ভূমিকা
মুসলিমদের জীবনের এক বিশেষ আধ্যাত্মিক সফর হজ্জ। প্রতি বছর পৃথিবীর সকল দেশ থেকে আগত প্রায় ৩০ লক্ষ মুসলিম হজ্জ পালন করেন। তাই হজ্জ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানব সমাবেশ হিসেবে বিবেচিত। ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি লোক হজ্জ পালন করতে যায়। হজ্জ পালনে শীর্ষ ৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান পঞ্চম।
হজ্জের উৎপত্তি
হজ্জ ইসলামের ৫ টি মূল স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। হজ্জের আভিধানিক অর্থ ‘কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করা, ‘সংকল্প করা’বা ‘চক্রাকারে প্রদক্ষিণ করা’। ইসলামের পরিভাষায় হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর দেখানো প্রক্রিয়ায়, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত থেকে নির্ধারিত কাজ সম্পাদন করার নামই হজ্জ। শারিরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থবান মুসলিমদের উপর জীবনে অন্তত একবার হজ্জ পালন করা আবশ্যক।
হিজরী বর্ষপঞ্জির সর্বশেষ মাস জিলহজ্জের ৮ থেকে ১২ তারিখ হল হজ্জের জন্য নির্ধারিত সময়। বর্তমানে প্রচলিত হজ্জ হযরত মুহাম্মদ (স) এর দেখানো পথে পালন করা হলেও, আল্লাহর নির্দেশে সকলের জন্য হজ্জের প্রবর্তন করেন হয়রত ইব্রাহিম (আ)। হয়রত ইব্রাহিম (আ) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ) পবিত্র কাবা শরীফ পুনঃনির্মান করে হজ্জ পালন করেন। এরপর থেকে প্রতিবছর দূরদূরান্ত থেকে বহু লোক হজ্জ পালন করতে কাবা শরীফে একত্রি হয়। মুসলিমরা কিভাবে হজ্জ পালন করবেন, তার পূর্নাঙ্গ প্রক্রিয়া হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর বিদায়ী হজ্জে দেখিয়ে গিয়েছেন।
হজ্বকালীন সার্বিক অবস্থাকে বলা হয় ইহরাম; যার প্রধান চিহ্ন হলো দুই খন্ড সেলাইবিহীন সাদা কাপড়। ইহরাম পরিধানের কিছু নির্দ্দিষ্ট স্থানকে বলা হয় মিকাত। মিকাত অতিক্রমের আগেই ইহরাম করতে হয়। ইহরাম হল সৃষ্টিকর্তার কাছে সকলের সমতা ও একতার প্রতীক। ইহরামে থাকা অবস্থায় সবাই সমান, কে ধনী কে গরিব বাইরে থেকে দেখে তা বোঝার কোন উপায় নেই।
ইহরামের পর থেকে তালবিয়াহ নামক দোয়া পাঠ করা হয় এবং এই দোয়া পুরো হজ্জ ব্যপী জারি থাকে। তালবিয়াহ হলো-‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইকা। ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা লাকা ওয়াাল মুলকা লা-শারীকা লাক। এর অর্থ হলো, হে আল্লাহ, আমি হাজির আছি, আমি হাজির আছি। আপনার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির আছি। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নেয়ামত আপনারই এবং সমগ্র বিশ্বজাহান আপনার। আপনার কোনো শরীক নেই।
উমরাহ
হজ্জের মতই বিশেষ এক তীর্থ যাত্রা হল উমরাহ। হজ্জের সাথে উমরার সাদৃশ্য থাকলেও; হজ্জের গুরুত্ব উমরার চেয়ে অনেক বেশি। ফরজ হজ্জের জন্য বছরের নির্ধারিত সময় থাকলেও, উমরার জন্য কোনো দিন-তারিখ নির্দিষ্ট নেই। উমরা বছরের যেকোন সময় করা যায়। আরবি ভাষায় উমরা শব্দের অর্থ হল জনবহুল স্থানে ভ্রমণ করা। ইসলামি পরিভাষায় উমরা বলতে, ইহরাম অবস্থায় কাবার চারপাশে তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সায়ী করা বা দৌড়ানোকে বোঝায়।
হজ্জ ও উমরাহ পালনের পরম্পরার ভিন্নতার জন্য হজ্জ তিন প্রকার হতে পারে। যেমন: ১. হজ্জে ইফরাদ ২. হজ্জে কেরান এবং ৩. হজ্জে তামাত্তু। হজ্জে ইফরাদ হল, শুধুমাত্র হজ্জের উদ্দেশ্যে ইহরাম করা। হজ্জে কিরান হল, হজ্জ ও উমরা উভয়ের উদ্দেশ্যে এক সঙ্গে ইহরাম করা; এক্ষেত্রে প্রথমে উমরা সম্পাদন করে পরে হজ্জ করতে হয়। এবং হজ্জে তামাত্তু হল, প্রথমে শুধু উমরার উদ্দেশ্যে ইহরাম করা ও উমরা শেষে ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে, পুনরায় হজ্জের ইহরাম করে হজ্জ সম্পাদন করা।
হজ্জের গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ হল তাওয়াফ। তাওয়াফ হল মসজিদুল হারামের কেন্দ্রে অবস্থিত ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান কাবা কে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করা। হজ্জের শুরুতে এবং শেষে হাজীরা ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ৭ বার কাবা ঘর প্রদক্ষিণ করেন।
হজের মূল কাজ
হজের মূল কাজ শুরু হয় ৮ জিলহজ এবং শেষ হয় ১২ জিলহজ। এ পাঁচ দিনের ফরজ ও ওয়াজিব কাজগুলো হাজীদের সচেতনতার সাথে যথার্থভাবে আদায় করতে হয়। ৮ জিলহজ হাজিদের মক্কার কাছাকাছি একটি উপশহর মিনায় পৌঁছাতে হয়। মিনা তাবুর শহর হিসেবেও পরিচিত। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। মক্কা থেকে আরাফাতের দিকে যাওয়ার রাস্তার পাশে প্রায় ২০ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে মিনার অবস্থান। এখানকার লক্ষাধিক তাবুতে হাজিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
৯ জিলহজের সকালে মিনা থেকে রওনা হয়ে আরাফাতের প্রান্তরে পৌঁছতে হয়। সেদিন সূর্যাস্তের পর হাজিরা আরাফা থেকে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা হন। ৯ তারিখের দিবাগত রাতে মুজদালিফায় বিশ্রাম নিয়ে, সূর্যোদয়ের আগেই আবার মিনার উদ্দেশে যাত্রা করতে হয়।
১০ জিলহজের কাজ হল শুধুমাত্র শয়তানের বড় স্তম্ভে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করা। পাথর মারার পর কুরবানির নির্দিষ্ট নিয়মে হাজিরা কুরবানি সম্পন্ন করেন। কোরবানি করার পর পুরুষেরা মাথা কামিয়ে ফেলে এবং নারীদের চুলের অংশ বিশেষ ছাঁটতে হয়। ১০ জিলহজ মাথা মুন্ডনের পরই ইহরাম অবস্থার অবসান ঘটে। এসমস্ত কাজ শেষে সেদিন কাবা শরীফ তাওয়াফ করতে হয়। অবশ্য ভিড় এড়ানোর জন্য এ তাওয়াফ ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিলম্বিত করা যেতে পারে।
১১ জিলহজে হাজীরা শয়তানের তিনটি স্তম্ভে সাতটি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করেন। ১২ জিলহজে আবারো শয়তানের তিনটি স্তম্ভে সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারতে হয়। ১১ ও ১২ তারিখে পাথর মারার সময় ছোট থেকে বড় স্তম্ভের দিকে যেতে হয়। ১২ তারিখের পর একজন হাজী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
মদিনা সফর
একজন হাজী হজের আগে মদিনায় না গেলে, হজ্জ পরবর্তী সময়ে মদিনায় গিয়ে আট দিন অবস্থান করতে হয় এবং মসজিদে নববীতে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হয়। মদিনায় যাওয়া যদিও হজের অংশ নয়। তবুও বিনা কারণে মদিনায় না যাওয়া রাসূল (সা) এর সাথে বেয়াদবির সামিল। হজের পরে মক্কা শরিফে অবস্থান কালে হাজিরা একাধিক ওমরা পালন করতে পারেন। হজ্জ থেকে নিজ দেশে ফেরার আগে হাজীদেরকে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয়, এটিও হজ্জের গুরুত্বপূর্ন অংশ।
হজ্জ সম্পাদন করতে পারা প্রতিটি মুসলিমের জীবনের বিশেষ অর্জন। হজ্জ শুধুমাত্র ধনীদের জন্য ফরজ হলেও, বহু দরিদ্র মুসলিম জীবনে একবার হজ্জ করার উদ্দেশ্যে সারাজীবন একটু একটু করে অর্থ সঞ্চয় করেন। বাংলা অঞ্চলে মুসলিম বিজয় ও ইসলাম প্রচারের পর থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা হজ্জ পালন করে আসছেন। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের মুসল্লিগণ ভারতের মুম্বাই হয়ে, জাহাজে চড়ে হজ্জ করতে যেতেন। যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে মুম্বাই পর্যন্ত গিয়েই অনেকে অসুস্থ হয়ে ফিরে আসতেন; তাঁদের বলা হতো মুম্বাই হাজী।
বৃহত্তম মানব সমাবেশ
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রায় লক্ষাধিক মুসলিম প্রতিবছর হজ্জ পালন করতে যায়। হজ্জ পালনে শীর্ষ ৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান পঞ্চম। প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি লোক হজ্জ করতে যায় ইন্দোনেশিয়া থেকে। শীর্ষ তালিকায় থাকা অন্যান্য দেশগুলো হল পাকিস্তান, ভারত ও মিশর। বাংলাদেশ থেকে হজ্জ যাত্রার বাইরেও, সৌদি আরব প্রবাসী বহু বাংলাদেশী প্রতিবছর হজ্জ পালন করে থাকেন।
হজ্জের মৌসুমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই মানব সমাবেশের ভিড় সামলাতে, প্রায় ১ লক্ষ নিরাপত্তা কর্মী এবং ২৫ হাজার চিকিৎসা সেবী নিয়োজিত থাকে। একই সময়ে একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে লক্ষ লক্ষ হাজী অবস্থান করায়, হজ্জের প্রায় সবগুলো আচার পালন করতে গিয়েই প্রচন্ড ভিড়ের সৃষ্টি হয়। অতীতে বহুবার ভিড়ের মধ্যে পদদলিত হয়ে বহু সংখ্যক হাজী মৃত্যু বরণ করেছেন।
১৯৯০ সালে এরকমই এক দুর্ঘটনায় প্রায় ১৪২৬ জন হাজী পদদলিত হয়ে মারা যায়। সর্বশেষ বড় দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে, সেবছর প্রায় ৭০০ জন হাজী দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া বর্তমানে গৃষ্মকালের অত্যধিক গরমে প্রতিবছরই কিছু সংখ্যক হাজী আহত ও নিহত হবার মত ঘটনা ঘটে।
হজ্জে মারাত্নক দুর্ঘটনার পাশাপশি নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে এক নীরব বিশৃঙ্খলা, আর তা হল সেলফি। ইসলামি পন্ডিতরা মনে করছেন, হজ্জ পালন করতে গিয়ে সেলফি তোলা কিছুতেই উচিত নয়, কারণ হজ্জ হল সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য অর্জনের সফর, এবং হাজীদেও সেই ধ্যানমগ্নতার মধ্যেই অবস্থান করা উচিত। এই প্রেক্ষিতে পবিত্র কিছু স্থানে ক্যামেরা বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তোলা ও ভিডিও করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এই নিয়ম অমান্য করলে ছবি তোলার যন্ত্রটি বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে। হাজীদেরকে তাঁদের আধ্যাতিক যাত্রার প্রতি মনোযোগী রাখতেই এই নিষেধাজ্ঞা আনা হয়েছে।