সূচনা
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তার আগ্রাসী ভূ-রাজনৈতিক নীতির প্রকাশ ঘটছে। পানামা খাল পুনরায় দখলের ঘোষণা, জোর করে গ্রীনল্যান্ড দ্বীপ কেনার চেষ্টা এবং কানাডার কিছু অংশ যুক্তরাষ্ট্রের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশের পর এবার তিনি নজর দিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বিতর্কিত অঞ্চল গাজা উপত্যকার দিকে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, গাজাকে সহিংসতা ও ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনার জন্য এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গাজার ২০ লাখ বাসিন্দাকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার এই দখলদারী মনোভাব বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ট্রাম্প কেন গাজা দখল করতে চায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।
ট্রম্পের গাজা নীতি
দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত হওয়ার পর, ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে প্রবেশের আগেই গাজার যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। অনেকেই মনে করছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়ত ফিলিস্তিনিদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বাইডেন প্রশাসনের চেয়েও অনেক বেশি বিধ্বংসী হতে যাচ্ছে।
২০১৭ সালে ট্রাম্পই জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। যা ছিল জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রস্তাবনায় জেরুজালেমকে ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন কোন দেশের নিয়ন্ত্রণে না দিয়ে, একে আন্তর্জাতিক অঞ্চল হিসেবে রাখার কথা বলা হয়েছিল।
২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর মধ্যস্থতায়, আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে আরব বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশকে ফিলিস্তিন ইস্যু পাশ কাটিয়ে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সর্বপ্রথম বিদেশি কোন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প গাজা নিয়ে তার সবচেয়ে ভয়ংকর পরিকল্পনার কথা জানান। ট্রাম্প জানিয়েছেন যে গাজা উপত্যকার পুনর্গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গাজা দখল করবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গাজাবাসীদের অন্যত্র পুনর্বাসন করা হবে। তিনি গাজাকে একটি ধ্বংসস্তূপ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে। তার মতে, অবিস্ফোরিত বোমা অপসারণ, গাজার পুনর্গঠন এবং সেখানকার অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করাই হবে মূল লক্ষ্য।
ট্রাম্প আরও উল্লেখ করেন যে, গাজা উপত্যকা বহু দশক ধরে মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রতীক হয়ে রয়েছে এবং এই অঞ্চলটিকে তিনি ‘দুর্ভাগা’ হিসেবেও বর্ণনা করেন। ট্রাম্পের দাবি গাজার মানুষ সেখানে থাকতে চায় না; বরং তারা অন্য দেশে চলে যেতে আগ্রহী। তার মতে গাজার লোকেদের আসলে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলেই তারা গাঁজায় ফিরে যাচ্ছে। ট্রাম্প বরাবরই তার নিজস্ব মনগড়া বক্তব্যকে ফ্যাক্ট হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করে। মাত্র কিছুদিন আগেই ট্রাম্প বলেছিল গ্রীনল্যান্ডের বাসিন্দারাও নাকি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হতে চায়। অথচ তারা দীর্ঘদিন থেকে গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছে।
অতীতে বাইডেন প্রশাসন গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন নিয়ে নগ্ন মিথ্যাচারের মাধ্যমে অনায্য যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, ট্রাম্প প্রশাসন কোন রাখঢাক না রেখে, সরাসরি গাঁজা দখলে নেওয়ার মতো বেআইনি বিষয়কে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ট্রাম্প তার ব্যক্তিগত জীবনে একজন সফল ডেভলপমেন্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। সে কারণে তিনি গাঁজা কেউ একটি আকর্ষণীয় প্রপার্টি হিসেবে দেখছেন। এই বিষয়টি তিনি নিজ মুখে স্বীকার করে বলেছেন গাঁজায় চমৎকার সব ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তৈরি করা হবে এবং এর জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো অর্থায়ন করবে। তিনি বিশেষ করে সৌদি আরবের কথা বলেছেন। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পেছনে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থ ব্যয় করেছে সেগুলোর মধ্যে ইলোন মাস্কের পরেই রয়েছে সৌদি আরবের সরকারী তহবিল পাবিলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড।
ট্রাম্প শুধু গাজা দখলই নয়; অতীতে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে যেসকল অবৈধ ইসরায়েলী স্যাটেলমেন্টের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল; ট্রাম্প সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। তারমানে ফিলিস্তিনের বাকি অঞ্চলে দখলদারি চালানোর বিষয়ে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আরো প্রত্যক্ষ মদদ পাবে। যুক্তরাষ্ট্র বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে বলেন, “হোয়াইট হাউজে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বন্ধু আপনি।” নেতা নিয়াহু এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যেসব অস্ত্র আটকে ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর সেসব অস্ত্র আবারো ইসরায়েলে সরবরাহ শুরু করেছেন। এছাড়া, জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-কে ট্রাম্প প্রশাসন আর তহবিল না দেওয়ার ঘোষণা করার কারণেও নেতানিয়াহু সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।