মসজিদে নববী
মসজিদে নববী
ইসলামের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান মসজিদে নববী। মসজিদ আল হারামের পরই মসজিদে নববীর স্থান। মসজিদে নববী শুধু উপাসানার যায়গা নয়, এটি একাধারে সম্মেলন কেন্দ্র, বিচারালয় এবং ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতি বছর হজ্জের আগে বা পরে সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মুসলিম এই মসজিদে ইবাদত করতে আসে।
হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কা ছেড়ে মদিনায় আসার পর মসজিদে নববী নির্মান করেন। মহানবী (স) নিজে এই মসজিদ নির্মানের জন্য শারিরীক শ্রম দিয়েছেন। সর্বপ্রথম মসজিদে নববীর দৈর্ঘ্য ছিল ১১৭ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ১০০ ফুট। তখন মসজিদের খুটি নির্মান করা হয়েছিল খেজুর গাছের কান্ড দিয়ে, এর ছাদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল খেজুর গাছের পাতা ও কাদার আস্তরন এবং মেঝেতে ছিল মরুভূমির বালি। খায়বারের যুদ্ধের পরে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে, মসজিদের সম্প্রসারণ করা হয়। তখন মসজিদের সবদিকে ১৫৫ ফুট করে সীমানা বৃদ্ধি পায়। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা) শাসনামল পর্যন্ত মসজিদের সেই আকার অপরিবর্তিত ছিল। এরপর দ্বিতীয় খলিফা হয়রত উমর (রা) মসজিদের সীমানা বৃদ্ধি করেন এবং মসজিদের মেঝেতে পাথর বসান। তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা) নতুন করে মসজিদটি নির্মান করেন, তিনি খেজুর গাছের কান্ডের বদলে, লোহা ও পাথর দিয়ে মসজিদের খুটি স্থাপন করেন এবং ছাদ নির্মান করতে সেগুন কাঠ ব্যবহার করেন। এরপর উমাইয়া, আব্বাসীয়, উসমানীয় এবং সর্বশেষ সৌদ রাজ পরিবারের শাসনামলে, বহু ধাপে মসজিদের সীমানা সম্প্রসারণ এবং মসজিদের কাঠামোর উন্নয়ন করা হয়েছে।
মসজিদে নববীর একটি প্রতিকী অংশ হল সবুজ গম্বুজ। এই জায়গাটি ছিল হযরত মুহাম্মদ (সা) এর বাসগৃহ। বর্তমানে মসজিদের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত এই গম্বুজের নিচে রয়েছে, মহানবী (সা) এর রওজা বা সমাধি। নবীজী (সা) এর সমাধির পাশে তাঁর ঘনিষ্ট দুই সহচর হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (রা) এর সমাধিও রয়েছে। এবং তাদের পাশে আরো একটি সমাধির যায়গা হযরত ঈসা (আ) এর জন্য খালি রাখা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী হযরত ঈসা (আ) কে জীবিত অবস্থায় আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, তিনি আবারো পৃথিবীতে ফিরে আসবেন; এবং তাঁর দ্বায়িত্ব সম্পাদন করে মারা যাবার পর, হযরত ঈসা (আ) কে হয়রত মুহাম্মদ (সা) এর রওজার পাশে থাকা খালি জায়গায় সমাহিত করা হবে। রাসূল (সা) এর রওজা জিয়ারত করার জন্য যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয়, তার নাম বাব উস সালাম এবং জিয়ারত শেষে বাব উল বাকী নামক দরজা দিয়ে বের হতে হয়। নবীজী (সা) এর রওজার দরজা কখনও খোলা হয় না; কারণ অনেকেই সেখানে গিয়ে সিজদা করতে পারে; ইসলামে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদাহ করা জায়েজ নেই। মহানবী (স) এর রওজা থেকে মসজিদে নববীর মিম্বার পর্যন্ত বিস্তৃত যায়গাটি কে বলা হয় রিয়াদুল জান্নাহ; যার অর্থ জান্নাতের বাগান। এই জায়গার মধ্যে নামাজ আদায় করা, জান্নাতের বাগানে নামাজ আদায় করার সামিল। রিয়াদুল জান্নার মধ্যে থেকে কোন দোয়া করা হলে, তা অবশ্যই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়। হজ্জের সময় আগত সকল মুসল্লিরা এখানে নামাজ আদায় করতে চায়, কিন্তু সবসময় এখানে নামাজ আদায়ের জায়গা পাওয়া যায় না।
হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবদ্দশায় মদিনার যতটুকু অংশজুড়ে মানব বসতি ছিল, তার অনেকাংশই এখন মসজিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এর প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, অতীতে মদিনা জনবসতির একেবারে শেষ প্রান্তে ছিল জান্নাত উল বাকী কবরস্থান। আর বর্তমানে জান্নাতুল বাকী মসজিদে নববীর প্রাঙ্গনের পাশেই অবস্থিত। জান্নাতুল বাকী করস্থানে মহানবী (স) এর স্ত্রী, আতœীয় স্বজন সহ বেশ কয়েক হাজার সাহাবীর করব রয়েছে। বর্তমান সময়ে মসজিদে নববী, এর প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের আয়তনের চেয়ে ১০০ গুণেরও বড়। মসজিদে নববীর ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৬ লক্ষ। তবে হজ্জের মৌসুমে প্রায় ১০ লক্ষের বেশি লোক এই মসজিদ প্রাঙ্গনে জমায়েত হতে পারে। অতীতে এই মসজিদ ছিল ইসলামী জ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র। মসজিদে সবসময় একদল সাহাবী বসবাস করত; তাদেরকে বলা হত আসহাবে সুফফা। তারা ইসলামের জ্ঞান অর্জনের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল। পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকেই বহু সংখ্যক হাদিস সংগ্রহ করা হয়েছে। মসজিদের প্রাঙ্গনে ছাতার মত তাঁবু রয়েছে। একটি জার্মান স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান এই ছাতাগুলো নির্মান করেছে। ১৯০৯ সালে সমগ্র অরব উপদ্বীপের মধ্যে মসজিদে নববীতেই সর্বপ্রথম বৈদুত্যিক বাতি জ্বালানো হয়। বলা হয়ে থাকে, তৎকালীন অটোমান স¤্রাট তার প্রাসাদে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার আগে, এই মসজিদে বিদ্যুৎ পৌছানোর ব্যবস্থা করেন।