G20 জোটের কাজ কী

maxresdefault (46)
কি কেন কিভাবে

G20 জোটের কাজ কী

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করা সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক ফোরাম G20 বা Group of 20। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় অর্থনীতির ১৯ টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে এই ফোরাম গঠন করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করার পর থেকে, বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ধারায় G20 অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

G20 জোটের কাজ কী ?

G7

বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের প্রভাবশালী বেশ কিছু দেশের পারস্পরিক সম্মেলন এবং আলোচনার ফসল হিসেবে G20 গঠিত হয়েছে। তবে G20 কিভাবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করল তা বোঝার আগে, G7 সম্পর্কে জানতে হবে। ১৯৭০ সালের দিকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ মিলে একটি অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলে। তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিথিশীল রাখা এবং তাদের নিজেদের আর্থিক স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখা। কালক্রমে সেই জোট কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ৭ দেশের একটি জোটে পরিণত হয়। সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির এই জোট Group of Seven বা G7 নামে পরিচিতি পায়। প্রথমদিকে এই দেশগুলো মনে করত, তারাই মূলত বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা উপলব্ধি করে যে, বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আগের চেয়ে অনেক বেশি বদলে যাচ্ছে, এবং শীর্ষ উন্নত দেশগুলোর বাইরেও, আরো বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ বৈশ্বিক অর্থণৈতিক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রন করছে। পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ছোট বড় সকল দেশই একে অপরের সাথে ঘনিষ্টভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন G7 ভুক্ত দেশগুলো মনে করল, বিশ্ব অর্থনীতিকে আরো পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাদের জোটে প্রতিটি মহাদেশের প্রভাবশালী আরো কয়েকটি দেশকে যুক্ত করতে হবে।

G20

১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে এশিয়া অঞ্চলে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা তৈরী হয়। সেই মন্দার ধাক্কা উন্নত দেশগুলোতেও পৌছে যায়। একই সময়ে তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলো ইউরোপ আমেরিকায় তেল রপ্তানি করা বন্ধ করে দেয়। সবমিলিয়ে তৈরী হওয়া আর্থিক অস্থিতিশীলতা কিভাবে কমানো যায়, তা আলোচনার জন্য ১৯ টি দেশের অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনরেরা জার্মানীর বার্লিনে মিলিত হয়। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একক ইউনিট হিসেবে যোগ দেয়। ১৯৯৯ সালে মিলিত হওয়া সেই ১৯ দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে G20 ফোরামের যাত্রা শুরু হয়। G20 র এই ১৯ টি দেশ হল, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

G20 গঠনতন্ত্র

G20 কোন প্রচলিত আন্তর্জাতিক সংগঠনের মত কাজ করে না, এটি মূলত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম। সেকারনে G20 র কোন স্থায়ী সচিবালয় বা সদরদপ্তরও নেই। G20 র প্রেসিডেন্ট এই ফোরামের কার্যক্রম পরিচালনা করে। সদস্য দেশগুলোর মধ্য থেকে একটি দেশকে পালাক্রমে প্রেসিডেন্সির দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট দেশই G20 সম্মেলন আয়োজন করা সহ, বছরব্যাপী চলমান সকল কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেয়। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশ পর্যায়ক্রমে তাদের এজন্ডা সেট করার সুযোগ পায়। গত বছর G20 র প্রেসিডেন্ট ছিল ইন্দোনেশিয়া, এ বছর প্রেসিডেন্সির পালন করছে ভারত, এবং আগামী বছর এই দ্বায়িত্ব পাবে ব্রাজিল।

প্রতিটি G20 সদস্য দেশ তাদের পক্ষ থেকে একজন উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাকে প্রতিনিধি নিয়োগ করে, এই প্রতিনিধিদেরকে বলা হয় Sherpa। এই শেরপারা তাদের নিজেদের দেশের সুবিধা অসুবিদা তুলে ধরা সহ, G20 এজেন্ডা তৈরী করার কাজ করে থাকে। G20 র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হল Finance Track নামের একটি প্রক্রিয়া। G20 Finance Track নির্ধারণের জন্য সদস্যে দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনরেরা সারা বছর ব্যাপী বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নেন।

G20 তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেশ কিছু Engagement Group এর উপর জোড় দেয়। এসব গ্রুপ গুলো B20, C20, L20, T20 এবং W20 নামে পরিচিত। B20 বা Business 20 গ্রুপের প্রধান কাজ হল অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান তৈরীর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা। C20 বা Civil 20 বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং টেকসই উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে। L20 বা Labor 20 বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, শ্রমিক অধিকার এবং কর্মসংস্থান বিষয়ক ইস্যু নিয়ে কাজ করে। T20 বা Think 20 সদস্যদেশগুলোর থিংকট্যাংক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে, G20 র সামগ্রিক নীতি নার্ধারণী বিষয়গুলোর ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করে। W20 বা Women 20 লৈঙ্গিক সমতা এবং নারী ক্ষমতায়নের মত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে।

এই গ্রুপগুলো থেকে আসা তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে, সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে G20 তাদের বৈশ্বিক এজেন্ডা তৈরী করে।

G20 এর উদ্দেশ্য

G20-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করা। এর মধ্যে রয়েছে মুদ্রা বিনিময় হার, আর্থিক ও মুদ্রা নীতি এবং আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণের মতো সমস্যাগুলি সমাধান করা। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশেগুলোর মধ্যে নীতি সমন্বয় করে, আর্থিক সংকট প্রতিরোধ করা এবং একটি স্থিতিশীল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখা G20 এর প্রধান লক্ষ্য।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে টেকসই উন্নয়ন G20 এর গুরুত্বপূর্ণ ফোকাস হয়ে উঠেছে। সদস্য দেশগুলি পরিবেশগত স্থায়িত্ব এবং সামাজিক ন্যায্যতার সাথে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, বৈষম্য হ্রাস এবং জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা।

G20 বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতি গঠনেও ভূমিকা পালন করে। সদস্য দেশগুলি বাণিজ্য বাধা, শুল্ক এবং বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করে। এর মাধ্যমে সকলের জন্য উন্মুক্ত বানিজ্যিক পরিবেশ এবং ন্যায্য বাণিজ্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এর বাইরে আন্তঃদেশীয় বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নও G20 এর এজেন্ডার মধ্যে রয়েছে।

G20 তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা IMF এর মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করে। এর কারণ হল, এই দুটি প্রতিষ্ঠান যেন বিশ্বব্যাপী তৈরী হওয়া অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলি আরো সহজে মোকাবেলা করতে পারে।

G20 এর অর্জন

G20 এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হল, 2008 সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা মোকাবেলা করা। সেসময় G20 নেতারা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য, আর্থিক উদ্দীপনা প্যাকেজ, আর্থিক খাতের সংস্কার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছে। যার ফলে সেই বৈশ্বিক আর্থিক মন্দাকে খুব কম সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রনে আনা গিয়েছিল। ভবিষ্যতে যেন আবারো একই ধরনের আর্থিক সঙ্কট তৈরী না হয়, সেজন্য ব্যাংকগুলোকে আরো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য G20 এর পক্ষ থেকে Basel III Framework এবং Financial Stability Board বা FSB গঠন করা হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, G20 টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের উপর বেশি জোর দিচ্ছে। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তায়নের জন্য G20 সদস্য দেশগুলো কাজ করে যাচ্ছে।

G20 এর সমালোচনা

G20 জোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করলেও, এ সদস্য দেশগুলোর ভেতরই বানিজ্যিক উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বিপরীত মেরুতে থাকা দুটি দেশ এই জোটে থাকার কারণে, G20 আদৌ কোন বানিজ্যিক সহাবস্থান তৈরী করতে পেরেছে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

G20 এর আরেকটি সমালোচনা হল, এটি অনেক ছোট দেশকে তাদের আলোচনার টেবিল থেকে দূরে রাখে। কিন্তু বিপরীতভাবে তাদের সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো ছোট ছোট দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় প্রভাব তৈরী করে।

কিছু কিছু সমালোচক G20 কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। G20 র বিভিন্ন চুক্তি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না এবং এর সদস্য দেশগুলো সবসময় তাদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলে না। ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে G20 অনেকে দিক থেকেই তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। একসাথে কাজ করার মাধ্যমে স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ এবং টেকসই বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা বলা হলেও, G20 এ ব্যাপারে খুব কমই সফলতা অর্জন করতে পেরেছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।