকোবেলা করার জন্য। তাই পাকিস্তান না খেয়ে হলেও ভারতকে দমন করার বিষয়ে কোন ছাড় দিতে চাইবে না। প্রথাগতগত যুদ্ধে যদি পাকিস্তানের অবস্থান ভেঙেও পড়ে, সেক্ষেত্রে পাকিস্তান ভারতের আগে পারমানবিক হামলা চালাতে পারে। সব মিলিয়ে, ভারত সামরিক সংখ্যার বিচারে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকলেও, একসাথে সব শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কারণ চীন, বাংলাদেশ, এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা – এই তিনটি ফ্রন্টে ভারতকে সমানভাবে নজর রাখতে হয়। তাই পাকিস্তানকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করা ভারতের জন্য কখনোই খুব সহজ কাজ নয়।

মানবিক করিডোর আসলে কী

ভূমিকা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গৃহযুদ্ধের কারণে যে মানবিক সংকট তৈরী হয়েছে, তা মোকাবিলা করার জন্য একটি মানবিক করিডোরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মানবিক করিডোরের ব্যাপারে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। তখন বিষয়টি নিয়ে বিএনপি, জামাত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল সমালোচনা শুরু করলে; পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন যে, জাতিসংঘের সাথে এ বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সরকারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে মানবিক করিডোরের বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরী হয়েছে। করিডোর কী? করিডোর হলো একটি নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিরাপদে ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণত আন্তর্জাতিক বা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়। মোটাদাগে করিডোর কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ১. বাণিজ্যিক করিডোর ২. মানবিক করিডোর এবং ৩. সামরিক করিডোর। দুটি অঞ্চলের মধ্যে অবাধে পণ্য ও বাণিজ্য সরবরাহের জন্য বাণিজ্যিক করিডোর নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)। কোন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় খাদ্য, ওষুধ বা ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর তৈরী করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া এবং ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধে মানবিক করিডোর স্থাপনের নজির আছে। অন্যদিকে সামরিক করিডোর হলো এমন নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা সামরিক বাহিনী, অস্ত্র, সরঞ্জাম বা সৈন্য পরিবহনের জন্য নিরাপদে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সৌদি আরব থেকে ইরাক ও কুয়েত সীমান্তের সড়কপথ যুক্তরাষ্ট্র সামরিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানবিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক করিডোর ছাড়াও অন্যান্য ধরনের করিডোর রয়েছে। যেমন: বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য পরিবেশগত করিডোর, রেল ও সড়ক যোগাযোগের জন্য পরিবহন করিডোর, তেল গ্যাস বা িবদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জ্বালানী বা শক্তি করিডোর, ফাইবার অপটিক কেবল, সাইবার নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল/তথ্য করিডোর এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ ও পর্যটন উন্নয়নের জন্য শিক্ষা/সাংস্কৃতিক করিডোর ইত্যাদি। মানবিক করিডোর কী? কোন সংঘাতপূর্ণ বা দুর্যোগ-আক্রান্ত এলাকায়, খাদ্য, ওষুধ, পানি বা চিকিৎসা সরঞ্জামের মত জরুরি ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর ব্যবহৃত হয়। এটি বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষা এবং মানবিক সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে স্থাপিত হয়। কখনো কখনো এই করিডোর বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হয়। মানবিক করিডোর সাধারণত জাতিসংঘ (UN) বা অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এবং সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে কার্যকর হয়। মানবিক করিডোরের প্রধান উদ্দেশ্য হলো: ১. ত্রাণ সরবরাহ ২. বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ৩. মানবাধিকার রক্ষা এবং ৪. নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সংকটগ্রস্ত জনগণ যেন দুর্ভিক্ষ, অনাহার বা স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি না হয় সেই লক্ষ্যে মানবিক করিডোর স্থাপন করা হয়। অবরুদ্ধ বা সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার আগে পরে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন নিশ্চিত করাও একটি উদ্দেশ্য। সেই সাথে ত্রাণ বিতরণে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়া সকল পক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যক্তির কাছে সহায়তা পৌঁছানোও গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। মানবিক করিডোরের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখেযোগ্য হল, করিডোরে সামরিক কার্যক্রম বা অস্ত্রের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা। করিডোরে ত্রাণ পরিবহন বা নাগরিকদের স্থানান্তরের সময় যেন নতুন করে কোন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরী না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা। সাধারণত জাতিসংঘ বা রেড ক্রস (ICRC) এর মত নিরপেক্ষ সংস্থাগুলো এটি পরিচালনা করে। তাই এমন কোন বিতর্কিত পক্ষ বা সংস্থাকে মানবিক করিডোরে প্রবেশাধিকার না দেওয়া, যাতে করে নতুন করে সংঘাত তৈরী হয়। কারণ এই ব্যবস্থার অন্যতম শর্তই হল যুদ্ধবিরতি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে করিডোরকে হামলামুক্ত রাখা। মানবিক করিডোর আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে পরিচালিত হয়, যা জেনেভা কনভেনশন (1949) এবং এর অতিরিক্ত প্রটোকল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইন অনুযায়ী ত্রাণ কর্মী ও কনভয়ের উপর হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কগজে কলমে মানবিক করিডোরকে বিভিন্নভাবে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও, অনেক সময় ত্রাণ সামগ্রী সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে যেতে পারে। ত্রাণ বিতরণে কিছু গোষ্ঠী বঞ্চিত হতে পারে, যা আরো বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করে। রাখাইনে মানবিক করিডোর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে ত্রাণ সামগ্রী রাখাইনের বেসামরিক জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়। বাংলাদেশ সরকার শর্তসাপেক্ষে এই করিডোর দেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। চুক্তির শর্তগুলোর বিস্তারিত জনসমক্ষে প্রকাশ না করায় রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্তের ব্যাপারে জানা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ত্রাণ সরবরাহ শুধুমাত্র জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। ত্রাণ যেন সরাসরি রাখাইনের নাজুক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় এবং আরাকান আর্মি বা মিয়ানমার জান্তার মত কোনো সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেন এটি দখল করতে না পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল করিডোর যেন রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে আরও জটিল না করে বা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি না বাড়ায়। এবং সকল জাতিগত গোষ্ঠী, বিশেষ করে রোহিঙ্গা, রাখাইন এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে ন্যায্যভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। মানবিক করিডোর বাস্তবায়নে চুক্তির শর্ত হিসেবে এসব বিষয় আলোচনা করা হলেও, বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। রাখাইনের বেশিরভাগ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, যারা একটি রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র গোষ্ঠী। ত্রাণ সামগ্রী তাদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। করিডোরের ফলে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এমনকি বিগত কয়ক মাসে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশও করেছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঝুঁকি জাতিসংঘের মাধ্যমে এই মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মূলত একটি আন্তর্জাতিক কৌশলের অংশ, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই করিডোর ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র চায় আরাকান আর্মিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করতে। কারণ, চীন ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে, রাখাইনকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভূক্ত করেছে। যার ফলে চীন এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে বঙ্গোপসারগ সহ ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে এখানে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাখাইনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে চীনের প্রভাবকে ভারসাম্যহীন করার চেষ্টা করতে পারে। জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাখাইনের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেও সহায়তা পাঠাতে পারে। কিন্তু তারা করিডোর ব্যবহারের পন্থা বেছে নিয়েছে, কারণ মানবিক করিডোর একটি ছদ্মবেশী কৌশল হতে পারে। যাতে ভবিষ্যতে এখানে পরিস্থিতি আরো জটিল হলে; আন্তর্জাতিক মঞ্চে কেউ জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে না পারে। উল্টো বাংলাদেশ, ভারত, চীন বা অন্য কোন পক্ষের উপর দায় চাপানো যায়। জাতিসংঘের নিরপেক্ষতার আড়ালে এই ধরনের আন্তর্জাতিক চালবাজি, বিশ্বের যে কোন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলেই একটি সাধারণ ঘটনা। এভাবেই বিশ্ব রাজনীতির খেলায় ‘মানবিক সাহায্য’ নামের আড়ালে গভীর কৌশল লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের জন্য মানবিক করিডোর একটি জটিল দ্বিধার জায়গা। একদিকে, করিডোরে সম্মতি দিলে হয়ত দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। আবার অন্যদিকে করিডোরে অসম্মতি জানালেও আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে দায়ী করে রোহিঙ্গা সংকটকে আরও ঘোলাটে করতে পারে। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি বোঝা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য

পোপকে কোথায় এবং কিভাবে সমাহিত করা হয়েছে

ভূমিকা রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। পোপদেরকে সাধারণত ভ্যাটিকান সিটিতে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নিচে সমাহিত করা হয়। তবে পোপ ফ্রান্সিসকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ভ্যাটিকানের বাইরে অবস্থিত রোমের ব্যাসিলিকা ডি সান্তা মারিয়া ম্যাজিওরে সমাহিত করা হয়েছে। বিগত ১২০ বছরের মধ্যে প্রথমবার কোনো পোপ কে ভ্যাটিকানের বাইরে সমাহিত করা হল। মৃত্যুর পর প্রস্তুতি পোপের মৃত্যুর পর তাঁর দেহকে সম্মানের সঙ্গে ধৌত করা হয় এবং পন্টিফিকাল ভেস্টমেন্ট নামের বিশেষ ধর্মীয় পোশাক পরানো হয়। এরপর তার দেহটি কয়েকদিন সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় রাখা হয় যাতে বিশ্বাসী ও ভক্তরা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। সমাধিস্থ করার আগে পোপের দেহ একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়, যা পরে সীসা ও আরেকটি কাঠের কফিনে সিল করা হয়। কফিনে পোপের নাম, তার রাজত্বের সময়কাল এবং অন্যান্য তথ্য খোদাই করা থাকে। এরপর কফিনটি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ক্রিপ্টে বা পোপের নির্দেশিত স্থানে সমাহিত করা হয়। সমাধির আগে ফিউনারেল মিসা নামে একটি বিশেষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কার্ডিনালরা ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থাকেন। পোপ ফ্রান্সিস ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর দেহকে সান্তা মার্তার চ্যাপেলে একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়। তিনি পোপদের জন্য ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী তিনটি কফিনের পরিবর্তে একটি সাধারণ কফিনে তার দেহ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কফিনে তাঁর শাসনকালের কয়েন, মেডেল এবং তাঁর ১২ বছরের পোপত্বের মূল বিষয়গুলোর একটি দলিল রাখা হয়। ২৩ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর দেহ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ২৬ এপ্রিল সকাল ১০টায় সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে কার্ডিনাল জিওভান্নি বাত্তিস্তার নেতৃত্বে  পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মিসা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২২০ জন কার্ডিনাল, ৭৫০ জন বিশপ এবং ৪,০০০-এর বেশি পুরোহিত অংশ নেন। এই মিসায় সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নেন। বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনুসও পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস কে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে পূর্বে মোমবাতি রাখার একটি কক্ষ ছিল। পোপ নিজেই এই জায়গাটি তার সমাধির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। পোপদের সাধারণত ভ্যাটিকানে সমাহিত করা হলেও, পোপ ফ্রান্সিস নিজেই সান্তা মারিয়া ম্যাজিওর বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ২০২২ সালে বলেছিলেন, ভার্জিন মেরি তাঁকে এখানে সমাধিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসের এই ব্যাসিলিকার প্রতি গভীর ভক্তি ছিল, বিশেষ করে এখানে অবস্থিত মেরি সালুস পপুলি রোমানি আইকনের প্রতি। তিনি তাঁর ৪৭টি আন্তর্জাতিক সফরের আগে ও পরে এবং হাসপাতালে ভর্তির পর এখানে প্রার্থনা করতেন। অতীতে তিনি কার্ডিনাল হিসেবেও রোম ভ্রমণ করলে এই গির্জায় বেড়াতে আসতেন। পোপ ফ্রান্সিসের সাদামাটা জীবন পোপ ফ্রান্সিস এর আসল নাম জর্জ মারিও বের্গোগ্লিও। তিনি ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত রোমান ক্যাথলিক চার্চের একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় সোসাইটি অফ জিসাস বা জেসুইটের সদস্য ছিলেন। জেসুইটরা অত্যন্ত সরল ও বিনয়ী জীবন যাপন করে। পোপ ফ্রান্সিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। পোপদের থাকার জন্য একটি রাজকীয় প্রাসাদ রয়েছে। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস পোপ নির্বাচিত হবার পর ভ্যাটিকানের অ্যাপোস্টলিক প্যালেসের পরিবর্তে, সান্তা মার্তা নামের একটি গেস্টহাউসে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এটি একটি সাধারণ বাসস্থান, যার মধ্যে ছিল একটি শোবার ঘর, বাথরুম এবং অধ্যয়ন কক্ষ। পোপ ফ্রান্সিস ঐতিহ্যবাহী পোপের পোশাকের তুলনায় সাধারণ পোশাক পছন্দ করেতেন। তিনি বিলাসবহুল পোপের জুতোর পরিবর্তে সাধারণ কালো চামড়ার জুতো পরতেন। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যেমন ঘড়ি বা ব্যাগ, সবই সাধারণ এবং কোনটিই ব্যয়বহুল নয়। পোপ ফ্রান্সিস বিলাসবহুল গাড়ির পরিবর্তে সাধারণ গাড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার মনে হয় একজন পুরোহিতের বিলাসবহুল গাড়ি থাকা উচিত নয়। পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানেও গরিব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য খাবার, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলতেন, “একটি গির্জা যদি গরিবদের পাশে না থাকে, তবে তা গির্জা নয়।”পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বাস করতেন যে নেতাদের উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই তিনি িনজে বিলাসিতা পরিহার করে, গির্জার পুরোহিত ও বিশপদের বিলাসিতা ত্যাগ করে সাধারণ জীবনযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে অতীতে অধিকাংশ পোপ কিন্তু পোপ ফ্রান্সিসের মত এতটা বিনয়ী এবং সাদামাটা জীবন যাপন করতেন না। মধ্যযুগের পোপেরা ছিলেন ইউরোপের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তারা একেকজন ক্ষমতালোভী রাজা বা সম্রাটদের চেয়েও অনেক বেশি দুর্ণীতিগ্রস্ত ছিলেন।

Shopping Cart
Scroll to Top