ভূমিকা
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে বিমান ভ্রমণের নিরাপত্তা নিয়ে যাত্রীদের মনে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমাগত প্রযুক্তির উন্নতি ও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও বিমান দুর্ঘটনা পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।
কিছু দুর্ঘটনার জন্য যান্ত্রিক ত্রুটি দায়ী, কিছু ক্ষেত্রে প্রতিকূল আবহাওয়া দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আবার কিছু দুর্ঘটনা মানবিক ভুলের কারণেও ঘটেছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটির আগাম সতর্কবার্তা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে তা প্রাণঘাতী পরিণতি ডেকে এনেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এত বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে কেন এবং আকাশপথে ভ্রমণ কতটুকু নিরাপদ, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।
সাম্প্রতিক বিমান দুর্ঘটনা
উড়োজাহাজ আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে, আকাশপথে যত ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা প্রতিরোধ করতে পর্যায়ক্রমে প্রায় সকল ধরনের ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে। সেকারণে বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র সেইসব দুর্ঘটনাই ঘটছে, যা আগে কখনও ঘটেনি অথবা তা আগে থেকে ধারণা করা সম্ভব ছিল না।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি আলোচিত বিমান দুর্ঘটনা হল, দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান বিমান বন্দরে জেজু এয়ারলাইন্সের দুর্ঘটনা (২৯ ডিসেম্বর ২০২৪), কাজাখস্তানের আকতাউয়ে আজারবাইজান এয়ারলাইন্সের দুর্ঘটনা (২৫ ডিসেম্বর ২০২৪), যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনায় মাঝ আকাশে দুই বিমানের সংঘর্ষ (১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫), ব্রাজিলের গ্রামাদো শহরে ছোট ব্যক্তিগত বিমান দুর্ঘটনা (২২ ডিসেম্বর ২০২৪), রাশিয়ার তিভের অঞ্চলে ব্যক্তিগত বিমান দুর্ঘটনা (২৩ আগস্ট ২০২৩), নেপালের পোখারা বিমান দুর্ঘটনা (জানুয়ারি ২০২৩) উল্লেখযোগ্য। এগুলোর বাইরেও কানাডা, তুরষ্ক, মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়ায় আরো বেশ কিছু ব্যক্তিগত ও সামরিক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। তবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস টি ছিল বিমান যাত্রার ইতিহাসে একটি অন্যতম কালো অধ্যায়। কারণ ডিসেম্বরে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে একের পর এক ঘটে যায় বেশ কয়টি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা, যাতে বহু লোক মৃত্যুবরণ করেন।
বিমান দুর্ঘটনা সাধারণত একাধিক কারণের সমন্বয়ে ঘটে থাকে। তবে মোটা দাগে বললে বিমান দুর্ঘটনার সাথে জড়িত প্রধান কারণ ৩টি।
আমেরিকার ন্যাশনাল এভিয়েশন সেফটি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ শতাংশ বিমান দুর্ঘটনাই ঘটে পাইলটের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। এরপর প্রায় ২৩% বিমান দুর্ঘটনা কোনো না কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটে থাকে। এবং প্রায় ১০% বিমান দুর্ঘটনা প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ঘটে থাকে।
জেজু দুর্ঘটনা
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনা গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হল দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারের দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনার প্রথম কারণ ছিল বার্ড স্ট্রাইক। অর্থাৎ পাখির সাথে বিমানের সংঘর্ষ। প্রায় এক কেজি ওজনের পাখি যখন কয়েকশো কিলোমিটার গতিতে চলা বিমানের সাথে ধাক্কা খায়, তখন এটি মারাত্নক বিস্ফোরণের মতো শক্তি তৈরি করতে পারে।
সাধারণত পাখি আর বিমানের এই সংঘর্ষ এড়াতে বিমানবন্দরগুলোর নকশায় ও অবস্থানে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়। জলাশয়ের আশেপাশে বিমানবন্দর তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং এয়ারপোর্টের আশেপাশে পাখির খাবারের উৎস সরিয়ে ফেলা হয়। অনেক সময় লেজার লাইট বা অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাখিদের তাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। পাখি বা পাখির ঝাঁক যদি বিমানের উইন্ডস্ক্রিনে ধাক্কা দেয় কিংবা জেট ইঞ্জিনের ভেতরে ঢুকে পড়ে, তখন দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে প্রতিবছর বিশাল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়। শুধু আমেরিকাতেই এ কারণে ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার! আর সারা বিশ্বের বাণিজ্যিক বিমানের ক্ষেত্রে এই ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার
কিন্তু মুয়ান বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এই সতর্কতাগুলো উপেক্ষা করেছিল। বিমানবন্দরের ঠিক পাশেই ছিল একটি জলাশয়, যা পাখিদের বসবাসের আদর্শ জায়গা। বিমানটি অবতরণের আগে পাখির সাথে এর সংঘর্ষ হয়, ফলে ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ করা বন্ধ করে দেয়। বিমানের পাইলট তারপরও যথেষ্ট দক্ষতার সাথে বিমানটিকে বেলি ল্যান্ডিং করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেখানে দেখা দেয় আরেকটা সমস্যা। মুয়ান এয়ারপোর্টের রানওয়ের সামনে ছিল একটি দীর্ঘ কংক্রিটের দেয়াল। বিমানটি খুব দ্রুত এই দেয়ালে আঘাত করার ফলে মারাত্নক বিস্ফোরণ ঘটে। এতে বিমানের আরোহী ১৮১ জনের মধ্যে ১৭৯ জন যাত্রী ও ক্রু নিহত হয়, মাত্র ২ জন বেঁচে যান। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা।
জেজু এয়ারের এই দূর্ঘটনাটি ছিল একাধিক দুর্ঘটনার অদ্ভূত সমন্বয়। পাখির আঘাতে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারালেও, পাইলটের দক্ষতায় ল্যান্ডিং গিয়ার ছাড়াই বিমানটি রানওয়েতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের মারাত্নক ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে ১৭৯ জন নিরীহ মানুষকে প্রাণ হারাতে হল।
অন্যান্য দুর্ঘটনা
ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনাটি ছিল ১৯৭৭ সালের ২৭ মার্চ স্পেনের তেনেরিফে দ্বীপে। তেনেরিফে বিমানবন্দরের রানওয়েতে দুটি বোয়িং ৭৪৭ বিমানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫৮৩ জন যাত্রী প্রাণ হারান। ঘন কুয়াশার কারণে নেদারল্যান্ডসের কেএলএম এবং যুক্তরাষ্ট্রের পান আম বিমান দুটির পাইলটরা একে অপরকে দেখতে পাননি। যার ফলেই এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে।
বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০০১ সালের পহেলা জুন। এয়ারফ্রান্স ফ্লাইট-৪৪৭ রিও ডি জেনেরো থেকে প্যারিসের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে আটলান্টিক মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয়। সেই মর্মান্তিক ঘটনায় ২২৮ জন প্রাণ হারায়। এই দুর্ঘটনার মূল কারণ ছিল বিমানটির পিটোট টিউবের ত্রুটি। এই পিটোট টিউবের মাধ্যমে প্লেনে বাতাসের দ্রুতি মাপা হয়।
আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ার সময় এগুলো ঠান্ডায় জমে যায়। ফলে হঠাৎ করে অটোপাইলট বন্ধ হয়ে যায়। পাইলটরা পরিস্থিতি সামলাতে না পারায় বিমানটি ভারসাম্য হারায় এবং ৩৫,০০০ ফুট থেকে সমুদ্রে আছড়ে পড়ে।
পাইলটের দক্ষতা
অনেক সময় বিমানে কোনো ত্রুটি দেখা দিলেও দক্ষ পাইলটের কারণে সেটি সরাসরি মাটিতে আছড়ে পড়ে না। পাইলট পরিস্থিতি সামলে বেলি ল্যান্ডিং করাতে সক্ষম হন। বেলি ল্যান্ডিং মানে হলো, বিমানটির চাকা না নামিয়ে মূল বডি দিয়েই রানওয়েতে অবতরণ করানো। তবে এতে বিমান আর রানওয়ের মধ্যে প্রচণ্ড ঘর্ষণ হয়, যা থেকে আগুন ধরে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
অনেক সময় অন্যান্য ত্রুটির কারণে বিমানে আগুন ধরে থাকে। গত ডিসেম্বরে কানাডার বিমানে অগ্নিকান্ড অনেকটা এরকমভাবেই হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় ল্যান্ডিং গিয়ারের সমস্যা থাকায় বিমানে আগুন ধরে যায়। সৌভাগ্যবশত এই দুর্ঘটনায় কোন প্রাণহানি ঘটেনি।
বিশ্বব্যাপী ম্যাটেরিয়ালস বিজ্ঞানীরা বিমানের মূল কাঠামো তৈরির জন্য এমন উপাদান তৈরি করার চেষ্টা করছেন যাতে দুর্ঘটনার পর বিমানে আগুন ধরে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করা যায়।
বিমান দুর্ঘটনার সমাধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি হলো, প্রতিটি দুর্ঘটনার সঠিক কারণ নির্ণয় করা এবং সেই তথ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। তবে, দুর্ভাগ্যবশত অনেক সময়ই কতৃপক্ষ নিজেদের দোষ আড়াল করার জন্য জাল রিপোর্ট দেয়। এর ফলে সঠিক সমস্যা চিহ্নিত করা যায় না, আর সেই সাথে কার্যকর সমাধানও অনিশ্চিত থেকে যায়।
বিমান ভ্রমণ কতটা নিরাপদ?
বিমান দুর্ঘটনার নিয়ে এত আলোচনার পর হয়তো মনে হচ্ছে, আকাশপথে যাত্রা করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সত্যিকার অর্থে সড়ক পথের চেয়ে আকাশ পথে ভ্রমণ অনেক বেশি নিরাপদ। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি যাত্রী বিমান ভ্রমণ করেন, কিন্তু দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা খুবই কম।
সড়ক পথে যাতায়াতে প্রতি ১০০ মিলিয়ন মাইল ভ্রমণে ১.৪২ জন নিহত হয়। অন্যদিকে আকাশ পথে প্রতি ১০০ মিলিয়ন মাইল ভ্রমণে ০.০৭ জন নিহত হয়। তারমানে বিমান ভ্রমণ গাড়ির তুলনায় প্রায় ২০০ গুণ বেশি নিরাপদ।
প্রতিদিন যে পরিমাণ বিমান আকাশে চলাচল করে, সেই তুলনায় বিমান দুর্ঘটনা খুবই বিরল এবং বিমান ভ্রমণ বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ভ্রমণ মাধ্যমগুলোর মধ্যে একটি।