কানাডা এবং ভারত উত্তেজনার কারণ কী
কানাডা এবং ভারত উত্তেজনার কারণ কী
সাম্প্রতিক সময়ে কানাডা এবং ভারতের কূটনৈতিক বিরোধ বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জি-২০ সম্মেলনে জাস্টিন ট্রুডো এবং নরেন্দ্র মোদির দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বাতিল, শুল্কমুক্ত বাণিজ্য আলোচনা বাতিল সহ বেশ কিছু বিষয় থেকে দুই দেশের সম্পর্কে অবনতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল।
কয়েক মাস আগে কানাডায় বসবাসকারী শিখ সম্প্রদায়ের নেতা হারদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দাবি করেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে। এরপর থেকেই মূলত দুই দেশের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং কূটনীতিক বহিঃষ্কারের মাধ্যমে কানাডা এবং ভারতের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ভারত-কানাডা সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী ফাটলের আশঙ্কা করছেন।
কানাডায় শিখ সম্প্রদায়
ভারত এবং কানাডার মধ্যে তৈরী হওয়া বৈরিতার মূলে রয়েছে কানাডা প্রবাসী শিখ সম্প্রদায়। কানাডার মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪ শতাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এবং এদের অর্ধেকের বেশি শিখ জনগোষ্ঠী। প্রায় ১৪ লাখ ভারতীয় কানাডায় বসবাস করে, যাদের মধ্যে শিখদের সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার। সে হিসেবে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ বাস করে কানাডায়। ভারত বরাবরই দাবি করে আসছিল যে, কানাডায় বসবাসকারী শিখরা খালিস্তান আন্দোলনের মত বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করে। ভারতের পাঞ্জাব এবং পাকিস্থানের কিছু অংশ মিলে, শিখ সম্প্রদায়ের জনগণ খালিস্তান নামে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। ভারতে বসবাসকারী শিখদের চেয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা প্রবাসী শিখরা খালিস্তান আন্দোলন নিয়ে বেশি সক্রিয়। সেকারণে ভারতে খালিস্তানপন্থীরা কোন অঘটন ঘটালে, বিদেশে গিয়ে সহজেই প্রবাসী শিখদের আশ্রয় পায়। ভারত সরকার এই বিষয়টি এর আগেও একাধিকবার কানাডা সরকারকে জানিয়েছিল।
১৯৮৪ সালে খালিস্তান আন্দোলন দমনের জন্য, ইন্দিরা গান্ধি সরকারের নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী, শিখদের সবচেয়ে পবিত্রস্থান পাঞ্জাবের অমৃতসরে অবস্থিত স্বর্ণ মন্দিরে Operation Blue Star নামে এক অভিযান চালিয়ে বহু শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে দুইজন পাঞ্জাবি শিখ দেহরক্ষী ইন্দিরা গান্ধিকে গুলি করে হত্যা করে। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডা প্রাবাসী শিখদের একাংশ, ইন্দিরা গান্ধির হত্যাকান্ডের সেই ঘটনাকে গৌরবান্বিত করে উৎযাপন করে। এরপর পরই ভারত বিষয়টিতে আপত্তি জানালেও, কানাডা একে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
হারদীপ সিং নিজ্জর কে?
অনেকেই মনে করছেন খালিস্তান আন্দোলন দমনের প্রচেষ্টা হিসেবে হারদীপ সিং নিজ্জর কে হত্যা করা হয়েছে। হারদীপ সিং ১৯৭৭ সালে পাঞ্জাব রাজ্যের জলন্ধর জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। এক হিন্দু পুরোহিতকে খুনের মামলায় হারদীপ সিং পলাতক ছিলেন। তাকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ রুপি পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল ভারত সরকার। তিনি ১৯৯৭ সালে ভুয়া পার্সপোর্ট এর সাহায্যে কানাডায় পাড়ি জমান। এবং কানাডায় গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। কিন্তু বেশ কয়েক দফা তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। পরবর্তীতে তিনি বৈবাহিক সূত্রে কানাডিয়ান নাগরিকত্ব লাভ করেন। ভারতের অভিযোগ হল, হারদীপ সিং খালিস্তান আন্দোলনের একজন নেতা। ভারতে দৃষ্টিতে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ খালিস্তান টাইগার ফোর্সের মূল পরিকল্পনাকারী এই হারদীপ সিং। এছাড়া শিখ ফর জাস্টিস নামে ভারতে নিষিদ্ধ আরেকটি সংগঠনের সঙ্গেও হারদীপ যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২০ সালে ভারত সরকার হারদীপ সিংকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেয়। এবং ভারতের ওয়ান্টেড তালিকায়ও তার নাম ছিল।
২০২৩ সালের ১৫ জুন শিখদের আরেক নেতা, খালিস্তান লিবারেশন ফোর্সের প্রধান আভতার সিং যুক্তরাজ্যের পুলিশ হেফাজতে মারা যান। তার তিন দিন পর, ১৮ জুন কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের শিখ অধ্যুষিত এক এলাকায় হারদীপ সিং কে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তদন্ত শুরু করে। সেই তদন্ত প্রতিবেদন থেকেই জাস্টিন ট্রুডো হারদিপ সিং হত্যায় ভারত সরকারের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলে।
পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ
কানডার পার্লামেন্টে বক্তব্য রাখার সময় জাস্টিন ট্রুডো জানান, তিনি ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে, কানাডায় শিখ নেতা হত্যার সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামনে তুলে ধরেন। কিন্তু মোদি বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।
ট্রুডোর দাবি, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা একসাথে তদন্ত করে, এই হত্যা কান্ডের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয় বা ‘র’এর জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পেয়েছে। এর ফলে কানাডায় নিযুক্ত ‘র’ এর প্রধানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কানাডীয় একজন শীর্ষ কূটনীতিককে ভারত ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। এবং হারদিপ সিং এর হত্যার সাথে ভারতের জড়িত থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয় ভারত সরকার। তারপর থেকে কানাডার নাগরিকদের ভারতীয় ভিসা দেওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স
কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এই পাঁচটি উন্নত দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে একসাথে বলা হয় ‘ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স’। এই পাঁচ দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান প্রদানের একটি চুক্তি আছে। কোন তথ্য যত সংবেদনশীলই হোক না কেন, তা নিজেদের মধ্যে আদান প্রদানের জন্য ফাইভ আইজ অঙ্গীকারবদ্ধ। ট্রুডো চাচ্ছিলেন কানাডিয়ান নাগরিক হারদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা জড়িত থাকার বিষয়টি নিয়ে ফাইভ আইজ যেন একটি যৌথ বিবৃতি দেয়। যাতে করে ভারতকে সম্মিলিত চাপের মুখে ফেলা যায়।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় বল হয়েছে, ‘ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স’ সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। আর সে কারণেই কানাডিয়ান পার্লামেন্টে ট্রুডো একাই এই অভিযোগ পেশ করেছেন। তিনি ভারতের জড়িত থাকার অভিযোগ করলেও, এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ দেননি।
ট্রুডোর রাজনীতি
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন জাস্টিন ট্রুডো তার ব্যক্তিগত রাজনীতি বাঁচানোর জন্যই ভারত কানাডা সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন। ২০২১ সালে কানাডার নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টি সংসদে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যার্থ হয়। তখন কানাডার পার্লামেন্টের চতুর্থ বৃহত্তম দল ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা এনডিপি ট্রুডোর দলকে সমর্থন করে। এরমাধ্যমে জাস্টিন ট্রুডো তৃতীয়বারের মত কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে তার সাহায্যে এগিয়ে আসা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির শীর্ষ নেতা হলেন, জাগমিত সিং। জাগমিত সিং নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রুডোর কট্টোর সমালোচক ছিলেন এবং অনেকেই ধারণা করছিলেন কানাডার তুমুল জনপ্রিয় এই রাজনীতিবিদ হয়ত ট্রুডোকে সরিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উঠে আসবেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ট্রুডোকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেন। জাগমিত সিং প্রকাশ্যে খালিস্তান আন্দোলনের একজন সমর্থন। বর্তমানে কানাডার পার্লামেন্টে ট্রুডোর চেয়ে জাগমিত সিং এর মাত্র ১০ টি আসন কম রয়েছে। তাই পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করাতে ট্রুডো সরকারের ভরসা জগমিত সিংয়ের এনডিপি। তাছাড়া ট্রুডো সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার মত ক্ষমতা রয়েছে জাগমিত সিংয়ের দলের। অনেকেই মনে করছেন সেই সুযোগ নিয়েই জাগমিত সিং জাস্টিন ট্রুডোকে দিয়ে হারদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকান্ডের বিষয়টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন।
শিখরা কানাডার মোট জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশের কিছু বেশি। কিন্তু বহু আসনের ফলাফল প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে শিখদের হাতে। সেকারনে ট্রুডো সরকার শিখ ভোট ব্যাংক হাতে রাখার জন্য খালিস্তান পন্থীদের হয়ে ভারতের বিপক্ষে নেমেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
পয়েন্ট অব নো রিটার্ন
পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই মনে করছেন, ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পর কানাডা বিষয়টি এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছে, কূটনীতির ভাষায় যাকে বলে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’। তারমানে যেখান থেকে পুরনো স্বাভাবিক বন্ধুত্বে ফিরে আসাটা খুব মুশকিল।
ভারতের বিরুদ্ধে করা অভিযোগে, ট্রুডোপশ্চিমা অন্যান্য দেশগুলোকে পাশে পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের বিশাল বাজার পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে একটি বড় আকর্ষনের বিষয়। সেই সাথে চীনের উত্থান ঠেকাতে ভারতকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার মনে করা হয়। সেকারণে অন্য কোন পশ্চিমা দেশগুলোও এই মুহুর্তে কানাডার পক্ষ নিয়ে ভারতের বিপক্ষে যেতে চাইবে না।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে ট্রুডো সরকার, ভারতের মত একটি দেশের সাথে কানডার সম্পর্ক খারাপ করছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ভারত-কানাডা নিয়মিত কূটনৈতিক কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে আছে। ভারত কানাডার দশম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। দুই দেশের মধ্যে ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয়ে থাকে। ভারত এবং কানাডা প্রায় এক দশক ধরে একটি বানিজ্য চুক্তি নিয়ে কাজ করছে। চুক্তির শর্তগুলোও এ বছরের মধ্যেই ঠিক হওয়ার কথা ছিল। এবং চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সেই কাঙ্খিত বানিজ্য চুক্তি বিষয়ে দুই দেশের শীর্ষ ব্যক্তিদের বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে, কানাডা ভারতের সাথে বানিজ্য চুক্তির আলোচনা বাতিল করে। সেই সাথে ভারতে আরো একটি বানিজ্য মিশনের পরিকল্পনাও বাতিল করেছে কানাডা। অন্যদিকে জি ২০ বৈঠকের সময় নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের শীর্ষ নেতাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করলেও, জাস্টিন ট্রুডোকে এই তালিকা থেকে বাদ রেখেছিলেন। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিশ্লেষকেরা বলছেন রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিষয়টি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।