ছেলেবেলায় আমরা সবাই কখনও না কখনও উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখেছি। অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যাপক উদ্ভাবনী ক্ষমতার কারণে মানুষ শুধু আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্নই পূরণ করেনি। বরং পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে বিচরণ করার মত প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাও অর্জন করেছে।
এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র মহাকাশচারী বা অ্যাস্ট্রোনাটদেরই মহাকাশে বিচরণ করার সুযোগ রয়েছে। সেকারণে বিশ্বজুড়েই এই পেশাটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। একই সাথে এটি অত্যন্ত কঠিন পেশাও বটে। সেকারণে খুব কম লোকই মহাকাশচারী হওয়ার সুযোগ পায়।
অ্যাস্ট্রোনাট বা মহাকাশচারী হতে কী কী যোগ্যতা লাগে এবং এই পেশাটা আসলে কতটা চ্যালেঞ্জিং সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।
শারিরীক ও মানসিক সক্ষমতা
মহাকাশচারী হওয়ার জন্য শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। শারীরিকভাবে সক্ষম থাকার জন্য প্রতিদিন শরীরচর্চা করতে হয়। এই শরীরচর্চা শুধু পৃথিবীতে থাকাকালীন সময়ের জন্যই নয়, বরং মহাকাশে গিয়ে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে দুই ঘন্টা ব্যায়াম করতে হয়। কারণ মহাকাশের মাইক্রোগ্রাভিটি বা অতি স্বল্প অভিকর্ষ বলের কারণে নভোচারীদের শরীরের হাড়গোড় পর্যন্ত একটি আরেকটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তাই নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করা এবং শারিরীকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া মহাকাশচারী হওয়ার অন্যতম পূর্ব শর্ত।
শারীরিক সক্ষমতার পর পরই আসে মানসিক সক্ষমতার পালা। সাধারণভাবে শুধু মানসিকভাবে শক্তিশালী হলেই হবে না, যে কোন জটিল এবং আপদকালীন পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ সামলানোর কৌশলও রপ্ত করতে হয়। স্থির মস্তিষ্ক এবং স্থিতিশীল চিন্তাশক্তি অর্জন করা একজন নভোচারীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ কোন মহাকাশ অভিযানে একজন মহাকাশচারীকে দীর্ঘদিন একা একা থাকতে হতে পারে। সেই সাথে মহাকাশ যানে কোন ধরনের ত্রুটি বা দুর্ঘটনা ঘটলে তা মোকাবেলা করার মত সাহস ও শক্তি থাকা নভোচারীর নিজের সুরক্ষার জন্যই অপরিহার্য।
শিক্ষাগত যোগ্যতা
মহাকাশচারী হতে হলে, শিক্ষাজীবনে যে ভালো ফলাফল অর্জন করতে হবে, তা সবারই জানা। তবে সকল ক্ষেত্রের উচ্চশিক্ষিতরাই এই পেশায় আসতে পারবেন না।
অ্যাস্ট্রোনাট হওয়ার জন্য মূলত STEM বিষয়গুলো উপর পড়ালেখা করতে হয়। STEM বলতে মূলত Science, Technology, Engineering, and Mathematics এর মত বিষয়গুলোকে বোঝানো হয়।
একজন মহাকাশচারীকে অবশ্যই পদার্থবিদ্যা, গণিত, জীববিদ্যা, রসায়ন এবং প্রকৌশল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। নির্দিষ্ট ডিগ্রি অর্জনের পর NASA বা ESA এর মত মহাকাশ সংস্থায় অ্যাপ্লাই করার সুযোগ পাওয়া যায়। STEM সােবজেক্টগুলেকে বাধ্যতামূলক করার কারণ হল, এসব বিষয়ে পড়ালেখা করলে সাধারণত মানুষের সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা বাড়ে।
তাছাড়া মহাকাশে নভোচারীদের পাঠানোই হয় এমনসব বিষয়ে গবেষণা করার জন্য, যেসব বিষয় নিয়ে পৃথিবীতে গবেষণা করা সম্ভব নয়। আর কেউ যদি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা গণিতে দক্ষ না হয়, তাহলে তার জন্য অভিনব সব মহাকাশ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা একেবারেই সম্ভব নয়।
প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন
শুধুমাত্র শারীরিক ফিটনেস, মানসিক দৃঢ়তা, এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেই অ্যাস্ট্রোনাট হওয়া যায় না। এর জন্য একজন ব্যক্তিকে প্রাসঙ্গিক কোনো একটি পেশায় উচ্চ দক্ষতা এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। NASA-র অ্যাস্ট্রোনাটরা যেসব পেশা থেকে আসে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ১. পাইলট বা এয়ারক্রাফট কমান্ডার ২. ইঞ্জিনিয়ার ৩. চিকিৎসক ৪. গবেষবক বা বিজ্ঞানী অথবা ৫. সেনাসদস্য।
মহাকাশচারী হওয়ার ক্ষেত্রে পাইলটদের অনেকক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কারণ তাদের কয়েক হাজার ঘণ্টার জেট ফ্লাইট পরিচালনার অভিজ্ঞতা মহাকাশযানের জটিল পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করে। চাঁদের বুেক প্রথম অবতরণ করা অ্যাস্ট্রোনাট নীল আর্মস্ট্রং ছিলেন একজন পাইলট।
ইঞ্জিনিয়াররা মহাকাশযানের নকশা এবং প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। চিকিৎসকরা মহাকাশে দীর্ঘসময় থাকার প্রভাব বুঝতে এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা পরিচালনা করতে ভূমিকা রাখেন। শুধু তাই নয়, প্রতিটি মহাকাশচারীর জন্য চিকিৎসার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। কারণ পৃথিবীর বাইরে কোন মিশনে গিয়ে অসুস্থ হলে নিজের অথবা দলের অন্যদের চিকিৎসা করার প্রয়োজন হতে পারে।
এছাড়াও, বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা অ্যাস্ট্রোনাট হওয়ার মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। প্রথম আমেরিকান নারী হিসেবে মহাকাশে স্পেসওয়াক করা নাসার ক্যাথরিন সুলিভান ছিলেন একজন ভূতত্ত্ববিদ ও সমুদ্রবিজ্ঞানী। এছাড়া সেনাসদস্যরাও তাদের শৃঙ্খলা, নেতৃত্বের গুণাবলী এবং চাপ সামলানোর দক্ষতার কারণে মহাকাশ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
এই পেশাগুলো ছাড়াও যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার একটিতে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অ্যাস্ট্রোনাট হওয়ার পথে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন।
প্রশিক্ষণ
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিতে মহাকাশচারী হিসেবে বাছাই করে। তবে এই বাছাই প্রক্রিয়াটা এতটাই কঠিন যে, ২০১৭ সালে ১৮ হাজার আবেদনকারীর ভেতর থেকে মাত্র ২২ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল।
মহাকাশে যাওয়া শারীরিকভাবে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তাই মহাকাশচারীদের কঠোর শারীরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেক নভোচারীর মতে মহাকাশে গিয়ে যে ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তার চেয়ে মহাকাশ মিশনের ট্রেনিংগুলো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।
নাসার একজন অ্যাস্ট্রোনাটকে দুই বছর প্রশিক্ষন নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণকালে প্রায় ২৩০টিরও বেশি বিষয় শিখতে হয়। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল, মহাকাশের সাধারণ প্রশিক্ষণ, স্পেস ওয়াক বা মহাকাশে হাঁটা, স্কুবা ডাইভিং কিংবা রাশিয়ান ভাষা শিক্ষার মত বিচিত্র সব কোর্স।
মহাকাশ যেহেতু এক ওজনহীন জগৎ, তাই মহাকাশচারীদের পৃথিবীতেই ওজনহীনতার অভিজ্ঞতা দেওয়া হয়। নাসার একটি বিশেষ এয়ারক্রাফটে করে নভোচারীদের ভ্রমণ করানোর মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই বিষয়টি মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর এক অনুভূতি। এই বিমানে ওঠার পর ওজনহীনতার জন্য অনেকেই বমি করেন। সেকারণে এই বিমানটির নামই রাখা হয়েছে Vomit Comet; বাংলা করলে যার অর্থ দাড়ায় বমির ধুমকেতু। একজন নভোচারীকে প্রতিবার ২০ সেকন্ড করে, দিনে প্রায় ৪০ বার এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
স্পেস স্যুট
বেশ কিছু পেশার সম্মান তাদের ইউনিফর্মের সাথে জড়িত। যেমন, সামরিক বাহিনীর সদস্য কিংবা পুলিশ তাদেরকে পোশাককে অনেক সম্মান করে। মহাকাশচারীদের ক্ষেত্রেও তাদের সম্মানিত ইউনিফর্ম হল স্পেস স্যুট।
একে শুধুই পোশাক ভাবলে ভূল হবে; এটিও এক ধরনের জটিল যন্ত্র। স্পেস স্যুট কে ব্যক্তিগত মহাকাশযান বললেও ভুল হবে না। এটি পরিধান করা এবং এর মধ্যে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। এই স্যুট মহাকাশচারীদের মহাশূন্যে সুরক্ষা প্রদান করে। এর ভেতরে অক্সিজেন সরবরাহ, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষুদ্র ধূলিকণা প্রতিরোধের মত প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থাও রয়েছে।
একজন নভোচারীকে সবসময়ে স্পেস স্যুট পরে থাকতে হয় না, তবে একটি মহাকাশ অভিযানের বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে অ্যাস্ট্রোনাটদের অবশ্যই স্পেস স্যুট পরে বেশ কিছু জটিল কাজ সম্পাদন করতে হয়। তাই স্পেস স্যুটের সাথে মানিয়ে নেওয়াটাও প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পৃথিবীতে মানুষ শুধুমাত্র পানির নিচেই কম পরিশ্রমে যেদিকে খুশি সেদিকে নড়াচড়া করতে পারে। সেকারণে নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে পানির নিচে মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষনের জন্য এক বিশাল ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে স্পেসওয়াক সহ মহাকাশ মিশন পরিচালনার মত নানা প্রশিক্ষণ েদওয়া হয়।
প্রত্যেক নভোচারীর জন্য ফ্লাইট প্রশিক্ষন বাধ্যতামূলক। তাদেরকে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন T-38 জেট বিমানে চড়ে মুক্ত আকাশে বিচরণ করতে হয়। যেন মহাকাশযান উৎক্ষেপনের সময়কার তীব্র চাপ সহ্য করতে তারা অভ্যস্ত হতে পারে। এসবের বাইরেও একজন মহাকাশচারীকে প্যারাসুটিং, জঙ্গলে বেঁচে থাকা, বরফাচ্ছাদিত এলাকায় তীব্র শীতে টিকে থাকা, ডুবন্ত স্পেসশিপ থেকে বেঁচে ফিরে আসার মত নানান সব চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।