রোজার বিজ্ঞানভিত্তিক উপকারিতা কী?
পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালন করা ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের একটি। ইসলাম ধর্মের এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যমই নয়, বরং এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী।
রমজান মাসে রোজা পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের পাশাপাশি আত্মসংযম, ধৈর্য, এবং সহানুভূতির মতো গুণাবলী অর্জন করে। এছাড়া, বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোজা শরীরের বিপাকীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানসিক চাপ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রোজার বহুমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।
শারীরিক উপকারিতা
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মে উপবাসের চর্চা রয়েছে, এবং আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে যে এটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ইসলাম ধর্মে আত্মশুদ্ধি, সংযম ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য রোজা পালন করা হয়। তবে বিজ্ঞানীরা একে স্বাস্থ্যের উন্নয়নে এক কার্যকরী কৌশল হিসেবেও ব্যাখ্যা করেছেন।
রোজার সময় দীর্ঘ সময় ধরে খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকার ফলে দেহের অভ্যন্তরে জমে থাকা টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থগুলো প্রাকৃতিকভাবে বের হয়ে যায়। লিভার, কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গগুলো এই সময়ে তাদের কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করে এবং দেহকে পরিষ্কার করে। রোজার সময় পাকস্থলী এবং হজমতন্ত্র বিশ্রাম পায়, যা হজমশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, রোজার মাধ্যমে গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, অ্যাসিডিটি এবং বদহজমের মতো সমস্যাগুলো কমে যায়।
যখন আমরা দীর্ঘ সময় ধরে খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকি, তখন শরীর গ্লুকোজের পরিবর্তে সঞ্চিত চর্বি থেকে শক্তি উৎপাদন শুরু করে। এই প্রক্রিয়া ‘কিটোসিস’ নামে পরিচিত; যা শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, রোজা রাখার সময় শরীর ‘অটোফেজি’ নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরনো ও ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে পরিষ্কার করে নতুন কোষ তৈরি করে। ২০১৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহসুমি এই অটোফেজি প্রক্রিয়ার গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে যে, উপবাসের মাধ্যমে শরীরের এই প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতা প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, যা ক্যান্সার ও আলঝেইমারের মতো রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
২০১৯ সালে ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোজার মত নিয়ন্ত্রিত উপবাস শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করে।
এছাড়া, রোজা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। ফলে কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড এবং রক্তচাপের মাত্রা হ্রাস পায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত উপবাস করেন, তাদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সমস্যা কম দেখা যায়।
২০১৪ সালে ‘সেল স্টেম সেল’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, দীর্ঘায়িত উপবাস শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন বাড়ায়, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়া শরীরকে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
রোজার মানসিক ও আত্মিক উপকারিতা
রোজা রাখার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার ইচ্ছাশক্তি ও সংযমকে উন্নত করতে শেখে। এটি শুধুমাত্র খাবার গ্রহণের বিরতি নয়, বরং এটি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি উপায়। রোজা রাখার মাধ্যমে ধৈর্যশীলতা ও মনোসংযোগ বৃদ্ধির অভ্যাস গড়ে তোলা সহজ হয়।
বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে উপবাস করলেই কর্টিসল (Cortisol) নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমে। রোজা রাখার ফলে ব্রেইনের নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর (Brain-Derived Neurotrophic Factor, BDNF) বৃদ্ধি পায়, যা স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং মস্তিষ্কের নিউরোনাল সংযোগ উন্নত করে। এটি মানসিক চাপ ও হতাশা কমাতেও সাহায্য করে।
রোজা রাখার অন্যতম প্রধান শিক্ষা হলো ধৈর্য ও সহানুভূতি অর্জন করা। যখন কেউ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সহ্য করে, তখন সে অভাবী ও দরিদ্রদের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে। এর ফলে সমাজে সহমর্মিতা ও সহানুভূতির মানসিকতা বৃদ্ধি পায়।
বর্তমান যুগে সুস্থ জীবনধারার অংশ হিসেবে রোজা বা উপবাসের গুরুত্ব নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে। রোজার মাধ্যমে দেহের ডিটক্সিফিকেশন, ওজন নিয়ন্ত্রণ, হজমশক্তির উন্নতি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নতি, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস এবং মানসিক প্রশান্তি অর্জন করা যায়।
তবে, রোজার উপকারিতা পুরোপুরি লাভ করতে হলে এটি সঠিকভাবে পালন করা জরুরি। ইফতার ও সেহরির সময় সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান এবং অতিরিক্ত তৈলাক্ত বা ভাজা খাবার এড়িয়ে চলা এই প্রক্রিয়াকে আরও ফলপ্রসূ করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে রোজার স্বাস্থ্য উপকারিতা কমে যেতে পারে। তাই, রোজার বিজ্ঞানভিত্তিক উপকারিতা লাভ করার জন্য, রোজা পালনের সময় স্বাস্থ্য সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র:
- de Cabo, R., & Mattson, M. P. (2019). Effects of Intermittent Fasting on Health, Aging, and Disease. New England Journal of Medicine, 381(26), 2541-2551.
- Ohsumi, Y. (2016). Autophagy: A Nobel Prize-Winning Discovery. Cell, 167(6), 1430-1442.
- Mattson, M. P., et al. (2018). Impact of Intermittent Fasting on Brain Health. Journal of Neuroscience, 38(45), 9739-9747.
- Longo, V. D., & Panda, S. (2014). Fasting, Circadian Rhythms, and Immune System Regeneration. Cell Stem Cell, 14(6), 810-821.
- Longo, V. D., & Mattson, M. P. (2014). Fasting: Molecular Mechanisms and Clinical Applications. Cell Metabolism, 19(2), 181-192.
- Patterson, R. E., & Sears, D. D. (2017). Metabolic Effects of Intermittent Fasting. Annual Review of Nutrition, 37, 371-393.
- Trepanowski, J. F., & Bloomer, R. J. (2010). The Impact of Religious Fasting on Human Health. Nutrition Journal, 9(1), 57.
- Faris, M. A. I. E., et al. (2012). Intermittent Fasting During Ramadan Attenuates Proinflammatory Cytokines and Immune Cells in Healthy Subjects. Nutrition Research, 32(12), 947-955.
- Mattson, M. P., et al. (2018). Intermittent Metabolic Switching, Neuroplasticity and Brain Health. Nature Reviews Neuroscience, 19(2), 63-80.
- Alghamdi, A. S., et al. (2013). The Effect of Ramadan Fasting on Glycemic Control in Patients with Type 2 Diabetes Mellitus. Journal of Family and Community Medicine, 20(3), 143-148.
- Saleh, S. A., et al. (2014). The Effect of Ramadan Fasting on Cardiovascular Parameters in Hypertensive Patients. Journal of Clinical Hypertension, 16(9), 629-633