সূচনা
শেখ হাসিনার পতনের পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে, দেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্ম নিয়েছিল। সাধারণ মানুষ ভেবেছিল, ড. ইউনূস তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশকে একটি নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সেই সাথে সুশীল সমাজের বহু সফল ও পরিচিত মুখ উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পাওয়ায়, বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও, দেশের মানুষ আবারো ঠিক আগের মতই হতাশ হয়ে পড়েছে। কারণ সত্যিকার অর্থে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা সহ কোন দিক থেকেই জনগণের ভোগান্তি কমেনি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়েও বেড়েছে।
সরকারের ভেতর ও বাইরে থেকে নানা মূখী চ্যালেঞ্জের কারণে, ড. ইউনূসের সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। ফলে জনগণের আস্থা দ্রুত কমতে শুরু করেছে এবং এই সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেন ব্যার্থ হচ্ছে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, মব জাস্টিস এবং সম্পত্তি ধ্বংসের ঘটনা ঘটে, যা অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়।
সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশ ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়। বিনা নোটিশে ভারত ত্রিপুরার বাঁধ খুলে দেওয়ায় পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলা প্লাবিত হয়, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি ও কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। সেসময় দেশের জনগণ সদ্য গঠিত হওয়া সরকারের ভরশায় না থেকে, নিজেরাই যে যার সাধ্যমত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেকারণেই সরকার তার চ্যালেঞ্জের প্রথম পরীক্ষায় অনেকটাই পার পেয়ে যায়।
নবগঠিত সরকারের দ্বায়িত্ব বুঝে উঠতে আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন; এমন ধারণা থেকেই রাজধানীর বাসিন্দারা ডাকাত আতঙ্কে নিজেরা রাত জেগে পাড়া মহল্লায় পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছে। তখনও হাসিনার খুনি পুলিশ বাহিনীর অধিকাংশই গা ঢাকা দিয়েছিল। তাই দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না।
কিন্তু সরকার তার ক্ষমতার মেয়াদ ছয় মাস পূর্ণ করলেও, এখনও পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বভাবিক হয়নি। এটি নিঃসন্দেহে এই সরকারের মারাত্নক ব্যার্থতা। মাঝখানে পুলিশ প্রশাসন সংস্কারের নামে র্যাব ও পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে, নেটিজেনদের কিছুটা হাসির খোড়াক যোগানো ছাড়া অন্তবর্তী সরকারের উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
সবশেষে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের যৌথ অভিযান শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সাফল্য আসলেও, এই কার্যক্রমও একেবারে বিতর্ক মুক্ত নয়।
অর্থনৈতিক সংকট
পূর্ববর্তী হাসিনা সরকারের লুটপাটের কারণে দেশে মারাত্নক অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত সৃষ্টি হয়েছিল। সেকারণে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকগুলোতে অর্থের ব্যাপক সংকট ছিল। সেই সাথে দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা অন্তবর্তী সরকারের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেছে।
ড. ইউনুস সরকার গঠনের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও, বাজারে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে কষ্ট শুধু বাড়িয়েই চলেছে। সরকার আমদানি করা খাদ্যপণ্যের উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার এবং টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি ব্যবস্থা করলেও, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। মাঝখানে ডিমের দাম নিয়ে ব্যাপক নৈরাজ্য, বাজার থেকে ভোজ্য তেল উধাও হয়ে যাওয়া, আবার বেশি দামে বাজারে ফিরে আসা, আলু-পেঁয়াজ অামদানি নিয়ে জটিলতা সহ নানা বিষয়ে সরকারের ব্যার্থতা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রশাসনিক সংস্কারে ধীরগতি
সরকারের বিভিন্ন স্তরে প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি সরকারের প্রতি জনগণের আস্থায় আঘাত করেছে।
এই সরকারের অন্যতম কাজ ছিল দেশের পুরনো ধ্বসে পড়া কাঠামো সংস্কার করা। সে লক্ষ্যে জনপ্রশাসন, পুলিশ, আদালত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সংবিধান সংস্কারের জন্য সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করলেও, এই সংস্কার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ফলে জনগণের প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসছে না।
ইতোমধ্যে সংস্কার কমিশনগুলো সরকারের হাতে তাদের অনুসন্ধান ও সুপারিশ পত্র তুলে দিলেও, এই সরকার সেসব সংস্কার আদৌ করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ তারা দেশ পরিচালনার কাজেই রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে।
তারচেয়েও বড় কথা হল, যাদের প্রানের বিনিময়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে, ২৪ এর সেই সব শহীদ পরিবারের প্রতি এখনও ন্যায় বিচার করা হয়নি। জুলাই বিপ্লবে আহতদের চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সরকার চূড়ান্ত রকমের ব্যার্থ হয়েছে। এবং এই সরকার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে কোন কাজে আসবে না বুঝতে পেরেই; আহতরা পর্যন্ত আবারো আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে। শুধু তাই নয়, জুলাই বিপ্লবের খুনিদের বিচার তো দূরের কথা; তাদের নামে ঠিকমত মামলা পর্যন্ত দিতে পারেনি এই সরকার। যেসব দুর্বল মামলা হয়েছে, সরকার পরিবর্তনের পর তাদের প্রায় শতভাগই খালাস পেয়ে যাবে। তাছাড়া আয়নাঘর প্রকাশ্যে আনা বা পিলখানা হত্যাকান্ডের মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়েও সরকারের যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে।
বলতে গেলে বিল্পব করেও কাঙ্খিত পরিবর্তন না পেয়ে হতাশ হয়েও, অনেকে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙতে গিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত
পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনীতিবিদ ও আমলারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার মহাপরিকল্পনা করছে। এর কারণেই অনেকটা সরকারের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সমস্যা হচ্ছে।
পূর্ববর্তী সরকারের প্রভাবশালী আমলারা সরকারের কার্যক্রম ব্যাহত করতে নানাভাবে অপপ্রচার, রাজনৈতিক উসকানি ও প্রশাসনিক বাধা সৃষ্টি করেছে বলে বিশ্লেষকদের মত। সরকার গঠনের পরপরই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের ভেতরে থেকে অসহযোগিতা একেবারেই স্পষ্ট ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের নেওয়া নীতিমালা বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করা হয়, যাতে জনসাধারণের মধ্যে সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বলছে, এই পুলিশ বাহিনীতে ৯০ শতাংশই আওয়ামী লীগ করে।
সেই সাথে রাজনৈতিক অঙ্গনে, ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার চালানো হয়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বিশেষ করে, অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য এককভাবে বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়।
এছাড়া, সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং বেশ কিছু অরাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রকাশ্যে ও গোপনে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন শহরে আকস্মিক বিক্ষোভ, রাস্তা অবরোধ এবং সরকারি ভবনে হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এগুলো ছিল সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চক্রান্ত, যাতে জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয় এবং সরকারের জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেওয়া যায়।
এসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ফলে ইউনূস সরকার নীতিগতভাবে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তার বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এ কারণেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারেনি।
জনগণের অতিরিক্ত প্রত্যাশা
অন্তবর্তী সরকারের ব্যার্থতা আমাদের চোখে এত প্রকটভাবে ধরা পড়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হল, ড. ইউনুসের সরকারের প্রতি জনগণের অতিরিক্ত প্রত্যাশা ছিল। দেশের জনগণ নতুন সরকারের কাছ থেকে দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নয়ন আশা করেছিল। তবে স্বল্প সময়ে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব না হওয়ায় জনগণের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সেই অধিক প্রত্যাশা থেকেও প্রতিদিন নতুন নতুন আন্দোলন হচ্ছে। এই সরকারের আমলে কোন কোন পেশাজীবীরা আন্দোলন করেছে, তার চেয়ে বয়ং কারা আন্দোলন করেনি, সেই তালিকা তৈরী করা সহজ হবে।
এই অল্প সময়ে হয়ত সকল সমস্যা সামাধান করাও যাবে না। তবে সরকারের অন্তত উচিত ছিল, কিছু মৌলিক বিষয়ে আরো তৎপর হওয়া। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে নি। এভাবে চলতে থাকলে ইউনুস সরকারের ব্যার্থতার বোঝা বাড়তেই থাকবে।
এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করে, নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই ভালো উপায়। তবে বিএনপি সহ অন্যান্য ছোট দল গুলোও যেভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে সামনে কী অপেক্ষা করছে তাও বলা মুশকিল। কারণ বিএনপির অতীত রেকর্ডও দেশের মানুষের জন্য খুব বেশি সুখকর নয়।
তবে দেশের অবস্থা এখনও খুব বেশি স্থিতিশীল না হলেও, অন্তত আওয়ামী লীগের মত হায়েনাদের কবল থেকে দেশ মুক্ত হয়েছে, এটিই বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনেক বড় স্বস্তির বিষয়। এবং ২৪ এর গণ অভ্যুত্থান বাংলাদেশের মানুষকে যেভাবে জাগ্রত হতে শিখিয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে শেখ হাসিনার মত কোন স্বৈরশাসক এককভাবে সকল ক্ষমতা কুক্ষীগত করতে পারবে না বলেই অাশা করা যায়।