নভোচারী হতে কি লাগে

ছেলেবেলায় আমরা সবাই কখনও না কখনও উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখেছি। অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যাপক উদ্ভাবনী ক্ষমতার কারণে মানুষ শুধু আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্নই পূরণ করেনি। বরং পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে বিচরণ করার মত প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাও অর্জন করেছে।

এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র মহাকাশচারী বা অ্যাস্ট্রোনাটদেরই মহাকাশে বিচরণ করার সুযোগ রয়েছে। সেকারণে বিশ্বজুড়েই এই পেশাটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। একই সাথে এটি অত্যন্ত কঠিন পেশাও বটে। সেকারণে খুব কম লোকই মহাকাশচারী হওয়ার সুযোগ পায়।

অ্যাস্ট্রোনাট বা মহাকাশচারী হতে কী কী যোগ্যতা লাগে এবং এই পেশাটা আসলে কতটা চ্যালেঞ্জিং সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।

শারিরীক ও মানসিক সক্ষমতা

মহাকাশচারী হওয়ার জন্য শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। শারীরিকভাবে সক্ষম থাকার জন্য প্রতিদিন শরীরচর্চা করতে হয়। এই শরীরচর্চা শুধু পৃথিবীতে থাকাকালীন সময়ের জন্যই নয়, বরং মহাকাশে গিয়ে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে দুই ঘন্টা ব্যায়াম করতে হয়। কারণ মহাকাশের মাইক্রোগ্রাভিটি বা অতি স্বল্প অভিকর্ষ বলের কারণে নভোচারীদের শরীরের হাড়গোড় পর্যন্ত একটি আরেকটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। তাই নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করা এবং শারিরীকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া মহাকাশচারী হওয়ার অন্যতম পূর্ব শর্ত। 

শারীরিক সক্ষমতার পর পরই আসে মানসিক সক্ষমতার পালা। সাধারণভাবে শুধু মানসিকভাবে শক্তিশালী হলেই হবে না, যে কোন জটিল এবং আপদকালীন পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ সামলানোর কৌশলও রপ্ত করতে হয়। স্থির মস্তিষ্ক এবং স্থিতিশীল চিন্তাশক্তি অর্জন করা একজন নভোচারীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ কোন মহাকাশ অভিযানে একজন মহাকাশচারীকে দীর্ঘদিন একা একা থাকতে হতে পারে। সেই সাথে মহাকাশ যানে কোন ধরনের ত্রুটি বা দুর্ঘটনা ঘটলে তা মোকাবেলা করার মত সাহস ও শক্তি থাকা নভোচারীর নিজের সুরক্ষার জন্যই অপরিহার্য।

শিক্ষাগত যোগ্যতা

মহাকাশচারী হতে হলে, শিক্ষাজীবনে যে ভালো ফলাফল অর্জন করতে হবে, তা সবারই জানা। তবে সকল ক্ষেত্রের উচ্চশিক্ষিতরাই এই পেশায় আসতে পারবেন না।

অ্যাস্ট্রোনাট হওয়ার জন্য মূলত STEM বিষয়গুলো উপর পড়ালেখা করতে হয়। STEM বলতে মূলত Science, Technology, Engineering, and Mathematics এর মত বিষয়গুলোকে বোঝানো হয়। 

একজন মহাকাশচারীকে অবশ্যই পদার্থবিদ্যা, গণিত, জীববিদ্যা, রসায়ন এবং প্রকৌশল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। নির্দিষ্ট ডিগ্রি অর্জনের পর NASA বা ESA এর মত মহাকাশ সংস্থায় অ্যাপ্লাই করার সুযোগ পাওয়া যায়। STEM সােবজেক্টগুলেকে বাধ্যতামূলক করার কারণ হল, এসব বিষয়ে পড়ালেখা করলে সাধারণত মানুষের সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা বাড়ে।

তাছাড়া মহাকাশে নভোচারীদের পাঠানোই হয় এমনসব বিষয়ে গবেষণা করার জন্য, যেসব বিষয় নিয়ে পৃথিবীতে গবেষণা করা সম্ভব নয়। আর কেউ যদি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা গণিতে দক্ষ না হয়, তাহলে তার জন্য অভিনব সব মহাকাশ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা একেবারেই সম্ভব নয়।

প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন

শুধুমাত্র শারীরিক ফিটনেস, মানসিক দৃঢ়তা, এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেই অ্যাস্ট্রোনাট হওয়া যায় না। এর জন্য একজন ব্যক্তিকে প্রাসঙ্গিক কোনো একটি পেশায় উচ্চ দক্ষতা এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। NASA-র অ্যাস্ট্রোনাটরা যেসব পেশা থেকে আসে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ১. পাইলট বা এয়ারক্রাফট কমান্ডার ২. ইঞ্জিনিয়ার ৩. চিকিৎসক ৪. গবেষবক বা বিজ্ঞানী অথবা ৫. সেনাসদস্য।

মহাকাশচারী হওয়ার ক্ষেত্রে পাইলটদের অনেকক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কারণ তাদের কয়েক হাজার ঘণ্টার জেট ফ্লাইট পরিচালনার অভিজ্ঞতা মহাকাশযানের জটিল পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করে। চাঁদের বুেক প্রথম অবতরণ করা অ্যাস্ট্রোনাট নীল আর্মস্ট্রং ছিলেন একজন পাইলট।

ইঞ্জিনিয়াররা মহাকাশযানের নকশা এবং প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। চিকিৎসকরা মহাকাশে দীর্ঘসময় থাকার প্রভাব বুঝতে এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা পরিচালনা করতে ভূমিকা রাখেন। শুধু তাই নয়, প্রতিটি মহাকাশচারীর জন্য চিকিৎসার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। কারণ পৃথিবীর বাইরে কোন মিশনে গিয়ে অসুস্থ হলে নিজের অথবা দলের অন্যদের চিকিৎসা করার প্রয়োজন হতে পারে।

এছাড়াও, বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা অ্যাস্ট্রোনাট হওয়ার মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। প্রথম আমেরিকান নারী হিসেবে মহাকাশে স্পেসওয়াক করা নাসার ক্যাথরিন সুলিভান ছিলেন একজন ভূতত্ত্ববিদ ও সমুদ্রবিজ্ঞানী। এছাড়া সেনাসদস্যরাও তাদের শৃঙ্খলা, নেতৃত্বের গুণাবলী এবং চাপ সামলানোর দক্ষতার কারণে মহাকাশ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

এই পেশাগুলো ছাড়াও যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার একটিতে দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অ্যাস্ট্রোনাট হওয়ার পথে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। 

প্রশিক্ষণ

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিতে মহাকাশচারী হিসেবে বাছাই করে। তবে এই বাছাই প্রক্রিয়াটা এতটাই কঠিন যে, ২০১৭ সালে ১৮ হাজার আবেদনকারীর ভেতর থেকে মাত্র ২২ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল।

মহাকাশে যাওয়া শারীরিকভাবে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তাই মহাকাশচারীদের কঠোর শারীরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেক নভোচারীর মতে মহাকাশে গিয়ে যে ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তার চেয়ে মহাকাশ মিশনের ট্রেনিংগুলো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।

নাসার একজন অ্যাস্ট্রোনাটকে দুই বছর প্রশিক্ষন নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণকালে প্রায় ২৩০টিরও বেশি বিষয় শিখতে হয়। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল, মহাকাশের সাধারণ প্রশিক্ষণ, স্পেস ওয়াক বা মহাকাশে হাঁটা, স্কুবা ডাইভিং কিংবা রাশিয়ান ভাষা শিক্ষার মত বিচিত্র সব কোর্স।

মহাকাশ যেহেতু এক ওজনহীন জগৎ, তাই মহাকাশচারীদের পৃথিবীতেই ওজনহীনতার অভিজ্ঞতা দেওয়া হয়। নাসার একটি বিশেষ এয়ারক্রাফটে করে নভোচারীদের ভ্রমণ করানোর মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই বিষয়টি মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর এক অনুভূতি। এই বিমানে ওঠার পর ওজনহীনতার জন্য অনেকেই বমি করেন। সেকারণে এই বিমানটির নামই রাখা হয়েছে Vomit Comet; বাংলা করলে যার অর্থ দাড়ায় বমির ধুমকেতু। একজন নভোচারীকে প্রতিবার ২০ সেকন্ড করে, দিনে প্রায় ৪০ বার এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

স্পেস স্যুট

বেশ কিছু পেশার সম্মান তাদের ইউনিফর্মের সাথে জড়িত। যেমন, সামরিক বাহিনীর সদস্য কিংবা পুলিশ তাদেরকে পোশাককে অনেক সম্মান করে। মহাকাশচারীদের ক্ষেত্রেও তাদের সম্মানিত ইউনিফর্ম হল স্পেস স্যুট।

একে শুধুই পোশাক ভাবলে ভূল হবে; এটিও এক ধরনের জটিল যন্ত্র। স্পেস স্যুট কে ব্যক্তিগত মহাকাশযান বললেও ভুল হবে না। এটি পরিধান করা এবং এর মধ্যে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। এই স্যুট মহাকাশচারীদের মহাশূন্যে সুরক্ষা প্রদান করে। এর ভেতরে অক্সিজেন সরবরাহ, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষুদ্র ধূলিকণা প্রতিরোধের মত প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থাও রয়েছে।

একজন নভোচারীকে সবসময়ে স্পেস স্যুট পরে থাকতে হয় না, তবে একটি মহাকাশ অভিযানের বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে অ্যাস্ট্রোনাটদের অবশ্যই স্পেস স্যুট পরে বেশ কিছু জটিল কাজ সম্পাদন করতে হয়। তাই স্পেস স্যুটের সাথে মানিয়ে নেওয়াটাও প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

পৃথিবীতে মানুষ শুধুমাত্র পানির নিচেই কম পরিশ্রমে যেদিকে খুশি সেদিকে নড়াচড়া করতে পারে। সেকারণে নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে পানির নিচে মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষনের জন্য এক বিশাল ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে স্পেসওয়াক সহ মহাকাশ মিশন পরিচালনার মত নানা প্রশিক্ষণ েদওয়া হয়।

প্রত্যেক নভোচারীর জন্য ফ্লাইট প্রশিক্ষন বাধ্যতামূলক। তাদেরকে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন T-38 জেট বিমানে চড়ে মুক্ত আকাশে বিচরণ করতে হয়। যেন মহাকাশযান উৎক্ষেপনের সময়কার তীব্র চাপ সহ্য করতে তারা অভ্যস্ত হতে পারে। এসবের বাইরেও একজন মহাকাশচারীকে প্যারাসুটিং, জঙ্গলে বেঁচে থাকা, বরফাচ্ছাদিত এলাকায় তীব্র  শীতে টিকে থাকা, ডুবন্ত স্পেসশিপ থেকে বেঁচে ফিরে আসার মত নানান সব চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। 

সম্পর্কিত পোস্ট

ভারত বনাম পাকিস্তান সামরিক শক্তিতে কে এগিয়ে

ভূমিকা ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার মধ্যেই রয়েছে। কাশ্মির ইস্যু, সীমান্ত সংঘাত এবং পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা উভয় দেশের সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন যে, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে কে জিতবে? এর উত্তরটা আসলে বেশ জটিল। দুই দেশের সামরিক জনবল, অস্ত্রশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বাজেট, পারমাণবিক ক্ষমতা, এবং কৌশলগত নীতি ও অবস্থান সহ আরো বেশ কিছু বিষয়ের উপর যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে। ভারত-পাকিস্তানের তুলনা সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনকি সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সামরিক শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের পরেই ভারতের অবস্থান। ২০২৫ সালের গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃত। এই সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান ১২ তম। তারমানে সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে ৮ ধাপ এগিয়ে। তবে সেই অর্থে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি ভারতের তুলনায় একেবারেও দুর্বল নয়। ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট মাত্র ৭.৬৪ বিলিয়ন ডলার। তারমানে ভারতের প্রতিক্ষা বাজেট পাকিস্তানের প্রায় ১০ গুণ বেশি। তবে ভারত বনাম পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজর্ভের দিকে তাকালে বিষয়টি খুব বেশি অস্বাভাবিকও লাগবে না। কারণ ভারতের রিজার্ভ ৬২৭ বিলিয়ন ডলার অন্যদিকে পাকিস্তানের রিজার্ভ আছে মাত্র ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার। জনসংখ্যার দিক থেকেও ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ভারতে জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। ২০২২ সালে, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি।  । সামরিক শক্তির তুলনা আধুনিক সামরিক শক্তি মূলত প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, কৌশল এবং অস্ত্রের মানের ওপর নির্ভর করে। সেনা সদস্যের সংখ্যা একটি দেশের সামরিক সক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি সামগ্রিক সামরিক শক্তি নির্ধারণের একমাত্র সূচক নয়। ভারতের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ ৫৫ হাজার, অন্যদিকে পাকিস্তানের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ ৫৪ হাজার। ভারতের রিজার্ভ সৈন্য ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার এবং পাকিস্তানের রিজার্ভ সৈন্য ৫.৫ লক্ষ। ভারতের আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লক্ষ ২৭ হাজার এবং পাকিস্তানের আধা-সামরিক বাহিনীতে প্রায় ৫ লক্ষ সদস্য রয়েছে। ভারতের ট্যাংকের সংখ্যা ৪ হাজার ২০১টি, পাকিস্তানের ট্যাংক আছে ২ হাজার ৬২৭টি। ভারতের সাঁজোয়া যান আছে ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৯৪ টি, পাকিস্তানের সাঁজোয়া যান আছে ১৭ হাজার ৫১৬টি। ভারতের বিমান বাহিনীতে মোট বিমানের সংখ্যা ২ হাজার ২২৯ টি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মোট বিমান ১ হাজার ৩৯৯টি। ভারতের যুদ্ধ বিমান আছে ৫১৩টি; পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমান ৩২৮টি। এট্যাক হেলিকপ্টার সহ ভারতের মোট হেলিকপ্টার আছে ৮৯৯ টি, পাকিস্তানের আছে ৩৭৩টি হেলিকপ্টার। এছাড়া ভারতের পরিবহন বিমান ২৭০ টি এবং পাকিস্তানের পরিবহণ বিমান ৬৪ টি। ভারতের কাছে ফ্রান্সের তৈরী রাফাল যুদ্ধবিমানের মত আধুনিক বিমান আছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে থাকা সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান হল, চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত JF-17 Thunder যুদ্ধবিমানের সর্বশেষ সংস্করণ Block III। তবে ভারতেও নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত তেজস সিরিজের বেশ কয়েকটি মডেলের উন্নত যুদ্ধবিমান রয়েছে। লজিসস্টিকসের দিক থেকে ভারতের বিমানবন্দর আছে ৩১১টি আর পাকিস্তানের আছে ১১৬টি। ভারতীয় নৌ বাহিনীতে মোট নৌযানের সংখ্যা ২৯৩ টি। পাকিস্তান নৌ বাহিনীর মোট নৌযানের সংখ্যা ১২১টি। ভারতের ফ্রিগেট যুদ্ধ জাহাজ আছে ১৪ টি, পাকিস্তানের ৯টি। ভারতের ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধ জাহাজ আছে ১৩ টি। কিন্তু পাকিস্তানের কোন ডেস্ট্রয়ার নেই। ছোট আকারের করভেট যুদ্ধ জাহাজ ভারতের আছে ১৮টি আর পাকিস্তানের ৯টি। ভারতের সাবমেরিন আছে ১৮টি, পাকিস্তানের ৮টি। এছাড়া ভারতের টহল নৌযান আছে ১৩৫টি এবং পাকিস্তানের টহল নৌযান আছে ৬৯টি। এসবের বাইরে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই পারমানবিক অস্ত্রভান্ডার আছে। ভারতের কাছে আনুমানিক ১৭২টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে ১৭০টি। ভারত “No First Use” অর্থাৎ প্রথমে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার নীতিতে অটল। তারমানে ভারত শুধুমাত্র আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। কিন্তু পাকিস্তান “No First Use” নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়; তারা অস্তিত্বগত হুমকির মুখে প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য ভূমি-ভিত্তিক Agni সিরিজ, সমুদ্র-ভিত্তিক Arihant শ্রেণির সাবমেরিন, এবং বিমান-ভিত্তিক একাধিক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য Shaheen ও Ghaznavi সিরিজের ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। তবে পাকিস্তান এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যেই পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ২০০-২৫০ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। উপরের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয় যে সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে রয়েছে। তবে পাকিস্তান পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পারমানবিক অস্ত্রের ব্যবহারের নীতিমালার দিক থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। কে এগিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বারবার গণতন্ত্রের ব্যাঘাত ঘটেছে। দেশটি বেশিরভাগ সময়ই সামরিক বাহিনীর শাসনে পরিচালিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশের রাজনীতি, প্রশাসন এমনকি অর্থনীতির একটি বড় অংশও নিয়ন্ত্রণ করে। সেনাবাহিনীর রয়েছে নিজস্ব ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, ব্যাংক, আবাসন প্রকল্প, এমনকি খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণনেও তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে যুদ্ধ বা সংঘাতের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা একটি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরী। অন্যদিকে, ভারত অন্তত কাগজে কলমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই যুদ্ধের নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে, এবং সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণে বিভিন্ন স্তরের পর্যালোচনা দরকার হয়। ভারতের একটি জটিল চ্যালেঞ্জ হল তাদের সামরিক শক্তির বড় একটি অংশ চীন সীমান্তে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশ এলাকায় ভারত চীনের দিক থেকে বরাবরেই চাপের মধ্যে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশাল স্থল সীমান্ত, সেটিও কৌশলগতভাবে অনেকটাই সংবেদনশীল। গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে, কারণ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশকে “মিত্র” রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করলেও, এখন ভারত নীতিগতভাবে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার সেভেন সিস্টার্স সম্পর্কিত বক্তব্যের পর থেকে। অন্যদিকে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের আরো এটি বড় সুবিধা রয়েছে। আর তা হল পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন। ভারত-চীন সম্পর্ক বরাবরই টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীন ও পাকিস্তানের দ্বৈত চাপ ভারতের কৌশলগত অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে। এছাড়াও, পাকিস্তান তুলনামূলক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও, তারা দীর্ঘদিন ধরে সামরিক খাতে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করে চলেছে শুধুমাত্র ভারতকে মোকোবেলা করার জন্য। তাই পাকিস্তান না খেয়ে হলেও ভারতকে দমন করার বিষয়ে কোন ছাড় দিতে চাইবে না। প্রথাগতগত যুদ্ধে যদি পাকিস্তানের অবস্থান ভেঙেও পড়ে, সেক্ষেত্রে পাকিস্তান ভারতের আগে পারমানবিক হামলা চালাতে পারে। সব মিলিয়ে, ভারত সামরিক সংখ্যার বিচারে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকলেও, একসাথে সব শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কারণ চীন, বাংলাদেশ, এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা – এই তিনটি ফ্রন্টে ভারতকে সমানভাবে নজর রাখতে হয়। তাই পাকিস্তানকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করা ভারতের জন্য কখনোই খুব সহজ কাজ নয়।

মানবিক করিডোর আসলে কী

ভূমিকা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গৃহযুদ্ধের কারণে যে মানবিক সংকট তৈরী হয়েছে, তা মোকাবিলা করার জন্য একটি মানবিক করিডোরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মানবিক করিডোরের ব্যাপারে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। তখন বিষয়টি নিয়ে বিএনপি, জামাত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল সমালোচনা শুরু করলে; পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন যে, জাতিসংঘের সাথে এ বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সরকারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে মানবিক করিডোরের বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরী হয়েছে। করিডোর কী? করিডোর হলো একটি নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিরাপদে ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণত আন্তর্জাতিক বা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়। মোটাদাগে করিডোর কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ১. বাণিজ্যিক করিডোর ২. মানবিক করিডোর এবং ৩. সামরিক করিডোর। দুটি অঞ্চলের মধ্যে অবাধে পণ্য ও বাণিজ্য সরবরাহের জন্য বাণিজ্যিক করিডোর নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)। কোন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় খাদ্য, ওষুধ বা ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর তৈরী করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া এবং ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধে মানবিক করিডোর স্থাপনের নজির আছে। অন্যদিকে সামরিক করিডোর হলো এমন নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা সামরিক বাহিনী, অস্ত্র, সরঞ্জাম বা সৈন্য পরিবহনের জন্য নিরাপদে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সৌদি আরব থেকে ইরাক ও কুয়েত সীমান্তের সড়কপথ যুক্তরাষ্ট্র সামরিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানবিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক করিডোর ছাড়াও অন্যান্য ধরনের করিডোর রয়েছে। যেমন: বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য পরিবেশগত করিডোর, রেল ও সড়ক যোগাযোগের জন্য পরিবহন করিডোর, তেল গ্যাস বা িবদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জ্বালানী বা শক্তি করিডোর, ফাইবার অপটিক কেবল, সাইবার নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল/তথ্য করিডোর এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ ও পর্যটন উন্নয়নের জন্য শিক্ষা/সাংস্কৃতিক করিডোর ইত্যাদি। মানবিক করিডোর কী? কোন সংঘাতপূর্ণ বা দুর্যোগ-আক্রান্ত এলাকায়, খাদ্য, ওষুধ, পানি বা চিকিৎসা সরঞ্জামের মত জরুরি ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর ব্যবহৃত হয়। এটি বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষা এবং মানবিক সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে স্থাপিত হয়। কখনো কখনো এই করিডোর বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হয়। মানবিক করিডোর সাধারণত জাতিসংঘ (UN) বা অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এবং সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে কার্যকর হয়। মানবিক করিডোরের প্রধান উদ্দেশ্য হলো: ১. ত্রাণ সরবরাহ ২. বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ৩. মানবাধিকার রক্ষা এবং ৪. নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সংকটগ্রস্ত জনগণ যেন দুর্ভিক্ষ, অনাহার বা স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি না হয় সেই লক্ষ্যে মানবিক করিডোর স্থাপন করা হয়। অবরুদ্ধ বা সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার আগে পরে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন নিশ্চিত করাও একটি উদ্দেশ্য। সেই সাথে ত্রাণ বিতরণে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়া সকল পক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যক্তির কাছে সহায়তা পৌঁছানোও গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। মানবিক করিডোরের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখেযোগ্য হল, করিডোরে সামরিক কার্যক্রম বা অস্ত্রের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা। করিডোরে ত্রাণ পরিবহন বা নাগরিকদের স্থানান্তরের সময় যেন নতুন করে কোন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরী না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা। সাধারণত জাতিসংঘ বা রেড ক্রস (ICRC) এর মত নিরপেক্ষ সংস্থাগুলো এটি পরিচালনা করে। তাই এমন কোন বিতর্কিত পক্ষ বা সংস্থাকে মানবিক করিডোরে প্রবেশাধিকার না দেওয়া, যাতে করে নতুন করে সংঘাত তৈরী হয়। কারণ এই ব্যবস্থার অন্যতম শর্তই হল যুদ্ধবিরতি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে করিডোরকে হামলামুক্ত রাখা। মানবিক করিডোর আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে পরিচালিত হয়, যা জেনেভা কনভেনশন (1949) এবং এর অতিরিক্ত প্রটোকল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইন অনুযায়ী ত্রাণ কর্মী ও কনভয়ের উপর হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কগজে কলমে মানবিক করিডোরকে বিভিন্নভাবে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও, অনেক সময় ত্রাণ সামগ্রী সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে যেতে পারে। ত্রাণ বিতরণে কিছু গোষ্ঠী বঞ্চিত হতে পারে, যা আরো বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করে। রাখাইনে মানবিক করিডোর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে ত্রাণ সামগ্রী রাখাইনের বেসামরিক জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়। বাংলাদেশ সরকার শর্তসাপেক্ষে এই করিডোর দেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। চুক্তির শর্তগুলোর বিস্তারিত জনসমক্ষে প্রকাশ না করায় রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্তের ব্যাপারে জানা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ত্রাণ সরবরাহ শুধুমাত্র জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। ত্রাণ যেন সরাসরি রাখাইনের নাজুক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় এবং আরাকান আর্মি বা মিয়ানমার জান্তার মত কোনো সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেন এটি দখল করতে না পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল করিডোর যেন রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে আরও জটিল না করে বা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি না বাড়ায়। এবং সকল জাতিগত গোষ্ঠী, বিশেষ করে রোহিঙ্গা, রাখাইন এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে ন্যায্যভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। মানবিক করিডোর বাস্তবায়নে চুক্তির শর্ত হিসেবে এসব বিষয় আলোচনা করা হলেও, বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। রাখাইনের বেশিরভাগ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, যারা একটি রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র গোষ্ঠী। ত্রাণ সামগ্রী তাদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। করিডোরের ফলে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এমনকি বিগত কয়ক মাসে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশও করেছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঝুঁকি জাতিসংঘের মাধ্যমে এই মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মূলত একটি আন্তর্জাতিক কৌশলের অংশ, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই করিডোর ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র চায় আরাকান আর্মিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করতে। কারণ, চীন ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে, রাখাইনকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভূক্ত করেছে। যার ফলে চীন এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে বঙ্গোপসারগ সহ ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে এখানে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাখাইনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে চীনের প্রভাবকে ভারসাম্যহীন করার চেষ্টা করতে পারে। জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাখাইনের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেও সহায়তা পাঠাতে পারে। কিন্তু তারা করিডোর ব্যবহারের পন্থা বেছে নিয়েছে, কারণ মানবিক করিডোর একটি ছদ্মবেশী কৌশল হতে পারে। যাতে ভবিষ্যতে এখানে পরিস্থিতি আরো জটিল হলে; আন্তর্জাতিক মঞ্চে কেউ জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে না পারে। উল্টো বাংলাদেশ, ভারত, চীন বা অন্য কোন পক্ষের উপর দায় চাপানো যায়। জাতিসংঘের নিরপেক্ষতার আড়ালে এই ধরনের আন্তর্জাতিক চালবাজি, বিশ্বের যে কোন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলেই একটি সাধারণ ঘটনা। এভাবেই বিশ্ব রাজনীতির খেলায় ‘মানবিক সাহায্য’ নামের আড়ালে গভীর কৌশল লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের জন্য মানবিক করিডোর একটি জটিল দ্বিধার জায়গা। একদিকে, করিডোরে সম্মতি দিলে হয়ত দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। আবার অন্যদিকে করিডোরে অসম্মতি জানালেও আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে দায়ী করে রোহিঙ্গা সংকটকে আরও ঘোলাটে করতে পারে। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি বোঝা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য

পোপকে কোথায় এবং কিভাবে সমাহিত করা হয়েছে

ভূমিকা রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। পোপদেরকে সাধারণত ভ্যাটিকান সিটিতে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নিচে সমাহিত করা হয়। তবে পোপ ফ্রান্সিসকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ভ্যাটিকানের বাইরে অবস্থিত রোমের ব্যাসিলিকা ডি সান্তা মারিয়া ম্যাজিওরে সমাহিত করা হয়েছে। বিগত ১২০ বছরের মধ্যে প্রথমবার কোনো পোপ কে ভ্যাটিকানের বাইরে সমাহিত করা হল। মৃত্যুর পর প্রস্তুতি পোপের মৃত্যুর পর তাঁর দেহকে সম্মানের সঙ্গে ধৌত করা হয় এবং পন্টিফিকাল ভেস্টমেন্ট নামের বিশেষ ধর্মীয় পোশাক পরানো হয়। এরপর তার দেহটি কয়েকদিন সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় রাখা হয় যাতে বিশ্বাসী ও ভক্তরা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। সমাধিস্থ করার আগে পোপের দেহ একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়, যা পরে সীসা ও আরেকটি কাঠের কফিনে সিল করা হয়। কফিনে পোপের নাম, তার রাজত্বের সময়কাল এবং অন্যান্য তথ্য খোদাই করা থাকে। এরপর কফিনটি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ক্রিপ্টে বা পোপের নির্দেশিত স্থানে সমাহিত করা হয়। সমাধির আগে ফিউনারেল মিসা নামে একটি বিশেষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কার্ডিনালরা ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থাকেন। পোপ ফ্রান্সিস ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর দেহকে সান্তা মার্তার চ্যাপেলে একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়। তিনি পোপদের জন্য ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী তিনটি কফিনের পরিবর্তে একটি সাধারণ কফিনে তার দেহ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কফিনে তাঁর শাসনকালের কয়েন, মেডেল এবং তাঁর ১২ বছরের পোপত্বের মূল বিষয়গুলোর একটি দলিল রাখা হয়। ২৩ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর দেহ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ২৬ এপ্রিল সকাল ১০টায় সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে কার্ডিনাল জিওভান্নি বাত্তিস্তার নেতৃত্বে  পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মিসা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২২০ জন কার্ডিনাল, ৭৫০ জন বিশপ এবং ৪,০০০-এর বেশি পুরোহিত অংশ নেন। এই মিসায় সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নেন। বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনুসও পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস কে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে পূর্বে মোমবাতি রাখার একটি কক্ষ ছিল। পোপ নিজেই এই জায়গাটি তার সমাধির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। পোপদের সাধারণত ভ্যাটিকানে সমাহিত করা হলেও, পোপ ফ্রান্সিস নিজেই সান্তা মারিয়া ম্যাজিওর বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ২০২২ সালে বলেছিলেন, ভার্জিন মেরি তাঁকে এখানে সমাধিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসের এই ব্যাসিলিকার প্রতি গভীর ভক্তি ছিল, বিশেষ করে এখানে অবস্থিত মেরি সালুস পপুলি রোমানি আইকনের প্রতি। তিনি তাঁর ৪৭টি আন্তর্জাতিক সফরের আগে ও পরে এবং হাসপাতালে ভর্তির পর এখানে প্রার্থনা করতেন। অতীতে তিনি কার্ডিনাল হিসেবেও রোম ভ্রমণ করলে এই গির্জায় বেড়াতে আসতেন। পোপ ফ্রান্সিসের সাদামাটা জীবন পোপ ফ্রান্সিস এর আসল নাম জর্জ মারিও বের্গোগ্লিও। তিনি ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত রোমান ক্যাথলিক চার্চের একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় সোসাইটি অফ জিসাস বা জেসুইটের সদস্য ছিলেন। জেসুইটরা অত্যন্ত সরল ও বিনয়ী জীবন যাপন করে। পোপ ফ্রান্সিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। পোপদের থাকার জন্য একটি রাজকীয় প্রাসাদ রয়েছে। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস পোপ নির্বাচিত হবার পর ভ্যাটিকানের অ্যাপোস্টলিক প্যালেসের পরিবর্তে, সান্তা মার্তা নামের একটি গেস্টহাউসে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এটি একটি সাধারণ বাসস্থান, যার মধ্যে ছিল একটি শোবার ঘর, বাথরুম এবং অধ্যয়ন কক্ষ। পোপ ফ্রান্সিস ঐতিহ্যবাহী পোপের পোশাকের তুলনায় সাধারণ পোশাক পছন্দ করেতেন। তিনি বিলাসবহুল পোপের জুতোর পরিবর্তে সাধারণ কালো চামড়ার জুতো পরতেন। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যেমন ঘড়ি বা ব্যাগ, সবই সাধারণ এবং কোনটিই ব্যয়বহুল নয়। পোপ ফ্রান্সিস বিলাসবহুল গাড়ির পরিবর্তে সাধারণ গাড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার মনে হয় একজন পুরোহিতের বিলাসবহুল গাড়ি থাকা উচিত নয়। পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানেও গরিব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য খাবার, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলতেন, “একটি গির্জা যদি গরিবদের পাশে না থাকে, তবে তা গির্জা নয়।”পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বাস করতেন যে নেতাদের উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই তিনি িনজে বিলাসিতা পরিহার করে, গির্জার পুরোহিত ও বিশপদের বিলাসিতা ত্যাগ করে সাধারণ জীবনযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে অতীতে অধিকাংশ পোপ কিন্তু পোপ ফ্রান্সিসের মত এতটা বিনয়ী এবং সাদামাটা জীবন যাপন করতেন না। মধ্যযুগের পোপেরা ছিলেন ইউরোপের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তারা একেকজন ক্ষমতালোভী রাজা বা সম্রাটদের চেয়েও অনেক বেশি দুর্ণীতিগ্রস্ত ছিলেন।

Shopping Cart
Scroll to Top