সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ শহর নিয়ম
সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ শহর নিয়ম
সৌদি আরব খনিজ তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে এবং সামগ্রীক অর্থনীতিকে আরো বৈচিত্রময় করতে ষৌদি ভিশন ২০৩০ গ্রহণ করেছে। ২০১৭ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ কনফারেন্সে কল্প কাহিনীকে বাস্তবে পরিণত করার মত এক প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পের নাম নিওম। নিওমের অধীনে সৌদি আরবে এমন সব নগর অঞ্চল গড়ে তোলার পরিবকল্পনা করা হয়েছে, যা অতীতে কেউ কখনও কল্পনাও করেনি। অনেকেই মনে করেন, নিয়ম হয়ত একটি শহর। কিন্তু বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। নিয়ম মূলত উত্তরাধুনিক শহর তৈরীর একটি নতুন ধারণা। বর্তমানে নিওম প্রকল্পের অধীনে তিনটি নগর অঞ্চল পরিকল্পনাধীন রয়েছে। ১. দা লাইন ২. অক্সাগন এবং ৩. ট্রোজেনা। নির্মাতারা নিয়ম প্রকল্পের শহর গুলোকে শুধু স্মার্ট সিটি বলতে রাজি নন। তারা বলছেন এগুলো হতে যাচ্ছে পৃথিবীর সর্বপ্রথম কগনেটিভ সিটি। অর্থাৎ এমন শহর যার নিজস্ব জ্ঞান আছে।
নিওম নামটি দুুটি শব্দ থেকে এসেছে। প্রথম তিনটি অক্ষর ঘঊঙ হল প্রাচীন গ্রীক উপসর্গ। যার অর্থ নতুন। এবং চতুর্থ অক্ষর গ দ্বারা আরবি শব্দ মুসতাকবাল বোঝানো হয়েছে। যার অর্থ ভবিষ্যত। তারমানে ঘঊঙগ এর পূর্ণাঙ্গ অর্থ দাঁড়ায় নতুন ভবিষ্যত। নিওমের প্রধান তিনটি প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত অঞ্চল হল দা লাইন। প্রথাগত শহরের অবকাঠামো এবং পরিবহণ ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে এই শহর। দা লাইন শহরের দৈর্ঘ্য হবে ১৭০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ মাত্র ২০০ মিটার। এত দীর্ঘ শহর হলেও, এখানে কোন গাড়ি চলবে না। তবে অতি আধুনিক বিশেষ ধরনের পরিবহনের সাহায্যে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে মাত্র ২০ মিনিট সময় লাগবে। এছাড়া প্রতিটি বাসাবাড়ি থেকে মাত্র ৫ মিনিটের দূরত্বেই প্রয়োজনীয় সকল নাগরিক সুবিধা পাওয়া যাবে। এখানে বসবাস করলে ব্যক্তিগত গাড়ির দরকার হবে না, ফলে এখান থেকে কোন ধরনের কার্বন নিঃসরণেরও সম্ভাবনা নেই। দ্যা লাইন শহরের জন্য প্রয়োজনীয় শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, বাতাস এবং সূর্যের আলোর মত নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক উৎস থেকে। প্রথাগত শহরের চেয়ে আলাদা হবার কারণে, এখানে বসবাসকারী নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণকে প্রধান্য দেওয়া হবে। শহরের ৯৫ শতাশ জমি প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য সংরক্ষন করা হবে। এখানে বসবাসের জন্য সারা বছর আদর্শ জলবায়ু নিশ্চিত করা হবে। এই শহরের মূল্য লক্ষ্যই হল, বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বিপুল জায়গা অপচয় না করে, সামান্য এলাকার পরিকল্পিত ব্যবহার করা। শহরটিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০ মিটার উচ্চতায় গতে তোলা হবে। শহরের নির্মান কাজ সম্পন্ন হলে, সব মিলিয়ে শহরের আয়তন দাঁড়াবে মাত্র ৩৪ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তুস এত অল্প জায়গায় প্রায় ৯০ লাখ লোক বসবাস করতে পারবে।
নিয়ম প্রকল্পের পার্বত্য অঞ্চল হল ট্রোজেনা। আকাবা উপসাগর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে, ১ হাজার ৫০০ মিটার থেকে ২ হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতায় এই অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। সমগ্র ট্রোজেনা প্রকল্পের আয়তন হবে প্রায় ৬০ বর্গ কিলোমিটার। এখানে শীতকালে তামপাত্রা শূণ্য ডিগ্রীর নিচে থাকবে, এবং বছরের অনান্য সময়ে, আশেপাশের অঞ্চল থেকে কমপক্ষে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ঠান্ডা থাকবে। কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ট্রোজেনাকে এমনভাবে গড়ে তোলা হবে, যার অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে আগে কেউ কখনও পায়নি। প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে, কৃত্রিম ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনের অন্যন্য মিশেলে এই জায়গাকে তৈরী করা হবে। পুরো প্রকল্পটিকে ৬টি ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের নকশায় সাজানো হবে। সেগুলো হল: ১. দা ভল্ট ২. দা লেক ৩. অবজারভেটরি ৪. আল্ট্রা লাক্সারি ম্যানশন ৫. স্কি ভিলেজ এবং ৬. ওয়াইল্ড লাইফ রিজার্ভ। কর্তৃপক্ষের দাবি দা ভল্ট হল কল্পনা আর বাস্তবতার মিশেলে তৈরী এক গ্রাম। এই জায়গার নিজস্ব বাতাস, পানি সহ আলাদা জলবায়ু থাকবে। দা লেক হল ট্রোজেনার হৃদপিন্ডের মত। এই লেক কে কেন্দ্র করে বিলাস বহুল আবাসন গতে তোলা হবে, সেই সাথে এখানে নানা রকমের ওয়াটার স্পোর্সের আয়োজন করা হবে। ট্রোজেনার সবচেয়ে সেরা জায়গা হবে অবজারভেরি। এখানকার রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খেতে খেতে, আশে পাশের বিস্তৃত অঞ্চলের সেরা দৃশ্য উপভোগ করা যাবে। রাতের বেলা অবজারভেটরি থেকে তারা দেখারও বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। ট্রোজেনায় বসবাসের জন্য সবচেয়ে সেরা জায়গা হবে, আল্ট্রা লাক্সারি ম্যানশন। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এখানে বিশ্বের শীর্ষ ধনীরা থাকবে। বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা আর্কিটেক্টরা এখানকার লেক ভিউ এবং হিল ভিউ প্রাসাদগুলো তৈরী করবে। এডভেঞ্চার প্রেমীদের জন্য ট্রোজেনার সেরা জায়গা হবে স্কি ভিলেজ। এখানে দিনের বেলা বিভিন্ন এডভেঞ্চার স্পোটর্স এবং রাতের বেলা পাঁচ তারকা মানের সুবিধা সম্বলিত বিনোদন ইভেন্টের আয়োজন করা হবে। এছাড়া ট্রোজেনার ওয়াইল্ড লাইফ রিজার্ভে নানা ধরনের বন্য প্রাণী থাকবে, সেই প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে অগমেন্টেন্ড রিয়ালিটি যুক্ত করা হবে। স্থায়ী বসবাস এবং পর্যটন, উভয় ক্ষেত্রেই ট্রোজেনা আকর্ষনীয় গন্তব্যে পরিণত হবে। এছাড়া ৪টি ঋতু ভেদে সারা বছর নাগরিক এবং পর্যটকদের জন্য; স্কিয়িং, ¯েœা বোর্ডিং, আইস স্কেটিং, মাউন্টেইন বাইকিং, প্যারাগ্লাইডিং, উইন্টার ফ্যাশন উইক, মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, আর্ট ফেয়ার, লাইট শো, কালচারাল উইক, অল্টারনেটিভ মেডিসিন, ইয়োগা রিট্রিট সহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে।
নিওম প্রকল্পের প্রধান বানিজ্যিক এবং প্রযুক্তিক কেন্দ্র হবে অক্সাগন। এটিই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাসমান অবকাঠামো। এই নগর প্রকল্পের আয়তন হবে প্রায় ৪৮ বর্গ কিলোমিটার। অক্সাগন শহরে সম্পূর্ণ অটোমেটেড সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলা হবে। এখানকার সাপ্লাই চেইনের সকল ধাপে অতি আধুনিক প্রযুক্তি এবং রোবট কাজ করবে। এছাড়াও উত্তরাধুনিক এই বন্দর নগরীতে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী হবে। সেই সাথে ৯০ হাজার মানুষ এখানে বসবাস করতে পারবে। এখানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য অভাবনীয় ব প্রযুক্তি পণ্য তৈরী করা হবে। এখানে বিশ্বের উদ্ভবনী উদ্যোক্তাদের জন্য সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকবে। অক্সাগন শহরে সমুদ্র বন্দর ছাড়াও থাকবে ক্রুজ টার্মিনাল, ব্লু ইকোনমি ইন্ড্রাস্ট্রি, ওশোনোগ্রাফিক রিসার্চ সেন্টার, এনার্জি, ফুড এন্ড ওয়াটার ইনোভেশন হাব সহ বহু স্পর্শকাতর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। দ্যা লাইন শহরের সাথে হাই স্পিড ট্রেনের সাথে যুক্ত থাকবে অক্সাগন শহর। এছাড়া নিওম এয়ার পোর্টের সাথেও এর সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখা হবে। যে এয়ার পোর্ট থেকে বিশ্বের ৪০ শতাংশ গন্তব্যে যেতে মাত্র ৬ ঘন্টারও কম সময় লাগবে। নিওম কর্তৃপক্ষের মতে, অক্সাগন হতে যাচ্ছে বিশ্বের সার্কুলার ইকোনমির ব্লুপ্রিন্ট। অর্থাৎ এখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই ভবিষ্যতের অতি আধুনিক বানিজ্যিক অঞ্চলগুলো গড়ে উঠবে।
সৌদি আরবের এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। এত সব প্রকল্পের মধ্যে শুধু মাত্র দা লইন শহরেরই বাজেট ধরা হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। নিওম প্রকল্পের শহরগুলো স্মার্ট টেকনোলজিতে পরিচালিত হবার কারণে, প্রতিনিয়ত নাগরিকদের সম্পর্কে বিপুল তথ্য সংগ্রহ করা হবে। বলতে গেলে এমন কোন তখ্য নেই যা, নগর কর্তৃপক্ষ জানবে না। সব মিলিয়ে এটি একটি পর্যবেক্ষণ শহরে পরিণত হবে। ফলে এখানকার নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য বলে কিছু থাকবে না। এছাড়া এত বড় প্রকল্প, সত্যিকার অর্থে পরিবেশ বান্ধব করা মোটেও সহজ নয়। এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশও বজায় থাকবে, আবার সারাবছর কৃত্রিমভাবে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণও করা হবে। এই দুটি বিষয় পরস্পর সাংঘর্ষিক। কোন অঞ্চলের জলবায়ু কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রন করতে যত উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হোক না কেন, তা সমগ্র পৃথিবীর প্রকৃতি এবং জলবায়ুর উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবেই। নিওম হবে সৌদি আরব দেশের মধ্যে আরেক দেশ। এখানে সৌদি আরবের প্রচলিত আইন চলবে না। নিওম অঞ্চল গুলোর জন্য আলাদা আইন কানুন সহ পৃথক পরিচালনা ব্যবস্থা থাকবে। কল্প কাহিনীর মত এসব শহর বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে।