শ্রীলংকা কীভাবে ঘুরে দাঁড়ালো
শ্রীলংকা কীভাবে ঘুরে দাঁড়ালো
২০২১ সালে শ্রীলংকা ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। তখন দেশটিতে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা তৈরী হয়। যার ফলে শ্রীলংকার সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছিলো। এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোটাভায়া রাজাপাকশে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিলো যে, শ্রীলংকা তার আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছিলো না। ফলে খাদ্য, ঔষধ, জ্বালানী সহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে তীব্র সংকট দেখা দেয়। তবে সেই পরিস্থিতি এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে পেরেছে শ্রীলংকা। আবারো জমে উঠতে শুরু করেছে শ্রীলংকার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি পর্যটন খাত। সেই সাথে দেশটির রেমিট্যান্সও বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।
সমস্যার সূত্রপাত
করোনা মহামারীর ধাক্কায় শ্রীলংকার অর্থনৈতিক পতেনের সূত্রপাত হয়েছিল। কারণ শ্রীলংকার অর্থনীতি অনেকটাই পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল। সেসময় মহামারির ধাক্কায় দেশটির পর্যটন খাত ধ্বসে পড়ার পাশাপাশি; প্রবাসী শ্রীলংকানদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ব্যাপকহারে কমে যায়। এর ফলে ২০২২ সালের শুরুর দিকে শ্রীলংকা ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে পড়ে। তখন আবার শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। যার কারণে বিশ্বজুড়ে পণ্য আমদানির ব্যয় ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়। একের পর এক এতগুলো ধাক্কা শ্রীলংকা সামাল দিতে পারেনি। তীব্র আর্থিক সংকটের কারণে নজিরবিহীন গণবিক্ষোভের মুখে, ২০২২ সালের ১৩ই জুলাই ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান দেশটির প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকশে। এরপর নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির দায়িত্ব নেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু কিছু খাতে সংস্কারের পাশাপাশি রনিল বিক্রমাসিংহে আইএমএফের সাথে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের একটি ‘বেইল আউট প্যাকেজ’ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
ঘুড়ে দাঁড়ানোর কারণ
বিশ্লেষকেরা মনে করেন শ্রীলংকা এখনও সংকট থেকে এখনো পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি। দেশটি যখন তাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা শুরু করবে, তখন প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
একটা সময় শ্রীলংকার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার মত কোন অর্থ ছিল না। সেকারণে বেশিরভাগ দোকানেই কোন পণ্য ছিল না; যেসব দোকানে সামান্য কিছু পণ্য ছিল, সেখানেও ছিল মানুষের দীর্ঘ সারি। বর্তমানে দাম বেশি হলেও নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্যের সরবরাহ রয়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রাও আগের তুলনায় অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন মোটাদাগে দুটি বিষয়ের কারণে, শ্রীলংকা মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে। ১. বেশ কিছু সরকারী নীতি এবং ২. কিছু অটোমেটিক বিষয়।
সরকারী নীতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন সরকার শুরু থেকেই ব্যয় কমানোর চেষ্টা করেছে ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য এবং বিদ্যুতের দাম কমিয়ে জনজীবন সহজ করার চেষ্টা করেছে সরকার। এবং এর অংশ হিসেবে ২৩ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। তবে রনিল বিক্রমাসিংহের সরকার সকল বিষয়ে জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোন কোন খাতে কর বাড়ানো এবং কিছু খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো পদক্ষেপ বেশ অজনপ্রিয় হয়েছে ।
অন্যদিকে অটোমেটিক রিকাভারির মধ্যে রয়েছে, পর্যটন খাত এবং রেমিটেন্সের উন্নয়ন। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর পর্যটন খাত থেকে শ্রীলংকার আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। এবং রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। ২০২২ সালে সঙ্কটকালীন সময়ে, শ্রীলংকা পর্যটন খাত থেকে আয় করেছিল মাত্র ৪৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০২৩ সালের প্রথম ৫ মাসেই শ্রীলংকার পর্যটন খাত থেকে আয় এসেছে ৮২৭.৮ মিলিয়ন ডলার। যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। পর্যটনের মতো খাত ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি রেমিটেন্সও অনেক বেড়েছে; ফলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে শ্রীলংকার তিন লাখ ১১ হাজারের বেশি দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিক কাজের জন্য বিদেশে গেছে। যাদের অনেকেই ডাক্তার, প্যারামেডিকেল কিংবা আইটি প্রফেশনাল। সব মিলিয়ে গত বছর বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে শ্রীলংকা অতীতে সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে শ্রীলংকার ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাত শতাংশ। কৃষি খাতও ভালো করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে চা ও রাবার রপ্তানি আগের চেয়ে বেড়েছে।
বৈদেশিক সাহায্য ও অগ্রগতি
শ্রীলংকার সরকার তাদের পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ঋণদাতা দেশ এবং আইএমএফ এর মতো সংস্থার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটির সংকট এড়াতে বিশ্বব্যাংক বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে এসেছিলো। শ্রীলংকায় চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকে বিশ্বব্যাংক প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ডলার জরুরি প্রয়োজনের খাতে সরিয়ে নেয়। যা ঔষধ, জ্বলানী এবং সার এর মতো জরুরী পণ্য ক্রয় করতে ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে দেশটির বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে বিশ্ব ব্যাংক প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে সংকটকালীন সমেয়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছিলো ৪৯ শতাংশের বেশি। বর্তমানে শ্রীলংকার সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর জুলাই মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৬.৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩ সালেও শ্রীলংকার জিডিপি কমতির দিকে থাকবে। তবে ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে দেশটির জিডিপি আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষের দিকেই তাদের অর্থনীতির বড় অগ্রগতি হবে।
শ্রীলংকার চ্যালেঞ্জ
শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধি অর্জনের পথে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল তাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরে থেকে নেওয়া শ্রীলংকার মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কোন কোন সংস্থার হিসেবে এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারও হতে পারে। এর মধ্যে শুধুমাত্র চীন, জাপান এবং ভারতকেই শোধ করতে হবে ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আবার মোট ঋণের মধ্যে আবার ২৮ বিলিয়ন ডলার শোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। বেশকিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বিদেশী ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। শ্রীলংকা যখন ঋণ শোধ করতে শুরু করবে, তখন আসলে বোঝা যাবে তাদের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলো।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় বাংলাদেশের কাছ থেকে শ্রীলংকা, ২০০ মিলিয়ন ডলার এক বছরের জন্য ঋণ নিয়েছিলো। সেই ঋণের ৫০ মিলিয়ন ডলার সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে ফেরত দিয়েছে তারা। খুব শীঘ্রই আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার কথা রয়েছে।
দেশটিতে সংস্কার কার্যক্রম চালাতে গিয়েও, সরকারকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি বছরেও সব মন্ত্রণালয়ের বাজেট ছয় শতাংশ করে কমানো হয়েছে। এছাড়া দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও কমিয়ে অর্ধেকে আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার। সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন ভাতা দিয়ে প্রশাসনিক কার্যম সচল রাখাটা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারী খরচ কমানোর জন্য শ্রীলংকান এয়ারলাইন্স, শ্রীলংকা টেলিকম এবং শ্রীলংকান ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশনের মতো রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে বেসরকারিকরণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নগুলো এসব সংস্কার কার্যক্রমের বিরোধিতা করে সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, ভর্তুকি কমানো বা বাদ দেয়ার কারণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মানুষের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। যেমন শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ব্যয় বেড়েছে ৬৫ ভাগ, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে।
সকল বিদেশী ঋণ শোধ করা এবং সরকারী পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব কিনা সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। দেশকে আবারো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে আনতে, শ্রীলংকাকে হয়ত আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।