Author name: MD Abdul Aowal

জীবনযাপন

ভারত বনাম পাকিস্তান সামরিক শক্তিতে কে এগিয়ে

ভূমিকা ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার মধ্যেই রয়েছে। কাশ্মির ইস্যু, সীমান্ত সংঘাত এবং পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা উভয় দেশের সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন যে, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে কে জিতবে? এর উত্তরটা আসলে বেশ জটিল। দুই দেশের সামরিক জনবল, অস্ত্রশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বাজেট, পারমাণবিক ক্ষমতা, এবং কৌশলগত নীতি ও অবস্থান সহ আরো বেশ কিছু বিষয়ের উপর যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে। ভারত-পাকিস্তানের তুলনা সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনকি সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সামরিক শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের পরেই ভারতের অবস্থান। ২০২৫ সালের গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃত। এই সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান ১২ তম। তারমানে সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে ৮ ধাপ এগিয়ে। তবে সেই অর্থে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি ভারতের তুলনায় একেবারেও দুর্বল নয়। ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট মাত্র ৭.৬৪ বিলিয়ন ডলার। তারমানে ভারতের প্রতিক্ষা বাজেট পাকিস্তানের প্রায় ১০ গুণ বেশি। তবে ভারত বনাম পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজর্ভের দিকে তাকালে বিষয়টি খুব বেশি অস্বাভাবিকও লাগবে না। কারণ ভারতের রিজার্ভ ৬২৭ বিলিয়ন ডলার অন্যদিকে পাকিস্তানের রিজার্ভ আছে মাত্র ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার। জনসংখ্যার দিক থেকেও ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ভারতে জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। ২০২২ সালে, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি।  । সামরিক শক্তির তুলনা আধুনিক সামরিক শক্তি মূলত প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, কৌশল এবং অস্ত্রের মানের ওপর নির্ভর করে। সেনা সদস্যের সংখ্যা একটি দেশের সামরিক সক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি সামগ্রিক সামরিক শক্তি নির্ধারণের একমাত্র সূচক নয়। ভারতের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ ৫৫ হাজার, অন্যদিকে পাকিস্তানের সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ ৫৪ হাজার। ভারতের রিজার্ভ সৈন্য ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার এবং পাকিস্তানের রিজার্ভ সৈন্য ৫.৫ লক্ষ। ভারতের আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লক্ষ ২৭ হাজার এবং পাকিস্তানের আধা-সামরিক বাহিনীতে প্রায় ৫ লক্ষ সদস্য রয়েছে। ভারতের ট্যাংকের সংখ্যা ৪ হাজার ২০১টি, পাকিস্তানের ট্যাংক আছে ২ হাজার ৬২৭টি। ভারতের সাঁজোয়া যান আছে ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৯৪ টি, পাকিস্তানের সাঁজোয়া যান আছে ১৭ হাজার ৫১৬টি। ভারতের বিমান বাহিনীতে মোট বিমানের সংখ্যা ২ হাজার ২২৯ টি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মোট বিমান ১ হাজার ৩৯৯টি। ভারতের যুদ্ধ বিমান আছে ৫১৩টি; পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমান ৩২৮টি। এট্যাক হেলিকপ্টার সহ ভারতের মোট হেলিকপ্টার আছে ৮৯৯ টি, পাকিস্তানের আছে ৩৭৩টি হেলিকপ্টার। এছাড়া ভারতের পরিবহন বিমান ২৭০ টি এবং পাকিস্তানের পরিবহণ বিমান ৬৪ টি। ভারতের কাছে ফ্রান্সের তৈরী রাফাল যুদ্ধবিমানের মত আধুনিক বিমান আছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে থাকা সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান হল, চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত JF-17 Thunder যুদ্ধবিমানের সর্বশেষ সংস্করণ Block III। তবে ভারতেও নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত তেজস সিরিজের বেশ কয়েকটি মডেলের উন্নত যুদ্ধবিমান রয়েছে। লজিসস্টিকসের দিক থেকে ভারতের বিমানবন্দর আছে ৩১১টি আর পাকিস্তানের আছে ১১৬টি। ভারতীয় নৌ বাহিনীতে মোট নৌযানের সংখ্যা ২৯৩ টি। পাকিস্তান নৌ বাহিনীর মোট নৌযানের সংখ্যা ১২১টি। ভারতের ফ্রিগেট যুদ্ধ জাহাজ আছে ১৪ টি, পাকিস্তানের ৯টি। ভারতের ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধ জাহাজ আছে ১৩ টি। কিন্তু পাকিস্তানের কোন ডেস্ট্রয়ার নেই। ছোট আকারের করভেট যুদ্ধ জাহাজ ভারতের আছে ১৮টি আর পাকিস্তানের ৯টি। ভারতের সাবমেরিন আছে ১৮টি, পাকিস্তানের ৮টি। এছাড়া ভারতের টহল নৌযান আছে ১৩৫টি এবং পাকিস্তানের টহল নৌযান আছে ৬৯টি। এসবের বাইরে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই পারমানবিক অস্ত্রভান্ডার আছে। ভারতের কাছে আনুমানিক ১৭২টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে ১৭০টি। ভারত “No First Use” অর্থাৎ প্রথমে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার নীতিতে অটল। তারমানে ভারত শুধুমাত্র আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। কিন্তু পাকিস্তান “No First Use” নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়; তারা অস্তিত্বগত হুমকির মুখে প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য ভূমি-ভিত্তিক Agni সিরিজ, সমুদ্র-ভিত্তিক Arihant শ্রেণির সাবমেরিন, এবং বিমান-ভিত্তিক একাধিক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য Shaheen ও Ghaznavi সিরিজের ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে। তবে পাকিস্তান এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যেই পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ২০০-২৫০ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। উপরের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয় যে সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে রয়েছে। তবে পাকিস্তান পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পারমানবিক অস্ত্রের ব্যবহারের নীতিমালার দিক থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। কে এগিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বারবার গণতন্ত্রের ব্যাঘাত ঘটেছে। দেশটি বেশিরভাগ সময়ই সামরিক বাহিনীর শাসনে পরিচালিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশের রাজনীতি, প্রশাসন এমনকি অর্থনীতির একটি বড় অংশও নিয়ন্ত্রণ করে। সেনাবাহিনীর রয়েছে নিজস্ব ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, ব্যাংক, আবাসন প্রকল্প, এমনকি খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণনেও তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে যুদ্ধ বা সংঘাতের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা একটি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরী। অন্যদিকে, ভারত অন্তত কাগজে কলমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই যুদ্ধের নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে, এবং সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণে বিভিন্ন স্তরের পর্যালোচনা দরকার হয়। ভারতের একটি জটিল চ্যালেঞ্জ হল তাদের সামরিক শক্তির বড় একটি অংশ চীন সীমান্তে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশ এলাকায় ভারত চীনের দিক থেকে বরাবরেই চাপের মধ্যে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশাল স্থল সীমান্ত, সেটিও কৌশলগতভাবে অনেকটাই সংবেদনশীল। গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে, কারণ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশকে “মিত্র” রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করলেও, এখন ভারত নীতিগতভাবে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার সেভেন সিস্টার্স সম্পর্কিত বক্তব্যের পর থেকে। অন্যদিকে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের আরো এটি বড় সুবিধা রয়েছে। আর তা হল পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন। ভারত-চীন সম্পর্ক বরাবরই টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীন ও পাকিস্তানের দ্বৈত চাপ ভারতের কৌশলগত অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে। এছাড়াও, পাকিস্তান তুলনামূলক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও, তারা দীর্ঘদিন ধরে সামরিক খাতে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করে চলেছে শুধুমাত্র ভারতকে মোকোবেলা করার জন্য। তাই পাকিস্তান না খেয়ে হলেও ভারতকে দমন করার বিষয়ে কোন ছাড় দিতে চাইবে না। প্রথাগতগত যুদ্ধে যদি পাকিস্তানের অবস্থান ভেঙেও পড়ে, সেক্ষেত্রে পাকিস্তান ভারতের আগে পারমানবিক হামলা চালাতে পারে। সব মিলিয়ে, ভারত সামরিক সংখ্যার বিচারে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকলেও, একসাথে সব শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কারণ চীন, বাংলাদেশ, এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা – এই তিনটি ফ্রন্টে ভারতকে সমানভাবে নজর রাখতে হয়। তাই পাকিস্তানকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করা ভারতের জন্য কখনোই খুব সহজ কাজ নয়।

বাংলাদেশ

মানবিক করিডোর আসলে কী

ভূমিকা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গৃহযুদ্ধের কারণে যে মানবিক সংকট তৈরী হয়েছে, তা মোকাবিলা করার জন্য একটি মানবিক করিডোরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মানবিক করিডোরের ব্যাপারে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। তখন বিষয়টি নিয়ে বিএনপি, জামাত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল সমালোচনা শুরু করলে; পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন যে, জাতিসংঘের সাথে এ বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সরকারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে মানবিক করিডোরের বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরী হয়েছে। করিডোর কী? করিডোর হলো একটি নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিরাপদে ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণত আন্তর্জাতিক বা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়। মোটাদাগে করিডোর কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ১. বাণিজ্যিক করিডোর ২. মানবিক করিডোর এবং ৩. সামরিক করিডোর। দুটি অঞ্চলের মধ্যে অবাধে পণ্য ও বাণিজ্য সরবরাহের জন্য বাণিজ্যিক করিডোর নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)। কোন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় খাদ্য, ওষুধ বা ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর তৈরী করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া এবং ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধে মানবিক করিডোর স্থাপনের নজির আছে। অন্যদিকে সামরিক করিডোর হলো এমন নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা সামরিক বাহিনী, অস্ত্র, সরঞ্জাম বা সৈন্য পরিবহনের জন্য নিরাপদে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সৌদি আরব থেকে ইরাক ও কুয়েত সীমান্তের সড়কপথ যুক্তরাষ্ট্র সামরিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানবিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক করিডোর ছাড়াও অন্যান্য ধরনের করিডোর রয়েছে। যেমন: বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য পরিবেশগত করিডোর, রেল ও সড়ক যোগাযোগের জন্য পরিবহন করিডোর, তেল গ্যাস বা িবদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জ্বালানী বা শক্তি করিডোর, ফাইবার অপটিক কেবল, সাইবার নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল/তথ্য করিডোর এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ ও পর্যটন উন্নয়নের জন্য শিক্ষা/সাংস্কৃতিক করিডোর ইত্যাদি। মানবিক করিডোর কী? কোন সংঘাতপূর্ণ বা দুর্যোগ-আক্রান্ত এলাকায়, খাদ্য, ওষুধ, পানি বা চিকিৎসা সরঞ্জামের মত জরুরি ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর ব্যবহৃত হয়। এটি বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষা এবং মানবিক সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে স্থাপিত হয়। কখনো কখনো এই করিডোর বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হয়। মানবিক করিডোর সাধারণত জাতিসংঘ (UN) বা অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এবং সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে কার্যকর হয়। মানবিক করিডোরের প্রধান উদ্দেশ্য হলো: ১. ত্রাণ সরবরাহ ২. বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ৩. মানবাধিকার রক্ষা এবং ৪. নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সংকটগ্রস্ত জনগণ যেন দুর্ভিক্ষ, অনাহার বা স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি না হয় সেই লক্ষ্যে মানবিক করিডোর স্থাপন করা হয়। অবরুদ্ধ বা সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার আগে পরে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন নিশ্চিত করাও একটি উদ্দেশ্য। সেই সাথে ত্রাণ বিতরণে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়া সকল পক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যক্তির কাছে সহায়তা পৌঁছানোও গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। মানবিক করিডোরের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখেযোগ্য হল, করিডোরে সামরিক কার্যক্রম বা অস্ত্রের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা। করিডোরে ত্রাণ পরিবহন বা নাগরিকদের স্থানান্তরের সময় যেন নতুন করে কোন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরী না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা। সাধারণত জাতিসংঘ বা রেড ক্রস (ICRC) এর মত নিরপেক্ষ সংস্থাগুলো এটি পরিচালনা করে। তাই এমন কোন বিতর্কিত পক্ষ বা সংস্থাকে মানবিক করিডোরে প্রবেশাধিকার না দেওয়া, যাতে করে নতুন করে সংঘাত তৈরী হয়। কারণ এই ব্যবস্থার অন্যতম শর্তই হল যুদ্ধবিরতি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে করিডোরকে হামলামুক্ত রাখা। মানবিক করিডোর আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে পরিচালিত হয়, যা জেনেভা কনভেনশন (1949) এবং এর অতিরিক্ত প্রটোকল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইন অনুযায়ী ত্রাণ কর্মী ও কনভয়ের উপর হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কগজে কলমে মানবিক করিডোরকে বিভিন্নভাবে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও, অনেক সময় ত্রাণ সামগ্রী সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে যেতে পারে। ত্রাণ বিতরণে কিছু গোষ্ঠী বঞ্চিত হতে পারে, যা আরো বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করে। রাখাইনে মানবিক করিডোর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে ত্রাণ সামগ্রী রাখাইনের বেসামরিক জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়। বাংলাদেশ সরকার শর্তসাপেক্ষে এই করিডোর দেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। চুক্তির শর্তগুলোর বিস্তারিত জনসমক্ষে প্রকাশ না করায় রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্তের ব্যাপারে জানা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ত্রাণ সরবরাহ শুধুমাত্র জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। ত্রাণ যেন সরাসরি রাখাইনের নাজুক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় এবং আরাকান আর্মি বা মিয়ানমার জান্তার মত কোনো সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেন এটি দখল করতে না পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল করিডোর যেন রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে আরও জটিল না করে বা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি না বাড়ায়। এবং সকল জাতিগত গোষ্ঠী, বিশেষ করে রোহিঙ্গা, রাখাইন এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে ন্যায্যভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। মানবিক করিডোর বাস্তবায়নে চুক্তির শর্ত হিসেবে এসব বিষয় আলোচনা করা হলেও, বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। রাখাইনের বেশিরভাগ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, যারা একটি রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র গোষ্ঠী। ত্রাণ সামগ্রী তাদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। করিডোরের ফলে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এমনকি বিগত কয়ক মাসে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশও করেছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঝুঁকি জাতিসংঘের মাধ্যমে এই মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মূলত একটি আন্তর্জাতিক কৌশলের অংশ, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই করিডোর ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র চায় আরাকান আর্মিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করতে। কারণ, চীন ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে, রাখাইনকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভূক্ত করেছে। যার ফলে চীন এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে বঙ্গোপসারগ সহ ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে এখানে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাখাইনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে চীনের প্রভাবকে ভারসাম্যহীন করার চেষ্টা করতে পারে। জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাখাইনের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেও সহায়তা পাঠাতে পারে। কিন্তু তারা করিডোর ব্যবহারের পন্থা বেছে নিয়েছে, কারণ মানবিক করিডোর একটি ছদ্মবেশী কৌশল হতে পারে। যাতে ভবিষ্যতে এখানে পরিস্থিতি আরো জটিল হলে; আন্তর্জাতিক মঞ্চে কেউ জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে না পারে। উল্টো বাংলাদেশ, ভারত, চীন বা অন্য কোন পক্ষের উপর দায় চাপানো যায়। জাতিসংঘের নিরপেক্ষতার আড়ালে এই ধরনের আন্তর্জাতিক চালবাজি, বিশ্বের যে কোন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলেই একটি সাধারণ ঘটনা। এভাবেই বিশ্ব রাজনীতির খেলায় ‘মানবিক সাহায্য’ নামের আড়ালে গভীর কৌশল লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের জন্য মানবিক করিডোর একটি জটিল দ্বিধার জায়গা। একদিকে, করিডোরে সম্মতি দিলে হয়ত দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। আবার অন্যদিকে করিডোরে অসম্মতি জানালেও আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে দায়ী করে রোহিঙ্গা সংকটকে আরও ঘোলাটে করতে পারে। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি বোঝা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য

কি কেন কিভাবে

পোপকে কোথায় এবং কিভাবে সমাহিত করা হয়েছে

ভূমিকা রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। পোপদেরকে সাধারণত ভ্যাটিকান সিটিতে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নিচে সমাহিত করা হয়। তবে পোপ ফ্রান্সিসকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ভ্যাটিকানের বাইরে অবস্থিত রোমের ব্যাসিলিকা ডি সান্তা মারিয়া ম্যাজিওরে সমাহিত করা হয়েছে। বিগত ১২০ বছরের মধ্যে প্রথমবার কোনো পোপ কে ভ্যাটিকানের বাইরে সমাহিত করা হল। মৃত্যুর পর প্রস্তুতি পোপের মৃত্যুর পর তাঁর দেহকে সম্মানের সঙ্গে ধৌত করা হয় এবং পন্টিফিকাল ভেস্টমেন্ট নামের বিশেষ ধর্মীয় পোশাক পরানো হয়। এরপর তার দেহটি কয়েকদিন সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় রাখা হয় যাতে বিশ্বাসী ও ভক্তরা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। সমাধিস্থ করার আগে পোপের দেহ একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়, যা পরে সীসা ও আরেকটি কাঠের কফিনে সিল করা হয়। কফিনে পোপের নাম, তার রাজত্বের সময়কাল এবং অন্যান্য তথ্য খোদাই করা থাকে। এরপর কফিনটি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ক্রিপ্টে বা পোপের নির্দেশিত স্থানে সমাহিত করা হয়। সমাধির আগে ফিউনারেল মিসা নামে একটি বিশেষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কার্ডিনালরা ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থাকেন। পোপ ফ্রান্সিস ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর দেহকে সান্তা মার্তার চ্যাপেলে একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়। তিনি পোপদের জন্য ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী তিনটি কফিনের পরিবর্তে একটি সাধারণ কফিনে তার দেহ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কফিনে তাঁর শাসনকালের কয়েন, মেডেল এবং তাঁর ১২ বছরের পোপত্বের মূল বিষয়গুলোর একটি দলিল রাখা হয়। ২৩ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর দেহ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ২৬ এপ্রিল সকাল ১০টায় সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে কার্ডিনাল জিওভান্নি বাত্তিস্তার নেতৃত্বে  পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মিসা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২২০ জন কার্ডিনাল, ৭৫০ জন বিশপ এবং ৪,০০০-এর বেশি পুরোহিত অংশ নেন। এই মিসায় সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নেন। বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনুসও পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস কে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে পূর্বে মোমবাতি রাখার একটি কক্ষ ছিল। পোপ নিজেই এই জায়গাটি তার সমাধির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। পোপদের সাধারণত ভ্যাটিকানে সমাহিত করা হলেও, পোপ ফ্রান্সিস নিজেই সান্তা মারিয়া ম্যাজিওর বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ২০২২ সালে বলেছিলেন, ভার্জিন মেরি তাঁকে এখানে সমাধিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসের এই ব্যাসিলিকার প্রতি গভীর ভক্তি ছিল, বিশেষ করে এখানে অবস্থিত মেরি সালুস পপুলি রোমানি আইকনের প্রতি। তিনি তাঁর ৪৭টি আন্তর্জাতিক সফরের আগে ও পরে এবং হাসপাতালে ভর্তির পর এখানে প্রার্থনা করতেন। অতীতে তিনি কার্ডিনাল হিসেবেও রোম ভ্রমণ করলে এই গির্জায় বেড়াতে আসতেন। পোপ ফ্রান্সিসের সাদামাটা জীবন পোপ ফ্রান্সিস এর আসল নাম জর্জ মারিও বের্গোগ্লিও। তিনি ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত রোমান ক্যাথলিক চার্চের একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় সোসাইটি অফ জিসাস বা জেসুইটের সদস্য ছিলেন। জেসুইটরা অত্যন্ত সরল ও বিনয়ী জীবন যাপন করে। পোপ ফ্রান্সিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। পোপদের থাকার জন্য একটি রাজকীয় প্রাসাদ রয়েছে। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস পোপ নির্বাচিত হবার পর ভ্যাটিকানের অ্যাপোস্টলিক প্যালেসের পরিবর্তে, সান্তা মার্তা নামের একটি গেস্টহাউসে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এটি একটি সাধারণ বাসস্থান, যার মধ্যে ছিল একটি শোবার ঘর, বাথরুম এবং অধ্যয়ন কক্ষ। পোপ ফ্রান্সিস ঐতিহ্যবাহী পোপের পোশাকের তুলনায় সাধারণ পোশাক পছন্দ করেতেন। তিনি বিলাসবহুল পোপের জুতোর পরিবর্তে সাধারণ কালো চামড়ার জুতো পরতেন। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যেমন ঘড়ি বা ব্যাগ, সবই সাধারণ এবং কোনটিই ব্যয়বহুল নয়। পোপ ফ্রান্সিস বিলাসবহুল গাড়ির পরিবর্তে সাধারণ গাড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার মনে হয় একজন পুরোহিতের বিলাসবহুল গাড়ি থাকা উচিত নয়। পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানেও গরিব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য খাবার, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলতেন, “একটি গির্জা যদি গরিবদের পাশে না থাকে, তবে তা গির্জা নয়।”পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বাস করতেন যে নেতাদের উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই তিনি িনজে বিলাসিতা পরিহার করে, গির্জার পুরোহিত ও বিশপদের বিলাসিতা ত্যাগ করে সাধারণ জীবনযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে অতীতে অধিকাংশ পোপ কিন্তু পোপ ফ্রান্সিসের মত এতটা বিনয়ী এবং সাদামাটা জীবন যাপন করতেন না। মধ্যযুগের পোপেরা ছিলেন ইউরোপের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তারা একেকজন ক্ষমতালোভী রাজা বা সম্রাটদের চেয়েও অনেক বেশি দুর্ণীতিগ্রস্ত ছিলেন।

কি কেন কিভাবে

নতুন পোপ কিভাবে নির্বাচন করা হয়

ভূমিকা ক্যাথলিক চার্চের ইতিহাসে পোপ নির্বাচন একটি পবিত্র ও ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়া। পোপের মৃত্যু বা পদত্যাগের পর একটি গোপন সভার মাধ্যমে নতুন পোপ নির্বাচিত হন। যিনি পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলে অনুষ্ঠিত এই প্রক্রিয়া কঠোর নিয়ম, গোপনীয়তা এবং আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ। ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরা গোপন ভোটের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নতুন পোপ নির্বাচন করেন। প্রাথমিক পদক্ষেপ পোপের মৃত্যু বা পদত্যাগের পর ভ্যাটিকানের পোপের আসন খালি থাকে, যাকে ল্যাটিন ভাষায় “সেদে ভাকান্তে” বলা হয়। এই সময়ে কার্ডিনালদের কলেজ ভ্যাটিকানের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে। একজন পোপ মারা যাবার পর ক্যামেরলেঙ্গো নামের ভ্যাটিকানের প্রশাসনিক প্রধান তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন। পোপের মৃত্যুর পর নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া কনক্লেভ নামে পরিচিত। এটি ক্যাথলিক চার্চের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি। কনক্লেভ শুরুর আগে ১৫-২০ দিনের একটি প্রস্তুতিমূলক সময় থাকে। এই সময়ের মধ্যে কার্ডিনালরা ভ্যাটিকানে সমবেত হন এবং প্রয়োজনীয় আলোচনা করেন। খ্রিস্টান প্রাদ্রী কার্ডিনাল কারা সেটি বোঝার জন্য খ্রিষ্টান পুরোহিতদের পদানুক্রম সম্পর্কে একটু জানা দরকার। ক্যাথলিক গির্জায় পুরোহিতদের পদবি তিনটি প্রধান স্তরে বিভক্ত: ১. ডিকন (Deacon), ২. প্রিস্ট (Priest), এবং ৩. বিশপ (Bishop)। ডিকন হলো গির্জার সর্বনিম্ন পুরোহিত পদ। তাদের উপরে থাকেন প্রিস্ট, যারা গির্জার দৈনন্দিন ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রিস্টদের প্রধানকে বলা হয় বিশপ। এবং একটি বৃহত্তর অঞ্চলের প্রধান বিশপকে বলা হয় আর্চ বিশপ। সাধারণত বিশপ বা আর্চবিশপদের মধ্য থেকে কার্ডিনাল নির্বাচিত হয়। কার্ডিনালরা গির্জার সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা, যারা পোপের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। বেশিরভাগ কার্ডিনাল বিশ্বব্যাপী গির্জার গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। সর্বোচ্চ মর্যাদার কার্ডিনালরা ভ্যাটিকান ও রোমের নিকটবর্তী এলাকার দায়িত্বে থাকেন। কার্ডিনালরাই মূলত পোপ নির্বাচনে ভোট দেন। তবে সকল কার্ডিনাল ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। শুধুমাত্র ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরাই পোপ নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে পারেন। তাদেরকে বলা হয় কলেজ অফ কার্ডিনালস। সাধারণত ১২০ জনের মতো সদস্য নিয়ে কলেজ অফ কার্ডিনালস গড়ে ওঠে। তবে এই সংখ্যা পরিবর্তিতও হতে পারে। কনক্লেভ ক্যাথলিক গির্জায় পোপ নির্বাচনের জন্য কনক্লেভ নামে যে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে কোনো আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন বা প্রার্থী হিসেবে নাম প্রস্তাবের ব্যবস্থা নেই। বরং, কার্ডিনালরা তাদের বিবেচনার ভিত্তিতে যেকোনো যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারেন। কনক্লেভের গোপনীয়তা এবং আধ্যাত্মিক প্রকৃতির কারণে মনোনয়ন প্রক্রিয়া এড়ানো হয়। বিশ্বাস করা হয় যে Holy Spirit বা পবিত্র আত্মা কার্ডিনালদের সিদ্ধান্তে পথপ্রদর্শন করে। কার্ডিনালরা কনক্লেভ শুরুর আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেন, একে জেনারেল কংগ্রিগেশন বলা হয়। এই আলোচনায় তারা গির্জার চ্যালেঞ্জ, প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের গুণাবলী, এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে কথা বলেন। কনক্লেভ অত্যন্ত গোপনীয়। তাই কার্ডিনালরা বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না। সিস্টিন চ্যাপেলে ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা বাইরের হস্তক্ষেপ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কনক্লেভ শুরুর আগে কার্ডিনালরা গোপনীয়তা রক্ষার শপথও নেন। কার্ডিনালরা গোপন ব্যালটে তাদের পছন্দের ব্যক্তির নাম লেখেন। ঐতিহাসিকভাবে, প্রায় সবসময়ই কার্ডিনালদের মধ্য থেকেই কাউকে নির্বাচিত করা হয়। প্রতিদিন সাধারণত দুই থেকে চার রাউন্ড ভোট হয়। পোপ নির্বাচিত হতে হলে কোনো ব্যক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ভোট প্রয়োজন। যদি একাধিক রাউন্ডে কেউ এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পান, তবে ভোট চলতেই থাকে। যদি কোনো প্রার্থী দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পান, তবে ভোটের কাগজপত্র পুড়িয়ে কালো ধোঁয়া তৈরি করা হয়, যা বাইরে থেকে দেখা যায়। এটি ইঙ্গিত করে যে পোপ নির্বাচিত হননি। যখন একজন প্রার্থী দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পান, তখন ভোটের কাগজপত্র পুড়িয়ে সাদা ধোঁয়া তৈরি করা হয়, যার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন পোপের ঘোষণা নির্বাচিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি পোপের দায়িত্ব গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কিনা। যদি তিনি সম্মত হন, তবে তিনি নতুন পোপ হিসেবে ঘোষিত হন। তখন নতুন পোপ তার ব্যক্তিগত নামের বাইরে একটি পোপীয় নাম গ্রহণ করেন। যেমন জর্জ মারিও পোপ হওয়ার পর তিনি পোপ ফ্রান্সিস নাম ধারণ করেছিলেন। এরপর সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার বারান্দায় কার্ডিনাল প্রোটোডিকন ঘোষণা করেন, “হাবেমুস পাপাম”। ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ “আমাদের পোপ আছেন”। এবং তারপর নতুন পোপের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়। তখন নতুন পোপ জনগণের উদ্দেশে তার প্রথম আশীর্বাদ প্রদান করেন। যাকে বলা হয় উর্বি এট অর্বি, এর অর্থ শহর ও বিশ্বের প্রতি আশীর্বাদ।

কি কেন কিভাবে

খাটাশের বিষ্ঠা থেকে বানানো হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি কফি

সূচনা বিশ্বের সবচেয়ে দামি কফি হিসেবে পরিচিত কপি লুয়াক। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই কফি উৎপাদন করা হয় গন্ধগকুল বা খাটাশের বিষ্টা থেকে। খাটাশের মল দিয়ে তৈরী এক কেজি কফির দাম প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। কপি লুয়াকের উৎপত্তি কপি লুয়াকের নামটি এসেছে ইন্দোনেশিয়ান শব্দ থেকে। যেখানে “কপি” অর্থ কফি এবং “লুয়াক” হলো খাটাশের স্থানীয় নাম। খাটাশের ভালো নাম হল গন্ধগকুল। তবে বাংলাদেশে এই প্রাণীটি খাটাশ নামেই বেশি পরিচিত। ইন্দোনেশিয়ার এই খাটাশ জাতীয় প্রাণীরা বহুকাল আগে থেকেই কফি বাগানে বিচরণ করত। ঔপনিবেশিক যুগে ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় কফি চাষ শুরু করেছিল। সেসময় স্থানীয় কৃষক ও শ্রমিকদের কফি বিন সংগ্রহ বা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়। তবে, তারা লক্ষ্য করেন যে বন্য খাটাশরা কফির ফল খায় এবং তাদের মলের মাধ্যমে আংশিক হজম হওয়া কফি বিন বের হয়ে আসে। ইন্দোনেশিয়ার কৃষকরা এই বিন সংগ্রহ করে পরিষ্কার করতেন এবং সেগুলো ভেজে কফি তৈরি করতেন। সেই কফির স্বাদ এতটাই অনন্য ছিল যে, পরবর্তীতে তা ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে খাটাশের বিষ্ঠা থেকে কফি উৎপাদন করাই এই অঞ্চলের কফি ব্যবসায়ীদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে যায়। উৎপাদন প্রক্রিয়া ইন্দোনেশিয়ার গন্ধগকুল কফি গাছের পাকা চেরি ফল খায়। তারা খাওয়ার জন্য সবচেয়ে মিষ্টি ও পাকা চেরি বেছে নেয়, যার ফলে এই কফির গুণগত মানও হয় অনেক ভালো। খাটাশের পাকস্থলীতে থাকা এনজাইম কফি চেরির বাইরের মাংসল অংশ হজম করে ফেলে। কিন্তু তারা ভেতরের বিন হজম করতে পারে না। তবে তাদের পেটের মধ্যে বিনের প্রোটিন ভেঙে যায়, যা কফির স্বাদে একটি অনন্য মসৃণতা ও বিশেষত্ব যোগ করে। কৃষকরা বনের মাটি থেকে গন্ধগোকুলের মল সংগ্রহ করে। তারপর সেগুলো ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। এরপর পরিষ্কার বিন শুকানো হয়, ভাজা হয় এবং শেষধাপে প্যাকেজিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়। অধুনিক সময়ে কিছু খামারে খাঁচার মধ্যে গন্ধগকুল পালন করে তাদের কফি চেরি খাওয়ানো হয়। এরপর সেখান থেকে মল সংগ্রহ করে কপি লুয়াক উৎপাদন করা হয়। বাজার মূল্য কফি প্রেমীরা বলে কপি লুয়াকের স্বাদ বিশ্বের অন্যান্য কফির থেকে আলাদা। খাটাশের হজম প্রক্রিয়ার কারণে কফির তিক্ততা অনেক কমে যায়, ফলে এটি অত্যন্ত মসৃণ ও নরম স্বাদের হয়ে থাকে। এর অ্যাসিডিটি তুলনামূলকভাবে কম, যা এটিকে পাকস্থলীর জন্য আরও আরামদায়ক করে তোলে। কপি লুয়াকের সীমিত উৎপাদন এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে চাইলেও বিপুল পরিমাণ কফি উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। আর দুষ্প্রাপ্যতার কারণেই কপি লুয়াকের দাম হয়েছে আকাশচুম্বী। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি কপি লুয়াকের দাম ১০০ থেকে ৬০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, উচ্চমানের বন্য খাটাশের কফির দাম প্রতি কেজিতে ১০০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। তারমানে খাটাশের বিষ্টা দিয়ে তৈরী এক কেজি কফির দাম প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তাছাড়া এক কাপ কফি লুয়াকের দাম সাড়ে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে থাকে। এত উচ্চ মূল্যের কারণে এটি প্রায়শই উপহার হিসেবে বা বিশেষ অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। নৈতিক ও পরিবেশগত উদ্বেগ কফি লুয়াকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর উৎপাদন নিয়ে নৈতিক ও পরিবেশগত উদ্বেগও বেড়েছে। বাণিজ্যিক চাহিদা মেটাতে অনেক খামারে গন্ধগকুলকে খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয় এবং জোর করে অতিরিক্ত কফি চেরি খাওয়ানো হয়। এটি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জন্য ক্ষতিকর। বন্য খাটাশের তুলনায় খাঁচায় রাখা খাটাশের উৎপাদিত কফির গুণগত মানও কম হয়। ব্যাপক উৎপাদনের জন্য বন উজাড় করে কফি বাগান সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, যার ফলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। অধিক দামের কারণে, অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ কফি বিনকে কফি লুয়াক বলে বিক্রি করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু কোম্পানি কৃত্রিমভাবে খাটাশের এনজাইম প্রক্রিয়া অনুকরণ করে কফি তৈরি করছে, যাতে প্রাণী প্রতি নিষ্ঠুরতা এড়ানো যায়। ইন্দোনেশিয়ার যেসব বাগানে কপি লুয়াক উৎপন্ন হয়, সেসব বাগান এখন রীতিমত জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। প্রাণীর মল থেকে সংগ্রহ করা হয় বলে, কিছু ধর্মীয় পণ্ডিত মনে করেন, এটি ব্যবহার করা উচিত নয়। আবার, অন্য পণ্ডিতরা মনে করেন, যেহেতু কফি তৈরির প্রক্রিয়ায় মল ব্যবহার করা হয় না, তাই এটি হালাল। আপনাদের কি মনে হয় এই কফি খাওয়া কি ঠিক এবং এত দাম দিয়ে কি আপনি কপি লুয়াক খাবেন?

জীবনযাপন

হজ্জ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব সমাবেশ

ভূমিকা মুসলিমদের জীবনের এক বিশেষ আধ্যাত্মিক সফর হজ্জ। প্রতি বছর পৃথিবীর সকল দেশ থেকে আগত প্রায় ৩০ লক্ষ মুসলিম হজ্জ পালন করেন। তাই হজ্জ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানব সমাবেশ হিসেবে বিবেচিত। ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি লোক হজ্জ পালন করতে যায়। হজ্জ পালনে শীর্ষ ৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান পঞ্চম। হজ্জের উৎপত্তি  হজ্জ ইসলামের ৫ টি মূল স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। হজ্জের আভিধানিক অর্থ ‘কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করা, ‘সংকল্প করা’বা ‘চক্রাকারে প্রদক্ষিণ করা’। ইসলামের পরিভাষায় হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর দেখানো প্রক্রিয়ায়, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত থেকে নির্ধারিত কাজ সম্পাদন করার নামই হজ্জ। শারিরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থবান মুসলিমদের উপর জীবনে অন্তত একবার হজ্জ পালন করা আবশ্যক। হিজরী বর্ষপঞ্জির সর্বশেষ মাস জিলহজ্জের ৮ থেকে ১২ তারিখ হল হজ্জের জন্য নির্ধারিত সময়। বর্তমানে প্রচলিত হজ্জ হযরত মুহাম্মদ (স) এর দেখানো পথে পালন করা হলেও, আল্লাহর নির্দেশে সকলের জন্য হজ্জের প্রবর্তন করেন হয়রত ইব্রাহিম (আ)। হয়রত ইব্রাহিম (আ) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ) পবিত্র কাবা শরীফ পুনঃনির্মান করে হজ্জ পালন করেন। এরপর থেকে প্রতিবছর দূরদূরান্ত থেকে বহু লোক হজ্জ পালন করতে কাবা শরীফে একত্রি হয়। মুসলিমরা কিভাবে হজ্জ পালন করবেন, তার পূর্নাঙ্গ প্রক্রিয়া হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর বিদায়ী হজ্জে দেখিয়ে গিয়েছেন। হজ্বকালীন সার্বিক অবস্থাকে বলা হয় ইহরাম; যার প্রধান চিহ্ন হলো দুই খন্ড সেলাইবিহীন সাদা কাপড়। ইহরাম পরিধানের কিছু নির্দ্দিষ্ট স্থানকে বলা হয় মিকাত। মিকাত অতিক্রমের আগেই ইহরাম করতে হয়। ইহরাম হল সৃষ্টিকর্তার কাছে সকলের সমতা ও একতার প্রতীক। ইহরামে থাকা অবস্থায় সবাই সমান, কে ধনী কে গরিব বাইরে থেকে দেখে তা বোঝার কোন উপায় নেই। ইহরামের পর থেকে তালবিয়াহ নামক দোয়া পাঠ করা হয় এবং এই দোয়া পুরো হজ্জ ব্যপী জারি থাকে। তালবিয়াহ হলো-‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইকা। ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা লাকা ওয়াাল মুলকা লা-শারীকা লাক। এর অর্থ হলো, হে আল্লাহ, আমি হাজির আছি, আমি হাজির আছি। আপনার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির আছি। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নেয়ামত আপনারই এবং সমগ্র বিশ্বজাহান আপনার। আপনার কোনো শরীক নেই। উমরাহ হজ্জের মতই বিশেষ এক তীর্থ যাত্রা হল উমরাহ। হজ্জের সাথে উমরার সাদৃশ্য থাকলেও; হজ্জের গুরুত্ব উমরার চেয়ে অনেক বেশি। ফরজ হজ্জের জন্য বছরের নির্ধারিত সময় থাকলেও, উমরার জন্য কোনো দিন-তারিখ নির্দিষ্ট নেই। উমরা বছরের যেকোন সময় করা যায়। আরবি ভাষায় উমরা শব্দের অর্থ হল জনবহুল স্থানে ভ্রমণ করা। ইসলামি পরিভাষায় উমরা বলতে, ইহরাম অবস্থায় কাবার চারপাশে তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সায়ী করা বা দৌড়ানোকে বোঝায়। হজ্জ ও উমরাহ পালনের পরম্পরার ভিন্নতার জন্য হজ্জ তিন প্রকার হতে পারে। যেমন: ১. হজ্জে ইফরাদ ২. হজ্জে কেরান এবং ৩. হজ্জে তামাত্তু। হজ্জে ইফরাদ হল, শুধুমাত্র হজ্জের উদ্দেশ্যে ইহরাম করা। হজ্জে কিরান হল, হজ্জ ও উমরা উভয়ের উদ্দেশ্যে এক সঙ্গে ইহরাম করা; এক্ষেত্রে প্রথমে উমরা সম্পাদন করে পরে হজ্জ করতে হয়। এবং হজ্জে তামাত্তু হল, প্রথমে শুধু উমরার উদ্দেশ্যে ইহরাম করা ও উমরা শেষে ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে, পুনরায় হজ্জের ইহরাম করে হজ্জ সম্পাদন করা। হজ্জের গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ হল তাওয়াফ। তাওয়াফ হল মসজিদুল হারামের কেন্দ্রে অবস্থিত ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান কাবা কে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করা। হজ্জের শুরুতে এবং শেষে হাজীরা ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ৭ বার কাবা ঘর প্রদক্ষিণ করেন। হজের মূল কাজ হজের মূল কাজ শুরু হয় ৮ জিলহজ এবং শেষ হয় ১২ জিলহজ। এ পাঁচ দিনের ফরজ ও ওয়াজিব কাজগুলো হাজীদের সচেতনতার সাথে যথার্থভাবে আদায় করতে হয়। ৮ জিলহজ হাজিদের মক্কার কাছাকাছি একটি উপশহর মিনায় পৌঁছাতে হয়। মিনা তাবুর শহর হিসেবেও পরিচিত। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। মক্কা থেকে আরাফাতের দিকে যাওয়ার রাস্তার পাশে প্রায় ২০ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে মিনার অবস্থান। এখানকার লক্ষাধিক তাবুতে হাজিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ৯ জিলহজের সকালে মিনা থেকে রওনা হয়ে আরাফাতের প্রান্তরে পৌঁছতে হয়। সেদিন সূর্যাস্তের পর হাজিরা আরাফা থেকে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা হন। ৯ তারিখের দিবাগত রাতে মুজদালিফায় বিশ্রাম নিয়ে, সূর্যোদয়ের আগেই আবার মিনার উদ্দেশে যাত্রা করতে হয়। ১০ জিলহজের কাজ হল শুধুমাত্র শয়তানের বড় স্তম্ভে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করা। পাথর মারার পর কুরবানির নির্দিষ্ট নিয়মে হাজিরা কুরবানি সম্পন্ন করেন। কোরবানি করার পর পুরুষেরা মাথা কামিয়ে ফেলে এবং নারীদের চুলের অংশ বিশেষ ছাঁটতে হয়। ১০ জিলহজ মাথা মুন্ডনের পরই ইহরাম অবস্থার অবসান ঘটে। এসমস্ত কাজ শেষে সেদিন কাবা শরীফ তাওয়াফ করতে হয়। অবশ্য ভিড় এড়ানোর জন্য এ তাওয়াফ ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিলম্বিত করা যেতে পারে। ১১ জিলহজে হাজীরা শয়তানের তিনটি স্তম্ভে সাতটি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করেন। ১২ জিলহজে আবারো শয়তানের তিনটি স্তম্ভে সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারতে হয়। ১১ ও ১২ তারিখে পাথর মারার সময় ছোট থেকে বড় স্তম্ভের দিকে যেতে হয়। ১২ তারিখের পর একজন হাজী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। মদিনা সফর একজন হাজী হজের আগে মদিনায় না গেলে, হজ্জ পরবর্তী সময়ে মদিনায় গিয়ে আট দিন অবস্থান করতে হয় এবং মসজিদে নববীতে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হয়। মদিনায় যাওয়া যদিও হজের অংশ নয়। তবুও বিনা কারণে মদিনায় না যাওয়া রাসূল (সা) এর সাথে বেয়াদবির সামিল। হজের পরে মক্কা শরিফে অবস্থান কালে হাজিরা একাধিক ওমরা পালন করতে পারেন। হজ্জ থেকে নিজ দেশে ফেরার আগে হাজীদেরকে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয়, এটিও হজ্জের গুরুত্বপূর্ন অংশ। হজ্জ সম্পাদন করতে পারা প্রতিটি মুসলিমের জীবনের বিশেষ অর্জন। হজ্জ শুধুমাত্র ধনীদের জন্য ফরজ হলেও, বহু দরিদ্র মুসলিম জীবনে একবার হজ্জ করার উদ্দেশ্যে সারাজীবন একটু একটু করে অর্থ সঞ্চয় করেন। বাংলা অঞ্চলে মুসলিম বিজয় ও ইসলাম প্রচারের পর থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা হজ্জ পালন করে আসছেন। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের মুসল্লিগণ ভারতের মুম্বাই হয়ে, জাহাজে চড়ে হজ্জ করতে যেতেন। যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে মুম্বাই পর্যন্ত গিয়েই অনেকে অসুস্থ হয়ে ফিরে আসতেন; তাঁদের বলা হতো মুম্বাই হাজী। বৃহত্তম মানব সমাবেশ বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রায় লক্ষাধিক মুসলিম প্রতিবছর হজ্জ পালন করতে যায়। হজ্জ পালনে শীর্ষ ৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান পঞ্চম। প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি লোক হজ্জ করতে যায় ইন্দোনেশিয়া থেকে। শীর্ষ তালিকায় থাকা অন্যান্য দেশগুলো হল পাকিস্তান, ভারত ও মিশর। বাংলাদেশ থেকে হজ্জ যাত্রার বাইরেও, সৌদি আরব প্রবাসী বহু বাংলাদেশী প্রতিবছর হজ্জ পালন করে থাকেন। হজ্জের মৌসুমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই মানব সমাবেশের ভিড় সামলাতে, প্রায় ১ লক্ষ নিরাপত্তা কর্মী এবং ২৫ হাজার চিকিৎসা সেবী নিয়োজিত থাকে। একই সময়ে একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে লক্ষ লক্ষ হাজী অবস্থান করায়, হজ্জের প্রায় সবগুলো আচার পালন করতে গিয়েই প্রচন্ড ভিড়ের সৃষ্টি হয়। অতীতে বহুবার ভিড়ের মধ্যে পদদলিত হয়ে বহু সংখ্যক হাজী মৃত্যু বরণ করেছেন। ১৯৯০ সালে এরকমই এক দুর্ঘটনায় প্রায় ১৪২৬ জন হাজী পদদলিত হয়ে মারা যায়। সর্বশেষ বড় দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে, সেবছর প্রায়

Shopping Cart
Scroll to Top