অপেনহাইমার
অপেনহাইমার
জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমার ভয়াবহতার কথা আমরা সবাই শুনেছি। বিজ্ঞানের সুফল এবং কুফলের মধ্যে বিতর্ক উঠলে, পারমানবিক শক্তি আবিষ্কারের কথা আসে সবার আগে। এসব বিষয়ের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত এক নাম রবার্ট অপেনহাইমার। সিনেমার মাধ্যমে ‘পারমানবিক বোমার জনক’, অপেনহাইমারকে জনমনে আবারও ফিরিয়ে এনেছেন হলিউড পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। তাঁর ছবি ‘অপেনহাইমার’ এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ অপেনহাইমার বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। তাঁকে বলা হয় “father of the atomic bomb”। অপেনহাইমারের নেতৃত্বেই আমেরিকানরা প্রথম পারমানবিক বোমা তৈরী করে পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তবে পারমানবিক শক্তি উন্মোচনের এই কৃতিত্ব অপেনহাইমারের একার নয়। বরং অপেনহাইমার তার কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা সাধনার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের কাছ থেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর, পারমানবিক বোমা আবিষ্কারের জন্য হাইজেনবার্গ ও অপেনহাইমারের মধ্যে অদৃশ্য এক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেসময় জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে খুঁজতে থাকে এটম বোমা বা পারমানবিক বোমা তৈরির কৌশল। মানব ইতিহাসের সবচাইতে শক্তিশালী মারণাস্ত্র, পারমানবিক বোমা আবিষ্কারের চেষ্টায় জার্মান বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ অপেনহাইমারের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তিনি তার কাজ শেষ করতে পারেননি। অন্যদিকে অপেনহাইমার মার্কিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের সহায়তায় এই অসাধ্যকে সাধন করতে পেরেছিলেন। রবার্ট অপেনহাইমার হাইজেনবার্গ থেকে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও কিভাবে সবার আগে পারমানবিকে বোমা আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন, তা বোঝার জন্য তৎকালীন সময়ের বিশ্বরাজনীতি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কেও জানতে হবে। মার্কিন বিজ্ঞানী অপেনহাইার এবং জার্মান বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের গবেষণার ইতিহাস অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। কারণ এর প্রাথমিক ধাপগুলো হাইজেনবার্গই সবার আগে সম্পন্ন করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির তরুণ বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ পদার্থ বিজ্ঞানের নতুন শাখা কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে কাজ শুরু করেন। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা হচ্ছে বস্তুর সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক – পরমাণুর পদার্থবিদ্যা। ১৯২৫ সালে হাইজেনবার্গ একটি পরমাণুর ভেতরকার ক্ষুদ্র কনা, ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের আচরণ সম্পর্কে গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। অতিপারমানবিক অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করা এ তত্ত্ব “হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তাবাদ” নামে পরিচিত। ১৯৩২ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে বিশেষ অবদানের জন্য হাইজেনবার্গ পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ঠিক একই সময়ে জার্মানির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আবির্ভুত হচ্ছিল এক নতুন শক্তি দ্য ন্যাশনাল সোশালিস্ট পার্টি বা নাৎসি পার্টি। অন্যদিকে হাইজেনবার্গের গবেষণা জার্মানী থেকে ৫ হাজার মাইল দূরে, আমেরিকান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ রবার্ট অপেনহাইমার কে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করছিল। ১৯৩৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানীদের একটি দল ইউরেনিয়ামের একটি পরমাণু কে বিভক্ত করে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়। নতুন ধরনের এই পারমানবিক বিক্রিয়ায়, রাসায়নিক বিক্রিয়ার চেয়ে ৫ কোটি গুন বেশি শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হয়। ততদিন পর্যন্ত পারমানবিক বোমা একটি তাত্ত্বিক বিষয় থাকলেও, এই পরীক্ষার পরে হাইজেনবার্গ ও অপেনহাইমার দুইজনেই বুঝতে পারেন পারমানবিক বোমা খুব শীঘ্রই বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে।
ইহুদি প্রযুক্তি
১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে হাইজেনবার্গ, নাৎসি পার্টিকে এটম বোমা তৈরির প্রস্তাব দেন। সেসময় ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকলে হিটলার পোল্যান্ড দখল করে নেয়। তখন ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নাৎসি রা তখন অতি দ্রুত ইউরোপের অন্যান্য অংশের দখল নিতে চাচ্ছিল, এবং সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এটম বোমা নাৎসিদের খুব দরকার ছিল। হাইজেনবার্গও নাৎসিদের প্রত্যাশা পূরণের উদ্দেশ্যে, জার্মানির লিপজিগে অবস্থিত তার পরীক্ষাগারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল. পারমানবিক বোমা তৈরীর জন্য যে পরিমাণ জনবল আর বাজেট দরকার ছিল, হাইজেনবার্গ সে ধরনের সাহায্য সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছিলেন না। কারণ হিটলার মনে করত, পারমানবিক বোমা একটি ইহুদি প্রযুক্তি।
প্রজেক্ট ম্যানহাটন
নানা ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও হাইজেনবার্গ তার পারমানবিক বোমা তৈরীর প্রক্রিয়ায় অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে আমেরিকাতে তখনও পারমানবিক রহস্য উন্মোচনের কাজ বলতে গেলে শুরুই হয়নি। ঠিক এমন সময়ে পৃথিবী শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন, আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কে চিঠি লিখে জানান, জার্মানরা এক সুপার ওয়েপন তৈরি করছে যা নিমিষেই একটি শহরকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে। আইনস্টাইনের সেই ইতিহাস বদলকারী চিঠি রুজভেল্ট অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেন। সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় আমেরিকানদের পাল্টা গবেষণা। ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হয় আমেরিকার সর্বকালের সবচেয়ে গোপন প্রকল্প “প্রজেক্ট ম্যানহাটন”। তৎকালীন সময়ে আমেরিকাতে পারমানবিক বোমা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা ছিল অপেনহাইমারের। কারণ অপেনহাইমার ইউরোপের বেশ কিছু সনামধন্য বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে গবেষণা করেছেন। এমনকি ইউরোপে থাকাকালীন সময়ে অপেনহাইমার, হাইজেনবার্গের কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার লেকচারে অংশ গ্রহণ করেছেন এবং এ বিষয়ে তাদের আলাপও হয়েছে। কোয়ান্টাম ফিজিক্সে অপেনহাইমারের অসাধারণ বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ার এবং অভিজ্ঞতার কারণে, তাঁকে ম্যানহাটন প্রজেক্টের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৪১ সালের আগে একটি পরমাণুর ভাঙন সম্ভব হলেও, একসাথে লক্ষ লক্ষ পরমাণুর ভাঙন তখনো সম্ভব হয়নি। একসাথে ভাঙা সম্ভব হলে গাণিতিক চক্রবৃদ্ধি হারে যে বিপুল পরিমান শক্তি পাওয়া যাবে, সেটি দিয়েই তৈরি হবে এটম বোমা। ১৯৪৩ সালের মার্চে আমেরিকার নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের লস আলামস এলাকার এক বিরান মরুভূমিতে নতুন শহর তৈরী করা হয়। যার ৪০ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে অন্য কোন কিছু ছিল না। এমন জনবিচ্ছিন্ন এলাকায় তৎকালীন সময়ের সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়ে অপেনহাইমার কাজ শুরু করেন।
অপেনহাইমারের কাজ যখন শুরু হয়েছে মাত্র, সে সময় হাইজেনবার্গ পারমানবিক বোমা আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হাইজেনবার্গের ল্যাবরেটরিতে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় হাইজেনবার্গ ও তার সহকর্মীরা কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে। কিন্তু তাদের সমস্ত কাজ ও অগ্রগতি সহ লিপজিগের সেই ল্যাবরেটরি একদম ধূলিস্যাত হয়ে যায়। এই খবর পেয়ে আমেরিকানরা ধরেই নেয় যে, জার্মানরা নিশ্চই এটম বোমা তৈরির শেষ পর্যায়ে এবং এই দুর্ঘটনা হয়তো তাদের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের অংশ। হাইজেনবার্গের ল্যাবটরি বিস্ফোরণের ঘটনা কে, জার্মানীর সাফল্য ভেবে ভুল করা খবরটাই, আমেরিকানদের সর্বদা তাগিদ দিচ্ছিলো। অন্যদিকে ল্যাবরেটরি ও গবেষণা সম্পূর্ন ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর হাইজেনবার্গ প্রচন্ড মানসিক চাপে ছিলেন। নাৎসিরা তাকে নতুন করে সাহায্য না করে, উল্টো বলে এতদিনের এই পারমানবিক প্রকল্প সময় আর অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে জার্মানির দুর্দশা চরমে পৌঁছায়। বার্লিনে বৃষ্টির মতো বোমা বর্ষণ এবং সোভিয়েত বাহিনী জার্মানির সীমানায় চলে আসায় নাৎসি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালের মে মাসের ৩ তারিখে হাইজেনবার্গ সহ জার্মানির শীর্ষ বিজ্ঞানীরা মিত্র বাহিনীর হাতে আটক হন। তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম সেরা পদার্থবিদ হওয়ার কারনে হাইজেনবার্গ কে কড়া নজরদারির মধ্যে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অপরদিকে, সব রকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অপেনহাইমার সাফল্যের খুব কাছাকাছি পৌছে যান। ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যেই তারা তৈরি করেন ৩টি পারমানবিক বোমা। ১টি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ নিউক্লিয়ার ফিশন টাইপ, যার সাংকেতিক নাম “লিটল বয়” এবং অপর ২টি প্লুটোনিয়াম বেইজড ইমপ্লোশন এটম বোমা। একটির নাম “গ্যাজেট”, অপরটির নাম “ফ্যাটম্যান”। এবার ৩ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরী, এটম বোমার সক্ষমতা পরীক্ষার পালা। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই, সর্বপ্রথম পারমানবিক বোমাটি পরীক্ষার করার মাধ্যমে, মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মত পারমানবিক শক্তির ব্যবহার করা হয়। পারমাণবিক বোমার সেই পরীক্ষা “ট্রিনিটি টেস্ট” নামে পরিচিত। ট্রিনিটি টেস্টের বোমাটি এতই শক্তিশালী ছিল যে, এর বিস্ফোরণ স্থলের তাপমাত্রা সূর্য পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার গুন বেশি ছিল। এর তীব্রতা ছিল ২০ হাজার টন টিএনটি বিস্ফোরকের সমতুল্য। এর মাধ্যমে অপেনহাইমার তৈরি করে ফেলেন মানব ইতিহাসের সবচাইতে শক্তিশালী মারণাস্ত্র।
ট্রিনিটি টেস্টের ৩ সপ্তাহ পর, আগস্টের ৬ তারিখ একটি আমেরিকান প্লেন অবশিষ্ট দুটি পারমানবিক বোমা নিয়ে উড়ে যায় জাপানের উদ্দেশ্যে। হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে চালানো হয় মানব ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক আক্রমণ। বলা হয়, এর উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতি টানা। আমেরিকার এই নৃশংস হত্যাকান্ডে ২০ হাজার সৈন্য সহ দুই লক্ষ ছাব্বিশ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। অসহ্য পারমানবিক বিকিরণে ভুগে পরবর্তী চারমাসে মারা যায় আরো বহু লোক। এটম বোমার পরস্পর বিরোধী একটি ব্যাপার হচ্ছে, জাপানের দুইলক্ষাধিক নিরাপরাধ মানুষ এতে মারা গেলেও রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরোপুরি থেমে যায়। জাপান পারমানবিক হামলার ছয়দিন পরেই আত্নসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে সূচিত হয় ধ্বংস যজ্ঞের শেষের শুরু। হাইজেনবার্গ ও অপেনহাইমার দুইজনেই এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। আবার একই সাথে চরম অমানবিক যুদ্ধ বন্ধ করার কান্ডারি হিসেবেও তারা সফল।
রবার্ট অপেনহাইমার পারমানবিক বোমা আবিষ্কারের সময়টাতে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের রহস্য উন্মোচনের এবং আবিষ্কারের নেশায় মত্ত ছিলেন। তখন তার সহকর্মীরা পারমানবিক বোমার নৈতিক দিকটি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছেন, আমাদের কাজ বোমা তৈরী করা, এটি কিভাবে ব্যবহার করা হবে সেটা আমাদের কাজ নয়। কিন্তু পরবর্তীতে পারমানবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ দেখার পর অপেনহাইমারের মধ্যে গভীর অনুশোচনা কাজ করতে থাকে। তিনি তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের সাথে সাক্ষাতের সময় বলেন, “আমার হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে”। এ উত্তরে ট্রুম্যান অপেনহাইমারের দিকে একটি রুমাল এগিয়ে দিয়ে বলেন, “নিন, মুছে ফেলুন”। ট্রুম্যান অপেনহাইমারকে বলেন, মানুষ মনে রাখবে না যে, কে পারমানবিক বোমা আবিষ্কার করেছে, মানুষ মনে রাখবে কে এই বোমা নিক্ষেপ করেছে। পরবর্তীতে অপেনহাইমারকে হাইড্রোজেন বোমা তৈরীর প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে বললে, তিনি সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। পারমানবিক বোমা বানানোর জন্য অপেনহাইমারের অনুতাপকে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন ভালোভাবে দেখেনি। অপেনহাইমারের স্ত্রী এবং ভাই সহ দু একজন কাছের মানুষজন অতীতে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। সেই কারণে অপেনসহাইমারকেও কমুউনিস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে মার্কন প্রশাসন। এবং অপেনহাইমারের বিরুদ্ধে “দেশদ্রোহীতার” অভিযোগ তুলে, তাঁকে নানা ভাবে অপদস্থ করা হয়। এত বড় একজন বিজ্ঞানী পারমানিবিক বোমা আবিষ্কারের মত এতবড় সাফল্য অজনের পরও, তিনি পারমানিবিক বোমা ব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এবং মার্কিন প্রশাসনের অপচন্দনীয় কথাগুলো স্পষ্ট করে বলার কারণে, বিদেশি শক্তির সঙ্গে গোপন আঁতাত, এমনকি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। এসব কারণে শেষ জীবনে অপেনহাইমার কিছুটা কষ্টের মধ্যে কাটিয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অপেনহাইমারের যখন দুঃসময় চলছিল, তখন অপেনহাইমারকে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ এবং ভারতে বসবাসের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ভারতের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গির ভাবার সাথে অপেনহাইমারের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমেরিকাতে যখন অপেনহাইমারের দেশদ্রোহীতার তদন্ত চলছিল, তখন হোমি ভাবা অপেনহাইমারকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার আর্জি নিয়ে জওহরলাল নেহরুর কাছে যান। জওহর লাল নেহরু ছিলেন বিজ্ঞান অনুরাগী একজন মানুষ। তিনি অপেনহাইমারকে একাধিক বার ভারতে আহ্বান জানান এবং চিঠি লিখে ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণেও উৎসাহিত করেন। কিন্তু অপেনহাইমার ভারতের প্রধানমন্ত্রী, নেহরুর অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। তিনি বলেন, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ না করে আমেরিকা থেকে একচুলও নড়বেন না। অপেনহাইমার শেষ পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অপেনহাইমারের ভারতীয় বন্ধু হোমি ভাবা ১৯৬০ এর দশকে ভারতের পারমানবিক শক্তি বিভাগের সচিব ছিলেন। ১৯৬১ সালে জওহরলাল নেহরু হোমি ভাবার উপরেই ভারতের মহাকাশ গবেষণারও দ্বায়িত্ব দেন। পরবর্তীতে হোমি ভাবা The Indian National Committee for Space Research বা INCOSPAR নামের একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানই পরবর্তীতে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ISRO হিসেবে রূপান্তরিত হয়। যে মহাকাশ সংস্থা একসময় বাইসাইকেলে করে রকেটের যন্ত্রাংশ পরিবহণ করত, তারাই এখন চাঁদের উদ্দেশ্যে পুরোদস্তুর মাহাকাশ অভিযান পরিচালনা করছে।