ইউনুস সরকার ব্যর্থ হল কেন

সূচনা

শেখ হাসিনার পতনের পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে, দেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্ম নিয়েছিল। সাধারণ মানুষ ভেবেছিল, ড. ইউনূস তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশকে একটি নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সেই সাথে সুশীল সমাজের বহু সফল ও পরিচিত মুখ উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পাওয়ায়, বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও, দেশের মানুষ আবারো ঠিক আগের মতই হতাশ হয়ে পড়েছে। কারণ সত্যিকার অর্থে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা সহ কোন দিক থেকেই জনগণের ভোগান্তি কমেনি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়েও বেড়েছে।

সরকারের ভেতর ও বাইরে থেকে নানা মূখী চ্যালেঞ্জের কারণে, ড. ইউনূসের সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। ফলে জনগণের আস্থা দ্রুত কমতে শুরু করেছে এবং এই সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেন ব্যার্থ হচ্ছে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।

নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, মব জাস্টিস এবং সম্পত্তি ধ্বংসের ঘটনা ঘটে, যা অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়।

সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশ ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়। বিনা নোটিশে ভারত ত্রিপুরার বাঁধ খুলে দেওয়ায় পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলা প্লাবিত হয়, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি ও কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। সেসময় দেশের জনগণ সদ্য গঠিত হওয়া সরকারের ভরশায় না থেকে, নিজেরাই যে যার সাধ্যমত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেকারণেই সরকার তার চ্যালেঞ্জের প্রথম পরীক্ষায় অনেকটাই পার পেয়ে যায়।

নবগঠিত সরকারের দ্বায়িত্ব বুঝে উঠতে আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন; এমন ধারণা থেকেই রাজধানীর বাসিন্দারা ডাকাত আতঙ্কে নিজেরা রাত জেগে পাড়া মহল্লায় পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছে। তখনও হাসিনার খুনি পুলিশ বাহিনীর অধিকাংশই গা ঢাকা দিয়েছিল। তাই দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। 

কিন্তু সরকার তার ক্ষমতার মেয়াদ ছয় মাস পূর্ণ করলেও, এখনও পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বভাবিক হয়নি। এটি নিঃসন্দেহে এই সরকারের মারাত্নক ব্যার্থতা। মাঝখানে পুলিশ প্রশাসন সংস্কারের নামে র‌্যাব ও পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে, নেটিজেনদের কিছুটা হাসির খোড়াক যোগানো ছাড়া অন্তবর্তী সরকারের উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

সবশেষে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের যৌথ অভিযান শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সাফল্য আসলেও, এই কার্যক্রমও একেবারে বিতর্ক মুক্ত নয়।

অর্থনৈতিক সংকট 

পূর্ববর্তী হাসিনা সরকারের লুটপাটের কারণে দেশে মারাত্নক অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত সৃষ্টি হয়েছিল। সেকারণে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকগুলোতে অর্থের ব্যাপক সংকট ছিল। সেই সাথে দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা অন্তবর্তী সরকারের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেছে।

ড. ইউনুস সরকার গঠনের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও, বাজারে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে কষ্ট শুধু বাড়িয়েই চলেছে। সরকার আমদানি করা খাদ্যপণ্যের উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার এবং টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি ব্যবস্থা করলেও, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। মাঝখানে ডিমের দাম নিয়ে ব্যাপক নৈরাজ্য, বাজার থেকে ভোজ্য তেল উধাও হয়ে যাওয়া, আবার বেশি দামে বাজারে ফিরে আসা, আলু-পেঁয়াজ অামদানি নিয়ে জটিলতা সহ নানা বিষয়ে সরকারের ব্যার্থতা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রশাসনিক সংস্কারে ধীরগতি

সরকারের বিভিন্ন স্তরে প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি সরকারের প্রতি জনগণের আস্থায় আঘাত করেছে।

এই সরকারের অন্যতম কাজ ছিল দেশের পুরনো ধ্বসে পড়া কাঠামো সংস্কার করা। সে লক্ষ্যে জনপ্রশাসন, পুলিশ, আদালত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সংবিধান সংস্কারের জন্য সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করলেও, এই সংস্কার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ফলে জনগণের প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসছে না।

ইতোমধ্যে সংস্কার কমিশনগুলো সরকারের হাতে তাদের অনুসন্ধান ও সুপারিশ পত্র তুলে দিলেও, এই সরকার সেসব সংস্কার আদৌ করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ তারা দেশ পরিচালনার কাজেই রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে।

তারচেয়েও বড় কথা হল, যাদের প্রানের বিনিময়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে, ২৪ এর সেই সব শহীদ পরিবারের প্রতি এখনও ন্যায় বিচার করা হয়নি। জুলাই বিপ্লবে আহতদের চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সরকার চূড়ান্ত রকমের ব্যার্থ হয়েছে। এবং এই সরকার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে কোন কাজে আসবে না বুঝতে পেরেই; আহতরা পর্যন্ত আবারো আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে। শুধু তাই নয়, জুলাই বিপ্লবের খুনিদের বিচার তো দূরের কথা; তাদের নামে ঠিকমত মামলা পর্যন্ত দিতে পারেনি এই সরকার। যেসব দুর্বল মামলা হয়েছে, সরকার পরিবর্তনের পর তাদের প্রায় শতভাগই খালাস পেয়ে যাবে। তাছাড়া আয়নাঘর প্রকাশ্যে আনা বা পিলখানা হত্যাকান্ডের মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়েও সরকারের যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে।

বলতে গেলে বিল্পব করেও কাঙ্খিত পরিবর্তন না পেয়ে হতাশ হয়েও, অনেকে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙতে গিয়েছে।

অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত

পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনীতিবিদ ও আমলারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার মহাপরিকল্পনা করছে। এর কারণেই অনেকটা সরকারের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সমস্যা হচ্ছে।

পূর্ববর্তী সরকারের প্রভাবশালী আমলারা সরকারের কার্যক্রম ব্যাহত করতে নানাভাবে অপপ্রচার, রাজনৈতিক উসকানি ও প্রশাসনিক বাধা সৃষ্টি করেছে বলে বিশ্লেষকদের মত। সরকার গঠনের পরপরই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের ভেতরে থেকে অসহযোগিতা একেবারেই স্পষ্ট ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের নেওয়া নীতিমালা বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করা হয়, যাতে জনসাধারণের মধ্যে সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বলছে, এই পুলিশ বাহিনীতে ৯০ শতাংশই আওয়ামী লীগ করে।

সেই সাথে রাজনৈতিক অঙ্গনে, ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার চালানো হয়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বিশেষ করে, অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য এককভাবে বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়।

এছাড়া, সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং বেশ কিছু অরাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রকাশ্যে ও গোপনে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন শহরে আকস্মিক বিক্ষোভ, রাস্তা অবরোধ এবং সরকারি ভবনে হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এগুলো ছিল সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চক্রান্ত, যাতে জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয় এবং সরকারের জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেওয়া যায়।

এসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ফলে ইউনূস সরকার নীতিগতভাবে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তার বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এ কারণেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারেনি।

জনগণের অতিরিক্ত প্রত্যাশা

অন্তবর্তী সরকারের ব্যার্থতা আমাদের চোখে এত প্রকটভাবে ধরা পড়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হল, ড. ইউনুসের সরকারের প্রতি জনগণের অতিরিক্ত প্রত্যাশা ছিল। দেশের জনগণ নতুন সরকারের কাছ থেকে দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নয়ন আশা করেছিল। তবে স্বল্প সময়ে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব না হওয়ায় জনগণের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সেই অধিক প্রত্যাশা থেকেও প্রতিদিন নতুন নতুন আন্দোলন হচ্ছে। এই সরকারের আমলে কোন কোন পেশাজীবীরা আন্দোলন করেছে, তার চেয়ে বয়ং কারা আন্দোলন করেনি, সেই তালিকা তৈরী করা সহজ হবে।

এই অল্প সময়ে হয়ত সকল সমস্যা সামাধান করাও যাবে না। তবে সরকারের অন্তত উচিত ছিল, কিছু মৌলিক বিষয়ে আরো তৎপর হওয়া। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে নি। এভাবে চলতে থাকলে ইউনুস সরকারের ব্যার্থতার বোঝা বাড়তেই থাকবে। 

এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করে, নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই ভালো উপায়। তবে বিএনপি সহ অন্যান্য ছোট দল গুলোও যেভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে সামনে কী অপেক্ষা করছে তাও বলা মুশকিল। কারণ বিএনপির অতীত রেকর্ডও দেশের মানুষের জন্য খুব বেশি সুখকর নয়।

তবে দেশের অবস্থা এখনও খুব বেশি স্থিতিশীল না হলেও, অন্তত আওয়ামী লীগের মত হায়েনাদের কবল থেকে দেশ মুক্ত হয়েছে, এটিই বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনেক বড় স্বস্তির বিষয়। এবং ২৪ এর গণ অভ্যুত্থান বাংলাদেশের মানুষকে যেভাবে জাগ্রত হতে শিখিয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে শেখ হাসিনার মত কোন স্বৈরশাসক এককভাবে সকল ক্ষমতা কুক্ষীগত করতে পারবে না বলেই অাশা করা যায়।

সম্পর্কিত পোস্ট

ভারত বনাম পাকিস্তান সামরিক শক্তিতে কে এগিয়ে

ভূমিকা ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার মধ্যেই রয়েছে। কাশ্মির ইস্যু, সীমান্ত সংঘাত এবং পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা উভয় দেশের সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন যে, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে কে জিতবে? এর উত্তরটা আসলে বেশ জটিল। দুই দেশের সামরিক জনবল, অস্ত্রশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বাজেট, পারমাণবিক ক্ষমতা, এবং কৌশলগত নীতি ও অবস্থান সহ আরো বেশ কিছু বিষয়ের উপর যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে। ভারত-পাকিস্তানের তুলনা সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনকি সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সামরিক শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের পরেই ভারতের অবস্থান। ২০২৫ সালের গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃত। এই সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান ১২ তম। তারমানে সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে ৮ ধাপ এগিয়ে। তবে সেই অর্থে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি ভারতের তুলনায় একেবারেও দুর্বল নয়। ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট মাত্র ৭.৬৪ বিলিয়ন ডলার। তারমানে ভারতের প্রতিক্ষা বাজেট পাকিস্তানের প্রায় ১০ গুণ বেশি। তবে ভারত বনাম পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজর্ভের দিকে তাকালে বিষয়টি খুব বেশি অস্বাভাবিকও লাগবে না। কারণ ভারতের রিজার্ভ ৬২৭ বিলিয়ন ডলার অন্যদিকে পাকিস্তানের রিজার্ভ আছে মাত্র ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার। জনসংখ্যার দিক থেকেও ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ভারতে জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। ২০২২ সালে, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি।  । সামরিক শক্তির তুলনা আধুনিক সামরিক শক্তি মূলত প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, কৌশল এবং অস্ত্রের মানের ওপর নির্ভর করে। সেনা সদস্যের সংখ্যা একটি দেশের সামরিক সক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি সামগ্রিক সামরিক শক্তি নির্ধারণের একমাত্র সূচক নয়। ভারতের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ ৫৫ হাজার, অন্যদিকে পাকিস্তানের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ ৫৪ হাজার। ভারতের রিজার্ভ সৈন্য ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার এবং পাকিস্তানের রিজার্ভ সৈন্য ৫.৫ লক্ষ। ভারতের আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লক্ষ ২৭ হাজার এবং পাকিস্তানের আধা-সামরিক বাহিনীতে প্রায় ৫ লক্ষ সদস্য রয়েছে। ভারতের ট্যাংকের সংখ্যা ৪ হাজার ২০১টি, পাকিস্তানের ট্যাংক আছে ২ হাজার ৬২৭টি। ভারতের সাঁজোয়া যান আছে ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৯৪ টি, পাকিস্তানের সাঁজোয়া যান আছে ১৭ হাজার ৫১৬টি। ভারতের বিমান বাহিনীতে মোট বিমানের সংখ্যা ২ হাজার ২২৯ টি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মোট বিমান ১ হাজার ৩৯৯টি। ভারতের যুদ্ধ বিমান আছে ৫১৩টি; পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমান ৩২৮টি। এট্যাক হেলিকপ্টার সহ ভারতের মোট হেলিকপ্টার আছে ৮৯৯ টি, পাকিস্তানের আছে ৩৭৩টি হেলিকপ্টার। এছাড়া ভারতের পরিবহন বিমান ২৭০ টি এবং পাকিস্তানের পরিবহণ বিমান ৬৪ টি। ভারতের কাছে ফ্রান্সের তৈরী রাফাল যুদ্ধবিমানের মত আধুনিক বিমান আছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে থাকা সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান হল, চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত JF-17 Thunder যুদ্ধবিমানের সর্বশেষ সংস্করণ Block III। তবে ভারতেও নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত তেজস সিরিজের বেশ কয়েকটি মডেলের উন্নত যুদ্ধবিমান রয়েছে। লজিসস্টিকসের দিক থেকে ভারতের বিমানবন্দর আছে ৩১১টি আর পাকিস্তানের আছে ১১৬টি। ভারতীয় নৌ বাহিনীতে মোট নৌযানের সংখ্যা ২৯৩ টি। পাকিস্তান নৌ বাহিনীর মোট নৌযানের সংখ্যা ১২১টি। ভারতের ফ্রিগেট যুদ্ধ জাহাজ আছে ১৪ টি, পাকিস্তানের ৯টি। ভারতের ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধ জাহাজ আছে ১৩ টি। কিন্তু পাকিস্তানের কোন ডেস্ট্রয়ার নেই। ছোট আকারের করভেট যুদ্ধ জাহাজ ভারতের আছে ১৮টি আর পাকিস্তানের ৯টি। ভারতের সাবমেরিন আছে ১৮টি, পাকিস্তানের ৮টি। এছাড়া ভারতের টহল নৌযান আছে ১৩৫টি এবং পাকিস্তানের টহল নৌযান আছে ৬৯টি। এসবের বাইরে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই পারমানবিক অস্ত্রভান্ডার আছে। ভারতের কাছে আনুমানিক ১৭২টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে ১৭০টি। ভারত “No First Use” অর্থাৎ প্রথমে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার নীতিতে অটল। তারমানে ভারত শুধুমাত্র আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। কিন্তু পাকিস্তান “No First Use” নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়; তারা অস্তিত্বগত হুমকির মুখে প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য ভূমি-ভিত্তিক Agni সিরিজ, সমুদ্র-ভিত্তিক Arihant শ্রেণির সাবমেরিন, এবং বিমান-ভিত্তিক একাধিক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য Shaheen ও Ghaznavi সিরিজের ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। তবে পাকিস্তান এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যেই পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ২০০-২৫০ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। উপরের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয় যে সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে রয়েছে। তবে পাকিস্তান পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পারমানবিক অস্ত্রের ব্যবহারের নীতিমালার দিক থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। কে এগিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বারবার গণতন্ত্রের ব্যাঘাত ঘটেছে। দেশটি বেশিরভাগ সময়ই সামরিক বাহিনীর শাসনে পরিচালিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশের রাজনীতি, প্রশাসন এমনকি অর্থনীতির একটি বড় অংশও নিয়ন্ত্রণ করে। সেনাবাহিনীর রয়েছে নিজস্ব ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, ব্যাংক, আবাসন প্রকল্প, এমনকি খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণনেও তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে যুদ্ধ বা সংঘাতের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা একটি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরী। অন্যদিকে, ভারত অন্তত কাগজে কলমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই যুদ্ধের নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে, এবং সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণে বিভিন্ন স্তরের পর্যালোচনা দরকার হয়। ভারতের একটি জটিল চ্যালেঞ্জ হল তাদের সামরিক শক্তির বড় একটি অংশ চীন সীমান্তে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশ এলাকায় ভারত চীনের দিক থেকে বরাবরেই চাপের মধ্যে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশাল স্থল সীমান্ত, সেটিও কৌশলগতভাবে অনেকটাই সংবেদনশীল। গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে, কারণ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশকে “মিত্র” রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করলেও, এখন ভারত নীতিগতভাবে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার সেভেন সিস্টার্স সম্পর্কিত বক্তব্যের পর থেকে। অন্যদিকে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের আরো এটি বড় সুবিধা রয়েছে। আর তা হল পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন। ভারত-চীন সম্পর্ক বরাবরই টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীন ও পাকিস্তানের দ্বৈত চাপ ভারতের কৌশলগত অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে। এছাড়াও, পাকিস্তান তুলনামূলক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও, তারা দীর্ঘদিন ধরে সামরিক খাতে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করে চলেছে শুধুমাত্র ভারতকে মোকোবেলা করার জন্য। তাই পাকিস্তান না খেয়ে হলেও ভারতকে দমন করার বিষয়ে কোন ছাড় দিতে চাইবে না। প্রথাগতগত যুদ্ধে যদি পাকিস্তানের অবস্থান ভেঙেও পড়ে, সেক্ষেত্রে পাকিস্তান ভারতের আগে পারমানবিক হামলা চালাতে পারে। সব মিলিয়ে, ভারত সামরিক সংখ্যার বিচারে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকলেও, একসাথে সব শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কারণ চীন, বাংলাদেশ, এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা – এই তিনটি ফ্রন্টে ভারতকে সমানভাবে নজর রাখতে হয়। তাই পাকিস্তানকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করা ভারতের জন্য কখনোই খুব সহজ কাজ নয়।

মানবিক করিডোর আসলে কী

ভূমিকা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গৃহযুদ্ধের কারণে যে মানবিক সংকট তৈরী হয়েছে, তা মোকাবিলা করার জন্য একটি মানবিক করিডোরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মানবিক করিডোরের ব্যাপারে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। তখন বিষয়টি নিয়ে বিএনপি, জামাত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল সমালোচনা শুরু করলে; পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন যে, জাতিসংঘের সাথে এ বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সরকারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে মানবিক করিডোরের বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরী হয়েছে। করিডোর কী? করিডোর হলো একটি নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিরাপদে ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণত আন্তর্জাতিক বা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়। মোটাদাগে করিডোর কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ১. বাণিজ্যিক করিডোর ২. মানবিক করিডোর এবং ৩. সামরিক করিডোর। দুটি অঞ্চলের মধ্যে অবাধে পণ্য ও বাণিজ্য সরবরাহের জন্য বাণিজ্যিক করিডোর নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)। কোন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় খাদ্য, ওষুধ বা ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর তৈরী করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া এবং ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধে মানবিক করিডোর স্থাপনের নজির আছে। অন্যদিকে সামরিক করিডোর হলো এমন নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা সামরিক বাহিনী, অস্ত্র, সরঞ্জাম বা সৈন্য পরিবহনের জন্য নিরাপদে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সৌদি আরব থেকে ইরাক ও কুয়েত সীমান্তের সড়কপথ যুক্তরাষ্ট্র সামরিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানবিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক করিডোর ছাড়াও অন্যান্য ধরনের করিডোর রয়েছে। যেমন: বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য পরিবেশগত করিডোর, রেল ও সড়ক যোগাযোগের জন্য পরিবহন করিডোর, তেল গ্যাস বা িবদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জ্বালানী বা শক্তি করিডোর, ফাইবার অপটিক কেবল, সাইবার নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল/তথ্য করিডোর এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ ও পর্যটন উন্নয়নের জন্য শিক্ষা/সাংস্কৃতিক করিডোর ইত্যাদি। মানবিক করিডোর কী? কোন সংঘাতপূর্ণ বা দুর্যোগ-আক্রান্ত এলাকায়, খাদ্য, ওষুধ, পানি বা চিকিৎসা সরঞ্জামের মত জরুরি ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর ব্যবহৃত হয়। এটি বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষা এবং মানবিক সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে স্থাপিত হয়। কখনো কখনো এই করিডোর বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হয়। মানবিক করিডোর সাধারণত জাতিসংঘ (UN) বা অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এবং সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে কার্যকর হয়। মানবিক করিডোরের প্রধান উদ্দেশ্য হলো: ১. ত্রাণ সরবরাহ ২. বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ৩. মানবাধিকার রক্ষা এবং ৪. নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সংকটগ্রস্ত জনগণ যেন দুর্ভিক্ষ, অনাহার বা স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি না হয় সেই লক্ষ্যে মানবিক করিডোর স্থাপন করা হয়। অবরুদ্ধ বা সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার আগে পরে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন নিশ্চিত করাও একটি উদ্দেশ্য। সেই সাথে ত্রাণ বিতরণে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়া সকল পক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যক্তির কাছে সহায়তা পৌঁছানোও গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। মানবিক করিডোরের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখেযোগ্য হল, করিডোরে সামরিক কার্যক্রম বা অস্ত্রের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা। করিডোরে ত্রাণ পরিবহন বা নাগরিকদের স্থানান্তরের সময় যেন নতুন করে কোন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরী না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা। সাধারণত জাতিসংঘ বা রেড ক্রস (ICRC) এর মত নিরপেক্ষ সংস্থাগুলো এটি পরিচালনা করে। তাই এমন কোন বিতর্কিত পক্ষ বা সংস্থাকে মানবিক করিডোরে প্রবেশাধিকার না দেওয়া, যাতে করে নতুন করে সংঘাত তৈরী হয়। কারণ এই ব্যবস্থার অন্যতম শর্তই হল যুদ্ধবিরতি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে করিডোরকে হামলামুক্ত রাখা। মানবিক করিডোর আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে পরিচালিত হয়, যা জেনেভা কনভেনশন (1949) এবং এর অতিরিক্ত প্রটোকল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইন অনুযায়ী ত্রাণ কর্মী ও কনভয়ের উপর হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কগজে কলমে মানবিক করিডোরকে বিভিন্নভাবে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও, অনেক সময় ত্রাণ সামগ্রী সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে যেতে পারে। ত্রাণ বিতরণে কিছু গোষ্ঠী বঞ্চিত হতে পারে, যা আরো বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করে। রাখাইনে মানবিক করিডোর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে ত্রাণ সামগ্রী রাখাইনের বেসামরিক জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়। বাংলাদেশ সরকার শর্তসাপেক্ষে এই করিডোর দেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। চুক্তির শর্তগুলোর বিস্তারিত জনসমক্ষে প্রকাশ না করায় রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্তের ব্যাপারে জানা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ত্রাণ সরবরাহ শুধুমাত্র জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। ত্রাণ যেন সরাসরি রাখাইনের নাজুক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় এবং আরাকান আর্মি বা মিয়ানমার জান্তার মত কোনো সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেন এটি দখল করতে না পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল করিডোর যেন রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে আরও জটিল না করে বা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি না বাড়ায়। এবং সকল জাতিগত গোষ্ঠী, বিশেষ করে রোহিঙ্গা, রাখাইন এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে ন্যায্যভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। মানবিক করিডোর বাস্তবায়নে চুক্তির শর্ত হিসেবে এসব বিষয় আলোচনা করা হলেও, বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। রাখাইনের বেশিরভাগ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, যারা একটি রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র গোষ্ঠী। ত্রাণ সামগ্রী তাদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। করিডোরের ফলে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এমনকি বিগত কয়ক মাসে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশও করেছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঝুঁকি জাতিসংঘের মাধ্যমে এই মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মূলত একটি আন্তর্জাতিক কৌশলের অংশ, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই করিডোর ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র চায় আরাকান আর্মিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করতে। কারণ, চীন ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে, রাখাইনকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভূক্ত করেছে। যার ফলে চীন এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে বঙ্গোপসারগ সহ ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে এখানে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাখাইনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে চীনের প্রভাবকে ভারসাম্যহীন করার চেষ্টা করতে পারে। জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাখাইনের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেও সহায়তা পাঠাতে পারে। কিন্তু তারা করিডোর ব্যবহারের পন্থা বেছে নিয়েছে, কারণ মানবিক করিডোর একটি ছদ্মবেশী কৌশল হতে পারে। যাতে ভবিষ্যতে এখানে পরিস্থিতি আরো জটিল হলে; আন্তর্জাতিক মঞ্চে কেউ জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে না পারে। উল্টো বাংলাদেশ, ভারত, চীন বা অন্য কোন পক্ষের উপর দায় চাপানো যায়। জাতিসংঘের নিরপেক্ষতার আড়ালে এই ধরনের আন্তর্জাতিক চালবাজি, বিশ্বের যে কোন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলেই একটি সাধারণ ঘটনা। এভাবেই বিশ্ব রাজনীতির খেলায় ‘মানবিক সাহায্য’ নামের আড়ালে গভীর কৌশল লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের জন্য মানবিক করিডোর একটি জটিল দ্বিধার জায়গা। একদিকে, করিডোরে সম্মতি দিলে হয়ত দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। আবার অন্যদিকে করিডোরে অসম্মতি জানালেও আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে দায়ী করে রোহিঙ্গা সংকটকে আরও ঘোলাটে করতে পারে। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি বোঝা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য

পোপকে কোথায় এবং কিভাবে সমাহিত করা হয়েছে

ভূমিকা রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। পোপদেরকে সাধারণত ভ্যাটিকান সিটিতে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নিচে সমাহিত করা হয়। তবে পোপ ফ্রান্সিসকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ভ্যাটিকানের বাইরে অবস্থিত রোমের ব্যাসিলিকা ডি সান্তা মারিয়া ম্যাজিওরে সমাহিত করা হয়েছে। বিগত ১২০ বছরের মধ্যে প্রথমবার কোনো পোপ কে ভ্যাটিকানের বাইরে সমাহিত করা হল। মৃত্যুর পর প্রস্তুতি পোপের মৃত্যুর পর তাঁর দেহকে সম্মানের সঙ্গে ধৌত করা হয় এবং পন্টিফিকাল ভেস্টমেন্ট নামের বিশেষ ধর্মীয় পোশাক পরানো হয়। এরপর তার দেহটি কয়েকদিন সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় রাখা হয় যাতে বিশ্বাসী ও ভক্তরা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। সমাধিস্থ করার আগে পোপের দেহ একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়, যা পরে সীসা ও আরেকটি কাঠের কফিনে সিল করা হয়। কফিনে পোপের নাম, তার রাজত্বের সময়কাল এবং অন্যান্য তথ্য খোদাই করা থাকে। এরপর কফিনটি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ক্রিপ্টে বা পোপের নির্দেশিত স্থানে সমাহিত করা হয়। সমাধির আগে ফিউনারেল মিসা নামে একটি বিশেষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কার্ডিনালরা ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থাকেন। পোপ ফ্রান্সিস ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর দেহকে সান্তা মার্তার চ্যাপেলে একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়। তিনি পোপদের জন্য ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী তিনটি কফিনের পরিবর্তে একটি সাধারণ কফিনে তার দেহ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কফিনে তাঁর শাসনকালের কয়েন, মেডেল এবং তাঁর ১২ বছরের পোপত্বের মূল বিষয়গুলোর একটি দলিল রাখা হয়। ২৩ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর দেহ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ২৬ এপ্রিল সকাল ১০টায় সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে কার্ডিনাল জিওভান্নি বাত্তিস্তার নেতৃত্বে  পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মিসা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২২০ জন কার্ডিনাল, ৭৫০ জন বিশপ এবং ৪,০০০-এর বেশি পুরোহিত অংশ নেন। এই মিসায় সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নেন। বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনুসও পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস কে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে পূর্বে মোমবাতি রাখার একটি কক্ষ ছিল। পোপ নিজেই এই জায়গাটি তার সমাধির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। পোপদের সাধারণত ভ্যাটিকানে সমাহিত করা হলেও, পোপ ফ্রান্সিস নিজেই সান্তা মারিয়া ম্যাজিওর বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ২০২২ সালে বলেছিলেন, ভার্জিন মেরি তাঁকে এখানে সমাধিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসের এই ব্যাসিলিকার প্রতি গভীর ভক্তি ছিল, বিশেষ করে এখানে অবস্থিত মেরি সালুস পপুলি রোমানি আইকনের প্রতি। তিনি তাঁর ৪৭টি আন্তর্জাতিক সফরের আগে ও পরে এবং হাসপাতালে ভর্তির পর এখানে প্রার্থনা করতেন। অতীতে তিনি কার্ডিনাল হিসেবেও রোম ভ্রমণ করলে এই গির্জায় বেড়াতে আসতেন। পোপ ফ্রান্সিসের সাদামাটা জীবন পোপ ফ্রান্সিস এর আসল নাম জর্জ মারিও বের্গোগ্লিও। তিনি ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত রোমান ক্যাথলিক চার্চের একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় সোসাইটি অফ জিসাস বা জেসুইটের সদস্য ছিলেন। জেসুইটরা অত্যন্ত সরল ও বিনয়ী জীবন যাপন করে। পোপ ফ্রান্সিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। পোপদের থাকার জন্য একটি রাজকীয় প্রাসাদ রয়েছে। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস পোপ নির্বাচিত হবার পর ভ্যাটিকানের অ্যাপোস্টলিক প্যালেসের পরিবর্তে, সান্তা মার্তা নামের একটি গেস্টহাউসে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এটি একটি সাধারণ বাসস্থান, যার মধ্যে ছিল একটি শোবার ঘর, বাথরুম এবং অধ্যয়ন কক্ষ। পোপ ফ্রান্সিস ঐতিহ্যবাহী পোপের পোশাকের তুলনায় সাধারণ পোশাক পছন্দ করেতেন। তিনি বিলাসবহুল পোপের জুতোর পরিবর্তে সাধারণ কালো চামড়ার জুতো পরতেন। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যেমন ঘড়ি বা ব্যাগ, সবই সাধারণ এবং কোনটিই ব্যয়বহুল নয়। পোপ ফ্রান্সিস বিলাসবহুল গাড়ির পরিবর্তে সাধারণ গাড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার মনে হয় একজন পুরোহিতের বিলাসবহুল গাড়ি থাকা উচিত নয়। পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানেও গরিব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য খাবার, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলতেন, “একটি গির্জা যদি গরিবদের পাশে না থাকে, তবে তা গির্জা নয়।”পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বাস করতেন যে নেতাদের উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই তিনি িনজে বিলাসিতা পরিহার করে, গির্জার পুরোহিত ও বিশপদের বিলাসিতা ত্যাগ করে সাধারণ জীবনযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে অতীতে অধিকাংশ পোপ কিন্তু পোপ ফ্রান্সিসের মত এতটা বিনয়ী এবং সাদামাটা জীবন যাপন করতেন না। মধ্যযুগের পোপেরা ছিলেন ইউরোপের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তারা একেকজন ক্ষমতালোভী রাজা বা সম্রাটদের চেয়েও অনেক বেশি দুর্ণীতিগ্রস্ত ছিলেন।

Shopping Cart
Scroll to Top