সাধারণ জনগণের সাথে ইসলামী জ্ঞান ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার একটি কার্যকর উপায় ওয়াজ মাহফিল। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বত্রই এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সংস্কৃতি। মূলত মানুষকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং ধর্মীয় জ্ঞান প্রচারের জন্যই তাফসিরুল কুরআন বা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে ওয়াজ মাহফিল অনেক বিতর্কিত হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কিছু বক্তা তাদের বক্তৃতার জন্য মোটা অংকের পারিশ্রমিক নিচ্ছেন, যা ইসলাম প্রচারের মূল উদ্দেশ্যের সাথেই সাংঘর্ষিক।
ওয়াজ মাহফিল বাংলাদেশের একটি সম্বৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকে কিভাবে একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।
এই ব্যবসা কিভাবে গড়ে উঠেছে?
প্রাচীনকাল থেকে ইসলামি জ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষার প্রচারের জন্য ওয়াজ মাহফিল একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে এ ধরনের সভা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে মানুষ কুরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন করে এবং নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করে। এটি সামাজে একতা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একটা সময় এসব মাহফিল ছিল গ্রামীণ জনগণের জন্য জ্ঞান অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। প্রাচীন আলেমরা গভীর অধ্যয়ন ও বাস্তবিক উদাহরণের মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারতেন। এমনকি বর্তমানেও অনেক জায়গায় ওয়াজ মাহফিল, সামাজিক উন্নয়ন, দানশীলতা এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতির চর্চাকে উৎসাহিত করে। এটি ইসলামের নৈতিক শিক্ষা ও সমাজ গঠনের প্রাথমিক উদ্দেশ্যের প্রতি মানুষকে মনোযোগী করে তোলে।
বিগত কয়েক দশকে ধর্মীয় নেতারা এবং জনপ্রিয় বক্তারা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের কথা শুনতে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হন। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি টানই এর পেছনে মূল কারণ। পাশাপাশি জনপ্রিয় বক্তাদের আবেগপ্রবণ উপস্থাপনা এবং তাদের গল্প মানুষকে আকৃষ্ট করে।
এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকরা; তাদেরকেই বেশি বেশি ডাকতে থাকে যাদের নিয়ে আসলে মাহফিলে বেশি লোক উপস্থিত হতে পারবে। আর বেশি লোকের উপস্থিতি মানেই বেশি বেশি দান গ্রহণ করা যাবে। এই একটি বিষয় থেকেই বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলের বানিজ্যিকীকরণ হতে থাকে। তখন থেকে জনপ্রিয় বক্তারা এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, এক বছর আগে থেকে তাদের বুকিং দিয়ে রাখতে হয়।
মাহফিল ব্যবসা
বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের জনপ্রিয় বক্তারা এক একটি অনুষ্ঠানের জন্য লক্ষাধিক টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। সেই সাথে জনপ্রিয় বক্তাদের জন্য হেলিকপ্টার ভাড়া করা, বিশাল মঞ্চ তৈরি, প্রচার ও অন্যান্য খরচ সহ একটি মাহফিল আয়োজন করতে বেশ মোটা অংকের টাকা খরচ করা হয়।
অথচ ওই একই এলাকার মসজিদের মুয়াজ্জিন, ইমাম এবং খতিবদের মাসিক বেতন মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। অনেক জায়গায় এই ন্যূনতম বেতনও নিয়মিত পরিশোধ করা হয় না। স্থানীয় আলেমদের অনেকেই ওয়াজ মাহফিলের জনপ্রিয় বক্তাদের সমপর্যায়ের জ্ঞানী এবং পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও, তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না।
একজন হুজুর দিনে ৫ বার এবং মাসে দেঢ়শ ওয়াক্ত নামাজ পরিয়ে বেতন পান মাত্র ৫ থেকে দশ হাজার টাকা। অারেকজন মাত্র ১ ঘন্টা বয়ান করে পান এক লক্ষ টাকা। কোন কোন বক্তার একই দিনে একাধিক জেলায় মাহফিল থাকে। এই ধরনের বৈষম্য ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। বিষয়টি নিয়ে সবার আগে প্রতিবাদ করা উচিত ছিল জনপ্রিয় আলেম ওলামাদের; কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে এই বিষয়টি নিয়ে কোন জোড়ালো প্রতিবাদ শোনা যায় না।
ওয়াজ মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু অধিক দান সদকা সংগ্রহ এবং বক্তাদের অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের চাহিদার কারণে, সেই মূল উদ্দেশ্য থেকেই আমরা বহু দূরে সরে গেছি। এর বাইরে, মাহফিলের আশে পাশে লোক সমাগমকে কেন্দ্র করে, ফুচকা চটপটির দোকান থেকে শুরু করে বাচ্চাদের খেলানার দোকান বসিয়ে, তাফসিরুল কুরআন মাহফিলকে মেলা বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
তবে এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। অনেক জায়গায় অপরিচিত আলেমদের দিয়ে ওয়াজ মাহফিল করানো হলে, লোক সমাগম হয় অতি নগন্য। যার ফলে দান-সদকা সংগ্রহ করা তো দূরের কথা। মাহফিলের খরচই উঠে আসে না। কারণ মানুষ এখন ওয়াজ মাহিফল শোনার চেয়ে, ফেসবুকের জনপ্রিয় সেলিব্রেটি আলেমদের সামনাসামনি দেখার উদ্দেশ্যেই বেশি যায়।
সমালোচনা
ওয়াজ মাহফিল এখন অনেকটাই বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আবেগপ্রবণ বক্তৃতা এবং গান-গজলের মতো পরিবেশনা মানুষকে আকৃষ্ট করলেও; ইসলামি জ্ঞান প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
ওয়াজ মাহফিলে অধিকাংশ জনপ্রিয় বক্তাই সুরে সুরে বক্তব্য দেন, যা অনেকের কাছে আকর্ষণীয় মনে হলেও; অন্যদের কাছে বিষয়টি হাস্যকর হয়ে উঠেছে। অনেক বক্তা বক্তব্য প্রদানের সময় খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। যার ফলে তারা ভালো ভালো কথা বললেও, শুনতে খুবই খারাপ লাগে। এই ধরনের অতি নাটকীয় ওয়াজের ভিডিও যখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, তখন তা অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরী করে। শুধু তাই নয়, বহু মুসলিমরাও এসব দেখে ওয়াজ মাহফিল কিংবা ইসলামা থেকেই দূরে সরে যেতে থাকে।
ওয়াজের আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষের কাছে ধর্মীয় শিক্ষা এবং নৈতিকতার বার্তা পৌঁছানো। কিন্তু বর্তমান ওয়াজ মাহফিলে শিক্ষার গভীরতা অনেকাংশেই হারিয়ে গেছে। কখনও দেখা যায়, একজন বক্তা খুব হাস্যরসত্নক বক্তব্য দিচ্ছেন। আবার মুহুর্তেই কথার মধ্যে লম্বা সুরে টান দিয়ে খুব আবেগী গলায় কান্নাকটি করে একটি সাধারণ বিষয়ের অতি নাটকীয় বর্ণনা শুরু করে দেন।
এসব বিষয় উল্লেখ করে ওয়াজ মাহফিল নিয়ে গঠনমূলক আলোচন করতে গেলেও, তারা বলবে ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করার পায়তারা চলছে। একদল লোক অবশ্যই আছে যারা ইসলাম বিদ্বেষের জায়গা থেকে, ধর্মীয় যে কোন বিষয় নিয়েই অহেতুক সমালোচনা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাই বলে, ওয়াজ মাহফিলে যে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থি নানা ধরনের চর্চা হচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
ওয়াজ মাহফিলে অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোভাব এবং কিছু বক্তার বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে সামগ্রিকভাবে ইসলামের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। ইসলামকে আবার তার মূল নৈতিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হলে বক্তাদের আরো সংযমী ও দায়বদ্ধ হতে হবে।
আলেমদের স্থলন
বর্তমানে ওয়াজ মাহফিল থেকে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা ও সামাজিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হল কতিপয় আলেম ওলামাদের নৈতিক স্খলন। কিছু কিছু আয়োজনে শরিয়তবিরোধী কার্যকলাপ, অপ্রয়োজনীয় খরচ এবং ভাইরাল বক্তাদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণে ইসলামের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অনেক মাহফিলে মাজহাবি ঝগড়া-বিবাদ নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করা হয়। অন্য আলেমদের মধ্যে কে মুরদতাদ কে কাফের হয়ে গেছে, সেসব নিয়ে হাজার হাজার লোকের সামনে বক্তারা অন্য বক্তা সম্পর্কে অসম্মানজনক আলোচনা করেন। সঠিক জ্ঞান এবং দায়িত্বশীলতার অভাবে কিছু বক্তার বক্তব্য ইসলামের বদনাম ডেকে আনে। তাছাড়া ধর্মীয় বিষয়গুলো অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা, সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া এবং সর্বোপরি ইসলামি শিক্ষার পরিবর্তে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেওয়া বক্তাদের সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত করে তুলেছে। বক্তাদের অানেকেই তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল সহ স্যোশাল মিডিয়া কন্টেন্টের কথা মাথায় রেখেও জনপ্রিয় বিষয়ে ওয়াজ করে থাকেন।
বেশ কিছু বক্তা তাদের বক্তৃতায় এমন অপ্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনা করেন যা ওয়াজ মাহফিলের আসল উদ্দেশ্য থেকে শ্রোতাদের দূরে সরিয়ে দেয়। এর মধ্যে থাকে ব্যক্তিগত কৌতুক, রাজনৈতিক বক্তব্য এবং এমন কিছু বিতর্কিত বিষয় যা ইসলামের শিক্ষা এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব কারণে অনেক সময় ওয়াজ মাহফিলের প্রভাব উল্টো ইসলামের ক্ষতি করে। ধর্মীয় জ্ঞান ও নৈতিকতার প্রসারের পরিবর্তে এটি সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। কিছু কিছু ওয়াজ মাহফিলে ইসলামী ভাবধারা প্রচারের আড়ালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টাও চলছে।
ওয়াজ মাহফিলের আরকটি নেতিবাচক দিক হল, উচ্চস্বরে মাইক ব্যবহার করে অযথা শব্দ দূষণ তৈরী করা। ওয়াজের মঞ্চ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত মাইক লাগিয়ে রাখা হয়, গভীর রাত পর্যন্ত চলে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন। যা সাধারণ মানুষের শান্তি বিঘ্নিত করে। বিশেষত, শিশু, বৃদ্ধ এবং শিক্ষার্থীরা এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। মজলিশে উপস্থিত জনগণের বাইরের মানুষকে জোড় পূর্বক পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত শোনানোও এক ধরনের গুনাহের কাজ। অথচ এত বড় বড় আলেমদের মাথায় এই বিষয়টি একবারও আসে না, েয সাধারণ মানুষদের অসুবিধা তৈরী করে তারা ইসলামের উপকার করতে পারবে না। ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় রাস্তা বন্ধ করে ওয়াজ মাহফিল আয়োজন করা হয়, যা রীতিমত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায়, একই সাথে দুই তিন জায়গায় মাহফিল হচ্ছে, যার ফলে কোনটার আওয়াজই ঠিকমত শোনা যায় না।
ওয়াজ মাহফিলে হাজারো মানুষ উপস্থিত হলেও, মসজিদে নামাজির সংখ্যা বাড়ে না। মানুষ শুধু বক্তার মজার গল্প উপভোগ করেই বাড়ি ফিরে আসে। সত্যিকার অর্থে ইসলামি আলোচনা অনেক হয়েছে, ইউটিউব-ফেসবুক ওয়াজের ভিডিও দেখতে দেখতে শ্রোতাদেরও এসব বয়ান মুখস্ত। তাই আমাদের এখন এমন আলেম দরকার, যারা শুধু কথার মাধ্যমে নয়, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধান করে মানুষকে কাজের মাধ্যমে ভালো পথ দেখাতে পারবেন।
ওয়াজ মাহফিল ইসলামের জ্ঞান ও নৈতিকতার প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, যা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাখে। তবে অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণ, বক্তাদের বিলাসিতা এবং ওয়াজকে নসিহত কে লাভজনক পেশা হিসেবে নেওয়ার কারণে, এর মূল উদ্দেশ্য ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। মাহফিলের বাজেট কমিয়ে তা স্থানীয় মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ব্যয় করা উচিত। উচ্চস্বরে মাইক ব্যবহারে সীমা নির্ধারণ করা এবং স্থানীয় আলেমদের অধিক সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে ওয়াজ মাহফিলকে আবার ইসলামের শিক্ষা ও সামাজিক কল্যাণের প্রকৃত উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।