বাংলাদেশ

মানবিক করিডোর আসলে কী

ভূমিকা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গৃহযুদ্ধের কারণে যে মানবিক সংকট তৈরী হয়েছে, তা মোকাবিলা করার জন্য একটি মানবিক করিডোরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মানবিক করিডোরের ব্যাপারে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। তখন বিষয়টি নিয়ে বিএনপি, জামাত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল সমালোচনা শুরু করলে; পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন যে, জাতিসংঘের সাথে এ বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সরকারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে মানবিক করিডোরের বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরী হয়েছে। করিডোর কী? করিডোর হলো একটি নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিরাপদে ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণত আন্তর্জাতিক বা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে স্থাপিত হয়। মোটাদাগে করিডোর কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ১. বাণিজ্যিক করিডোর ২. মানবিক করিডোর এবং ৩. সামরিক করিডোর। দুটি অঞ্চলের মধ্যে অবাধে পণ্য ও বাণিজ্য সরবরাহের জন্য বাণিজ্যিক করিডোর নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)। কোন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় খাদ্য, ওষুধ বা ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর তৈরী করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া এবং ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধে মানবিক করিডোর স্থাপনের নজির আছে। অন্যদিকে সামরিক করিডোর হলো এমন নির্দিষ্ট পথ বা রুট, যা সামরিক বাহিনী, অস্ত্র, সরঞ্জাম বা সৈন্য পরিবহনের জন্য নিরাপদে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সৌদি আরব থেকে ইরাক ও কুয়েত সীমান্তের সড়কপথ যুক্তরাষ্ট্র সামরিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করেছে। মানবিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক করিডোর ছাড়াও অন্যান্য ধরনের করিডোর রয়েছে। যেমন: বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য পরিবেশগত করিডোর, রেল ও সড়ক যোগাযোগের জন্য পরিবহন করিডোর, তেল গ্যাস বা িবদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জ্বালানী বা শক্তি করিডোর, ফাইবার অপটিক কেবল, সাইবার নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল/তথ্য করিডোর এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ ও পর্যটন উন্নয়নের জন্য শিক্ষা/সাংস্কৃতিক করিডোর ইত্যাদি। মানবিক করিডোর কী? কোন সংঘাতপূর্ণ বা দুর্যোগ-আক্রান্ত এলাকায়, খাদ্য, ওষুধ, পানি বা চিকিৎসা সরঞ্জামের মত জরুরি ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডোর ব্যবহৃত হয়। এটি বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষা এবং মানবিক সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে স্থাপিত হয়। কখনো কখনো এই করিডোর বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হয়। মানবিক করিডোর সাধারণত জাতিসংঘ (UN) বা অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এবং সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে কার্যকর হয়। মানবিক করিডোরের প্রধান উদ্দেশ্য হলো: ১. ত্রাণ সরবরাহ ২. বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা ৩. মানবাধিকার রক্ষা এবং ৪. নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সংকটগ্রস্ত জনগণ যেন দুর্ভিক্ষ, অনাহার বা স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি না হয় সেই লক্ষ্যে মানবিক করিডোর স্থাপন করা হয়। অবরুদ্ধ বা সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার আগে পরে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন নিশ্চিত করাও একটি উদ্দেশ্য। সেই সাথে ত্রাণ বিতরণে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়া সকল পক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যক্তির কাছে সহায়তা পৌঁছানোও গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। মানবিক করিডোরের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখেযোগ্য হল, করিডোরে সামরিক কার্যক্রম বা অস্ত্রের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা। করিডোরে ত্রাণ পরিবহন বা নাগরিকদের স্থানান্তরের সময় যেন নতুন করে কোন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরী না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা। সাধারণত জাতিসংঘ বা রেড ক্রস (ICRC) এর মত নিরপেক্ষ সংস্থাগুলো এটি পরিচালনা করে। তাই এমন কোন বিতর্কিত পক্ষ বা সংস্থাকে মানবিক করিডোরে প্রবেশাধিকার না দেওয়া, যাতে করে নতুন করে সংঘাত তৈরী হয়। কারণ এই ব্যবস্থার অন্যতম শর্তই হল যুদ্ধবিরতি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে করিডোরকে হামলামুক্ত রাখা। মানবিক করিডোর আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে পরিচালিত হয়, যা জেনেভা কনভেনশন (1949) এবং এর অতিরিক্ত প্রটোকল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইন অনুযায়ী ত্রাণ কর্মী ও কনভয়ের উপর হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কগজে কলমে মানবিক করিডোরকে বিভিন্নভাবে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও, অনেক সময় ত্রাণ সামগ্রী সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে যেতে পারে। ত্রাণ বিতরণে কিছু গোষ্ঠী বঞ্চিত হতে পারে, যা আরো বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করে। রাখাইনে মানবিক করিডোর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে ত্রাণ সামগ্রী রাখাইনের বেসামরিক জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়। বাংলাদেশ সরকার শর্তসাপেক্ষে এই করিডোর দেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। চুক্তির শর্তগুলোর বিস্তারিত জনসমক্ষে প্রকাশ না করায় রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্তের ব্যাপারে জানা যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ত্রাণ সরবরাহ শুধুমাত্র জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। ত্রাণ যেন সরাসরি রাখাইনের নাজুক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় এবং আরাকান আর্মি বা মিয়ানমার জান্তার মত কোনো সামরিক বা বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেন এটি দখল করতে না পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল করিডোর যেন রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে আরও জটিল না করে বা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি না বাড়ায়। এবং সকল জাতিগত গোষ্ঠী, বিশেষ করে রোহিঙ্গা, রাখাইন এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে ন্যায্যভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। মানবিক করিডোর বাস্তবায়নে চুক্তির শর্ত হিসেবে এসব বিষয় আলোচনা করা হলেও, বাস্তবে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। রাখাইনের বেশিরভাগ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, যারা একটি রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র গোষ্ঠী। ত্রাণ সামগ্রী তাদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। করিডোরের ফলে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এমনকি বিগত কয়ক মাসে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশও করেছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঝুঁকি জাতিসংঘের মাধ্যমে এই মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মূলত একটি আন্তর্জাতিক কৌশলের অংশ, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই করিডোর ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র চায় আরাকান আর্মিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করতে। কারণ, চীন ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে, রাখাইনকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভূক্ত করেছে। যার ফলে চীন এই অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে বঙ্গোপসারগ সহ ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে এখানে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাখাইনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে চীনের প্রভাবকে ভারসাম্যহীন করার চেষ্টা করতে পারে। জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র চাইলে রাখাইনের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেও সহায়তা পাঠাতে পারে। কিন্তু তারা করিডোর ব্যবহারের পন্থা বেছে নিয়েছে, কারণ মানবিক করিডোর একটি ছদ্মবেশী কৌশল হতে পারে। যাতে ভবিষ্যতে এখানে পরিস্থিতি আরো জটিল হলে; আন্তর্জাতিক মঞ্চে কেউ জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে না পারে। উল্টো বাংলাদেশ, ভারত, চীন বা অন্য কোন পক্ষের উপর দায় চাপানো যায়। জাতিসংঘের নিরপেক্ষতার আড়ালে এই ধরনের আন্তর্জাতিক চালবাজি, বিশ্বের যে কোন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলেই একটি সাধারণ ঘটনা। এভাবেই বিশ্ব রাজনীতির খেলায় ‘মানবিক সাহায্য’ নামের আড়ালে গভীর কৌশল লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের জন্য মানবিক করিডোর একটি জটিল দ্বিধার জায়গা। একদিকে, করিডোরে সম্মতি দিলে হয়ত দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। আবার অন্যদিকে করিডোরে অসম্মতি জানালেও আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশকে দায়ী করে রোহিঙ্গা সংকটকে আরও ঘোলাটে করতে পারে। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি এমনিতেই বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি বোঝা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য

বাংলাদেশ

ইউনুস সরকার ব্যর্থ হল কেন

সূচনা শেখ হাসিনার পতনের পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে, দেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্ম নিয়েছিল। সাধারণ মানুষ ভেবেছিল, ড. ইউনূস তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশকে একটি নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সেই সাথে সুশীল সমাজের বহু সফল ও পরিচিত মুখ উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পাওয়ায়, বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও, দেশের মানুষ আবারো ঠিক আগের মতই হতাশ হয়ে পড়েছে। কারণ সত্যিকার অর্থে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা সহ কোন দিক থেকেই জনগণের ভোগান্তি কমেনি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়েও বেড়েছে। সরকারের ভেতর ও বাইরে থেকে নানা মূখী চ্যালেঞ্জের কারণে, ড. ইউনূসের সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। ফলে জনগণের আস্থা দ্রুত কমতে শুরু করেছে এবং এই সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেন ব্যার্থ হচ্ছে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, মব জাস্টিস এবং সম্পত্তি ধ্বংসের ঘটনা ঘটে, যা অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশ ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়। বিনা নোটিশে ভারত ত্রিপুরার বাঁধ খুলে দেওয়ায় পূর্বাঞ্চলের ১১ টি জেলা প্লাবিত হয়, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি ও কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। সেসময় দেশের জনগণ সদ্য গঠিত হওয়া সরকারের ভরশায় না থেকে, নিজেরাই যে যার সাধ্যমত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেকারণেই সরকার তার চ্যালেঞ্জের প্রথম পরীক্ষায় অনেকটাই পার পেয়ে যায়। নবগঠিত সরকারের দ্বায়িত্ব বুঝে উঠতে আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন; এমন ধারণা থেকেই রাজধানীর বাসিন্দারা ডাকাত আতঙ্কে নিজেরা রাত জেগে পাড়া মহল্লায় পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছে। তখনও হাসিনার খুনি পুলিশ বাহিনীর অধিকাংশই গা ঢাকা দিয়েছিল। তাই দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না।  কিন্তু সরকার তার ক্ষমতার মেয়াদ ছয় মাস পূর্ণ করলেও, এখনও পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বভাবিক হয়নি। এটি নিঃসন্দেহে এই সরকারের মারাত্নক ব্যার্থতা। মাঝখানে পুলিশ প্রশাসন সংস্কারের নামে র‌্যাব ও পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে, নেটিজেনদের কিছুটা হাসির খোড়াক যোগানো ছাড়া অন্তবর্তী সরকারের উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সবশেষে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের যৌথ অভিযান শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সাফল্য আসলেও, এই কার্যক্রমও একেবারে বিতর্ক মুক্ত নয়। অর্থনৈতিক সংকট  পূর্ববর্তী হাসিনা সরকারের লুটপাটের কারণে দেশে মারাত্নক অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত সৃষ্টি হয়েছিল। সেকারণে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকগুলোতে অর্থের ব্যাপক সংকট ছিল। সেই সাথে দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা অন্তবর্তী সরকারের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেছে। ড. ইউনুস সরকার গঠনের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও, বাজারে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে কষ্ট শুধু বাড়িয়েই চলেছে। সরকার আমদানি করা খাদ্যপণ্যের উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার এবং টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি ব্যবস্থা করলেও, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। মাঝখানে ডিমের দাম নিয়ে ব্যাপক নৈরাজ্য, বাজার থেকে ভোজ্য তেল উধাও হয়ে যাওয়া, আবার বেশি দামে বাজারে ফিরে আসা, আলু-পেঁয়াজ অামদানি নিয়ে জটিলতা সহ নানা বিষয়ে সরকারের ব্যার্থতা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রশাসনিক সংস্কারে ধীরগতি সরকারের বিভিন্ন স্তরে প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি সরকারের প্রতি জনগণের আস্থায় আঘাত করেছে। এই সরকারের অন্যতম কাজ ছিল দেশের পুরনো ধ্বসে পড়া কাঠামো সংস্কার করা। সে লক্ষ্যে জনপ্রশাসন, পুলিশ, আদালত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সংবিধান সংস্কারের জন্য সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করলেও, এই সংস্কার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ফলে জনগণের প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসছে না। ইতোমধ্যে সংস্কার কমিশনগুলো সরকারের হাতে তাদের অনুসন্ধান ও সুপারিশ পত্র তুলে দিলেও, এই সরকার সেসব সংস্কার আদৌ করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ তারা দেশ পরিচালনার কাজেই রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা হল, যাদের প্রানের বিনিময়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে, ২৪ এর সেই সব শহীদ পরিবারের প্রতি এখনও ন্যায় বিচার করা হয়নি। জুলাই বিপ্লবে আহতদের চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সরকার চূড়ান্ত রকমের ব্যার্থ হয়েছে। এবং এই সরকার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে কোন কাজে আসবে না বুঝতে পেরেই; আহতরা পর্যন্ত আবারো আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে। শুধু তাই নয়, জুলাই বিপ্লবের খুনিদের বিচার তো দূরের কথা; তাদের নামে ঠিকমত মামলা পর্যন্ত দিতে পারেনি এই সরকার। যেসব দুর্বল মামলা হয়েছে, সরকার পরিবর্তনের পর তাদের প্রায় শতভাগই খালাস পেয়ে যাবে। তাছাড়া আয়নাঘর প্রকাশ্যে আনা বা পিলখানা হত্যাকান্ডের মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়েও সরকারের যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে। বলতে গেলে বিল্পব করেও কাঙ্খিত পরিবর্তন না পেয়ে হতাশ হয়েও, অনেকে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙতে গিয়েছে। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনীতিবিদ ও আমলারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার মহাপরিকল্পনা করছে। এর কারণেই অনেকটা সরকারের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সমস্যা হচ্ছে। পূর্ববর্তী সরকারের প্রভাবশালী আমলারা সরকারের কার্যক্রম ব্যাহত করতে নানাভাবে অপপ্রচার, রাজনৈতিক উসকানি ও প্রশাসনিক বাধা সৃষ্টি করেছে বলে বিশ্লেষকদের মত। সরকার গঠনের পরপরই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের ভেতরে থেকে অসহযোগিতা একেবারেই স্পষ্ট ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের নেওয়া নীতিমালা বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করা হয়, যাতে জনসাধারণের মধ্যে সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বলছে, এই পুলিশ বাহিনীতে ৯০ শতাংশই আওয়ামী লীগ করে। সেই সাথে রাজনৈতিক অঙ্গনে, ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার চালানো হয়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বিশেষ করে, অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য এককভাবে বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়া, সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং বেশ কিছু অরাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রকাশ্যে ও গোপনে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন শহরে আকস্মিক বিক্ষোভ, রাস্তা অবরোধ এবং সরকারি ভবনে হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এগুলো ছিল সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চক্রান্ত, যাতে জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয় এবং সরকারের জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেওয়া যায়। এসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ফলে ইউনূস সরকার নীতিগতভাবে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তার বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এ কারণেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারেনি। জনগণের অতিরিক্ত প্রত্যাশা অন্তবর্তী সরকারের ব্যার্থতা আমাদের চোখে এত প্রকটভাবে ধরা পড়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হল, ড. ইউনুসের সরকারের প্রতি জনগণের অতিরিক্ত প্রত্যাশা

বাংলাদেশ

ওয়াজ মাহফিল কী ব্যবসায় পরিণত হয়েছে

সাধারণ জনগণের সাথে ইসলামী জ্ঞান ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার একটি কার্যকর উপায় ওয়াজ মাহফিল। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বত্রই এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সংস্কৃতি। মূলত মানুষকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং ধর্মীয় জ্ঞান প্রচারের জন্যই তাফসিরুল কুরআন বা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে ওয়াজ মাহফিল অনেক বিতর্কিত হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কিছু বক্তা তাদের বক্তৃতার জন্য মোটা অংকের পারিশ্রমিক নিচ্ছেন, যা ইসলাম প্রচারের মূল উদ্দেশ্যের সাথেই সাংঘর্ষিক। ওয়াজ মাহফিল বাংলাদেশের একটি সম্বৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকে কিভাবে একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে। এই ব্যবসা কিভাবে গড়ে উঠেছে? প্রাচীনকাল থেকে ইসলামি জ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষার প্রচারের জন্য ওয়াজ মাহফিল একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে এ ধরনের সভা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে মানুষ কুরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন করে এবং নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করে। এটি সামাজে একতা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একটা সময় এসব মাহফিল ছিল গ্রামীণ জনগণের জন্য জ্ঞান অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। প্রাচীন আলেমরা গভীর অধ্যয়ন ও বাস্তবিক উদাহরণের মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারতেন। এমনকি বর্তমানেও অনেক জায়গায় ওয়াজ মাহফিল, সামাজিক উন্নয়ন, দানশীলতা এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতির চর্চাকে উৎসাহিত করে। এটি ইসলামের নৈতিক শিক্ষা ও সমাজ গঠনের প্রাথমিক উদ্দেশ্যের প্রতি মানুষকে মনোযোগী করে তোলে। বিগত কয়েক দশকে ধর্মীয় নেতারা এবং জনপ্রিয় বক্তারা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের কথা শুনতে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হন। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি টানই এর পেছনে মূল কারণ। পাশাপাশি জনপ্রিয় বক্তাদের আবেগপ্রবণ উপস্থাপনা এবং তাদের গল্প মানুষকে আকৃষ্ট করে। এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকরা; তাদেরকেই বেশি বেশি ডাকতে থাকে যাদের নিয়ে আসলে মাহফিলে বেশি লোক উপস্থিত হতে পারবে। আর বেশি লোকের উপস্থিতি মানেই বেশি বেশি দান গ্রহণ করা যাবে। এই একটি বিষয় থেকেই বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলের বানিজ্যিকীকরণ হতে থাকে। তখন থেকে জনপ্রিয় বক্তারা এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, এক বছর আগে থেকে তাদের বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। মাহফিল ব্যবসা বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের জনপ্রিয় বক্তারা এক একটি অনুষ্ঠানের জন্য লক্ষাধিক টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। সেই সাথে জনপ্রিয় বক্তাদের জন্য হেলিকপ্টার ভাড়া করা, বিশাল মঞ্চ তৈরি, প্রচার ও অন্যান্য খরচ সহ একটি মাহফিল আয়োজন করতে বেশ মোটা অংকের টাকা খরচ করা হয়। অথচ ওই একই এলাকার মসজিদের মুয়াজ্জিন, ইমাম এবং খতিবদের মাসিক বেতন মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। অনেক জায়গায় এই ন্যূনতম বেতনও নিয়মিত পরিশোধ করা হয় না। স্থানীয় আলেমদের অনেকেই ওয়াজ মাহফিলের জনপ্রিয় বক্তাদের সমপর্যায়ের জ্ঞানী এবং পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও, তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। একজন হুজুর দিনে ৫ বার এবং মাসে দেঢ়শ ওয়াক্ত নামাজ পরিয়ে বেতন পান মাত্র ৫ থেকে দশ হাজার টাকা। অারেকজন মাত্র ১ ঘন্টা বয়ান করে পান এক লক্ষ টাকা। কোন কোন বক্তার একই দিনে একাধিক জেলায় মাহফিল থাকে। এই ধরনের বৈষম্য ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। বিষয়টি নিয়ে সবার আগে প্রতিবাদ করা উচিত ছিল জনপ্রিয় আলেম ওলামাদের; কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে এই বিষয়টি নিয়ে কোন জোড়ালো প্রতিবাদ শোনা যায় না।  ওয়াজ মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু অধিক দান সদকা সংগ্রহ এবং বক্তাদের অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের চাহিদার কারণে, সেই মূল উদ্দেশ্য থেকেই আমরা বহু দূরে সরে গেছি। এর বাইরে, মাহফিলের আশে পাশে লোক সমাগমকে কেন্দ্র করে, ফুচকা চটপটির দোকান থেকে শুরু করে বাচ্চাদের খেলানার দোকান বসিয়ে, তাফসিরুল কুরআন মাহফিলকে মেলা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। অনেক জায়গায় অপরিচিত আলেমদের দিয়ে ওয়াজ মাহফিল করানো হলে, লোক সমাগম হয় অতি নগন্য। যার ফলে দান-সদকা সংগ্রহ করা তো দূরের কথা। মাহফিলের খরচই উঠে আসে না। কারণ মানুষ এখন ওয়াজ মাহিফল শোনার চেয়ে, ফেসবুকের জনপ্রিয় সেলিব্রেটি আলেমদের সামনাসামনি দেখার উদ্দেশ্যেই বেশি যায়। সমালোচনা ওয়াজ মাহফিল এখন অনেকটাই বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আবেগপ্রবণ বক্তৃতা এবং গান-গজলের মতো পরিবেশনা মানুষকে আকৃষ্ট করলেও; ইসলামি জ্ঞান প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে।  ওয়াজ মাহফিলে অধিকাংশ জনপ্রিয় বক্তাই সুরে সুরে বক্তব্য দেন, যা অনেকের কাছে আকর্ষণীয় মনে হলেও; অন্যদের কাছে বিষয়টি হাস্যকর হয়ে উঠেছে। অনেক বক্তা বক্তব্য প্রদানের সময় খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। যার ফলে তারা ভালো ভালো কথা বললেও, শুনতে খুবই খারাপ লাগে। এই ধরনের অতি নাটকীয় ওয়াজের ভিডিও যখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, তখন তা অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরী করে।  ‍শুধু তাই নয়, বহু মুসলিমরাও এসব দেখে ওয়াজ মাহফিল কিংবা ইসলামা থেকেই দূরে সরে যেতে থাকে। ওয়াজের আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষের কাছে ধর্মীয় শিক্ষা এবং নৈতিকতার বার্তা পৌঁছানো। কিন্তু বর্তমান ওয়াজ মাহফিলে শিক্ষার গভীরতা অনেকাংশেই হারিয়ে গেছে। কখনও দেখা যায়, একজন বক্তা খুব হাস্যরসত্নক বক্তব্য দিচ্ছেন। আবার মুহুর্তেই কথার মধ্যে লম্বা সুরে টান দিয়ে খুব আবেগী গলায় কান্নাকটি করে একটি সাধারণ বিষয়ের অতি নাটকীয় বর্ণনা শুরু করে দেন। এসব বিষয় উল্লেখ করে ওয়াজ মাহফিল নিয়ে গঠনমূলক আলোচন করতে গেলেও, তারা বলবে ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করার পায়তারা চলছে। একদল লোক অবশ্যই আছে যারা ইসলাম বিদ্বেষের জায়গা থেকে, ধর্মীয় যে কোন বিষয় নিয়েই অহেতুক সমালোচনা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাই বলে, ওয়াজ মাহফিলে যে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থি নানা ধরনের চর্চা হচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। ওয়াজ মাহফিলে অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোভাব এবং কিছু বক্তার বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে সামগ্রিকভাবে ইসলামের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। ইসলামকে আবার তার মূল নৈতিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হলে বক্তাদের আরো সংযমী ও দায়বদ্ধ হতে হবে। আলেমদের স্থলন বর্তমানে ওয়াজ মাহফিল থেকে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা ও সামাজিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হল কতিপয় আলেম ওলামাদের নৈতিক স্খলন। কিছু কিছু আয়োজনে শরিয়তবিরোধী কার্যকলাপ, অপ্রয়োজনীয় খরচ এবং ভাইরাল বক্তাদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণে ইসলামের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অনেক মাহফিলে মাজহাবি ঝগড়া-বিবাদ নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করা হয়। অন্য  আলেমদের মধ্যে কে মুরদতাদ কে কাফের হয়ে গেছে, সেসব নিয়ে হাজার হাজার লোকের সামনে বক্তারা অন্য বক্তা সম্পর্কে অসম্মানজনক আলোচনা করেন। সঠিক জ্ঞান এবং দায়িত্বশীলতার অভাবে কিছু বক্তার বক্তব্য ইসলামের বদনাম ডেকে আনে। তাছাড়া ধর্মীয় বিষয়গুলো অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা, সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া এবং সর্বোপরি ইসলামি শিক্ষার পরিবর্তে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেওয়া বক্তাদের সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত করে তুলেছে। বক্তাদের অানেকেই তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল সহ স্যোশাল মিডিয়া কন্টেন্টের কথা মাথায় রেখেও জনপ্রিয় বিষয়ে ওয়াজ করে থাকেন। বেশ কিছু বক্তা তাদের বক্তৃতায় এমন অপ্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনা করেন যা ওয়াজ মাহফিলের আসল উদ্দেশ্য থেকে শ্রোতাদের দূরে সরিয়ে দেয়।

Shopping Cart
Scroll to Top