কি কেন কিভাবে

পোপকে কোথায় এবং কিভাবে সমাহিত করা হয়েছে

ভূমিকা রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। পোপদেরকে সাধারণত ভ্যাটিকান সিটিতে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নিচে সমাহিত করা হয়। তবে পোপ ফ্রান্সিসকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ভ্যাটিকানের বাইরে অবস্থিত রোমের ব্যাসিলিকা ডি সান্তা মারিয়া ম্যাজিওরে সমাহিত করা হয়েছে। বিগত ১২০ বছরের মধ্যে প্রথমবার কোনো পোপ কে ভ্যাটিকানের বাইরে সমাহিত করা হল। মৃত্যুর পর প্রস্তুতি পোপের মৃত্যুর পর তাঁর দেহকে সম্মানের সঙ্গে ধৌত করা হয় এবং পন্টিফিকাল ভেস্টমেন্ট নামের বিশেষ ধর্মীয় পোশাক পরানো হয়। এরপর তার দেহটি কয়েকদিন সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় রাখা হয় যাতে বিশ্বাসী ও ভক্তরা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। সমাধিস্থ করার আগে পোপের দেহ একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়, যা পরে সীসা ও আরেকটি কাঠের কফিনে সিল করা হয়। কফিনে পোপের নাম, তার রাজত্বের সময়কাল এবং অন্যান্য তথ্য খোদাই করা থাকে। এরপর কফিনটি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ক্রিপ্টে বা পোপের নির্দেশিত স্থানে সমাহিত করা হয়। সমাধির আগে ফিউনারেল মিসা নামে একটি বিশেষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কার্ডিনালরা ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থাকেন। পোপ ফ্রান্সিস ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর দেহকে সান্তা মার্তার চ্যাপেলে একটি সাধারণ কাঠের কফিনে রাখা হয়। তিনি পোপদের জন্য ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী তিনটি কফিনের পরিবর্তে একটি সাধারণ কফিনে তার দেহ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কফিনে তাঁর শাসনকালের কয়েন, মেডেল এবং তাঁর ১২ বছরের পোপত্বের মূল বিষয়গুলোর একটি দলিল রাখা হয়। ২৩ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁর দেহ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ২৬ এপ্রিল সকাল ১০টায় সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে কার্ডিনাল জিওভান্নি বাত্তিস্তার নেতৃত্বে  পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মিসা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২২০ জন কার্ডিনাল, ৭৫০ জন বিশপ এবং ৪,০০০-এর বেশি পুরোহিত অংশ নেন। এই মিসায় সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নেন। বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনুসও পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস কে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে পূর্বে মোমবাতি রাখার একটি কক্ষ ছিল। পোপ নিজেই এই জায়গাটি তার সমাধির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। পোপদের সাধারণত ভ্যাটিকানে সমাহিত করা হলেও, পোপ ফ্রান্সিস নিজেই সান্তা মারিয়া ম্যাজিওর বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ২০২২ সালে বলেছিলেন, ভার্জিন মেরি তাঁকে এখানে সমাধিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসের এই ব্যাসিলিকার প্রতি গভীর ভক্তি ছিল, বিশেষ করে এখানে অবস্থিত মেরি সালুস পপুলি রোমানি আইকনের প্রতি। তিনি তাঁর ৪৭টি আন্তর্জাতিক সফরের আগে ও পরে এবং হাসপাতালে ভর্তির পর এখানে প্রার্থনা করতেন। অতীতে তিনি কার্ডিনাল হিসেবেও রোম ভ্রমণ করলে এই গির্জায় বেড়াতে আসতেন। পোপ ফ্রান্সিসের সাদামাটা জীবন পোপ ফ্রান্সিস এর আসল নাম জর্জ মারিও বের্গোগ্লিও। তিনি ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত রোমান ক্যাথলিক চার্চের একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় সোসাইটি অফ জিসাস বা জেসুইটের সদস্য ছিলেন। জেসুইটরা অত্যন্ত সরল ও বিনয়ী জীবন যাপন করে। পোপ ফ্রান্সিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। পোপদের থাকার জন্য একটি রাজকীয় প্রাসাদ রয়েছে। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস পোপ নির্বাচিত হবার পর ভ্যাটিকানের অ্যাপোস্টলিক প্যালেসের পরিবর্তে, সান্তা মার্তা নামের একটি গেস্টহাউসে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এটি একটি সাধারণ বাসস্থান, যার মধ্যে ছিল একটি শোবার ঘর, বাথরুম এবং অধ্যয়ন কক্ষ। পোপ ফ্রান্সিস ঐতিহ্যবাহী পোপের পোশাকের তুলনায় সাধারণ পোশাক পছন্দ করেতেন। তিনি বিলাসবহুল পোপের জুতোর পরিবর্তে সাধারণ কালো চামড়ার জুতো পরতেন। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যেমন ঘড়ি বা ব্যাগ, সবই সাধারণ এবং কোনটিই ব্যয়বহুল নয়। পোপ ফ্রান্সিস বিলাসবহুল গাড়ির পরিবর্তে সাধারণ গাড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার মনে হয় একজন পুরোহিতের বিলাসবহুল গাড়ি থাকা উচিত নয়। পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানেও গরিব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য খাবার, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলতেন, “একটি গির্জা যদি গরিবদের পাশে না থাকে, তবে তা গির্জা নয়।”পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বাস করতেন যে নেতাদের উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই তিনি িনজে বিলাসিতা পরিহার করে, গির্জার পুরোহিত ও বিশপদের বিলাসিতা ত্যাগ করে সাধারণ জীবনযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে অতীতে অধিকাংশ পোপ কিন্তু পোপ ফ্রান্সিসের মত এতটা বিনয়ী এবং সাদামাটা জীবন যাপন করতেন না। মধ্যযুগের পোপেরা ছিলেন ইউরোপের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তারা একেকজন ক্ষমতালোভী রাজা বা সম্রাটদের চেয়েও অনেক বেশি দুর্ণীতিগ্রস্ত ছিলেন।

কি কেন কিভাবে

নতুন পোপ কিভাবে নির্বাচন করা হয়

ভূমিকা ক্যাথলিক চার্চের ইতিহাসে পোপ নির্বাচন একটি পবিত্র ও ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়া। পোপের মৃত্যু বা পদত্যাগের পর একটি গোপন সভার মাধ্যমে নতুন পোপ নির্বাচিত হন। যিনি পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলে অনুষ্ঠিত এই প্রক্রিয়া কঠোর নিয়ম, গোপনীয়তা এবং আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ। ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরা গোপন ভোটের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নতুন পোপ নির্বাচন করেন। প্রাথমিক পদক্ষেপ পোপের মৃত্যু বা পদত্যাগের পর ভ্যাটিকানের পোপের আসন খালি থাকে, যাকে ল্যাটিন ভাষায় “সেদে ভাকান্তে” বলা হয়। এই সময়ে কার্ডিনালদের কলেজ ভ্যাটিকানের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে। একজন পোপ মারা যাবার পর ক্যামেরলেঙ্গো নামের ভ্যাটিকানের প্রশাসনিক প্রধান তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন। পোপের মৃত্যুর পর নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া কনক্লেভ নামে পরিচিত। এটি ক্যাথলিক চার্চের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি। কনক্লেভ শুরুর আগে ১৫-২০ দিনের একটি প্রস্তুতিমূলক সময় থাকে। এই সময়ের মধ্যে কার্ডিনালরা ভ্যাটিকানে সমবেত হন এবং প্রয়োজনীয় আলোচনা করেন। খ্রিস্টান প্রাদ্রী কার্ডিনাল কারা সেটি বোঝার জন্য খ্রিষ্টান পুরোহিতদের পদানুক্রম সম্পর্কে একটু জানা দরকার। ক্যাথলিক গির্জায় পুরোহিতদের পদবি তিনটি প্রধান স্তরে বিভক্ত: ১. ডিকন (Deacon), ২. প্রিস্ট (Priest), এবং ৩. বিশপ (Bishop)। ডিকন হলো গির্জার সর্বনিম্ন পুরোহিত পদ। তাদের উপরে থাকেন প্রিস্ট, যারা গির্জার দৈনন্দিন ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রিস্টদের প্রধানকে বলা হয় বিশপ। এবং একটি বৃহত্তর অঞ্চলের প্রধান বিশপকে বলা হয় আর্চ বিশপ। সাধারণত বিশপ বা আর্চবিশপদের মধ্য থেকে কার্ডিনাল নির্বাচিত হয়। কার্ডিনালরা গির্জার সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা, যারা পোপের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। বেশিরভাগ কার্ডিনাল বিশ্বব্যাপী গির্জার গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। সর্বোচ্চ মর্যাদার কার্ডিনালরা ভ্যাটিকান ও রোমের নিকটবর্তী এলাকার দায়িত্বে থাকেন। কার্ডিনালরাই মূলত পোপ নির্বাচনে ভোট দেন। তবে সকল কার্ডিনাল ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। শুধুমাত্র ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরাই পোপ নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে পারেন। তাদেরকে বলা হয় কলেজ অফ কার্ডিনালস। সাধারণত ১২০ জনের মতো সদস্য নিয়ে কলেজ অফ কার্ডিনালস গড়ে ওঠে। তবে এই সংখ্যা পরিবর্তিতও হতে পারে। কনক্লেভ ক্যাথলিক গির্জায় পোপ নির্বাচনের জন্য কনক্লেভ নামে যে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে কোনো আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন বা প্রার্থী হিসেবে নাম প্রস্তাবের ব্যবস্থা নেই। বরং, কার্ডিনালরা তাদের বিবেচনার ভিত্তিতে যেকোনো যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারেন। কনক্লেভের গোপনীয়তা এবং আধ্যাত্মিক প্রকৃতির কারণে মনোনয়ন প্রক্রিয়া এড়ানো হয়। বিশ্বাস করা হয় যে Holy Spirit বা পবিত্র আত্মা কার্ডিনালদের সিদ্ধান্তে পথপ্রদর্শন করে। কার্ডিনালরা কনক্লেভ শুরুর আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেন, একে জেনারেল কংগ্রিগেশন বলা হয়। এই আলোচনায় তারা গির্জার চ্যালেঞ্জ, প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের গুণাবলী, এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে কথা বলেন। কনক্লেভ অত্যন্ত গোপনীয়। তাই কার্ডিনালরা বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না। সিস্টিন চ্যাপেলে ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা বাইরের হস্তক্ষেপ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কনক্লেভ শুরুর আগে কার্ডিনালরা গোপনীয়তা রক্ষার শপথও নেন। কার্ডিনালরা গোপন ব্যালটে তাদের পছন্দের ব্যক্তির নাম লেখেন। ঐতিহাসিকভাবে, প্রায় সবসময়ই কার্ডিনালদের মধ্য থেকেই কাউকে নির্বাচিত করা হয়। প্রতিদিন সাধারণত দুই থেকে চার রাউন্ড ভোট হয়। পোপ নির্বাচিত হতে হলে কোনো ব্যক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ভোট প্রয়োজন। যদি একাধিক রাউন্ডে কেউ এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পান, তবে ভোট চলতেই থাকে। যদি কোনো প্রার্থী দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পান, তবে ভোটের কাগজপত্র পুড়িয়ে কালো ধোঁয়া তৈরি করা হয়, যা বাইরে থেকে দেখা যায়। এটি ইঙ্গিত করে যে পোপ নির্বাচিত হননি। যখন একজন প্রার্থী দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পান, তখন ভোটের কাগজপত্র পুড়িয়ে সাদা ধোঁয়া তৈরি করা হয়, যার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন পোপের ঘোষণা নির্বাচিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি পোপের দায়িত্ব গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কিনা। যদি তিনি সম্মত হন, তবে তিনি নতুন পোপ হিসেবে ঘোষিত হন। তখন নতুন পোপ তার ব্যক্তিগত নামের বাইরে একটি পোপীয় নাম গ্রহণ করেন। যেমন জর্জ মারিও পোপ হওয়ার পর তিনি পোপ ফ্রান্সিস নাম ধারণ করেছিলেন। এরপর সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার বারান্দায় কার্ডিনাল প্রোটোডিকন ঘোষণা করেন, “হাবেমুস পাপাম”। ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ “আমাদের পোপ আছেন”। এবং তারপর নতুন পোপের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়। তখন নতুন পোপ জনগণের উদ্দেশে তার প্রথম আশীর্বাদ প্রদান করেন। যাকে বলা হয় উর্বি এট অর্বি, এর অর্থ শহর ও বিশ্বের প্রতি আশীর্বাদ।

কি কেন কিভাবে

খাটাশের বিষ্ঠা থেকে বানানো হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি কফি

সূচনা বিশ্বের সবচেয়ে দামি কফি হিসেবে পরিচিত কপি লুয়াক। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই কফি উৎপাদন করা হয় গন্ধগকুল বা খাটাশের বিষ্টা থেকে। খাটাশের মল দিয়ে তৈরী এক কেজি কফির দাম প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। কপি লুয়াকের উৎপত্তি কপি লুয়াকের নামটি এসেছে ইন্দোনেশিয়ান শব্দ থেকে। যেখানে “কপি” অর্থ কফি এবং “লুয়াক” হলো খাটাশের স্থানীয় নাম। খাটাশের ভালো নাম হল গন্ধগকুল। তবে বাংলাদেশে এই প্রাণীটি খাটাশ নামেই বেশি পরিচিত। ইন্দোনেশিয়ার এই খাটাশ জাতীয় প্রাণীরা বহুকাল আগে থেকেই কফি বাগানে বিচরণ করত। ঔপনিবেশিক যুগে ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় কফি চাষ শুরু করেছিল। সেসময় স্থানীয় কৃষক ও শ্রমিকদের কফি বিন সংগ্রহ বা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়। তবে, তারা লক্ষ্য করেন যে বন্য খাটাশরা কফির ফল খায় এবং তাদের মলের মাধ্যমে আংশিক হজম হওয়া কফি বিন বের হয়ে আসে। ইন্দোনেশিয়ার কৃষকরা এই বিন সংগ্রহ করে পরিষ্কার করতেন এবং সেগুলো ভেজে কফি তৈরি করতেন। সেই কফির স্বাদ এতটাই অনন্য ছিল যে, পরবর্তীতে তা ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে খাটাশের বিষ্ঠা থেকে কফি উৎপাদন করাই এই অঞ্চলের কফি ব্যবসায়ীদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে যায়। উৎপাদন প্রক্রিয়া ইন্দোনেশিয়ার গন্ধগকুল কফি গাছের পাকা চেরি ফল খায়। তারা খাওয়ার জন্য সবচেয়ে মিষ্টি ও পাকা চেরি বেছে নেয়, যার ফলে এই কফির গুণগত মানও হয় অনেক ভালো। খাটাশের পাকস্থলীতে থাকা এনজাইম কফি চেরির বাইরের মাংসল অংশ হজম করে ফেলে। কিন্তু তারা ভেতরের বিন হজম করতে পারে না। তবে তাদের পেটের মধ্যে বিনের প্রোটিন ভেঙে যায়, যা কফির স্বাদে একটি অনন্য মসৃণতা ও বিশেষত্ব যোগ করে। কৃষকরা বনের মাটি থেকে গন্ধগোকুলের মল সংগ্রহ করে। তারপর সেগুলো ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। এরপর পরিষ্কার বিন শুকানো হয়, ভাজা হয় এবং শেষধাপে প্যাকেজিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়। অধুনিক সময়ে কিছু খামারে খাঁচার মধ্যে গন্ধগকুল পালন করে তাদের কফি চেরি খাওয়ানো হয়। এরপর সেখান থেকে মল সংগ্রহ করে কপি লুয়াক উৎপাদন করা হয়। বাজার মূল্য কফি প্রেমীরা বলে কপি লুয়াকের স্বাদ বিশ্বের অন্যান্য কফির থেকে আলাদা। খাটাশের হজম প্রক্রিয়ার কারণে কফির তিক্ততা অনেক কমে যায়, ফলে এটি অত্যন্ত মসৃণ ও নরম স্বাদের হয়ে থাকে। এর অ্যাসিডিটি তুলনামূলকভাবে কম, যা এটিকে পাকস্থলীর জন্য আরও আরামদায়ক করে তোলে। কপি লুয়াকের সীমিত উৎপাদন এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে চাইলেও বিপুল পরিমাণ কফি উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। আর দুষ্প্রাপ্যতার কারণেই কপি লুয়াকের দাম হয়েছে আকাশচুম্বী। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি কপি লুয়াকের দাম ১০০ থেকে ৬০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, উচ্চমানের বন্য খাটাশের কফির দাম প্রতি কেজিতে ১০০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। তারমানে খাটাশের বিষ্টা দিয়ে তৈরী এক কেজি কফির দাম প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তাছাড়া এক কাপ কফি লুয়াকের দাম সাড়ে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে থাকে। এত উচ্চ মূল্যের কারণে এটি প্রায়শই উপহার হিসেবে বা বিশেষ অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। নৈতিক ও পরিবেশগত উদ্বেগ কফি লুয়াকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর উৎপাদন নিয়ে নৈতিক ও পরিবেশগত উদ্বেগও বেড়েছে। বাণিজ্যিক চাহিদা মেটাতে অনেক খামারে গন্ধগকুলকে খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয় এবং জোর করে অতিরিক্ত কফি চেরি খাওয়ানো হয়। এটি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জন্য ক্ষতিকর। বন্য খাটাশের তুলনায় খাঁচায় রাখা খাটাশের উৎপাদিত কফির গুণগত মানও কম হয়। ব্যাপক উৎপাদনের জন্য বন উজাড় করে কফি বাগান সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, যার ফলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। অধিক দামের কারণে, অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ কফি বিনকে কফি লুয়াক বলে বিক্রি করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু কোম্পানি কৃত্রিমভাবে খাটাশের এনজাইম প্রক্রিয়া অনুকরণ করে কফি তৈরি করছে, যাতে প্রাণী প্রতি নিষ্ঠুরতা এড়ানো যায়। ইন্দোনেশিয়ার যেসব বাগানে কপি লুয়াক উৎপন্ন হয়, সেসব বাগান এখন রীতিমত জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। প্রাণীর মল থেকে সংগ্রহ করা হয় বলে, কিছু ধর্মীয় পণ্ডিত মনে করেন, এটি ব্যবহার করা উচিত নয়। আবার, অন্য পণ্ডিতরা মনে করেন, যেহেতু কফি তৈরির প্রক্রিয়ায় মল ব্যবহার করা হয় না, তাই এটি হালাল। আপনাদের কি মনে হয় এই কফি খাওয়া কি ঠিক এবং এত দাম দিয়ে কি আপনি কপি লুয়াক খাবেন?

Shopping Cart
Scroll to Top