এমটিএফই কিভাবে এত বড় প্রতারণা করল

maxresdefault (49)
কি কেন কিভাবে

এমটিএফই কিভাবে এত বড় প্রতারণা করল

MTFE প্রতারণা

মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ বা MTFE নামের একটি বিদেশী কম্পানি বাংলাদেশের গ্রাহকদের বিপুল অর্থ লুট করে পালিয়েছে। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ধাঁচের এই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে; বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশের হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশী গ্রাহকদের ক্ষতির পরিমাণই সবচেয়ে বেশি।

গ্রামের সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়েছিল যে, এটি ইসলামী শরীয়ত সম্মত একটা ব্যবসা। এই টাকা বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে, সেখান থেকেই সদস্যদের মুনাফা দেয়া হবে। প্রথম প্রথম সবাই প্রতিদিন নিয়মিত মুনাফা পেয়েছেন। আরো লাভের আশায় গ্রাহকরা সেই মুনাফার টাকা আবারও MTFE এ্যাপেই বিনিয়োগ করেছে।

কিছু কিছু গণমাধ্যমে বলা হয়েছে যে, MTFE ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি আত্নসাৎ করেছে। তবে যেহেতু এটি একটি অনিবন্ধিত প্লাটফর্ম, তাই প্রকৃত পক্ষে MTFE কত টাকা নিয়ে পালিয়েছে তার কোন সঠিক হিসেব নেই।

MTFE কিভাবে এত বড় প্রতারণা করল ?

MTFE কোম্পানি

মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ বা MTFE একটি দুবাই ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এদের ওয়েবসাইটে কানাডার অন্টারিও প্রদেশের একটি ঠিকানা দেয়া হয়েছে। বাস্তবে যদিও ওই ঠিকানায় MTFE নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অফিস পাওয়া যায়নি। MTFE ২০২২ সাল থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে তাদের ওয়েবসাইটের কম্পানিটি ২০১৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু করার ভুয়া তথ্য দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশি মাসুদ আল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি MTFE কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ।

MTFE দাবি করে এটি কমিউনিটি ভিত্তিক ফরেন এক্সচেঞ্জ প্লাটফর্ম। যেখানে বিদেশী মুদ্রা কেনাবেচা করে সহজেই টাকা কামানো যায়। সত্যিকার অর্থে ফরেক্স ট্রেডিং করে অর্থ উপার্জন করতে বিশেষ দক্ষতা দরকার হয়। কিন্তু MTFE তার গ্রাহকদেরকে বুঝিয়েছে যে, এখান থেকে টাকা কামানোর জন্য আপনার কোন দক্ষতার প্রয়োজন নেই। MTFE র বিশেষ রোবট গ্রাহকদের পক্ষ থেকে লেনদেনের কাজটি করে দিবে। যার ফলে সাধারণ বিনিয়োগের চেয়ে MTFE তে অনেক বেশি মুনাফা অর্জন করা যায়। এছাড়াও MTFE অ্যাপে দাবি করা হয়, তারা বিদেশী মুদ্রা ছাড়াও স্বর্ণ, জ্বালানি তেল, শেয়ার মার্কেটসহ শতাধিক পণ্যে বিনিয়োগ করে।

সাধারণত গুগল প্লে স্টোর এবং অ্যাপল অ্যাপস্টোর থেকে MTFE অ্যাপ ডাউনলোড করে এর সদস্য হতে হয়। শুরুতে কমপক্ষে ২৬ ডলার বা তার সমপরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করেও এই টাকা জমা দেয়া যায়। যারা স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করতে চান, তাদেরকে লক্ষ্য করেই অ্যাপ ভিত্তিক এই প্রতারণার ফাঁদ গড়ে তোলা হয়েছিল। MTFE দাবি করেছিল, এখানে যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করা হবে, তার তুলনায় প্রতিদিন ৩ থেকে ৮ শতাংশ মুনাফা দেয়া হবে। তাদের বিনিয়োগ প্যাকেজে বলা হয়, কেউ যদি ৩০ ডলার বিনিয়োগ করে, তাহলে মাসে ২২ থেকে ৪৪ ডলার পর্যন্ত পেতে পারে। এভাবে বিভিন্ন ধাপে যদি কেউ ৭ হাজার ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করে, তাহলে মাসে ৪ হাজার ৫০০ থেকে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত মুনাফা আসতে পারে।

প্রতারণার ফাঁদ

MTFE অ্যাপে বিনিয়োগ করা অধিকাংশ মানুষই বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা পর্যায়ের। বিভিন্ন প্রবাসী বাংলাদেশী বা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে বোঝানো হয়, বিদেশি একটি কোম্পানিতে ডলারে বিনিয়োগ করলে প্রতিমাসে ভালো মুনাফা পাওয়া যাবে। সেই মুনাফা প্রতিদিন গ্রাহকের একাউন্টে যোগ হবে। কত টাকা লাভ হল, কত টাকা লস হল সবকিছু মোবাইলের মাধ্যমেই দেখা যাবে। প্রথমদিকে MTFE অ্যাপ থেকে টাকা পেয়েছে, এমন লোকজনকে দেখে অন্যরাও আগ্রহী হয়। অনেকে এনজিও থেকে টাকা ঋণ করে, কেউ নিজের গরু বিক্রি করে, কেউবা আবার জমি বেচে MTFE অ্যাপে বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগ থেকে যা লাভ এসেছে, সেই টাকাও আবারও MTFE তেই বিনিয়োগ করেছেন গ্রাহকরা। এসব লোকজন তাদের আত্নীয় স্বজনকেও MTFE তে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছেন। এভাবেই খুব দ্রুত MTFE র গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে। গুগল প্লে স্টোর থেকে প্রায় ১০ লাখের বেশি মানুষ এই অ্যাপটি ডাউনলোড করেছিল।

শরীয়ার নামে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং

MTFE কোম্পানির কোথাও মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম এর কথা বলা হয়নি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারী সংগ্রহ পদ্ধতি সম্পূর্ণ মাল্টি লেভেল এর মত। প্রথম লেভেলে দুইজনকে আনতে হবে। সেই দুজন আবার দুজন করে সদস্য আনবে। এদের প্রত্যেকে যে টাকা বিনিয়োগ করবেন, তার একটা কমিশন পাবেন প্রথম ব্যক্তি। নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে সদস্য বানাতে পারলে সিইও হিসাবে পদোন্নতি দেয়া হতো। কারো রেফারেন্সে নতুন বিনিয়োগকারী আসলে প্রত্যেক নতুন সদস্যের জন্য তিনি দুই ডলার করে পাবেন। যেমন, কারো রেফারেন্সে যদি ১০ জন আসে, তাহলে  সেই ব্যক্তি প্রতিদিন ২০ ডলার করে পাবে। এভাবে যত লোক বাড়তে থাকবে, তত ডলারের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। সেকারণে দেখা যায়, MTFE তে বিনিয়োগ করার চেয়ে, রেফারেন্সের মাধ্যমে নতুন লোক নিয়ে আসা বেশি লাভজনক। তাই এর গ্রাহকরা নিজেদের সাধ্যমত MTFE গ্রাহক বাড়াতে থাকে। বাংলাদেশে অতীতেও ঠিক একই পদ্ধতিতে ডেসটিনি, জিজিএন, নিউওয়ের মতো অসংখ্য কোম্পানি এভাবে ব্যবসা করেছে। যাদের সাথে জড়িত হয়ে অসংখ্য গ্রাহক প্রতারণা শিকার হয়েছে।

MTFE র এই ব্যবস্থাকে ইসলামী শরিয়ার আদলে মুনাফা হিসেবে দেখানোর জন্য; সপ্তাহে চারদিন মুনাফা যোগ করা হতো এবং একদিন লোকসান দেখানো হতো। আর বাকি দুইদিন থাকতো সাপ্তাহিক ছুটি। অর্থাৎ একজন ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে সপ্তাহে চারদিনে পাঁচ ডলার করে ২০ ডলার পেতেন। আরেকদিন লোকসান দেখানোর জন্য আবার পাঁচ ডলার কাটা যেতো। এভাবে সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা আসতো।

নিয়মিত মোবাইলে অ্যাপের মাধ্যমে লাভের টাকার হিসাব দেখা যেত। অ্যাপ থেকেই মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে টাকা জমা বা তোলার ব্যবস্থা থাকলেও, বেশিরভাগ মানুষ কোম্পানির প্রতিনিধি বা যার মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, তার কাছেই লেনদেন করতেন।

অর্থ আত্নসাৎ

MTFE অ্যাপি থেকে গ্রাহকরা প্রথম কয়েকমাস ঠিকমত টাকা তুলতে পারলেও, অাগাস্ট মাস থেকে কোন টাকা তোলা যাচ্ছিল না। আগস্ট মাসের শুরুর দিকে দেখা যায়, লাভ লোকসান কিছুই আসছিল না। তখন কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের সিস্টেম আপগ্রেড এবং সার্ভারে সমস্যার কারণে এমন হচ্ছে। এর কয়েকদিন পরে দ্বিগুণ লাভ আসতে শুরু করে, কিন্তু কেউ টাকা তুলতে পারছিল না। এরপর হঠাৎ করে সবার একাউন্টে লোকসান দেখাতে শুরু করে। তখন MTFE মেসেজ দিতে থাকে, বকেয়া টাকা পরিশোধ করেন। তা না হলে কোম্পানি আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অর্থাৎ তাদের কথা হল, এত দিন গ্রাহক লাভের টাকা গ্রহণ করেছে, এখন যেহেতু কম্পানি লোকসান করেছে, তাই সেই টাকা ভর্তুকি দিয়ে গ্রাহককেও লসের ভাগ নিতে হবে। এভাবে বহু মানুষ MTFE অ্যাপে বিনিয়োগ করে তাদের সর্বস্ব হারিয়েছে।

অর্থ পাচার

MTFE চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দাবি করেছিল, তারা এখন পর্যন্ত ২০০ বিলিয়ন ডলারের লেনদেন করেছে। তবে এই কোম্পানি বিশ্বের কোথায়, কোন ব্যবসায় বা কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, তার কোন তথ্য কোথাও উল্লেখ নেই। দুবাই, ভারত বা বাংলাদেশ সহ বিশ্বের কোন দেশের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জে তাদের বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া যায়নি। কানাডায় এই কোম্পানির বিনিয়োগ রয়েছে বলে দাবি করা হলেও; কানডার অন্টারিও’র সিকিউরিটিজ কমিশন জানিয়েছে, এই কোম্পানির ব্যবসা করার কোন অনুমোদন নেই। MTFE কানাডার ফিনট্রাস অনুমোদিত বলে প্রচার করা হলেও, ফিনট্রাস আসলে কোন রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান নয়। তাদের মূল কাজ কানাডায় অর্থ পাচার রোধ করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, MTFE কম্পানির বাংলাদেশে বিনিয়োগ বা ব্যবসা করার কোন অনুমোদন নেই।

ডলারে বিনিয়োগের হিসাব-নিবেশ করা হলেও মূলত বিভিন্ন দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকার লেনদেন করা হতো। বাংলাদেশে যেমন সদস্যরা ডলারের সমপরিমাণে টাকা দিয়েছেন। আবার মুনাফা তুলতে হলে ডলারের সমপরিমাণ হিসাব করে টাকা তোলা হতো। বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করেও এই টাকার লেনদেন করা হতো।

এই ধরনের অ্যাপ ভিত্তিক প্রতারণার বিষয়ে, বাংলাদেশের সরকারী সংস্থাগুলো এক অপরের উপর দায় চাপাচ্ছে। বানিজ্য মন্ত্রনালয় বলছে MTFE র প্রতারণা তাদের কাজের আওতার বাইরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে এটি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা BTRC র দেখার বিষয়। কিন্তু BTRC বলছে, যেহেতু এখানে আর্থিক লেনদেনের বিষয় জড়িত, তাই এটি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখার বিষয়। তবে জাতীয় ভোক্ত অধিকার সংরক্ষণ অধিদপপ্তর বলছে, সন্দেহজনক লেনদেন বা অবৈধ আর্থিক কার্যকলাপ নজরদারি করার দ্বায়িত্ব বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটির। এই সংস্থাটি মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে কাজ করে।

মূলত প্রবাসীদের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় MTFE অ্যাপের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ায়, দেশের গণমাধ্যমে এ বিষয়টি উঠে আসেনি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অনেকগুলো জেলা থেকে লোকজনের ক্ষতিগ্রস্ত হবার খবর প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে MTFE র নাম আলোচনায় উঠে এসেছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।