ভূমিকা
ডিপসিক একটি চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই কোম্পানি। সাম্প্রতিক সময়ে কম্পানিটি প্রযুক্তি জগতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ডিপসিকের মূল লক্ষ্য হল কম খরচে কার্যকর এআই মডেল তৈরি করা। ডিপসিকের তৈরি ডিপসিক চ্যাটবট অ্যাপ অত্যন্ত অল্প সময়ে এবং নামমাত্র বিনিয়োগে, বর্তমান সময়ের শীর্ষ এআই কম্পানি ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি সহ গুগলের জিমিনি বা মাইক্রোসফটের
কোপাইলট কে টেক্কা দিতে পেরেছে। ডিপসিক অ্যাপ প্রকাশের মাত্র দশ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপ স্টোরের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোডকৃত অ্যাপে পরিণত হয়েছে।
ডিপসিকের আর্বিভাবের ফলে, বিশ্বের শীর্ষ এআই চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া একদিনে শেয়ার বাজার থেকে প্রায় ৫৯৩ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬৫ লক্ষ ২৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। এটি ওয়াল স্ট্রিটের ইতিহাসেএক দিনে কোনো একক কোম্পানির জন্য সবচেয়ে বড় শেয়ার পতনের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
চীনের তৈরী ডিপসিক এআই প্রযুক্তি বিশ্বে কেন এতটা আলোড়ন তুলেছে এবং ভবিষ্যতে এই কম্পানি কিভাবে এআই এর ধারণা আমূল বদলে দিবে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।
ডিপসিক
ডিপসিক ২০২৩ সালে চীনের হাংঝু শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ডিপসিকের গবেষকরা এআই মডেল তৈরিতে এমন উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যার ফলে এআই মডেল তৈরীর ধারণাই আমূল বদলে গেছে। আর সেকারণেই মাত্র দুই বছর বয়সী একটি কম্পানি এআই প্রযুক্তির বাজারে রীতিমিত ভূমিকম্প তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে।
ডিপসিকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং, উন্নত মানের অথচ কম খরচের এআই মডেল তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। তিনি মূলত প্রচলিত এআই অবকাঠামোকে পাশ কাটিয়ে নতুন ধরনের কিছু একটা করার পরিকল্পনা করছিলেন।
বর্তমানে আমরা যে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করি, তার জন্য অনেক বেশি কম্পিউটেশনাল পাওয়ার দরকার হয়। এর জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার এবং বিপুল পরিমাণ এআই চিপ ব্যবহার করতে হয়। সেকারণে এআই নিয়ে গবেষণা বা এআই নির্ভর একটি কার্যকর সেবা বা পণ্য তৈরী করাটা এতদিন পর্যন্ত অনেক ব্যয়বহুল প্রকল্প হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছিল।
ডিপসিক কেন সেরা?
ডিপসিক এআই এর নতুন কোন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেনি। তারা প্রচলিত এআই অবকাঠামোকে নতুন করে ডিজাইন করেছে মাত্র। তাহলে ডিপসিক নিয়ে এত মাতামাতির আসল কারণ কী? এর উত্তর হল ডিপসিক এআই মডেল তৈরীর খরচকে রীতিমত আকাশ থেকে পাতালে নামিয়ে এনেছে।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কার্যকর এআই প্রোডাক্ট ওপেনএআই এর চ্যাটজিপিটি। ডিপসিক ওপেন এআই এর প্রায় সমকক্ষ ডিপথিংক আর-১ মডেল ট্রেইন করেছে মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলারে, বাংলাদেশী টাকায় মাত্র ৬৬ কোটি টাকা। ৬ মিলিয়ন ডলার শুনতে অনেক মনে হলেও, এআই প্রযুক্তি খাতে এই খরচ নিতান্তই দুধভাত। কারণ চ্যাটজিপিটির জিপিটি-৪ মডেল কে ট্রেনিং করতে ওপেনএআই-এর আনুমানিক
খরচ ছিল প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার; বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা।
তারমানে ডিপসিক চ্যাটজিপিটির তুলনায় প্রায় ১৭ গুণ কম খরচে এআই ট্রেনিংসম্পন্ন করেছে। যা কিছুদিন আগ পর্যন্তও ছিল অকল্পনীয়।
এআই এর প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকতে হলে, কাড়ি কাড়ি ডলার বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই; এমন ধারনা থেকে মাত্র কিছু দিন আগেই গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফটের মত প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। অথচ ডিপসিকের মত পুচকে এক চাইনিজ কম্পানি বিশ্ব টেক জায়ান্টদের রীতিমত নাকানি চুবানি দিচ্ছে।
ডিপসিক কিভাবে করল?
ডিপসিক এমন একটা সময়ে তাদের এই নতুন এআই মডেল বাজারে ছেড়েছে; যার ২ বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর সকল ধরনের চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর প্রথম বড় পরিসরে চিপ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা দেয় ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে। এরপর ২০২৩ সালের অক্টোবরে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। তারমানে ডিপসিকের জন্মই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের চিপ নিষেধাজ্ঞার পরবর্তী সময়ে।
মার্কিন সরকার চীনে উন্নত চিপ, আধুনিক প্রসেসিং ইউনিট বা GPU, এবং AI ও সুপারকম্পিউটিং-এর জন্য ব্যবহৃত চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। শুধু চিপই নয়, চীনে আধুনিক চিপ তৈরির সরঞ্জাম রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, যাতে চীন উন্নত চিপ তৈরি করতে না পারে। কিন্তু তারপরও ডিপসিক কিভাবে এত অল্প সময়ে এত উন্নত এআই মডেল তৈরী করল তা গবেষকদের মধ্যে এখনও এক বিষ্ময়।
অনেককেই ধারণা করছেন ডিপসিকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং চীন ভিত্তিক একটি ক্রিপ্টো মাইনিং গ্রুপের সদস্য ছিলেন। ধারণা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আগেই এই গ্রুপটি প্রায় ৫০ হাজারের বেশি গ্রাফিক প্রসেসিং ইউনিট বা GPU কিনে রেখেছিল। তারা এক প্রকার ব্যক্তিগত আগ্রহের বশেই এআই মডেল নিয়ে কাজ শুরু করে।
ডিপসিক প্রথমে এআই মডেলের টোকেন গুলোকে সহজ করেছে। টোকেন হল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষা মডেলে ব্যবহৃত সবচেয়ে ছোট তথ্যের একক, যা একটি শব্দ, বাক্যের অংশ, বা এমনকি অক্ষরের টুকরো হতে পারে। উদাহরণস্বরূপবলা যায়: “Artificial Intelligence is amazing!” এই বাক্যটিকে প্রচলিত এআই মডেল – [“Arti”, “ficial”, “Intelli”, “gence”, “is”, “amaz”, “ing”, “!”] এরকম একেকটি শব্দকে কয়েক
ভাগে ভাগ করার মাধ্যমে টোকেন তৈরী করে। যা দিয়েই মূলত এআই মডেলগুলো নতুন নতুন শব্দ, বাক্য বা একটি রচনা তৈরী করতে পারে।
কিন্তু ডিপসিক টোকেনগুলোকে এতটা ছোট করে না ভেঙে, প্রতিটি শব্দকে একেকটি টোকেন হিসেবে ধরে নিয়েছে। যেমন: ডিপসিকের জন্য [“Artificial”, “Intelligence”, “is”, “amazing”, “!”] এরকম প্রতিটি শব্দ একেকটি টোকেন। এরফলে ডিপসিক অনেক কম কম্পিউটেশনার পাওয়ার ব্যবহার করেও, দীর্ঘ মেয়াদে অনেকটা একই রকম ফলাফল পেয়েছে।
সকলের বোঝার স্বার্থে টোকেনের এমন সহজ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টা এতটাও সহজ নয়। ডিপসিক এআই একসাথে প্রায় ১ লক্ষ ২৮ হাজার টোকেন পর্যন্ত মনে রাখতে পারে। যা প্রায় চ্যাটজিপিটির সমান। মাত্র কয়দিন আগেও চ্যাটজিপিটি মাত্র ১৬ হাজার টোকেন নিয়ে কাজ করত। তবে চ্যাটজিপিটির এই অবস্থায় আসতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু ডিপসিক তাদের যাত্রার শুরুতেই কিভাবে চ্যাটজিপিটির সমপর্যায়ে পৌছাতে পারল তা নিয়ে বিষ্ময়ের শেষ নেই।
চ্যাটজিপিটির নির্মাণে টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট বিরাট অংকের বিনিয়োগ করেছিল। চীনা প্রতিষ্ঠান ডিপসিক ওপেনএআই এর তথ্য চুরি করে তাদের মডেল তৈরী করেছে কিনা, সে বিষয়ে মাইক্রোসফট ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। তাছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিয়োগ দেওয়া হোয়াইট হাউসের এআই ও ক্রিপ্টো বিষয়ক কর্মকর্তা ডেভিড স্যাকস বলেছেন, ডিপসিক যে ওপেন এআই এর মডেল চুরি করেছে, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
ডিপসিক ওপেন সোর্স কেন?
ডিপসিকের তৈরী এআই মডেল ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি, গুগলের জিমিনি বা মাইক্রোসফটের কোপাইলটের শুধু সমক্ষই নয়, কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন মডেলগুলোর চেয়েও ভালো কার্যক্ষমতা প্রদর্শন করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এআই মডেল গুলোর সামান্য অংশ বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। এগুলো থেকে ব্যবহারকারীরা সেরা আউটপুট পেতে চাইলে অর্থ খরচ করে মাসিক সাবস্ক্রিপশন নিতে হয়। কিন্তু ডিপসিক এআই এর সর্বোচ্চ সেবা ব্যবহার করা যায় সম্পূর্ন বিনামূল্যে।
শুধু তাই নয়, ডিপসিক একটি ওপেনসোর্স মডেল। তারমানেডপসিক কিভাবে তৈরী করা হয়েছে, সেই প্রক্রিয়া সবার জন্য উন্মুক্ত। এখন চাইলেই যে কেউ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজেদের মত করে একটি নতুন এআই মডেল তৈরী করে নিতে পারবে।
অর্থাৎ ডিপসিক শুধু অর্থনৈতিকভাবেই পশ্চিমা কম্পানিগুলোকে দেউলিয়া করার পায়তারা করছে না, বরং তাদের প্রযুক্তিগত গোপন গবেষণাগুলোও সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে এআই প্রযুক্তি সহজলভ্য করেছে।
যেহেতু চীনের পৃষ্ঠপোশকতায় ডিপসিক তৈরী হয়েছে, তাই এখানে চীনের সরকার বিরোধী কোন তথ্য বা ফলাফল দেখানো হয় না। এই সামান্য অসুবিধা মেনে নিলে, ডিপসিক প্রযুক্তিপ্রেমীদের জন্য অর্শিবাদই বলা চলে।
শুধু ডিপসিকই নয়, ডিপসিকের পর চীনের মুনশট নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান কিমি এআই নামের নতুন আরেক চ্যাটবট নিয়ে এসেছে। এটিও বর্তমান সময়ে প্রচলিত শীর্ষ এআইগুলোর সমকক্ষ।
প্রযুক্তি জগতে চীনের উত্থান ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার যে পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল, তা পুরোপুুরি ব্যার্থ হয়েছে। চীন যেভাবে রাতারাতি এআই প্রযুক্তির শীর্ষে চলে এসেছে, তাতে ভাবিষ্যতে যে চীনই এই খাতে রাজত্ব করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে চীনের কাছে থেকে বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পর, এবার যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোও কম খরচে এআই অবকাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টায় নামবে। যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীনের এই এআই যুদ্ধে সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহারকারীরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।