Author name: Nizam Uddin

জীবনযাপন

রোজার বিজ্ঞানভিত্তিক উপকারিতা কী

রোজার বিজ্ঞানভিত্তিক উপকারিতা কী? পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালন করা ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের একটি। ইসলাম ধর্মের এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যমই নয়, বরং এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। রমজান মাসে রোজা পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের পাশাপাশি আত্মসংযম, ধৈর্য, এবং সহানুভূতির মতো গুণাবলী অর্জন করে। এছাড়া, বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোজা শরীরের বিপাকীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানসিক চাপ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  রোজার বহুমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। শারীরিক উপকারিতা প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মে উপবাসের চর্চা রয়েছে, এবং আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে যে এটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ইসলাম ধর্মে আত্মশুদ্ধি, সংযম ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য রোজা পালন করা হয়। তবে বিজ্ঞানীরা একে স্বাস্থ্যের উন্নয়নে এক কার্যকরী কৌশল হিসেবেও ব্যাখ্যা করেছেন।  রোজার সময় দীর্ঘ সময় ধরে খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকার ফলে দেহের অভ্যন্তরে জমে থাকা টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থগুলো প্রাকৃতিকভাবে বের হয়ে যায়। লিভার, কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গগুলো এই সময়ে তাদের কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করে এবং দেহকে পরিষ্কার করে। রোজার সময় পাকস্থলী এবং হজমতন্ত্র বিশ্রাম পায়, যা হজমশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, রোজার মাধ্যমে গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, অ্যাসিডিটি এবং বদহজমের মতো সমস্যাগুলো কমে যায়। যখন আমরা দীর্ঘ সময় ধরে খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকি, তখন শরীর গ্লুকোজের পরিবর্তে সঞ্চিত চর্বি থেকে শক্তি উৎপাদন শুরু করে। এই প্রক্রিয়া ‘কিটোসিস’ নামে পরিচিত; যা শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, রোজা রাখার সময় শরীর ‘অটোফেজি’ নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরনো ও ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে পরিষ্কার করে নতুন কোষ তৈরি করে। ২০১৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহসুমি এই অটোফেজি প্রক্রিয়ার গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে যে, উপবাসের মাধ্যমে শরীরের এই প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতা প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, যা ক্যান্সার ও আলঝেইমারের মতো রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। ২০১৯ সালে ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোজার মত নিয়ন্ত্রিত উপবাস শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করে।  এছাড়া, রোজা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। ফলে কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড এবং রক্তচাপের মাত্রা হ্রাস পায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত উপবাস করেন, তাদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সমস্যা কম দেখা যায়। ২০১৪ সালে ‘সেল স্টেম সেল’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, দীর্ঘায়িত উপবাস শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন বাড়ায়, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়া শরীরকে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী করে তোলে। রোজার মানসিক ও আত্মিক উপকারিতা রোজা রাখার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার ইচ্ছাশক্তি ও সংযমকে উন্নত করতে শেখে। এটি শুধুমাত্র খাবার গ্রহণের বিরতি নয়, বরং এটি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি উপায়। রোজা রাখার মাধ্যমে ধৈর্যশীলতা ও মনোসংযোগ বৃদ্ধির অভ্যাস গড়ে তোলা সহজ হয়। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে উপবাস করলেই কর্টিসল (Cortisol) নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমে। রোজা রাখার ফলে ব্রেইনের নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর (Brain-Derived Neurotrophic Factor, BDNF) বৃদ্ধি পায়, যা স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং মস্তিষ্কের নিউরোনাল সংযোগ উন্নত করে। এটি মানসিক চাপ ও হতাশা কমাতেও সাহায্য করে।  রোজা রাখার অন্যতম প্রধান শিক্ষা হলো ধৈর্য ও সহানুভূতি অর্জন করা। যখন কেউ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সহ্য করে, তখন সে অভাবী ও দরিদ্রদের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে। এর ফলে সমাজে সহমর্মিতা ও সহানুভূতির মানসিকতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমান যুগে সুস্থ জীবনধারার অংশ হিসেবে রোজা বা উপবাসের গুরুত্ব নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে। রোজার মাধ্যমে দেহের ডিটক্সিফিকেশন, ওজন নিয়ন্ত্রণ, হজমশক্তির উন্নতি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নতি, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস এবং মানসিক প্রশান্তি অর্জন করা যায়। তবে, রোজার উপকারিতা পুরোপুরি লাভ করতে হলে এটি সঠিকভাবে পালন করা জরুরি। ইফতার ও সেহরির সময় সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান এবং অতিরিক্ত তৈলাক্ত বা ভাজা খাবার এড়িয়ে চলা এই প্রক্রিয়াকে আরও ফলপ্রসূ করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে রোজার স্বাস্থ্য উপকারিতা কমে যেতে পারে। তাই, রোজার বিজ্ঞানভিত্তিক উপকারিতা লাভ করার জন্য, রোজা পালনের সময় স্বাস্থ্য সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যসূত্র: de Cabo, R., & Mattson, M. P. (2019). Effects of Intermittent Fasting on Health, Aging, and Disease. New England Journal of Medicine, 381(26), 2541-2551. Ohsumi, Y. (2016). Autophagy: A Nobel Prize-Winning Discovery. Cell, 167(6), 1430-1442. Mattson, M. P., et al. (2018). Impact of Intermittent Fasting on Brain Health. Journal of Neuroscience, 38(45), 9739-9747. Longo, V. D., & Panda, S. (2014). Fasting, Circadian Rhythms, and Immune System Regeneration. Cell Stem Cell, 14(6), 810-821. Longo, V. D., & Mattson, M. P. (2014). Fasting: Molecular Mechanisms and Clinical Applications. Cell Metabolism, 19(2), 181-192. Patterson, R. E., & Sears, D. D. (2017). Metabolic Effects of Intermittent Fasting. Annual Review of Nutrition, 37, 371-393. Trepanowski, J. F., & Bloomer, R. J. (2010). The Impact of Religious Fasting on Human Health. Nutrition Journal, 9(1), 57. Faris, M. A. I. E., et al. (2012). Intermittent Fasting During Ramadan Attenuates Proinflammatory Cytokines and Immune Cells in Healthy Subjects. Nutrition Research, 32(12), 947-955. Mattson, M. P., et al. (2018). Intermittent Metabolic Switching, Neuroplasticity and Brain Health. Nature Reviews Neuroscience, 19(2), 63-80. Alghamdi, A. S., et al. (2013). The Effect of Ramadan Fasting on Glycemic Control in Patients with Type 2 Diabetes Mellitus. Journal of Family and Community Medicine, 20(3), 143-148. Saleh, S. A., et al. (2014). The Effect of Ramadan Fasting on Cardiovascular Parameters in Hypertensive Patients. Journal of Clinical Hypertension, 16(9), 629-633

বাংলাদেশ

ইউনুস সরকার ব্যর্থ হল কেন

সূচনা শেখ হাসিনার পতনের পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে, দেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্ম নিয়েছিল। সাধারণ মানুষ ভেবেছিল, ড. ইউনূস তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশকে একটি নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সেই সাথে সুশীল সমাজের বহু সফল ও পরিচিত মুখ উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পাওয়ায়, বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও, দেশের মানুষ আবারো ঠিক আগের মতই হতাশ হয়ে পড়েছে। কারণ সত্যিকার অর্থে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা সহ কোন দিক থেকেই জনগণের ভোগান্তি কমেনি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়েও বেড়েছে। সরকারের ভেতর ও বাইরে থেকে নানা মূখী চ্যালেঞ্জের কারণে, ড. ইউনূসের সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। ফলে জনগণের আস্থা দ্রুত কমতে শুরু করেছে এবং এই সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেন ব্যার্থ হচ্ছে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, মব জাস্টিস এবং সম্পত্তি ধ্বংসের ঘটনা ঘটে, যা অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশ ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়। বিনা নোটিশে ভারত ত্রিপুরার বাঁধ খুলে দেওয়ায় পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলা প্লাবিত হয়, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি ও কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। সেসময় দেশের জনগণ সদ্য গঠিত হওয়া সরকারের ভরশায় না থেকে, নিজেরাই যে যার সাধ্যমত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেকারণেই সরকার তার চ্যালেঞ্জের প্রথম পরীক্ষায় অনেকটাই পার পেয়ে যায়। নবগঠিত সরকারের দ্বায়িত্ব বুঝে উঠতে আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন; এমন ধারণা থেকেই রাজধানীর বাসিন্দারা ডাকাত আতঙ্কে নিজেরা রাত জেগে পাড়া মহল্লায় পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছে। তখনও হাসিনার খুনি পুলিশ বাহিনীর অধিকাংশই গা ঢাকা দিয়েছিল। তাই দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না।  কিন্তু সরকার তার ক্ষমতার মেয়াদ ছয় মাস পূর্ণ করলেও, এখনও পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বভাবিক হয়নি। এটি নিঃসন্দেহে এই সরকারের মারাত্নক ব্যার্থতা। মাঝখানে পুলিশ প্রশাসন সংস্কারের নামে র‌্যাব ও পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে, নেটিজেনদের কিছুটা হাসির খোড়াক যোগানো ছাড়া অন্তবর্তী সরকারের উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সবশেষে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের যৌথ অভিযান শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সাফল্য আসলেও, এই কার্যক্রমও একেবারে বিতর্ক মুক্ত নয়। অর্থনৈতিক সংকট  পূর্ববর্তী হাসিনা সরকারের লুটপাটের কারণে দেশে মারাত্নক অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত সৃষ্টি হয়েছিল। সেকারণে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকগুলোতে অর্থের ব্যাপক সংকট ছিল। সেই সাথে দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা অন্তবর্তী সরকারের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেছে। ড. ইউনুস সরকার গঠনের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও, বাজারে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে কষ্ট শুধু বাড়িয়েই চলেছে। সরকার আমদানি করা খাদ্যপণ্যের উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার এবং টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি ব্যবস্থা করলেও, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। মাঝখানে ডিমের দাম নিয়ে ব্যাপক নৈরাজ্য, বাজার থেকে ভোজ্য তেল উধাও হয়ে যাওয়া, আবার বেশি দামে বাজারে ফিরে আসা, আলু-পেঁয়াজ অামদানি নিয়ে জটিলতা সহ নানা বিষয়ে সরকারের ব্যার্থতা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রশাসনিক সংস্কারে ধীরগতি সরকারের বিভিন্ন স্তরে প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি সরকারের প্রতি জনগণের আস্থায় আঘাত করেছে। এই সরকারের অন্যতম কাজ ছিল দেশের পুরনো ধ্বসে পড়া কাঠামো সংস্কার করা। সে লক্ষ্যে জনপ্রশাসন, পুলিশ, আদালত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সংবিধান সংস্কারের জন্য সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করলেও, এই সংস্কার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ফলে জনগণের প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসছে না। ইতোমধ্যে সংস্কার কমিশনগুলো সরকারের হাতে তাদের অনুসন্ধান ও সুপারিশ পত্র তুলে দিলেও, এই সরকার সেসব সংস্কার আদৌ করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ তারা দেশ পরিচালনার কাজেই রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা হল, যাদের প্রানের বিনিময়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে, ২৪ এর সেই সব শহীদ পরিবারের প্রতি এখনও ন্যায় বিচার করা হয়নি। জুলাই বিপ্লবে আহতদের চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সরকার চূড়ান্ত রকমের ব্যার্থ হয়েছে। এবং এই সরকার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে কোন কাজে আসবে না বুঝতে পেরেই; আহতরা পর্যন্ত আবারো আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে। শুধু তাই নয়, জুলাই বিপ্লবের খুনিদের বিচার তো দূরের কথা; তাদের নামে ঠিকমত মামলা পর্যন্ত দিতে পারেনি এই সরকার। যেসব দুর্বল মামলা হয়েছে, সরকার পরিবর্তনের পর তাদের প্রায় শতভাগই খালাস পেয়ে যাবে। তাছাড়া আয়নাঘর প্রকাশ্যে আনা বা পিলখানা হত্যাকান্ডের মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়েও সরকারের যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে। বলতে গেলে বিল্পব করেও কাঙ্খিত পরিবর্তন না পেয়ে হতাশ হয়েও, অনেকে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙতে গিয়েছে। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনীতিবিদ ও আমলারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার মহাপরিকল্পনা করছে। এর কারণেই অনেকটা সরকারের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সমস্যা হচ্ছে। পূর্ববর্তী সরকারের প্রভাবশালী আমলারা সরকারের কার্যক্রম ব্যাহত করতে নানাভাবে অপপ্রচার, রাজনৈতিক উসকানি ও প্রশাসনিক বাধা সৃষ্টি করেছে বলে বিশ্লেষকদের মত। সরকার গঠনের পরপরই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের ভেতরে থেকে অসহযোগিতা একেবারেই স্পষ্ট ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের নেওয়া নীতিমালা বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করা হয়, যাতে জনসাধারণের মধ্যে সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বলছে, এই পুলিশ বাহিনীতে ৯০ শতাংশই আওয়ামী লীগ করে। সেই সাথে রাজনৈতিক অঙ্গনে, ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার চালানো হয়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বিশেষ করে, অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য এককভাবে বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়া, সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং বেশ কিছু অরাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রকাশ্যে ও গোপনে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন শহরে আকস্মিক বিক্ষোভ, রাস্তা অবরোধ এবং সরকারি ভবনে হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এগুলো ছিল সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চক্রান্ত, যাতে জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয় এবং সরকারের জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেওয়া যায়। এসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ফলে ইউনূস সরকার নীতিগতভাবে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তার বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এ কারণেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারেনি। জনগণের অতিরিক্ত প্রত্যাশা অন্তবর্তী সরকারের ব্যার্থতা আমাদের চোখে এত প্রকটভাবে ধরা পড়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হল, ড. ইউনুসের সরকারের প্রতি জনগণের অতিরিক্ত প্রত্যাশা

সত্যের খোঁজে

ট্রাম্প এবার গাজা দখল করতে চায় কেন

সূচনা ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তার আগ্রাসী ভূ-রাজনৈতিক নীতির প্রকাশ ঘটছে। পানামা খাল পুনরায় দখলের ঘোষণা, জোর করে গ্রীনল্যান্ড দ্বীপ কেনার চেষ্টা এবং কানাডার কিছু অংশ যুক্তরাষ্ট্রের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশের পর এবার তিনি নজর দিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বিতর্কিত অঞ্চল গাজা উপত্যকার দিকে।  ট্রাম্প দাবি করেছেন, গাজাকে সহিংসতা ও ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনার জন্য এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গাজার ২০ লাখ বাসিন্দাকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।  ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার এই দখলদারী মনোভাব বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ট্রাম্প কেন গাজা দখল করতে চায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। ট্রম্পের গাজা নীতি দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত হওয়ার পর, ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে প্রবেশের আগেই গাজার যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। অনেকেই মনে করছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়ত ফিলিস্তিনিদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বাইডেন প্রশাসনের চেয়েও অনেক বেশি বিধ্বংসী হতে যাচ্ছে।  ২০১৭ সালে ট্রাম্পই জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। যা ছিল জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রস্তাবনায় জেরুজালেমকে ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন কোন দেশের নিয়ন্ত্রণে না দিয়ে, একে আন্তর্জাতিক অঞ্চল হিসেবে রাখার কথা বলা হয়েছিল।  ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর মধ্যস্থতায়, আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে আরব বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশকে ফিলিস্তিন ইস্যু পাশ কাটিয়ে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল।  ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সর্বপ্রথম বিদেশি কোন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন।  বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প গাজা নিয়ে তার সবচেয়ে ভয়ংকর পরিকল্পনার কথা জানান। ট্রাম্প জানিয়েছেন যে গাজা উপত্যকার পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গাজা দখল করবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গাজাবাসীদের অন্যত্র পুনর্বাসন করা হবে। তিনি গাজাকে একটি ধ্বংসস্তূপ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে। তার মতে, অবিস্ফোরিত বোমা অপসারণ, গাজার পুনর্গঠন এবং সেখানকার অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করাই হবে মূল লক্ষ্য। ট্রাম্প আরও উল্লেখ করেন যে, গাজা উপত্যকা বহু দশক ধরে মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রতীক হয়ে রয়েছে এবং এই অঞ্চলটিকে তিনি ‘দুর্ভাগা’ হিসেবেও বর্ণনা করেন। ট্রাম্পের দাবি গাজার মানুষ সেখানে থাকতে চায় না; বরং তারা অন্য দেশে চলে যেতে আগ্রহী। তার মতে গাজার লোকেদের আসলে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলেই তারা গাঁজায় ফিরে যাচ্ছে। ট্রাম্প বরাবরই তার নিজস্ব মনগড়া বক্তব্যকে ফ্যাক্ট হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করে। মাত্র কিছুদিন আগেই ট্রাম্প বলেছিল গ্রীনল্যান্ডের বাসিন্দারাও নাকি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হতে চায়। অথচ তারা দীর্ঘদিন থেকে গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছে। অতীতে বাইডেন প্রশাসন গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন নিয়ে নগ্ন মিথ্যাচারের মাধ্যমে অনায্য যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, ট্রাম্প প্রশাসন কোন রাখঢাক না রেখে, সরাসরি গাঁজা দখলে নেওয়ার মতো বেআইনি বিষয়কে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।  ট্রাম্প তার ব্যক্তিগত জীবনে একজন সফল ডেভলপমেন্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। সে কারণে তিনি গাঁজা কেউ একটি আকর্ষণীয় প্রপার্টি হিসেবে দেখছেন। এই বিষয়টি তিনি নিজ মুখে স্বীকার করে বলেছেন গাঁজায় চমৎকার সব ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তৈরি করা হবে এবং এর জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো অর্থায়ন করবে। তিনি বিশেষ করে সৌদি আরবের কথা বলেছেন। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পেছনে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থ ব্যয় করেছে সেগুলোর মধ্যে ইলোন মাস্কের পরেই রয়েছে সৌদি আরবের সরকারী তহবিল পাবিলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড। ট্রাম্প শুধু গাজা দখলই নয়; অতীতে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে যেসকল অবৈধ ইসরায়েলী স্যাটেলমেন্টের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল; ট্রাম্প সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। তারমানে ফিলিস্তিনের বাকি অঞ্চলে দখলদারি চালানোর বিষয়ে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আরো প্রত্যক্ষ মদদ পাবে। যুক্তরাষ্ট্র বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে বলেন, “হোয়াইট হাউজে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বন্ধু আপনি।” নেতা নিয়াহু এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যেসব অস্ত্র আটকে ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর সেসব অস্ত্র আবারো ইসরায়েলে সরবরাহ শুরু করেছেন। এছাড়া, জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-কে ট্রাম্প প্রশাসন আর তহবিল না দেওয়ার ঘোষণা করার কারণেও নেতানিয়াহু সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

সত্যের খোঁজে

ট্রাম্প পানামা খাল দখল করতে চায় কেন

ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে দখলদারী মনোভাব পোষণ করে আসছিল। ক্ষমতা গ্রহণের দিন উদ্বোধনী ভাষণেই ট্রাম্প পানামা খাল দখেলে নেওয়ার বিষয়ে জোড়ালো মন্তব্য করেন। এছাড়ও গ্রীনলান্ড দ্বীপ বা কানাডার মত দেশ দখল করে যুক্তরাষ্ট্রের মানচিত্রে অন্তর্ভূক্ত করার মত নানা বিষয়ে ট্রাম্প একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করেই চলেছে। পানামা খাল কিভাবে তৈরী করা হয়েছিল, এই খাল কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ট্রাম্প কেন পানামা খাল দখল করতে চায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। পানামা খালের গুরুত্ব বিশ্ব বাণিজ্য ও রাজনীতিতে পনামা খাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই খালটি একই সাথে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে পৃথক করেছে এবং আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। সমগ্র বিশ্ব বানিজ্যের প্রায় ৫ শতাংশ সম্পন্ন হয় পানামা খাল দিয়ে।  অতীতে আর্জেন্টিনার কেপ হর্ণের জলপথ ঘুরে, আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে নৌযানভেদে সময় লাগত প্রায় ২ থেকে ৬ মাস। পরবর্তীতে পানাম খাল তৈরী হবার পর মাত্র ২০-৩০ ঘন্টার মধ্যেই আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাতায়াত করা যায়। ১৫৩৪ সালে সর্বপ্রথম স্প্যানিশ প্রকৌশলীরা একটি জরিপ করে, আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর জন্য পানামায় একটি খালের প্রস্তাব দেন। তৎকালীন সময়ের নির্মান পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতার কারনে এই প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়।  প্রথম খাল খনন চেষ্টা তৎকালীন সময়ে পানামা ছিল কলম্বিয়ার অংশ। ১৮৫৯ সালে মিশরের মরুভূমির মধ্য দিয়ে সুয়েজ খাল নির্মাণ প্রকল্প সম্পন্ন হবার পর পানামা খাল নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু মরুভূমির মাঝে সুয়েজ খাল খনন আর, পানামার পাহাড়ি জঙ্গলে খাল নির্মাণ এক বিষয় নয়। সেই সাথে পানামার এই জঙ্গলে ছিল আগ্নেয় শিলার স্তুপ, দুরারোগ্য ব্যাধির সংক্রমন, হিংস্র বন্যপ্রাণী এবং বিষাক্ত পোকামাকড় সহ নানা রকমের প্রতবন্ধকতা। তাই পানামা খাল খনন করাটা, সুয়েজ খাল খননের চেয়েও অনেক বেশি কঠিন ছিল।  ১৮৮১ সালে একটি ফ্রেঞ্চ কোম্পানি ক্যারিবিয়ান ও ইন্ডিয়ান শ্রমিকদের দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করার মাধ্যমে পানামা খাল খননের কাজ শুরু করে। জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে ইয়েলো ফিভার আর ম্যালেরিয়া সহ বিষাক্ত পোকামাকড়, আর সাপের কামড়ে প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়ার মারা যায়। সেসময় গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন শ্রমিক মারা যেতে থাকে। এছাড়া পানামার পর্বতময় এলাকার ভেতর দিয়ে খাল খনন করতে গিয়ে নিয়মিত ভূমি ধ্বস হতে থাকে। ফলে এক পা আগালে তিন পা পিছিয়ে আসতে হচ্ছিল। ম্যালেরিয়ার বিস্তার আর মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতির কারনে ১৮৮৯ সালে, ২০ হাজারেরও বেশী কর্মীর লাশ পেছনে ফেলে, ফ্রেঞ্চ কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পানামা খাল খননের কাজে ইস্তফা দেয়। সেই বিশাল ব্যর্থতায় ফ্রান্স সরকারের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। পানামা খাল খনন ১৮৯৮ সালে স্প্যানিশ আমেরিকান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হলেও, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৈন্য পরিবহণ ও রসদ সরবারাহের ক্ষেত্রে আমেরিকানরা বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিল। সেকারণে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট নতুন করে পানামা খাল খনন করার পরিকল্পনা করেন। তখনও পর্যন্ত কাগজে কলমে পানামার মালিক ছিল কলম্বিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কলম্বিয়ার সাথে কোন চুক্তি না করে, পানামার বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনা করতে থাকে। ১৯০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র পানামার বিদ্রোহী গোষ্ঠী কে প্রস্তাব দেয়: তারা যদি যুক্তরাষ্ট্রকে পানামার উপর খাল খননের অনুমতি দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র পানামা কে কলম্বিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করবে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ খবরদারিতে রক্তপাত বিহীন এক বিদ্রোহের মাধ্যমে পানামা স্বাধীনতা লাভ করে। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পানামা খাল এলাকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখানে একটি মার্কিন ছিটমহল গড়ে তোলে। এবং ১৯০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র পানামা খাল খননের কাজ শুরু করে। পানামা খালের প্রযুক্তি আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর কে সংযুক্ত করার জন্য পানামা খাল খনন করা হলেও, পানামার এই অঞ্চলের ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত। সেকারণে পানামার দুই প্রান্তে বেশ কিছু লক বা জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এগুলো অনেকটা পানি দিয়ে তৈরী জাহাজের লিফটের মত কাজ করে। এগুলোর মাধ্যমে জাহাজগুলোকে পর্যায়ক্রমে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৬ মিটার বা প্রায় ৭ তলার সমান উঁচুতে তোলা হয়।  তবে পানামা খালের সমস্ত অংশই খাল খননের মাধ্যমে তৈরী করা হয়নি। এই অঞ্চলে প্রবাহিত চার্গেস নদীতে বাঁধ দিয়ে, গাটুন নামে এখানে একটি কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করা হয়। বাঁধের পানি দিয়ে প্লাবিত ১৬৪ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত গাটুন হ্রদ; তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম হ্রদ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। এই হ্রদ থেকে আবারো বেশ কিছু জলকপাটের মাধ্যমে, জাহাজগুলোকে প্রশান্ত মহাসাগরের জলের স্তরে নামিয়ে আনা হয়। পানামা খাল তৈরী করতে এখানকার কুলেবড়া পর্বতকে ৮ মাইল লম্বা, ৩০০ ফিট চওড়া ও ৫০ ফিট গভীর করে খনন করা হয়। দুসাধ্য এই কাজ সম্পন্ন করতে প্রায় ২৭ হাজার শ্রমিক মারা যায়। অবশেষে ১৯১৪ সালের ৩ অগাস্ট, পানামা খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। পানামা খালের বাণিজ্যিক এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পানামার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র পানামায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে, পানামাবাসী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পেলে, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পানামা খাল হস্তান্তর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এবং তার প্রায় ২২ বছর পর ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পানামাবাসী পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তখন থেকে দেশটির সরকারী প্রতিষ্ঠান পানামা ক্যানাল অথরিটি খালটি ব্যবস্থাপনার দ্বায়িত্ব পালন করে আসছে। ট্রাম্প দখল করতে চায় কেন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু পানামা খাল খনন করেছিল, তাই বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন পানামা খাল আবারো যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আসা উচিত। তাছাড়া ট্রাম্পের যুক্তি হল, পানামা খালে মার্কিন জাহাজ চলাচলে অধিক শুল্ক আরোপ করা হয়, এবং পানামা সরকারকে হাত করে, চীন কৌশলে এই খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। সেকারণেই ট্রাম্প আবারো পানামা খালকে মার্কিন সরকারের দখলে আনতে চায়। ট্রাম্প তার উদ্বোধনী ভাষণেও এ বিষয়ে হুমকি দিয়েছেন। ট্রাম্প শুধু মৌখিক হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সে অনেকটা পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছে। সাধারণত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রথমে বড় বড় মিত্রদেশগুলোতে সফর করেন। তবে ট্রাম্পের পররাস্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিও তার প্রথম সফরেই পানামায় গেছেন।  বর্তমানে বছরে প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি নৌযান পনামা খাল দিয়ে যাতায়াত করে। যা পানামার জাতীয় অর্থনীতির ৬ শতাংশের জোগান দেয়। পানামা খাল দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের ৭৪ শতাংশই মার্কিন জাহাজ। এরপরই রয়েছে চীনের অবস্থান। পানামা খালে চলা প্রায় ২১ শতাংশ জাহাজ চীনের।  পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো বলেছেন, ‘খালটির ওপর চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তিরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ সকল ধরনের নৌযান, এমনকি যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন এই খাল দিয়ে চলাচল করতে পারে। পানামার সাথে চুক্তির মাধ্যমে খাল নির্মাণের সময় থেকে প্রায় ১০০ বছর যুক্তরাষ্ট্র এখানে এক ধরনের ছিটমহল তৈরী করে রেখেছিল। পানামার মধ্যে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সেই ছিটমহলে, মার্কিন সামরিক ঘাঁটি, পুলিশ, এমনকি মার্কিন আদালত পর্যন্ত কার্যকর ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ আগ্রাসনের মাধ্যমে, পানামা খালে চীনের দখলদারির কাল্পনিক অভিযোগ তুলে, বিশ্ব বানিজ্যের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পানামা

সত্যের খোঁজে

ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল কতটা ভয়াবহ

ভূমিকা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে এক ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। শুষ্ক আবহাওয়া, মরুভূমির তীব্র বাতাস এবং দীর্ঘস্থায়ী খরার ফলে এই আগুন একের পর এক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের প্যাসিফিক প্যালিসেডস থেকে শুরু হওয়া এই দাবানল এখনও পর্যন্ত যে পরিমাণ এলাকা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছে, তার আয়তন সমগ্র ঢাকা শহরের আয়তনের চেয়েও প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। বিশাল এই বিপর্যয় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখা হলেও, এর পেছনে মানবসৃষ্ট কারণও থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দাবানল আসলে কী, দাবানল কিভাবে তৈরী হয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার এই দাবানল এতটা মারাত্নক হয়ে উঠল কেন সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। দাবানল কী? সাধারণত বনাঞ্চলে সংঘটিত অগ্নিকান্ডকে দাবানল বলা হয়। দাবানল সৃষ্টি হবার মত শুষ্ক পরিবেশে কোন বনে আগুন লাগলে, তা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বনের ঝড়া পাতা থেকে শুরু করে ছোট বড় সকল বৃক্ষ এই আগুনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে থাকে। ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এই আগুন সামনে যা কিছু পায়, সবকিছু পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। সেকারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাবানলের আগুন আপন মনে যতক্ষণ খুশি জ্বলতে থাকে। তবে অধিকাংশ সময়ই এই আগুনের সূত্রপাত হয় মানুষের দ্বারা। ইউএস ফরেস্ট সার্ভিসের তথ্য মতে, আমেরিকার প্রায় ৮৫ শতাংশ দাবানল মানুষের কারণে হয়ে থাকে। অযত্নে ফেলে রাখা ক্যাম্পফায়ারের আগুন বা সিগারেটের আগুন এর মত, মানুষের অসতর্ক আগুন থেকে সবচেয়ে বেশি দাবানল সৃষ্টি হয়। কোন কোন গবেষক বলেন, মাত্র ১ শতাংশ দাবানল প্রাকৃতিক আগুন থেকে তৈরী হয়। এগুলো মধ্যে বজ্রপাত এবং আগ্নেয়গিরির আগুনই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।  দাবানল কিভাবে তৈরী হয়? সমগ্র আমেরিকার বনাঞ্চলে বিভিন্ন উপায়ে বছরে প্রায় এক লক্ষ বার আগুন লাগে। এর ফলে প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ হেক্টর জমি পুড়ে যায়। গত তিরিশ বছরে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বন, আফ্রিকার কঙ্গোর রেইন ফরেস্ট এলাকা এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের লক্ষ লক্ষ একর এলাকার বনভূমি মানব সৃষ্ট দাবানলে ধ্বংস হয়েছে। সাধারণত চাষাবাদের নতুন জমি সৃষ্টি করার জন্য বনে আগুন দেওয়ার পর, এসব দাবানল সৃষ্টি হয়।  দাবানলের ক্ষতিকর প্রভাব আক্রান্ত অঞ্চল ছাড়াও আরো বহু দূর ছড়িয়ে পড়ে। দাবানলের আগুন থেকে অগ্নি ঝড়, আগুনে সাইক্লোন বা আগুনের টর্নেডোও তৈরী হতে পারে। যা নদীর মত বাঁধা পার করেও দাবনলকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, দাবানলের ধোাঁয়া ও ছাইও অনেক দূরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।  সাইবেরিয়ার তাইগা বনে তৈরী হওয়া দাবানলের ধোঁয়া ৩ হাজার মাইল দূরে জাপানের ওসাকা শহরকে অন্ধকার করে দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার ব্ল্যাক ফ্রাইডে বুশ-ফায়ারের ছাই ২ হাজার মাইল উড়ে গিয়ে নিউজিল্যান্ডে পড়েছিল।  দাবানল মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক যেভাবেই হোক না কেন, প্রথমত এটি ক্ষতিকর রূপ নিলেও, এ ভেতরে বেশ কিছু কল্যাণকর দিকও আছে। দাবনলের কারণে বনের মৃত ও পচনশীল দ্রব্যাদি পুড়ে গিয়ে পরিবেশ শুদ্ধ হয়। গাছের কাণ্ডে জমে থাকা পুষ্টি, অগ্নিকান্ডের পরে আবারো জমিতে ফেরত আসে। এছাড়া যাবতীয় ক্ষতিকর পোকামাকড় এবং রোগশোকের জীবাণুও ধ্বংস হয়ে যায়; যার ফলে নির্দিষ্ট সময় পর বনের বাস্তুসংস্থান আবারো নতুন করে গড়ে ওঠে। ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল সাম্প্রতিক সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় যে দাবানল সৃষ্টি হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের ইতহাসের অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরী, আর তা হল, ক্যালিফোর্নিয়ায় তৈরী হওয়া দাবানল কোন একক দাবানল নয়। কাছাকাছি সময়ে প্রায় ৫টি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় দাবানল তৈরী হয়েছে। প্রথম দাবানল শুরু হয়েছিল প্যালিসেডসে, এরপর ইটন, হার্স্ট, লিডিয়া এবং কেনেথ এলাকায় একের পর এক দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। সেকারণেই দাবানল পরিস্থিতি ক্যালিফোর্নিয়ায় এতটা ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছে।  যেহেতু দাবানল সৃষ্টি হবার প্রায় চার দিন পেরিয়ে গেলেও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি; তাই এর প্রকৃত ভয়াবহতা সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এই দাবানলে ইতোমধ্যেই অন্তত ১১ জন মারা গেছেন, ১০,০০০-এরও বেশি ঘরবাড়ি এবং স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে, এবং ১,৫৩,০০০-এরও বেশি মানুষকে তাদের এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই দাবানল প্রথম শুরু হয়েছিল প্যাসিফিক প্যালিসেডস এলাকায়, সেখানে এখন পর্যন্ত ২১,০০০ একরের বেশি জমি পুড়ে গেছে। এছাড়া ইটন দাবানল প্রায় ১৪,০০০ একর জমি ধ্বংস করেছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দাবানলগুলোর মধ্যে হার্স্ট দাবানলে ৭৭১ একর, লিডিয়া দাবানলে ৪০০ একর এবং কেনেথ দাবানলে ১,০০০ একর জমি পুড়ে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়া এমনিতেই দাবানলপ্রবণ এলাকা। ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমি এবং আবহাওয়া দাবানলের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। ক্যালিফোর্নিয়ার পাহাড়ি এলাকা এবং ঘন গাছপালা দাবানলের বিস্তারকে সহজ করে তোলে। শুষ্ক ঘাস, ঝোপঝাড় এবং গাছপালা দ্রুত জ্বলে ওঠার কারণে আগুন সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, তারা অতীতে ক্যালিফোর্নিয়ার পাহাড় এবং বনাঞ্চলে দাবানলের আগুন দেখেছেন, কিন্তু এবার তারা চোখের সামনে দাবানলে তাদের শহর পুড়ে যেত দেখল। কেন এত ভয়াবহ হল ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল এত দ্রুত ছড়ানোর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী খরা, শুষ্ক আবহাওয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমি অঞ্চল থেকে আসা তীব্র বাতাস। এই বাতাসকে সান্তা আনা বাতাস নামে অভিহিত করা হয়। যার গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ১৬০ কিমি পর্যন্তও পৌঁছেছে। এই ঝড়ো বাতাসই মূলত আগুনকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে। দাবানল শুরু হওয়ার কারণ এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে, ক্যালিফোর্নিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় উদ্ভিদ এবং ভূমি অত্যন্ত শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল, যা আগুন ছড়ানোর জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে।  বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তীব্র বাতাসের প্রভাবে বিদ্যুতের তার ঝুলে পড়ে, তখন বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুন শুরু হতে পারে। তবে প্রাথমিক তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করা যায়নি। তবে সমগ্র আমেরিকার প্রায় ৮৫ শতাংশ দাবানল মানুষের কারণে হয়ে থাকলেও, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় ৯৫ শতাংশ দাবানলের আগুনই মানবসৃষ্ট। ৭,৫০০ অগ্নিনির্বাপক কর্মী এবং ন্যাশনাল গার্ড ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলের আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। তবে পানির সংকট এবং বাতাসের উচ্চ গতি দাবানল নেভানোর প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাছাড়া অগ্নি নির্বাপনে পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত ফায়ার হাইড্রেন্ট গুলোতে পর্যাপ্ত পানির চাপ ছিল না। এরই মধ্যে আবার দাবানল তৈরী হবার কয়দিন আগে, প্যাসিফিক প্যালিসেডসের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাধার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, গত মাসেই ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস ফায়ার ডিপার্টমেন্টের জন্য ৭ মিলিয়ন ডলার বাজেট কর্তন করা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে দাবানল তৈরী হবার মাত্র ২০ দিন আগে, এখানকার ফায়ার ডিপার্টমেন্ট এর প্রধান উচ্চপদস্থ  কর্মকর্তাদের চিঠি লিখে সতর্ক করেছিলেন যে, বাজেট কাটছাঁটের কারণে দাবানল, বন্যা, ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম এসব বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তারমানে ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল যদি সরাসির মানবসৃষ্ট কারণে নাও ঘটে থাকে, তবে মানুষের অদূরদর্শী আচরণের কারণে তা আরো বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে দাবানলের সরাসরি সংযোগ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দীর্ঘ খরা এবং বৃষ্টির অনিয়মিত চক্র পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রে এমন বিপর্যয়ের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। এই সঙ্কট আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানো, এই মুহুর্তে ‍পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বাংলাদেশ

ওয়াজ মাহফিল কী ব্যবসায় পরিণত হয়েছে

সাধারণ জনগণের সাথে ইসলামী জ্ঞান ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার একটি কার্যকর উপায় ওয়াজ মাহফিল। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বত্রই এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সংস্কৃতি। মূলত মানুষকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং ধর্মীয় জ্ঞান প্রচারের জন্যই তাফসিরুল কুরআন বা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে ওয়াজ মাহফিল অনেক বিতর্কিত হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কিছু বক্তা তাদের বক্তৃতার জন্য মোটা অংকের পারিশ্রমিক নিচ্ছেন, যা ইসলাম প্রচারের মূল উদ্দেশ্যের সাথেই সাংঘর্ষিক। ওয়াজ মাহফিল বাংলাদেশের একটি সম্বৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকে কিভাবে একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। এই ব্যবসা কিভাবে গড়ে উঠেছে? প্রাচীনকাল থেকে ইসলামি জ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষার প্রচারের জন্য ওয়াজ মাহফিল একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে এ ধরনের সভা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে মানুষ কুরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন করে এবং নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করে। এটি সামাজে একতা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একটা সময় এসব মাহফিল ছিল গ্রামীণ জনগণের জন্য জ্ঞান অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। প্রাচীন আলেমরা গভীর অধ্যয়ন ও বাস্তবিক উদাহরণের মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারতেন। এমনকি বর্তমানেও অনেক জায়গায় ওয়াজ মাহফিল, সামাজিক উন্নয়ন, দানশীলতা এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতির চর্চাকে উৎসাহিত করে। এটি ইসলামের নৈতিক শিক্ষা ও সমাজ গঠনের প্রাথমিক উদ্দেশ্যের প্রতি মানুষকে মনোযোগী করে তোলে। বিগত কয়েক দশকে ধর্মীয় নেতারা এবং জনপ্রিয় বক্তারা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের কথা শুনতে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হন। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি টানই এর পেছনে মূল কারণ। পাশাপাশি জনপ্রিয় বক্তাদের আবেগপ্রবণ উপস্থাপনা এবং তাদের গল্প মানুষকে আকৃষ্ট করে। এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকরা; তাদেরকেই বেশি বেশি ডাকতে থাকে যাদের নিয়ে আসলে মাহফিলে বেশি লোক উপস্থিত হতে পারবে। আর বেশি লোকের উপস্থিতি মানেই বেশি বেশি দান গ্রহণ করা যাবে। এই একটি বিষয় থেকেই বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলের বানিজ্যিকীকরণ হতে থাকে। তখন থেকে জনপ্রিয় বক্তারা এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, এক বছর আগে থেকে তাদের বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। মাহফিল ব্যবসা বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের জনপ্রিয় বক্তারা এক একটি অনুষ্ঠানের জন্য লক্ষাধিক টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। সেই সাথে জনপ্রিয় বক্তাদের জন্য হেলিকপ্টার ভাড়া করা, বিশাল মঞ্চ তৈরি, প্রচার ও অন্যান্য খরচ সহ একটি মাহফিল আয়োজন করতে বেশ মোটা অংকের টাকা খরচ করা হয়। অথচ ওই একই এলাকার মসজিদের মুয়াজ্জিন, ইমাম এবং খতিবদের মাসিক বেতন মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। অনেক জায়গায় এই ন্যূনতম বেতনও নিয়মিত পরিশোধ করা হয় না। স্থানীয় আলেমদের অনেকেই ওয়াজ মাহফিলের জনপ্রিয় বক্তাদের সমপর্যায়ের জ্ঞানী এবং পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও, তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। একজন হুজুর দিনে ৫ বার এবং মাসে দেঢ়শ ওয়াক্ত নামাজ পরিয়ে বেতন পান মাত্র ৫ থেকে দশ হাজার টাকা। অারেকজন মাত্র ১ ঘন্টা বয়ান করে পান এক লক্ষ টাকা। কোন কোন বক্তার একই দিনে একাধিক জেলায় মাহফিল থাকে। এই ধরনের বৈষম্য ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। বিষয়টি নিয়ে সবার আগে প্রতিবাদ করা উচিত ছিল জনপ্রিয় আলেম ওলামাদের; কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে এই বিষয়টি নিয়ে কোন জোড়ালো প্রতিবাদ শোনা যায় না।  ওয়াজ মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু অধিক দান সদকা সংগ্রহ এবং বক্তাদের অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের চাহিদার কারণে, সেই মূল উদ্দেশ্য থেকেই আমরা বহু দূরে সরে গেছি। এর বাইরে, মাহফিলের আশে পাশে লোক সমাগমকে কেন্দ্র করে, ফুচকা চটপটির দোকান থেকে শুরু করে বাচ্চাদের খেলানার দোকান বসিয়ে, তাফসিরুল কুরআন মাহফিলকে মেলা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। অনেক জায়গায় অপরিচিত আলেমদের দিয়ে ওয়াজ মাহফিল করানো হলে, লোক সমাগম হয় অতি নগন্য। যার ফলে দান-সদকা সংগ্রহ করা তো দূরের কথা। মাহফিলের খরচই উঠে আসে না। কারণ মানুষ এখন ওয়াজ মাহিফল শোনার চেয়ে, ফেসবুকের জনপ্রিয় সেলিব্রেটি আলেমদের সামনাসামনি দেখার উদ্দেশ্যেই বেশি যায়। সমালোচনা ওয়াজ মাহফিল এখন অনেকটাই বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আবেগপ্রবণ বক্তৃতা এবং গান-গজলের মতো পরিবেশনা মানুষকে আকৃষ্ট করলেও; ইসলামি জ্ঞান প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে।  ওয়াজ মাহফিলে অধিকাংশ জনপ্রিয় বক্তাই সুরে সুরে বক্তব্য দেন, যা অনেকের কাছে আকর্ষণীয় মনে হলেও; অন্যদের কাছে বিষয়টি হাস্যকর হয়ে উঠেছে। অনেক বক্তা বক্তব্য প্রদানের সময় খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। যার ফলে তারা ভালো ভালো কথা বললেও, শুনতে খুবই খারাপ লাগে। এই ধরনের অতি নাটকীয় ওয়াজের ভিডিও যখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, তখন তা অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরী করে।  ‍শুধু তাই নয়, বহু মুসলিমরাও এসব দেখে ওয়াজ মাহফিল কিংবা ইসলামা থেকেই দূরে সরে যেতে থাকে। ওয়াজের আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষের কাছে ধর্মীয় শিক্ষা এবং নৈতিকতার বার্তা পৌঁছানো। কিন্তু বর্তমান ওয়াজ মাহফিলে শিক্ষার গভীরতা অনেকাংশেই হারিয়ে গেছে। কখনও দেখা যায়, একজন বক্তা খুব হাস্যরসত্নক বক্তব্য দিচ্ছেন। আবার মুহুর্তেই কথার মধ্যে লম্বা সুরে টান দিয়ে খুব আবেগী গলায় কান্নাকটি করে একটি সাধারণ বিষয়ের অতি নাটকীয় বর্ণনা শুরু করে দেন। এসব বিষয় উল্লেখ করে ওয়াজ মাহফিল নিয়ে গঠনমূলক আলোচন করতে গেলেও, তারা বলবে ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করার পায়তারা চলছে। একদল লোক অবশ্যই আছে যারা ইসলাম বিদ্বেষের জায়গা থেকে, ধর্মীয় যে কোন বিষয় নিয়েই অহেতুক সমালোচনা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাই বলে, ওয়াজ মাহফিলে যে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থি নানা ধরনের চর্চা হচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। ওয়াজ মাহফিলে অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোভাব এবং কিছু বক্তার বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে সামগ্রিকভাবে ইসলামের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। ইসলামকে আবার তার মূল নৈতিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হলে বক্তাদের আরো সংযমী ও দায়বদ্ধ হতে হবে। আলেমদের স্থলন বর্তমানে ওয়াজ মাহফিল থেকে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা ও সামাজিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হল কতিপয় আলেম ওলামাদের নৈতিক স্খলন। কিছু কিছু আয়োজনে শরিয়তবিরোধী কার্যকলাপ, অপ্রয়োজনীয় খরচ এবং ভাইরাল বক্তাদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণে ইসলামের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অনেক মাহফিলে মাজহাবি ঝগড়া-বিবাদ নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করা হয়। অন্য  আলেমদের মধ্যে কে মুরদতাদ কে কাফের হয়ে গেছে, সেসব নিয়ে হাজার হাজার লোকের সামনে বক্তারা অন্য বক্তা সম্পর্কে অসম্মানজনক আলোচনা করেন। সঠিক জ্ঞান এবং দায়িত্বশীলতার অভাবে কিছু বক্তার বক্তব্য ইসলামের বদনাম ডেকে আনে। তাছাড়া ধর্মীয় বিষয়গুলো অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা, সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া এবং সর্বোপরি ইসলামি শিক্ষার পরিবর্তে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেওয়া বক্তাদের সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত করে তুলেছে। বক্তাদের অানেকেই তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল সহ স্যোশাল মিডিয়া কন্টেন্টের কথা মাথায় রেখেও জনপ্রিয় বিষয়ে ওয়াজ করে থাকেন। বেশ কিছু বক্তা তাদের বক্তৃতায় এমন অপ্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনা করেন যা ওয়াজ মাহফিলের আসল উদ্দেশ্য থেকে শ্রোতাদের দূরে সরিয়ে দেয়।

সত্যের খোঁজে

হলিউড কী পুড়ে গেছে

সূচনা বিশ্ব চলচিত্র এবং বিনোদনের রাজধানী হলিউড। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলে হলিউড পুড়ে যাওয়ার কিছু ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। আসলেই কী বিশ্ব বিনোদনের শীর্ষ ইন্ডাস্ট্রি হলিউড পুড়ে গেছে? সে সম্পর্কেই জানব কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। হলিউড কী? আমরা মনে করি, হলিউড হয়ত বাংলাদেশের এফডিসির মত কোন একটি বিশাল স্টুডিও। কিন্তু বাস্তবে হলিউড নিজে কোনো স্টুডিও নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের একটি বিখ্যাত এলাকা। তবে এটি বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, এবং বিনোদন শিল্পের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, হলিউড হল সেই জায়গা যেখানে ইউনিভার্সাল, ওয়ার্নার ব্রাদার্স, প্যারামাউন্ট পিকচার্স, এবং ডিজনির মত বহু বিখ্যাত স্টুডিও তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। এবং এখানেই ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল, ব্যয়বহুল এবং বড় বড় সিনেমা বানানো হয়েছে। যে “হলিউড” নামটি শুনলে মানুষের মনে বিখ্যাত সব সিনেমা আর গ্ল্যামারের ছবি ভেসে ওঠে, তা মূলত এই এলাকার চারপাশে গড়ে ওঠা চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য। তাই হলিউড কোনো নির্দিষ্ট স্টুডিও নয়, এটি লস অ্যাঞ্জেলস শহরের একটি এলাকা যা বিশ্ব বিনোদন জগতের অলিখিত রাজধানী হিসেবে পরিচিত। হলিউড এর আইকন হলিউডের সবচেয়ে অাইকনিক জায়গা হল এই হলিউড সাইন। এটি লস অ্যাঞ্জেলেসের সান্তা মনিকা পাহাড়ের হলিউড হিলসের মাউন্ট লি তে অবস্থিত গ্লিফিথ পার্কের একটি অংশ। হলিউড হিলসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখান থেকে পুরো লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের এক অনন্য দৃশ্য দেখা যায়। বিশাল সাদা অক্ষরে “HOLLYWOOD” লেখা সাইনটি, অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। সর্বপ্রথম প্রথম ১৯২৩ সালে, একটি আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপনের জন্য “HOLLYWOODLAND” নামে এখানে একটি সাইন বোর্ড স্থাপন করা হয়েছিল। যার প্রতিটি অক্ষর ছিল প্রায় ৫০ ফুট লম্বা। ১৯৪৯ সালে, “LAND” অংশটি সরিয়ে ফেলা হয়, এবং তখন থেকে এটি শুধু “HOLLYWOOD” হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে এটিই লস অ্যাঞ্জেলেস এবং পুরো বিনোদন জগতের প্রতীক হয়ে উঠেছে। হলিউডের আরো দুটি বিখ্যাত জায়গা হল Hollywood Boulevard এবং Sunset Boulevard। হলিউড বুলেভার্ড মূলত হলিউড ওয়াক অফ ফেম, চায়না থিয়েটার এবং ডলবি থিয়েটারের জন্য বিখ্যাত। এই ডলবি থিয়েটারেই প্রতি বছর অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বা “অস্কার” পুরষ্কার প্রদান করা হয়। অন্যদিকে, হলিউডের গ্ল্যামারাস জীবনের ঝলক সামনা সামনি উপভোগের জায়গা হল সানসেট বুলেভার্ড। এই সড়কটি স্ট্রিট পারফর্মারদের নানারকম প্রদর্শনী, হলিউড থিমযুক্ত দোকান, বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট, নাইটক্লাব, এবং মিউজিক মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির জন্য জনপ্রিয়। হলিউড কী সত্যি পুড়েছে? লস অ্যাঞ্জেলেসে চলমান দাবানলের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ছবি এবং ভিডিওতে দেখা গেছে যে, বিখ্যাত হলিউড সাইন পুড়ে গেছে। কিন্তু এটি একটি ভুয়া খবর। হলিউড সাইন ট্রাস্টের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, সাইনটি অক্ষত আছে এবং দাবানলের কারণে কোনো ক্ষতি হয়নি। এমনকি সাইনটি আগুনের সরাসরি হুমকিতেও ছিল না। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ছবি ও ভিডিওগুলো সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। তবে হলিউড সাইন থেকে প্রায় ১০ িকলোমিটার দূরে হলিউডের অন্য দুটি বিখ্যাত এলাকা হলিউড বুলেভার্ড এবং সানসেট বুলেভার্ড সহ আশে পাশের এলাকায় সত্যি সত্যি দাবানলের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া হলিউড সাইন থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে, সমুদ্রতীরবর্তী প্যাসিফিক প্যালিসেডসে বহু হলিউড তারকার বিলাসবহুল বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।  সহজ করে বলতে গেলে, হলিউড যেহেতু কোন একক জায়গা নয়, তাই সেই অর্থে হলিউড পুড়ে যায়নি। কিন্তু বিশ্ব বিনোদনের রাজধানী হলিউড দাবানলের কারণে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়েছে। আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরী, আর তা হল, ক্যালিফোর্নিয়ায় তৈরী হওয়া দাবানল কোন একক দাবানল নয়। কাছাকাছি সময়ে প্রায় ৫টি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় দাবানল তৈরী হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার এই দাবানল কতটা ভয়াবহ সে সম্পর্কে জানতে চাইলে কিকেনকিভাবে র এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।

মহাকাশ

নভোচারী হতে কি লাগে

ছেলেবেলায় আমরা সবাই কখনও না কখনও উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখেছি। অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যাপক উদ্ভাবনী ক্ষমতার কারণে মানুষ শুধু আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্নই পূরণ করেনি। বরং পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে বিচরণ করার মত প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাও অর্জন করেছে। এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র মহাকাশচারী বা অ্যাস্ট্রোনাটদেরই মহাকাশে বিচরণ করার সুযোগ রয়েছে। সেকারণে বিশ্বজুড়েই এই পেশাটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। একই সাথে এটি অত্যন্ত কঠিন পেশাও বটে। সেকারণে খুব কম লোকই মহাকাশচারী হওয়ার সুযোগ পায়। অ্যাস্ট্রোনাট বা মহাকাশচারী হতে কী কী যোগ্যতা লাগে এবং এই পেশাটা আসলে কতটা চ্যালেঞ্জিং সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। শারিরীক ও মানসিক সক্ষমতা মহাকাশচারী হওয়ার জন্য শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। শারীরিকভাবে সক্ষম থাকার জন্য প্রতিদিন শরীরচর্চা করতে হয়। এই শরীরচর্চা শুধু পৃথিবীতে থাকাকালীন সময়ের জন্যই নয়, বরং মহাকাশে গিয়ে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে দুই ঘন্টা ব্যায়াম করতে হয়। কারণ মহাকাশের মাইক্রোগ্রাভিটি বা অতি স্বল্প অভিকর্ষ বলের কারণে নভোচারীদের শরীরের হাড়গোড় পর্যন্ত একটি আরেকটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তাই নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করা এবং শারিরীকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া মহাকাশচারী হওয়ার অন্যতম পূর্ব শর্ত।  শারীরিক সক্ষমতার পর পরই আসে মানসিক সক্ষমতার পালা। সাধারণভাবে শুধু মানসিকভাবে শক্তিশালী হলেই হবে না, যে কোন জটিল এবং আপদকালীন পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ সামলানোর কৌশলও রপ্ত করতে হয়। স্থির মস্তিষ্ক এবং স্থিতিশীল চিন্তাশক্তি অর্জন করা একজন নভোচারীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোন মহাকাশ অভিযানে একজন মহাকাশচারীকে দীর্ঘদিন একা একা থাকতে হতে পারে। সেই সাথে মহাকাশ যানে কোন ধরনের ত্রুটি বা দুর্ঘটনা ঘটলে তা মোকাবেলা করার মত সাহস ও শক্তি থাকা নভোচারীর নিজের সুরক্ষার জন্যই অপরিহার্য। শিক্ষাগত যোগ্যতা মহাকাশচারী হতে হলে, শিক্ষাজীবনে যে ভালো ফলাফল অর্জন করতে হবে, তা সবারই জানা। তবে সকল ক্ষেত্রের উচ্চশিক্ষিতরাই এই পেশায় আসতে পারবেন না। অ্যাস্ট্রোনাট হওয়ার জন্য মূলত STEM বিষয়গুলো উপর পড়ালেখা করতে হয়। STEM বলতে মূলত Science, Technology, Engineering, and Mathematics এর মত বিষয়গুলোকে বোঝানো হয়।  একজন মহাকাশচারীকে অবশ্যই পদার্থবিদ্যা, গণিত, জীববিদ্যা, রসায়ন এবং প্রকৌশল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। নির্দিষ্ট ডিগ্রি অর্জনের পর NASA বা ESA এর মত মহাকাশ সংস্থায় অ্যাপ্লাই করার সুযোগ পাওয়া যায়। STEM সােবজেক্টগুলেকে বাধ্যতামূলক করার কারণ হল, এসব বিষয়ে পড়ালেখা করলে সাধারণত মানুষের সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা বাড়ে। তাছাড়া মহাকাশে নভোচারীদের পাঠানোই হয় এমনসব বিষয়ে গবেষণা করার জন্য, যেসব বিষয় নিয়ে পৃথিবীতে গবেষণা করা সম্ভব নয়। আর কেউ যদি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা গণিতে দক্ষ না হয়, তাহলে তার জন্য অভিনব সব মহাকাশ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা একেবারেই সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন শুধুমাত্র শারীরিক ফিটনেস, মানসিক দৃঢ়তা, এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেই অ্যাস্ট্রোনাট হওয়া যায় না। এর জন্য একজন ব্যক্তিকে প্রাসঙ্গিক কোনো একটি পেশায় উচ্চ দক্ষতা এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। NASA-র অ্যাস্ট্রোনাটরা যেসব পেশা থেকে আসে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ১. পাইলট বা এয়ারক্রাফট কমান্ডার ২. ইঞ্জিনিয়ার ৩. চিকিৎসক ৪. গবেষবক বা বিজ্ঞানী অথবা ৫. সেনাসদস্য। মহাকাশচারী হওয়ার ক্ষেত্রে পাইলটদের অনেকক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কারণ তাদের কয়েক হাজার ঘণ্টার জেট ফ্লাইট পরিচালনার অভিজ্ঞতা মহাকাশযানের জটিল পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করে। চাঁদের বুেক প্রথম অবতরণ করা অ্যাস্ট্রোনাট নীল আর্মস্ট্রং ছিলেন একজন পাইলট। ইঞ্জিনিয়াররা মহাকাশযানের নকশা এবং প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। চিকিৎসকরা মহাকাশে দীর্ঘসময় থাকার প্রভাব বুঝতে এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা পরিচালনা করতে ভূমিকা রাখেন। শুধু তাই নয়, প্রতিটি মহাকাশচারীর জন্য চিকিৎসার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। কারণ পৃথিবীর বাইরে কোন মিশনে গিয়ে অসুস্থ হলে নিজের অথবা দলের অন্যদের চিকিৎসা করার প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও, বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা অ্যাস্ট্রোনাট হওয়ার মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। প্রথম আমেরিকান নারী হিসেবে মহাকাশে স্পেসওয়াক করা নাসার ক্যাথরিন সুলিভান ছিলেন একজন ভূতত্ত্ববিদ ও সমুদ্রবিজ্ঞানী। এছাড়া সেনাসদস্যরাও তাদের শৃঙ্খলা, নেতৃত্বের গুণাবলী এবং চাপ সামলানোর দক্ষতার কারণে মহাকাশ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এই পেশাগুলো ছাড়াও যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার একটিতে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অ্যাস্ট্রোনাট হওয়ার পথে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন।  প্রশিক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিতে মহাকাশচারী হিসেবে বাছাই করে। তবে এই বাছাই প্রক্রিয়াটা এতটাই কঠিন যে, ২০১৭ সালে ১৮ হাজার আবেদনকারীর ভেতর থেকে মাত্র ২২ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। মহাকাশে যাওয়া শারীরিকভাবে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তাই মহাকাশচারীদের কঠোর শারীরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেক নভোচারীর মতে মহাকাশে গিয়ে যে ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তার চেয়ে মহাকাশ মিশনের ট্রেনিংগুলো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। নাসার একজন অ্যাস্ট্রোনাটকে দুই বছর প্রশিক্ষন নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণকালে প্রায় ২৩০টিরও বেশি বিষয় শিখতে হয়। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল, মহাকাশের সাধারণ প্রশিক্ষণ, স্পেস ওয়াক বা মহাকাশে হাঁটা, স্কুবা ডাইভিং কিংবা রাশিয়ান ভাষা শিক্ষার মত বিচিত্র সব কোর্স। মহাকাশ যেহেতু এক ওজনহীন জগৎ, তাই মহাকাশচারীদের পৃথিবীতেই ওজনহীনতার অভিজ্ঞতা দেওয়া হয়। নাসার একটি বিশেষ এয়ারক্রাফটে করে নভোচারীদের ভ্রমণ করানোর মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই বিষয়টি মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর এক অনুভূতি। এই বিমানে ওঠার পর ওজনহীনতার জন্য অনেকেই বমি করেন। সেকারণে এই বিমানটির নামই রাখা হয়েছে Vomit Comet; বাংলা করলে যার অর্থ দাড়ায় বমির ধুমকেতু। একজন নভোচারীকে প্রতিবার ২০ সেকন্ড করে, দিনে প্রায় ৪০ বার এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্পেস স্যুট বেশ কিছু পেশার সম্মান তাদের ইউনিফর্মের সাথে জড়িত। যেমন, সামরিক বাহিনীর সদস্য কিংবা পুলিশ তাদেরকে পোশাককে অনেক সম্মান করে। মহাকাশচারীদের ক্ষেত্রেও তাদের সম্মানিত ইউনিফর্ম হল স্পেস স্যুট। একে শুধুই পোশাক ভাবলে ভূল হবে; এটিও এক ধরনের জটিল যন্ত্র। স্পেস স্যুট কে ব্যক্তিগত মহাকাশযান বললেও ভুল হবে না। এটি পরিধান করা এবং এর মধ্যে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। এই স্যুট মহাকাশচারীদের মহাশূন্যে সুরক্ষা প্রদান করে। এর ভেতরে অক্সিজেন সরবরাহ, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষুদ্র ধূলিকণা প্রতিরোধের মত প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থাও রয়েছে। একজন নভোচারীকে সবসময়ে স্পেস স্যুট পরে থাকতে হয় না, তবে একটি মহাকাশ অভিযানের বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে অ্যাস্ট্রোনাটদের অবশ্যই স্পেস স্যুট পরে বেশ কিছু জটিল কাজ সম্পাদন করতে হয়। তাই স্পেস স্যুটের সাথে মানিয়ে নেওয়াটাও প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পৃথিবীতে মানুষ শুধুমাত্র পানির নিচেই কম পরিশ্রমে যেদিকে খুশি সেদিকে নড়াচড়া করতে পারে। সেকারণে নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে পানির নিচে মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষনের জন্য এক বিশাল ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে স্পেসওয়াক সহ মহাকাশ মিশন পরিচালনার মত নানা প্রশিক্ষণ েদওয়া হয়। প্রত্যেক নভোচারীর জন্য ফ্লাইট প্রশিক্ষন বাধ্যতামূলক। তাদেরকে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন T-38 জেট বিমানে চড়ে মুক্ত আকাশে বিচরণ করতে হয়। যেন মহাকাশযান উৎক্ষেপনের সময়কার তীব্র চাপ সহ্য করতে তারা অভ্যস্ত হতে পারে। এসবের বাইরেও একজন মহাকাশচারীকে প্যারাসুটিং, জঙ্গলে বেঁচে থাকা, বরফাচ্ছাদিত এলাকায় তীব্র  শীতে টিকে থাকা, ডুবন্ত স্পেসশিপ থেকে বেঁচে ফিরে আসার মত নানান সব চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। 

প্রযুক্তি

ডিপসিক কিভাবে AI প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ বদলে দিল

ভূমিকা ডিপসিক একটি চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই কোম্পানি। সাম্প্রতিক সময়ে কম্পানিটি প্রযুক্তি জগতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ডিপসিকের মূল লক্ষ্য হল কম খরচে কার্যকর এআই মডেল তৈরি করা। ডিপসিকের তৈরি ডিপসিক চ্যাটবট অ্যাপ অত্যন্ত অল্প সময়ে এবং নামমাত্র বিনিয়োগে, বর্তমান সময়ের শীর্ষ এআই কম্পানি ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি সহ গুগলের জিমিনি বা মাইক্রোসফটের কোপাইলট কে টেক্কা দিতে পেরেছে। ডিপসিক অ্যাপ প্রকাশের মাত্র দশ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপ স্টোরের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোডকৃত অ্যাপে পরিণত হয়েছে। ডিপসিকের আর্বিভাবের ফলে, বিশ্বের শীর্ষ এআই চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া একদিনে শেয়ার বাজার থেকে প্রায় ৫৯৩ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬৫ লক্ষ ২৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। এটি ওয়াল স্ট্রিটের ইতিহাসেএক দিনে কোনো একক কোম্পানির জন্য সবচেয়ে বড় শেয়ার পতনের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। চীনের তৈরী ডিপসিক এআই প্রযুক্তি বিশ্বে কেন এতটা আলোড়ন তুলেছে এবং ভবিষ্যতে এই কম্পানি কিভাবে এআই এর ধারণা আমূল বদলে দিবে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। ডিপসিক ডিপসিক ২০২৩ সালে চীনের হাংঝু শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ডিপসিকের গবেষকরা এআই মডেল তৈরিতে এমন উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যার ফলে এআই মডেল তৈরীর ধারণাই আমূল বদলে গেছে। আর সেকারণেই মাত্র দুই বছর বয়সী একটি কম্পানি এআই প্রযুক্তির বাজারে রীতিমিত ভূমিকম্প তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। ডিপসিকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং, উন্নত মানের অথচ কম খরচের এআই মডেল তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। তিনি মূলত প্রচলিত এআই অবকাঠামোকে পাশ কাটিয়ে নতুন ধরনের কিছু একটা করার পরিকল্পনা করছিলেন। বর্তমানে আমরা যে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করি, তার জন্য অনেক বেশি কম্পিউটেশনাল পাওয়ার দরকার হয়। এর জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার এবং বিপুল পরিমাণ এআই চিপ ব্যবহার করতে হয়। সেকারণে এআই নিয়ে গবেষণা বা এআই নির্ভর একটি কার্যকর সেবা বা পণ্য তৈরী করাটা এতদিন পর্যন্ত অনেক ব্যয়বহুল প্রকল্প হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছিল। ডিপসিক কেন সেরা? ডিপসিক এআই এর নতুন কোন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেনি। তারা প্রচলিত এআই অবকাঠামোকে নতুন করে ডিজাইন করেছে মাত্র। তাহলে ডিপসিক নিয়ে এত মাতামাতির আসল কারণ কী? এর উত্তর হল ডিপসিক এআই মডেল তৈরীর খরচকে রীতিমত আকাশ থেকে পাতালে নামিয়ে এনেছে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কার্যকর এআই প্রোডাক্ট ওপেনএআই এর চ্যাটজিপিটি। ডিপসিক ওপেন এআই এর প্রায় সমকক্ষ ডিপথিংক আর-১ মডেল ট্রেইন করেছে মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলারে, বাংলাদেশী টাকায় মাত্র ৬৬ কোটি টাকা। ৬ মিলিয়ন ডলার শুনতে অনেক মনে হলেও, এআই প্রযুক্তি খাতে এই খরচ নিতান্তই দুধভাত। কারণ চ্যাটজিপিটির জিপিটি-৪ মডেল কে ট্রেনিং করতে ওপেনএআই-এর আনুমানিক খরচ ছিল প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার; বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা। তারমানে ডিপসিক চ্যাটজিপিটির তুলনায় প্রায় ১৭ গুণ কম খরচে এআই ট্রেনিংসম্পন্ন করেছে। যা কিছুদিন আগ পর্যন্তও ছিল অকল্পনীয়। এআই এর প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকতে হলে, কাড়ি কাড়ি ডলার বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই; এমন ধারনা থেকে মাত্র কিছু দিন আগেই গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফটের মত প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। অথচ ডিপসিকের মত পুচকে এক চাইনিজ কম্পানি বিশ্ব টেক জায়ান্টদের রীতিমত নাকানি চুবানি দিচ্ছে। ডিপসিক কিভাবে করল? ডিপসিক এমন একটা সময়ে তাদের এই নতুন এআই মডেল বাজারে ছেড়েছে; যার ২ বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর সকল ধরনের চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর প্রথম বড় পরিসরে চিপ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা দেয় ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে। এরপর ২০২৩ সালের অক্টোবরে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। তারমানে ডিপসিকের জন্মই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের চিপ নিষেধাজ্ঞার পরবর্তী সময়ে। মার্কিন সরকার চীনে উন্নত চিপ, আধুনিক প্রসেসিং ইউনিট বা GPU, এবং AI ও সুপারকম্পিউটিং-এর জন্য ব্যবহৃত চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। শুধু চিপই নয়, চীনে আধুনিক চিপ তৈরির সরঞ্জাম রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, যাতে চীন উন্নত চিপ তৈরি করতে না পারে। কিন্তু তারপরও ডিপসিক কিভাবে এত অল্প সময়ে এত উন্নত এআই মডেল তৈরী করল তা গবেষকদের মধ্যে এখনও এক বিষ্ময়। অনেককেই ধারণা করছেন ডিপসিকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং চীন ভিত্তিক একটি ক্রিপ্টো মাইনিং গ্রুপের সদস্য ছিলেন। ধারণা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আগেই এই গ্রুপটি প্রায় ৫০ হাজারের বেশি গ্রাফিক প্রসেসিং ইউনিট বা GPU কিনে রেখেছিল। তারা এক প্রকার ব্যক্তিগত আগ্রহের বশেই এআই মডেল নিয়ে কাজ শুরু করে। ডিপসিক প্রথমে এআই মডেলের টোকেন গুলোকে সহজ করেছে। টোকেন হল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষা মডেলে ব্যবহৃত সবচেয়ে ছোট তথ্যের একক, যা একটি শব্দ, বাক্যের অংশ, বা এমনকি অক্ষরের টুকরো হতে পারে। উদাহরণস্বরূপবলা যায়: “Artificial Intelligence is amazing!” এই বাক্যটিকে প্রচলিত এআই মডেল – [“Arti”, “ficial”, “Intelli”, “gence”, “is”, “amaz”, “ing”, “!”] এরকম একেকটি শব্দকে কয়েক ভাগে ভাগ করার মাধ্যমে টোকেন তৈরী করে। যা দিয়েই মূলত এআই মডেলগুলো নতুন নতুন শব্দ, বাক্য বা একটি রচনা তৈরী করতে পারে। কিন্তু ডিপসিক টোকেনগুলোকে এতটা ছোট করে না ভেঙে, প্রতিটি শব্দকে একেকটি টোকেন হিসেবে ধরে নিয়েছে। যেমন: ডিপসিকের জন্য [“Artificial”, “Intelligence”, “is”, “amazing”, “!”] এরকম প্রতিটি শব্দ একেকটি টোকেন। এরফলে ডিপসিক অনেক কম কম্পিউটেশনার পাওয়ার ব্যবহার করেও, দীর্ঘ মেয়াদে অনেকটা একই রকম ফলাফল পেয়েছে। সকলের বোঝার স্বার্থে টোকেনের এমন সহজ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টা এতটাও সহজ নয়। ডিপসিক এআই একসাথে প্রায় ১ লক্ষ ২৮ হাজার টোকেন পর্যন্ত মনে রাখতে পারে। যা প্রায় চ্যাটজিপিটির সমান। মাত্র কয়দিন আগেও চ্যাটজিপিটি মাত্র ১৬ হাজার টোকেন নিয়ে কাজ করত। তবে চ্যাটজিপিটির এই অবস্থায় আসতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু ডিপসিক তাদের যাত্রার শুরুতেই কিভাবে চ্যাটজিপিটির সমপর্যায়ে পৌছাতে পারল তা নিয়ে বিষ্ময়ের শেষ নেই। চ্যাটজিপিটির নির্মাণে টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট বিরাট অংকের বিনিয়োগ করেছিল। চীনা প্রতিষ্ঠান ডিপসিক ওপেনএআই এর তথ্য চুরি করে তাদের মডেল তৈরী করেছে কিনা, সে বিষয়ে মাইক্রোসফট ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। তাছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিয়োগ দেওয়া হোয়াইট হাউসের এআই ও ক্রিপ্টো বিষয়ক কর্মকর্তা ডেভিড স্যাকস বলেছেন, ডিপসিক যে ওপেন এআই এর মডেল চুরি করেছে, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। ডিপসিক ওপেন সোর্স কেন? ডিপসিকের তৈরী এআই মডেল ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি, গুগলের জিমিনি বা মাইক্রোসফটের কোপাইলটের শুধু সমক্ষই নয়, কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন মডেলগুলোর চেয়েও ভালো কার্যক্ষমতা প্রদর্শন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এআই মডেল গুলোর সামান্য অংশ বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। এগুলো থেকে ব্যবহারকারীরা সেরা আউটপুট পেতে চাইলে অর্থ খরচ করে মাসিক সাবস্ক্রিপশন নিতে হয়। কিন্তু ডিপসিক এআই এর সর্বোচ্চ সেবা ব্যবহার করা যায় সম্পূর্ন বিনামূল্যে। শুধু তাই নয়, ডিপসিক একটি ওপেনসোর্স মডেল। তারমানেডপসিক কিভাবে তৈরী করা হয়েছে, সেই প্রক্রিয়া সবার জন্য উন্মুক্ত। এখন চাইলেই যে কেউ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজেদের মত করে একটি নতুন এআই মডেল তৈরী করে নিতে পারবে। অর্থাৎ ডিপসিক শুধু অর্থনৈতিকভাবেই পশ্চিমা কম্পানিগুলোকে দেউলিয়া করার পায়তারা করছে না, বরং তাদের প্রযুক্তিগত গোপন গবেষণাগুলোও সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে এআই প্রযুক্তি সহজলভ্য করেছে। যেহেতু চীনের পৃষ্ঠপোশকতায় ডিপসিক তৈরী হয়েছে, তাই এখানে চীনের সরকার বিরোধী কোন তথ্য বা ফলাফল দেখানো হয়

জীবন

আকাশপথে ভ্রমণ কি নিরাপদ

ভূমিকা সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে বিমান ভ্রমণের নিরাপত্তা নিয়ে যাত্রীদের মনে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমাগত প্রযুক্তির উন্নতি ও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও বিমান দুর্ঘটনা পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।  কিছু দুর্ঘটনার জন্য যান্ত্রিক ত্রুটি দায়ী, কিছু ক্ষেত্রে প্রতিকূল আবহাওয়া দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আবার কিছু দুর্ঘটনা মানবিক ভুলের কারণেও ঘটেছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটির আগাম সতর্কবার্তা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে তা প্রাণঘাতী পরিণতি ডেকে এনেছে।  সাম্প্রতিক সময়ে এত বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে কেন এবং আকাশপথে ভ্রমণ কতটুকু নিরাপদ, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। সাম্প্রতিক বিমান দুর্ঘটনা উড়োজাহাজ আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে, আকাশপথে যত ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা প্রতিরোধ করতে পর্যায়ক্রমে প্রায় সকল ধরনের ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে। সেকারণে বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র সেইসব দুর্ঘটনাই ঘটছে, যা আগে কখনও ঘটেনি অথবা তা আগে থেকে ধারণা করা সম্ভব ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি আলোচিত বিমান দুর্ঘটনা হল, দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান বিমান বন্দরে জেজু এয়ারলাইন্সের দুর্ঘটনা (২৯ ডিসেম্বর ২০২৪), কাজাখস্তানের আকতাউয়ে আজারবাইজান এয়ারলাইন্সের দুর্ঘটনা (২৫ ডিসেম্বর ২০২৪), যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনায় মাঝ আকাশে দুই বিমানের সংঘর্ষ (১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫), ব্রাজিলের গ্রামাদো শহরে ছোট ব্যক্তিগত বিমান দুর্ঘটনা (২২ ডিসেম্বর ২০২৪), রাশিয়ার তিভের অঞ্চলে ব্যক্তিগত বিমান দুর্ঘটনা (২৩ আগস্ট ২০২৩), নেপালের পোখারা বিমান দুর্ঘটনা (জানুয়ারি ২০২৩) উল্লেখযোগ্য। এগুলোর বাইরেও কানাডা, তুরষ্ক, মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়ায় আরো বেশ কিছু ব্যক্তিগত ও সামরিক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। তবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস টি ছিল বিমান যাত্রার ইতিহাসে একটি অন্যতম কালো অধ্যায়। কারণ ডিসেম্বরে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে একের পর এক ঘটে যায় বেশ কয়টি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা, যাতে বহু লোক মৃত্যুবরণ করেন।  বিমান দুর্ঘটনা সাধারণত একাধিক কারণের সমন্বয়ে ঘটে থাকে।  তবে মোটা দাগে বললে বিমান দুর্ঘটনার সাথে জড়িত প্রধান কারণ ৩টি।   আমেরিকার ন্যাশনাল এভিয়েশন সেফটি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ শতাংশ বিমান দুর্ঘটনাই ঘটে পাইলটের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। এরপর প্রায় ২৩% বিমান দুর্ঘটনা কোনো না কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটে থাকে। এবং প্রায় ১০% বিমান দুর্ঘটনা প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ঘটে থাকে। জেজু দুর্ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনা গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হল দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারের দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনার প্রথম কারণ ছিল বার্ড স্ট্রাইক। অর্থাৎ পাখির সাথে বিমানের সংঘর্ষ। প্রায় এক কেজি ওজনের পাখি যখন কয়েকশো কিলোমিটার গতিতে চলা বিমানের সাথে ধাক্কা খায়, তখন এটি মারাত্নক বিস্ফোরণের মতো শক্তি তৈরি করতে পারে। সাধারণত পাখি আর বিমানের এই সংঘর্ষ এড়াতে বিমানবন্দরগুলোর নকশায় ও অবস্থানে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়। জলাশয়ের আশেপাশে বিমানবন্দর তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং এয়ারপোর্টের আশেপাশে পাখির খাবারের উৎস সরিয়ে ফেলা হয়। অনেক সময় লেজার লাইট বা অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাখিদের তাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। পাখি বা পাখির ঝাঁক যদি বিমানের উইন্ডস্ক্রিনে ধাক্কা দেয় কিংবা জেট ইঞ্জিনের ভেতরে ঢুকে পড়ে, তখন দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে প্রতিবছর বিশাল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়। শুধু আমেরিকাতেই এ কারণে ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার! আর সারা বিশ্বের বাণিজ্যিক বিমানের ক্ষেত্রে এই ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার   কিন্তু মুয়ান বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এই সতর্কতাগুলো উপেক্ষা করেছিল। বিমানবন্দরের ঠিক পাশেই ছিল একটি জলাশয়, যা পাখিদের বসবাসের আদর্শ জায়গা। বিমানটি অবতরণের আগে পাখির সাথে এর সংঘর্ষ হয়, ফলে ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ করা বন্ধ করে দেয়। বিমানের পাইলট তারপরও যথেষ্ট দক্ষতার সাথে বিমানটিকে বেলি ল্যান্ডিং করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেখানে দেখা দেয় আরেকটা সমস্যা। মুয়ান এয়ারপোর্টের রানওয়ের সামনে ছিল একটি দীর্ঘ কংক্রিটের দেয়াল। বিমানটি খুব দ্রুত এই দেয়ালে আঘাত করার ফলে মারাত্নক বিস্ফোরণ ঘটে। এতে বিমানের আরোহী ১৮১ জনের মধ্যে ১৭৯ জন যাত্রী ও ক্রু নিহত হয়, মাত্র ২ জন বেঁচে যান। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা। জেজু এয়ারের এই দূর্ঘটনাটি ছিল একাধিক দুর্ঘটনার অদ্ভূত সমন্বয়। পাখির আঘাতে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারালেও, পাইলটের দক্ষতায় ল্যান্ডিং গিয়ার ছাড়াই বিমানটি রানওয়েতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের মারাত্নক ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে ১৭৯ জন নিরীহ মানুষকে প্রাণ হারাতে হল। অন্যান্য দুর্ঘটনা ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনাটি ছিল ১৯৭৭ সালের ২৭ মার্চ স্পেনের তেনেরিফে দ্বীপে। তেনেরিফে বিমানবন্দরের রানওয়েতে দুটি বোয়িং ৭৪৭ বিমানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫৮৩ জন যাত্রী প্রাণ হারান। ঘন কুয়াশার কারণে নেদারল্যান্ডসের কেএলএম এবং যুক্তরাষ্ট্রের পান আম বিমান দুটির পাইলটরা একে অপরকে দেখতে পাননি। যার ফলেই এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০০১ সালের পহেলা জুন। এয়ারফ্রান্স ফ্লাইট-৪৪৭ রিও ডি জেনেরো থেকে প্যারিসের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে আটলান্টিক মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয়। সেই মর্মান্তিক ঘটনায় ২২৮ জন প্রাণ হারায়। এই দুর্ঘটনার মূল কারণ ছিল বিমানটির পিটোট টিউবের ত্রুটি। এই পিটোট টিউবের মাধ্যমে প্লেনে বাতাসের দ্রুতি মাপা হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ার সময় এগুলো ঠান্ডায় জমে যায়। ফলে হঠাৎ করে অটোপাইলট বন্ধ হয়ে যায়। পাইলটরা পরিস্থিতি সামলাতে না পারায় বিমানটি ভারসাম্য হারায় এবং ৩৫,০০০ ফুট থেকে সমুদ্রে আছড়ে পড়ে। পাইলটের দক্ষতা অনেক সময় বিমানে কোনো ত্রুটি দেখা দিলেও দক্ষ পাইলটের কারণে সেটি সরাসরি মাটিতে আছড়ে পড়ে না। পাইলট পরিস্থিতি সামলে বেলি ল্যান্ডিং করাতে সক্ষম হন। বেলি ল্যান্ডিং মানে হলো, বিমানটির চাকা না নামিয়ে মূল বডি দিয়েই রানওয়েতে অবতরণ করানো। তবে এতে বিমান আর রানওয়ের মধ্যে প্রচণ্ড ঘর্ষণ হয়, যা থেকে আগুন ধরে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। অনেক সময় অন্যান্য ত্রুটির কারণে বিমানে আগুন ধরে থাকে। গত ডিসেম্বরে কানাডার বিমানে অগ্নিকান্ড অনেকটা এরকমভাবেই হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় ল্যান্ডিং গিয়ারের সমস্যা থাকায় বিমানে আগুন ধরে যায়। সৌভাগ্যবশত এই দুর্ঘটনায় কোন প্রাণহানি ঘটেনি। বিশ্বব্যাপী ম্যাটেরিয়ালস বিজ্ঞানীরা বিমানের মূল কাঠামো তৈরির জন্য এমন উপাদান তৈরি করার চেষ্টা করছেন যাতে দুর্ঘটনার পর বিমানে আগুন ধরে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করা যায়। বিমান দুর্ঘটনার সমাধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি হলো, প্রতিটি দুর্ঘটনার সঠিক কারণ নির্ণয় করা এবং সেই তথ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। তবে, দুর্ভাগ্যবশত অনেক সময়ই কতৃপক্ষ নিজেদের দোষ আড়াল করার জন্য জাল রিপোর্ট দেয়। এর ফলে সঠিক সমস্যা চিহ্নিত করা যায় না, আর সেই সাথে কার্যকর সমাধানও অনিশ্চিত থেকে যায়।  বিমান ভ্রমণ কতটা নিরাপদ? বিমান দুর্ঘটনার নিয়ে এত আলোচনার পর হয়তো মনে হচ্ছে, আকাশপথে যাত্রা করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সত্যিকার অর্থে সড়ক পথের চেয়ে আকাশ পথে ভ্রমণ অনেক বেশি নিরাপদ। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি যাত্রী বিমান ভ্রমণ করেন, কিন্তু দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা খুবই কম। সড়ক পথে যাতায়াতে প্রতি ১০০ মিলিয়ন মাইল ভ্রমণে ১.৪২ জন নিহত হয়। অন্যদিকে আকাশ পথে প্রতি ১০০ মিলিয়ন মাইল ভ্রমণে ০.০৭ জন নিহত হয়। তারমানে বিমান ভ্রমণ গাড়ির তুলনায় প্রায় ২০০ গুণ বেশি নিরাপদ। প্রতিদিন যে পরিমাণ বিমান আকাশে চলাচল

Shopping Cart
Scroll to Top