চীন কিভাবে যাত্রীবাহী বিমান তৈরী করছে ?

maxresdefault (56)
কি কেন কিভাবে

চীন কিভাবে যাত্রীবাহী বিমান তৈরী করছে ?

চীনের বিমান পরিবহন খাত

সমগ্র পৃথিবীর বিমানের বাজার শুধু মাত্র দুটি কম্পানির দখলে। একটি হল বোয়িং এবং অন্যটি এয়ারবাস। কিন্তু চাইনিজ একটি কম্পানি শীঘ্রই এই দুই কম্পানির বাজারে ভাগ বসাতে যাচ্ছে। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন Commercial Aircraft Corporation Of China বা COMAC নতুন নতুন যাত্রীবাহী বানিজ্যিক বিমান উৎপাদন শুরু করেছে। চীনের ক্রমবর্ধমান মধবিত্তদের মাঝে বিমান ভ্রমণ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।  সেকারণে চীন আগামী ১৫ বছরে ২০০ টি নতুন বিমান বন্দর তৈরী করার পরিকল্পনা করেছে। যাত্রীদের চাহিদা মেটানোর জন্য চীনের বিপুল পরিমাণ বিমান প্রয়োজন। বোয়িং এর বানিজ্যিক শাখা থেকে জানানো হয়েছে যে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চীনের ৮ হাজারেরও বেশি বিমান দরকার হবে।  সেই সাথে আগামী বিশ বছরে চীনের বিমান পরিবহন খাতের বানিজ্য ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এত বড় এক বানিজ্যিক সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বিদেশীদের হাতে ছেড়ে দিতে চায় না চীনা সরকার। সেকারণেই মূলত এই খাতে নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির উপর জোড় দিয়েছে তারা। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের তৈরী যাত্রীবাহী বিমানের বানিজ্যিক ফ্লাইটও উদ্বোধন করা হয়েছে।

চীন কিভাবে যাত্রীবাহী বিমান তৈরী করছে ?

চীনের ইঞ্জিনিয়ার

চীনের অর্থনীতি এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিমান পরিসেবার জন্য নিজস্ব বিমান উৎপাদন ব্যবস্থা অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। চীনে হাজার হাজার দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে, যারা এই খাতের জন্য কাজ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এইসব ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়েই চীন নিজস্ব গাড়ি এবং ট্রেন উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। চীনের উড়োজাহাজ নির্মাণ প্রক্রিয়াও একই রকমভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

ARJ21

চীন মূলত চার ধরনের বিমান উৎপাদনের জন্য চেষ্টা করছে। প্রথমটি হল ARJ21। ARJ অর্থ হল Advanced Regional Jet। এরপর রয়েছে তিনটি সমগোত্রীয় মডেলের C919, C929 এবং C939। এখানে C দিয়ে COMAC কে বোঝানো হয়েছে। পরর্বতী অক্ষরগুলোর মধ্যে 9 একটি ধ্রুবক এবং পরের দুটি সংখ্যাগুলো দ্বারা, বিমানগুলোর যাত্রী ধারণ ক্ষমতা বোঝানো হয়েছে।

চীনের তৈরী প্রথম বিমান ARJ21 সর্বপ্রথম উড্ডয়ন সম্পন্ন করেছিল ২০০৮ সালে। কিন্তু এটি তাদের প্রথম ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করতে প্রায় সাত বছর সময় নিয়েছিল। বর্তমানে এই মডেলের ৩২ টি এয়ারক্রাফট চীনের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই বিমানের প্রায় দুই শতাধিক অর্ডার এখনও নির্মানাধীন রয়েছে। এই মডেলের বিমানগুলো ১২০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত উড়তে পারে।

C919

চীনের উৎপাদিত বিমানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হল C919 যা এখনও পর্যন্ত তৈরী করা সবচেয়ে জনপ্রিয় বিমান বোয়িং 737 এবং এয়ারবাস A320 মডেলের সমতূল্য। এতে বোয়িং 737 Max এর ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। যার কারণে বিমানটি ২ হাজার ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত উড়তে পারে। এর একটি বর্ধিত সংস্করণ রয়েছে যা ৩ হাজার নটিক্যাল মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। C919 এর ইকোনমি ক্লাস হিসেবে ১৬৮ জন অথবা বিজনেস ক্লাস হিসেবে ১৫৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। ফ্লাইট টেস্টিং এর জন্য C919 মডেলের ৬টি বিমান নির্মান করা হয়েছিল। এর একেকটি বিমান তৈরী করতে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। যদিও অন্যান্য সূত্রে জানা যায় চীনা বিমানগুলো নির্মানের প্রকৃত খরচ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।

C919 ই চীনের উৎপাদিত বিমান গুলোর মধ্যে সবেচেয়ে জনপ্রিয়। কারণ এখনও পর্যন্ত এই বিমানের প্রায় এক হাজারের বেশি অর্ডার রয়েছে। এসকল অর্ডারই এসেছে চীনের নিজস্ব বিভিন্ন বিমান পরিবহণ সংস্থার কাছ থেকে। যার প্রায় অধিকাংশ কম্পানির মালিকানাই রয়েছে চীনা সরকারের হাতে। এছাড়া যেসব উন্নয়নশীল দেশে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে, সেসব দেশের বিমান সংস্থাগুলোও চীনের নতুন এই বিমান কেনার জন্য বেশ কিছু অর্ডার দিয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোন পশ্চিমা বিমান কম্পানি চীনের এসব বিমান কেনার আগ্রহ দেখায়নি। C919 মডেলের বিমানগুলোকে পৃথিবীর সকল ধরনের আবহাওয়া পরিস্থিতিতে ভালোমত পরীক্ষা চালানোর পর; ২০২৩ সালের ২৮ মে C919 তার প্রথম বানিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। প্রথম উড্ডয়নে বিমানটি সাংহাই থেকে বেইজিং পর্যন্ত উড়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে চীনের উৎপাদিত বিমান সারা বিশ্বের সামনে তাদের সক্ষমতার জানান দিয়েছে।

C929

C919 এর পরে রয়েছে C929 যার আরেক নাম CRAIC CR 929। এই বিমানটির দুটি নামের কারণ হল, এটি রাশিয়ানদের সাথে মিলে তৈরি করা হয়েছে। চীনের বিমান উৎপাদনকারী প্রতিষ্টান COMAC এর সাথে Russian United Aircraft Corporation বা RUIC যৌথ উদ্যোগে এই বিমানটি নির্মানের চেষ্টা করেছে। চীনের C929 বিমানটি মূলত এয়ারবাস A330 এবং বোয়িং এর 787 মডেলের অনুকরণে নকশা করা হয়েছে। এতে ইকোনমি এবং বিজনেস ক্লাস মিলে প্রায় ২৯১ জন যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতা রয়েছে। তবে শুধু ইকোনমি ক্লাস হিসেবে পরিচালনা করলে এতে প্রায় ৪৪০ জন যাত্রী পরিবহণ করা সম্ভব। এই প্লেনটি ৬ হাজার ৪৮০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পর্যন্ত উড়তে সক্ষম। চীন এবং রাশিয়া আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে C929 মডেলের প্রায় এক হাজার বিমান বিক্রি করার আশা করেছিল। তবে সাম্প্রতিক খবর অনুযায়ী এই বিমান নির্মানের প্রক্রিয়া কিছুটা পিছিয়ে গেছে। এরফলে C929 প্রথম ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করতে প্রায় ২০২৯ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। যদিও এতটা পিছিয়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানা যায়নি।

C939

চীনের নির্মিত বিমানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী এবং সেরা বিমান হল C939। এই মডেলকে রহস্যজনক বিমান বলা হচ্ছে। কারণ C939 সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। এই বিমানটি এমন এক সময় নির্মানের কথা জানানো হয়, যখন বোয়িং তাদের 747 এবং এয়ারবাস তাদের A380 বিমানগুলো বানানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। তবে ধারণা করা হয় C939 বিমানটি প্রায় চার শতাধিক যাত্রী পরিবহণ করতে পারবে। যা অনেকটা বোয়িং 777 X এবং এয়ারবাস A350 এর মত। এমনকি একে বোয়িং 747 এর সমান যাত্রী পরিবহণের জন্যও প্রস্তুত করা হতে পারে। যদিও এত বেশি যাত্রীবাহী বিমান শুধু চীনের বাজারের জন্য উপযোগী নয় এবং বিদেশী ক্রেতারাও এই বিমান খুব বেশি কিনবে বলে মনে হয় না। তাই বিমানগুলোকে এত বড় করে তৈরী করা হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

চীনের চ্যালেঞ্জ

চীনের নিজস্ব বিমান উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল বিমানের ইঞ্জিন। কারণ চীন এখনও পর্যন্ত কার্যকরী সেরা ইঞ্জিন তৈরী করতে পারেনি। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানি General Electric এবং যুক্তরাজ্যের Rolls Royce সহ একাদিক বিদেশী কম্পানির সাথে ইঞ্জিন উৎপাদনের কাজ করছে। COMAC তাদের বিমানের ভেতরের নকশাও নিজেরা করতে পারছে না। সেজন্য তারা ফ্রান্সের ডিজাইনারদের সাথে কাজ করছে।

তবে চীনের নির্মিত এই বিমানগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল বিশ্বব্যাপী বিমানগুলোর জন্য সার্টিফিকেশন যোগাড় করা। কোন নতুন কম্পানির বিমান চলাচলের জন্য সার্টিফিকেট যোগাড় করা অনেক দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া। তার উপর যদি হয় ব্রান্ড নিউ মডেলের এয়ারক্রাফট তাহলে সেই জটিলতা আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের Federal Aviation Administration বা FAA এবং ইউরোপের European Union Aviation Safety Agency বা EASA এখনও পর্যন্ত চীনের উৎপাদিত বিমানকে উড্ডয়নের সার্টিফিকেট দেয়নি। এই সার্টিফিকেটগুলো ছাড়া আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করা যায় না। তবে আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট পাওয়ার আগ পর্যন্ত, আগামী কয়েক বছরে চীনের যতগুলো বিমানি তৈরী করবে, তার অধিকাংশ তাদের নিদের দেশেই ব্যবহৃত হবে। 

চীনের এসব বিমান যদি সহজে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করার যায়ও, তারপরও COMAC এর আরেকটি বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর তা হল বিমান রক্ষণাবেক্ষণ। যেসব এয়ার লাইন বিমানগুলোকে কিনবে তাদের কাছে পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের সরঞ্জাম সরবরাহ করতে না পারলে, বিমানের বিক্রি অনেকটাই থেমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। চীনের এখনও পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণের মত অবকাঠামো এবং পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ নেই। অতীতে মেক্সিকোর ইন্টারজেট নামের একটি কম্পানি রাশিয়ার তৈরী বিমান দিয়ে তাদের অত্যন্তরীণ বিমান পরিসেবা চালু করেছিল। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশের অভাবে, কম্পানিটি এক সময় বন্ধ হয়ে যায়।

চীনের বিমান উৎপাদনে আগমন এবং এই ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখে হয়ত বোয়িং এবং এয়ারবাস উভয়েই উপহাস করছে। কিন্তু একটা সময় এয়ারবাসের আগমন দেখেও বোয়িং তাচ্ছিল্য করেছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই এয়ারবাসই বোয়িং এর একমাত্র শক্ত প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেছে। বিমান পরিবহণ খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চীনই হয়ত একমাত্র দেশ, যারা পশ্চিমা বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া ব্যবসায় ভাগ বসাতে পারবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।