ভারত নাম পরিবর্তন করতে চায় কেন

maxresdefault (45)
কি কেন কিভাবে

ভারত নাম পরিবর্তন করতে চায় কেন

ভারতের নাম পরিবর্তন করা নিয়ে দেশটিতে তুমুল বিতর্ক তৈরী হয়েছে। দেশটির ইংরেজি নাম India র বদলে ভারত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এর পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে নানান মতামত। দেশের নাম পরিবর্তন করার চেষ্টা এবার ভারতেই প্রথম নয়। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং জাতিগত পরিচয় আরো ভালোভাবে প্রকাশ করার জন্য অতীতেও বেশ কিছু দেশ তাদের নাম পরিবর্তন করেছে। যেমন: পারস্যের নাম বদলে করা হয়েছে ইরান, থাইল্যান্ডের নাম আগে ছিল সিয়াম, ক্যাম্পুচিয়া হয়েছে কেমবোডিয়া, বার্মা হয়েছে মিয়ানমার, হল্যান্ড এর নাম হয়েছে নেদারল্যান্ড, সিংহল থেকে হয়েছে শ্রীলংকা, রোডেশিয়ার নতুন নাম জিম্বাবুয়ে, সোয়াজি ল্যান্ডের নাম হয়েছে এসওয়াতিনি, চেক রিপাবলিক হয়েছে চেজিয়া, রিপাবলিক অব মেসেডোনিয়া হয়েছে নর্থ মেসেডোনিয়া, তুরষ্কের নতুন নাম তুর্কিয়ে। এভাবে নাম পরিবর্তন করা আরো বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে।

ভারত নাম পরিবর্তন করতে চায় কেন ?

নাম পরিবর্তন বিতর্ক

ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর পাঠানো এক চিঠি কে কেন্দ্র করে, দেশটির নাম পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। জি২০ সম্মেলনে বিদেশি অতিথিদের রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ জানানো চিঠিতে, রাষ্ট্রপতির দ্রৌপদী মুর্মুর পরিচয় হিসেবে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’র বদলে লেখা হয়েছিল ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। সাধারণত ভারতের আন্তর্জাতিক পরিচয় ইন্ডিয়া হিসেবে। এবং দেশটির দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত নথিপত্রেও ইন্ডিয়া লেখার প্রচলন রয়েছে। অন্যদিকে, ২০তম আসিয়ান-ভারত শীর্ষ সম্মেলন এবং ১৮তম পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির ইন্দোনেশিয়া সফরের একটি নোটে ‘প্রাইম মিনিস্টার অব ইন্ডিয়া’র পরিবর্তে ‘প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সামাজিক মাধ্যমে এই নোটের ছবি প্রকাশ করার পর থেকে কংগ্রেস সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু করে। তবে ভারতের নাম পরিবর্তনের বিতর্ক এখানেই শেষ হয় না, বরং সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া আরেকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে এই বিতর্ক দেশের সীমা অতিক্রম করে। যদিও এখনও পর্যন্ত ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেওয়া হয়নি।

সাউথ এশিয়ান ইনডেক্স নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করা একটি পোস্টে বলা হয়, জাতিসংঘের স্বীকৃতি সাপেক্ষে ভারত যদি ইন্ডিয়া নাম ত্যাগ করে, তাহলে পাকিস্তান এই নামটি নিজেদের জন্য দাবি করতে পারে। কারণ পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদীরা বহুদিন ধরে সিন্ধ প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে ইন্ডিয়া রাখার দাবি জানিয়ে আসছে। এই প্রদেশের প্রাচীন নাম ছিল ইন্ডুস।

ভাইরাল এই পোস্টকে ঘিরে দুই দেশের নেটিজেনদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। ভারতের জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার বীরেন্দর শেবাগও সেই কমেন্ট যুদ্ধে জড়িয়েছেন।

দিল্লির জি-২০ সম্মেলনে অংশ নিতে আসা জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, এ বিষয়ে মন্তব্য করা জাতিসংঘের কাজ নয়। বিষয়টি মূলত আমলাতান্ত্রিক বিষয়। ভারত নাম পরিবর্তনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর জাতিসংঘ তাদের নথিপত্রে ‘ইন্ডিয়া’র পরিবর্তে ‘ভারত’ করে দেবে।

ভারতের প্রাচীন নাম সমূহ

অতীতে বিভিন্ন সময়ে ভারতের নাম বিভিন্নভাবে বদলেছে। ৪ হাজার ৫০০ বছর আগে প্রাচীন প্রারস্যের রাজা এই অঞ্চলের নাম দিয়েছিলেন মেলুহা। ২ হাজার ৫০০ বছর আগে পারস্যে সম্রাট দারিয়ুস এই অঞ্চলের নাম দিয়েছিল হিন্দ। এর মাধ্যমে সিন্ধু নদের ওপারে বসবাসকারী জনগণকে বোঝানো হত। ২ হাজার ৩০০ বছর আগে গ্রীক ঐতিহাসিক মেগাস্থিনিস Indus River বা ইন্দুস নদী থেকে এই অঞ্চলের নাম দেন ইন্ডিকা বা ইন্ডিয়া। ২ হাজার ২০০ বছর আগে সম্রাট অশোক ভারতের নাম দিয়েছিলেন জাম্বুদ্বীপ। এই নামের মাধ্যমে বৃহত্তর ভারতে সম্রাট অশোকের রাজত্ব বোঝানো হত। ২ হাজার ১০০ বছর আগে কলিঙ্গের রাজা কারাভেলা এই অঞলের নাম রাখেন ভারতবর্ষ। ২ হাজার বছর আগে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে এই অঞ্চলকে আরিয়া দেশা বা আর্যদেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই সকল নাম দ্বারা প্রধানত উত্তর ভারতের এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করা হত। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে সুনির্দিষ্ট কোন ভৌগলিক মানচিত্রও ছিল না।

বর্তমানে নতুন করে বিতর্ক শুরু হবার পর, ভারতের নাম কি ইন্ডিয়া, ভারতবর্ষ নাকি হিন্দুস্তান হওয়া উচিত তা নিয়ে দেশবাসী একমত হতে পারছে না।

নাম পরিবর্তনের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি

ভারত সরকার যেহেতু এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোন কিছু বলেনি, তাই  নাম পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তিগুলো কি হতে পারে তা নিয়ে কোন স্পষ্ট করে কিছু বলা যায় না। তবে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারা বলছেন, ‘ইন্ডিয়া’ নামটি ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনেকে মনে করেন ইন্ডিয়া নামটি ব্রিটিশরা দিয়েছিল। সেকারণে ঔপনিবেশিক এই নাম ভারতের মুছে ফেলা উচিত। যদিও বিষয়টি মোটেও সত্য নয়। ব্রিটিশদের আসার আগে থেকেই এই অঞ্চলের নাম ছিল ইন্ডিয়া। সেই ইন্ডিয়ার খোঁেজই পর্তুগীজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানি, ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানি, ডাচ ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানি, ফ্রেঞ্চ ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানির মত আরো কিছু ইউরোপীয় দেশ ভারতে এসে পৌছেছিল। ব্রিটিশরা ভারতে তাদের পাকাপোক্তভাবে তাদের আস্তানা গাড়ার পর, এর নাম দেয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়া।

উপমহাদেশ স্বাধীন হবার পর, ভারতের ইন্ডিয়া নাম প্রাপ্তি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পছন্দ ছিল না। এর কারণ হল, স্বাধীনতার আগে ভারত পাকিস্তান সম্মিলিতভাবে ইন্ডিয়া হিসেবে পরিচিত ছিল। তাই জিন্না মনে করত, মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান এবং হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান নামে আলাদা দেশ হওয়া দরকার। কারণ ইন্ডিার নামটির একটি বিশাল ব্রান্ড ভ্যালু রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত তাদের ইন্ডিয়া ব্রান্ড ভ্যালুর সুফল ভোগ করতে থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানকে ব্রান্ড ভ্যালু তৈরীর জন্য শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। ভারত স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়ান আর্মি, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে। কিন্তু পাকিস্তান এর কিছুই পায়নি।

ভারতের ব্রান্ড নেম এর সবচেয়ে বড় আরেকটি কারণ হল Indian Ocean। ইন্ডিয়ার মত একটি দেশের নামে একটি মহাসাগরের নাম হওয়ায়, চীনারা এই নামটি মোটেও পছন্দ করে না।

কিছুদিন আগে ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতৃত্বে Indian National Developmental Inclusive Alliance বা INDIA নামে ২৬ দলের একটি জোট গড়ে তোলা হয়। বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, নির্বাচনী জোট ‘ইনডিয়া’কে খাটো করতেই দেশের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার।

নাম পরিবর্তনের অসুবিধা

ভারত যদি তাদের নাম বদলে ফেলে তাহলে, দেশটির বেশ কিছু সনামধন্য প্রতিষ্ঠানেরও নাম বদলে ফেলতে হবে। Indian Institute of Science বদলে হবে Bharat Institute of science, Indian Space Research Organization বা ISRO হবে, Bharat Space Research Organisation বা BISRO। নাম বদলের সাথে সাথে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্জনও কিছুটা ম্লান হয়ে যাবে। সেই সাথে ভারত তার বহু মূল্যবান ব্রান্ড ভ্যালু হারাবে। যার কারণে রপ্তানি বাজার সহ আন্তর্জাতিক মহলে দেশটিকে পদে পদে ভুগতে হবে। ভারতের সংিবধানের Article 1 এ বলা হয়েছে, “India that is Bharat”। তারমানে ইন্ডিয়াই ভারত।  সে হিসেবে সংবিধান অনুযায়ী ভারত আর ইন্ডিয়া নিয়ে কোন বিতর্ক হওয়া উচিত নয়।

সাধারণত একটি দেশ তখনই তাদের নাম বদলায়, যখন সেই দেশের জনগণের সাথে অনেক বড় কোন ঘটনা ঘটে। হতে পারে তারা কোন উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করছে, অথবা, দেশটিতে কোন বিপ্লব সাধিত হয়েছে, অথবা দেশের সাংবিধানিক কোন বড় রকমের পরিবর্তন হয়েছে, অথবা দেশটি তাদের নামের কারনে কোন না কোন ভাবে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতের ক্ষেত্রে এর কোনটিই ঘটেনি।

অতীতে আমাদের দেশের নামও ছিল ইস্ট পাকিস্তান। পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমরা বাংলাদেশ হয়েছি। রিপাবলিক অব মেসেডোনিয়া তাদের নাম বদলে নর্থ মেসেডোনিয়া করেছে। এর কারণ হল গ্রীসেও মেসেডোনিয়া নামের একটি অঞ্চল রয়েছে। শ্রীলংকা তাদের বহুসংস্কৃতির বর্হিঃপ্রকাশ করার জন্য এবং ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ছিন্ন করার জন্য সিলন থেকে শ্রীলংকা নাম ধারণ করেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের শাসনকে দেশের জন্য নতুন অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করে, বার্মা থেকে মিয়ানমার নাম রেখেছে। থাইল্যান্ডে পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে উপেক্ষা করার জন্য প্রাচীন নাম সিয়াম থেকে থ্যাইল্যান্ড রাখা হয়। চেকোস্লোভাকিয়া দেশটি ভেঙে দুটি নতুন দেশ হয়েছে চেক রিাবলিক এবং স্লোভাকিয়া। পরবর্তীতে চেক রিপাবিলিকও নাম বদলে হয়েছে চেজিয়া। অতি সাম্প্রতিক সময়ে নাম বদল করেছে তুরষ্ক। ইংরেজিতে একে বলা হত টার্কি। কিন্তু টার্কি দ্বারা ইংরেজি ভাষায় এক ধরনের বিশেষ মুরগীকে বোঝানো হয়। সেকারণে তুরষ্কে নাম বদলে তুর্কিয়ে নাম ধারণ করেছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।