নাইজার অভ্যুত্থান
নাইজার অভ্যুত্থান
ভূমিকা
পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ নাইজার। নাইজার বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে নাইজার সারা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। অতীতে ইউরোপের অন্যান্য দখলবাজ দেশগুলোর মত ফ্রান্স নাইজারে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ১৯৬০ সালে নাইজার ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। নাইজারের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সাথে ফ্রান্সের আগেকার ঔপনিবেশিক সম্পর্কের যোগসূত্র রয়েছে।
নাইজার দেশ পরিচিতি
নাইজার দেশটির নামকরণ করা হয়েছে নাইজার নদী থেকে। নাইজারের রাজধানীর নাম নিয়ামি। নাইজার একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এই দেশের ৯৯ শতাংশ লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ১৯৬০ সালে দেশটি ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও, নাইজারে ফ্রান্সের প্রভাব এখনও অনেক বেশি। এখনও পর্যন্ত দেশের আড়াই কোটি নাইজারবাসীর দাপ্তরিক ভাষাও ফরাসি। নাইজারে এখনো ফ্রান্সের দেড় হাজার সেনার একটি পুরো গ্যারিসন আছে। সেই সাথে জঙ্গি বিমান এবং ড্রোন সহ ফ্রান্সের একটি বিমানঘাঁটিও রয়েছে। তবে নাইজারের সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ প্রকট ফ্রান্স বিরোধী মনোভাব রয়েছে। কারণ ফ্রান্স তাদের নিজেদের স্বার্থে এই দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেপরোয়া দুর্নীতি ঢুকিয়ে দিয়েছে।
গত দুই বছরে উন্নয়ন খাতে দুই বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা পাওয়ার পরও নাইজার বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি। দেশটিতে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩৭ শতাংশ। ২০২২ থেকে ২৪ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নাইজারের জন্য ৫০৩ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিলেও, এসব অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে আবারো ইউরোপেই ফিরে গেছে। ফ্রান্সের নেতারা আফ্রিকাকে ফ্রান্সের বাড়ির পেছনের আঙিনা বলে মনে করেন। নাইজার তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান ইউরেনিয়াম উৎপাদনে নাইজার বিশ্বে সপ্তম। নাইজারের ইউরেনিয়ামের প্রধান আমদানিকারক আবার ফ্রান্স। এই ইউরেনিয়াম দিয়েই ফ্রান্স তাদের পারমানবিক শক্তি উৎপাদন করে। এবং ফ্রান্সের মোট জ্বালানীর ৭০ শতাংশই আসে পারমানবিক শক্তি থেকে। যার জন্য তারা সরাসরি নাইজারের উপর নির্ভরশীল।
নাইজার এর সেনা অভ্যুত্থান
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে, নাইজারের রাজনীতি একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশটির ক্ষমতায় আসেন মোহাম্মদ বাজোউম। ২০২১ সালে তার ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন আগে একটি অভ্যুত্থান হলেও, তা ব্যার্থ হয়। বাজোউম সরকারের মাধ্যমেই প্রথমবারের মত কোন নির্বাচিত সরকারের হাত থেকে আরেকটি নির্বাচিত সরকার নাইজারের শাসনভার গ্রহণ করে। মোহাম্মদ বাজোউম ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মাথায় চলতি বছরের ২৬ জুলাই আবারো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। নিজের প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ডের সদস্যদের হাতেই বন্দী হন তিনি। এখনও পর্যন্ত বাজোউম সামরিক বাহিনীর হাতে আটক রয়েছেন।
সামরিক নেতারা ক্ষমতা দখলের পর নাইজারের সংবিধান বাতিল করে দিয়েছে, দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেছে এবং দেশের সকল সীমান্ত ও আকাশ সীমা বন্ধ করে দিয়েছে। অভ্যুত্থানের দুই দিন পর ২৮ জুলাই সামরিক বাহিনী, বাজাউমের প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ডের প্রধান জেনারেল আব্দররহমানে চিয়ানী কে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে। নাইজারের সাধারণ জনগণ এই অভ্যুত্থানকে ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। তারা সামিরিক সরকারের সমর্থনের রাজপথে নেমে এসেছে। কয়েকদিন আগে সামরিক নেতাদের সমর্থন জানানোর জন্য দেশের জনগন একটি স্টেডিয়ামে একত্রিত হয়। সেখানে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।
অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়া
পশ্চিম আফ্রিকার ১৫ টি দেশের একটি সংগঠন ECOWAS। যার পূর্ণরূপ হল Economic Community of West African States। ECOWAS ভুক্ত দেশগুলো নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধীতা করেছে। তারা সাবেক প্রেসিডেন্ট বাজাউমের কাছ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য, নাইজারে সদ্য গঠিত সেনা শাসককে দুই সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছে। তা না ECOWAS জোটের দেশগুলো যৌথভাবে নাইজারে সেনা শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করবে। তবে এই জোটের তিনটি সদস্য গিনি, মালি এবং বুরকিনা ফাসো ECOWAS এর বিবিৃতির সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে। কারণ মালি ও বুরকিনা ফাসোতেও সামরিক শাসন জারি রয়েছে। ২০২০ সালে মালিতে এবং ২০২১ ও ২০২২ সালে বুরকিনা ফাসোতে দুই দফা সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। এই দুটি দেশও ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে গোটা অঞ্চল অনেকটা অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ অভ্যুত্থানের পর পরই বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘ফ্রান্স ও এর স্বার্থের ওপর কোনো আঘাত বরদাশত করা হবে না।’ তিনি সাম্রাজ্যবাদী বর্বর নেতাদের মত প্রতিশোধ নেওয়ার কঠোর হুশিয়ারিও দিয়েছেন। তাছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল নাইজারের এই অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া সহ কাউন্সিলের ১৫ সদস্য এক বিবৃতির মাধ্যমে, বাজাউমের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নও এই সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে। তবে নাইজারের সামরিক বাহিনী এই সকল প্রতিক্রিয়াকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। তারা প্রতিবেশী দুই দেশ বুরকিনা ফাসো ও মালির সামরিক শাসকদের সমর্থন পাচ্ছে।
অভ্যুত্থানের ইন্ধন
অতীতে নাইজার সহ পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলের ৮টি দেশে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। তখন এই অঞ্চল কে বলা হত ফ্রেঞ্চ ওয়েস্ট আফ্রিকা। ফ্রান্সের সাবেক এসব উপনিবেশগুলোতে ফ্রান্স এবং পশ্চিমা বিরোধী অসন্তোষ বেড়েই চলেছে। সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাইছে রাশিয়া, তুরস্ক ও চীন। অভ্যুত্থানের সময় নাইজারের বিক্ষুব্ধ জনতা ‘ফ্রান্স নিপাত যাক’ স্লোগান দিতে দিতে ফ্রান্স দূতাবাস আক্রমণ করে। তাঁরা ঢিল ছুড়ে ফরাসি দূতাবাসের জানালার কাচ ভেঙে ফেলে এবং সীমানাপ্রাচীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় কারো কারো হাতে রাশিয়ার পতাকাও দেখতে পাওয়া যায়। সেকারণে পশ্চিমারা মনে করছে যে, এই অভ্যুত্থানের পেছনে রাশিয়ার মদদ রয়েছে।
অতীতে মালি ও বুরকিনা ফাসো তে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ফ্রান্সের সেনাদের সরিয়ে দেয়। এরপর নিরাপত্তার জন্য মালিতে রাশিয়ার ভারাটে বাহিনী ওয়াগনার কে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। খুব শীঘ্রই বুরকিনা ফাসোতেও ওয়াগনারদেরকে নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নাইজারও তাদের প্রতিবেশী সামরিক শাসকদের মত ওয়াগনারের সাহায্য নিতে পারে। এই সাহায্য দরকার হবার কারণ হল, এতদিন পর্যন্তও নাইজারের সামরিক বাহিনী অনেকটাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে ৫০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে। চলতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন নাইজারে তিন কোটি ডলারের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে।
ফ্রাঙ্কাফ্রিক
ফ্রান্স যখন আফ্রিকা থেকে তাদের উপনিবেশ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়, তখন তারা “ফ্রাঙ্কাফ্রিক” নামের নতুন এক ধারণা চালু করে। এর অর্থ হল ফ্রান্সের ভাষা ও মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে এক ধরনের নব্য-উপনিবেশবাদী প্রভাব বলয় গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে তারা পশ্চিম আফ্রিকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সরাসরি নাকগলানোর ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে। এমনকি নাইজার সহ আফ্রিকার ১৪ টি দেশে ফ্রান্সের মুদ্রা CFA Franc প্রচলন করা হয়েছিল। যার মাধ্যমে এসব দেশের অর্থনীতিও ফ্রান্স সরাসরি তদারকি করতে পারত। একদিকে তারা দেশগুলোকে স্বাধীনতা দিয়েছে এবং অন্যদিকে আবার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে তাঁদের সামরিক ঘাঁটি ধরে রেখেছেন।
শুধু বাজোউম সরকারই নয়, নাইজারে অতীতের সকল সরকারই ফ্রান্সের ইশারায় নেচেছে। নাইজারসহ আফ্রিকায় ফ্রান্সের প্রভাব বলয়ের দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে কিছুই বলে না, কারণ অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে এই অঞ্চল মার্কিনদের পক্ষে ছিল। বর্তমানকালেও পম্চিমাদের বিশাল অঙ্কের সহায়তা কর্মসূচির বিনিময়ে এই অঞ্চলের আজ্ঞাবহ পুতুল নেতারা গণতন্ত্রের নাটক মঞ্চস্থ করেেগছে। এখানে তথাকথিত গণতন্ত্র থাকেলে, ফ্রান্স সহ পশ্চিমারা সহজেই তাদের স্বার্থ হাসিল করতে পারবে। এই বিষয়গুলো নাইজার সহ এই অঞ্চলের মানুষ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। সেকারণেই নাইজারের মানুষ এখন ফ্রাঙ্কাফ্রিক ধারণাকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইছে।
ফ্রান্সের মতই আরো বেশ কিছু স্বার্থার্ন্বেষী পশ্চিমা রাষ্ট্র মিলে ন্যাটো নামের একটি জোট গড়ে তুলেছিল। এরা নিজেদের নিরাপত্তার অযুহাত দিয়ে সারা বিশ্বে যুদ্ধ বাধিয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরী করে। North Atlantic Treaty Organization বা NATO প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য। কিন্তু সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন হলেও, ন্যাটো আজও তাদের আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।