
পোপকে কোথায় এবং কিভাবে সমাহিত করা হয়েছে
ভূমিকা রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। পোপদেরকে সাধারণত ভ্যাটিকান সিটিতে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নিচে সমাহিত করা হয়। তবে পোপ ফ্রান্সিসকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ভ্যাটিকানের বাইরে অবস্থিত রোমের ব্যাসিলিকা ডি সান্তা মারিয়া ম্যাজিওরে সমাহিত করা হয়েছে। বিগত ১২০ বছরের মধ্যে প্রথমবার কোনো পোপ কে ভ্যাটিকানের বাইরে সমাহিত করা হল। মৃত্যুর পর প্রস্তুতি পোপের মৃত্যুর পর তাঁর দেহকে সম্মানের সঙ্গে ধৌত করা হয় এবং পন্টিফিকাল ভেস্টমেন্ট নামের বিশেষ ধর্মীয় পোশাক পরানো হয়। এরপর তার দেহটি কয়েকদিন সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় রাখা হয় যাতে বিশ্বাসী ও ভক্তরা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। সমাধিস্থ করার আগে পোপের দেহ একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়, যা পরে সীসা ও আরেকটি কাঠের কফিনে সিল করা হয়। কফিনে পোপের নাম, তার রাজত্বের সময়কাল এবং অন্যান্য তথ্য খোদাই করা থাকে। এরপর কফিনটি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ক্রিপ্টে বা পোপের নির্দেশিত স্থানে সমাহিত করা হয়। সমাধির আগে ফিউনারেল মিসা নামে একটি বিশেষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কার্ডিনালরা ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থাকেন। পোপ ফ্রান্সিস ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর দেহকে সান্তা মার্তার চ্যাপেলে একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়। তিনি পোপদের জন্য ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী তিনটি কফিনের পরিবর্তে একটি সাধারণ কফিনে তার দেহ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কফিনে তাঁর শাসনকালের কয়েন, মেডেল এবং তাঁর ১২ বছরের পোপত্বের মূল বিষয়গুলোর একটি দলিল রাখা হয়। ২৩ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর দেহ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ২৬ এপ্রিল সকাল ১০টায় সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে কার্ডিনাল জিওভান্নি বাত্তিস্তার নেতৃত্বে পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মিসা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২২০ জন কার্ডিনাল, ৭৫০ জন বিশপ এবং ৪,০০০-এর বেশি পুরোহিত অংশ নেন। এই মিসায় সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নেন। বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনুসও পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস কে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে পূর্বে মোমবাতি রাখার একটি কক্ষ ছিল। পোপ নিজেই এই জায়গাটি তার সমাধির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। পোপদের সাধারণত ভ্যাটিকানে সমাহিত করা হলেও, পোপ ফ্রান্সিস নিজেই সান্তা মারিয়া ম্যাজিওর বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ২০২২ সালে বলেছিলেন, ভার্জিন মেরি তাঁকে এখানে সমাধিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসের এই ব্যাসিলিকার প্রতি গভীর ভক্তি ছিল, বিশেষ করে এখানে অবস্থিত মেরি সালুস পপুলি রোমানি আইকনের প্রতি। তিনি তাঁর ৪৭টি আন্তর্জাতিক সফরের আগে ও পরে এবং হাসপাতালে ভর্তির পর এখানে প্রার্থনা করতেন। অতীতে তিনি কার্ডিনাল হিসেবেও রোম ভ্রমণ করলে এই গির্জায় বেড়াতে আসতেন। পোপ ফ্রান্সিসের সাদামাটা জীবন পোপ ফ্রান্সিস এর আসল নাম জর্জ মারিও বের্গোগ্লিও। তিনি ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত রোমান ক্যাথলিক চার্চের একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় সোসাইটি অফ জিসাস বা জেসুইটের সদস্য ছিলেন। জেসুইটরা অত্যন্ত সরল ও বিনয়ী জীবন যাপন করে। পোপ ফ্রান্সিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। পোপদের থাকার জন্য একটি রাজকীয় প্রাসাদ রয়েছে। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস পোপ নির্বাচিত হবার পর ভ্যাটিকানের অ্যাপোস্টলিক প্যালেসের পরিবর্তে, সান্তা মার্তা নামের একটি গেস্টহাউসে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এটি একটি সাধারণ বাসস্থান, যার মধ্যে ছিল একটি শোবার ঘর, বাথরুম এবং অধ্যয়ন কক্ষ। পোপ ফ্রান্সিস ঐতিহ্যবাহী পোপের পোশাকের তুলনায় সাধারণ পোশাক পছন্দ করেতেন। তিনি বিলাসবহুল পোপের জুতোর পরিবর্তে সাধারণ কালো চামড়ার জুতো পরতেন। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যেমন ঘড়ি বা ব্যাগ, সবই সাধারণ এবং কোনটিই ব্যয়বহুল নয়। পোপ ফ্রান্সিস বিলাসবহুল গাড়ির পরিবর্তে সাধারণ গাড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার মনে হয় একজন পুরোহিতের বিলাসবহুল গাড়ি থাকা উচিত নয়। পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানেও গরিব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য খাবার, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলতেন, “একটি গির্জা যদি গরিবদের পাশে না থাকে, তবে তা গির্জা নয়।”পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বাস করতেন যে নেতাদের উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই তিনি িনজে বিলাসিতা পরিহার করে, গির্জার পুরোহিত ও বিশপদের বিলাসিতা ত্যাগ করে সাধারণ জীবনযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে অতীতে অধিকাংশ পোপ কিন্তু পোপ ফ্রান্সিসের মত এতটা বিনয়ী এবং সাদামাটা জীবন যাপন করতেন না। মধ্যযুগের পোপেরা ছিলেন ইউরোপের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তারা একেকজন ক্ষমতালোভী রাজা বা সম্রাটদের চেয়েও অনেক বেশি দুর্ণীতিগ্রস্ত ছিলেন।