এমিরেটস এয়ারলাইনস
এমিরেটস এয়ারলাইনস
এমিরেটস এয়ারলাইন
এমিরেটস এয়ারলাইন বিশ্বের সবচেয়ে কম সময়ে শীর্ষ বিমান পরিবহন কম্পানিতে পরিণত হয়েছে। অথচ এই কম্পানির যখন যাত্রা শুরু করে, তখন তাদের নিজস্ব কোন বিমানও ছিল না। পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে মাত্র দুটি বিমান ভাড়া নিয়ে এমিরেটসের বিমান পরিবহণ ব্যবসা শুরু করেছিল। আর বর্তমানে এমিরেটস তাদের ২৬২ টি বিমান দিয়ে, বিশ্বের ১৫২ টি গন্তব্যে যাত্রীসেবা প্রদান করছে।
করোনা মহামারির সময় অন্যান্য এয়ারলাইনগুলো যেখানে দেউলিয়া হতে শুরু করেছিল, সেখােন ২০২০ সালে এমিরেটস এক কোটি ৫৮ লাখ যাত্রী পরিবহণ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান সংস্থায় পরিণত হয়। এমনকি এমিরেটস তাদের ৩৮ বছরের ইতিহাসে ৩৫ বছরই মুনাফায় ছিল।
শুরুর ইতিহাস
দুবাই এর অতীত সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। এক সময়কার অনুন্নত এই জেলে পল্লী বর্তমানে পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল এক শহরে। ১৯৬০ এর দশকে উপাসাগরীয় অন্যান্য দেশের মত দুবাইতেও তেলের খনির সন্ধান পাওয়া যায়। তৎকালীন আমির শেখ রশিদ বিন সাঈদ আল মাকতুম এর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি বলেছিলেন, আমার কাছে একটি ভালো খবর আর একটি খারাপ খবর আছে। ভালো খবর হল আমরা তেল পেয়েছি এবং খারাপ খবর হল আমাদের খুব বেশি তেল নেই। সৌদি আরবে যেখানে প্রায় ২৯৭ বিলিয়ন ব্যারেল তেল আছে, সেখানে দুবাইয়ের তেল আছে মাত্র ৪ বিলিয়ন ব্যারেল। শেখ রশিদ বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই তেল শেষ হয়ে গেলে দুবাই আবারো আগের মত গরিব হয়ে যাবে। তাই দুবাইয়ের তেল শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই এই অর্থ ব্যবহার করে অন্যান্য সম্পদ গড়ে তুলতে হবে। তখন দুবাই আবাসন, পর্যটন সহ নানান খাতে তাদের আর্থ বিনিয়োগ করতে শুরু করে। আর কিভাবে দুবাই তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে? সে বিষয়ে তারা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে থাকে। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, দুবাই ভৌগলিকভাবে এমন একটা জায়গায় অবস্থিত, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের মধ্যে বিমান চলাচলের জন্য দুবাই খুব স্বাভাবিকভাবেই একেবারে মাঝপথে পড়ে। এবং তিনটি মহাদেশের বড় বড় শহর গুলো থেকে দুবাইয়ের দূরত্ব মাত্র চার থেকে ছয় ঘন্টা। শুধু তাই নয় দুবাই থেকে বিমানযোগে মাত্র ৮ ঘন্টা দূরত্বের মধ্যে, পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ জনগণ বসবাস করে। ফলে এখানে চাইলেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোর জন্য চমৎকার কানেক্টিং পয়েন্ট গড়ে তোলা সম্ভব। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই দুবাই সরকার এমিরেটস এয়ারলাইন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে।
এমিরেটস প্রতিষ্ঠা
বহু আগে থেকে দুবাই শাসন করে আসছে আল মাকতুম পারিবার। বর্তমান দুবাই এর আমির হলেন মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম। বর্তমান আমির মোহাম্মদ বিন রশিদ এর চাচা শেখ আহমেদ বিন সাইদ আল মাকতুম ১৯৮৫ সালে এমিরেটস এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এমিরেটস গ্রুপ পরিচালনার পাশাপাশি, দুবাই বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ এবং দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পরিচালনার দ্বায়িত্বও পালন করছেন। তৎকালীন আমির শেখ রশিদ বিন সাঈদ এমিরেটস প্রতিষ্ঠার সময় ২ টি শর্ত দিয়েছিলেন। তিনি বলেন দুবাইয়ের এই এয়ারলাইনকে সর্বোচ্চ মানের যাত্রীসেবা দিতে হবে এবং তিনি এই এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠার জন্য মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলার দিবেন। পরবর্তীতে এয়ারলাইন পরিচালনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এক টাকাও দেওয়া হবে না। তারমানে কম্পানিকে তার নিজস্ব লাভের টাকায় পরিচালনা করতে হবে। যদি এই শর্তে দুবাই এর বিমান ব্যবসা শুরু করা যায়, শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই দুবাই বিমান পরিসেবা পরিচালনা করবে। তা না হলে, দুবাই বিমানের ব্যবসাই করবে না। তখন আমির শেখ রশিদ বিন সাঈদ এর ভাই শেখ আহমেদ বিন সাঈদ এই দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। এমিরেটসের সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব। শেখ আহমেদ এমিরেটস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সারা বিশ্বের এভিয়েশন শিল্পে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আগাতে থাকেন। তার প্রধান কৌশল ছিল, সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদান করে দীর্ঘমেয়াদে কম্পানিকে টেকসই করে গড়ে তোলা।
সম্প্রসারণ এবং আধুনিকায়ন
দুবাই তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সেই টাকা খরচ করে শুরুতেই নতুন বিমান কেনেনি। তারা প্রথমে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে Boeing 737 এবং Airbus A300 মডেলের দুটি বিমান ভাড়া নেয়। যত ঘন্টা বিমান আকাশে উড়বে, শুধুমাত্র তত ঘন্টার ভাড়া দেওয়ার শর্তে, পাকিস্তান এয়ারলাইনসের ক্রু এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়। এর বিপপরীতে দুবাই শুধুমাত্র জ্বালানী খরচ, এয়ারপোর্ট ফি, ট্যাক্স এবং অন্যান্য পরিচালনা ব্যয় বহন করে। এই ভাড়া করা বিমানের মাধ্যমে এমিরেটস তাদের ব্যাসায়িক মডেল ভালোভাবে যাচাই করার সুযোগ পায়। এবং বিমান পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও, প্রথম দিন থেকেই তারা সেরা যাত্রীসেবা দেওয়া শুরু করে। প্রাথমিক মূলধন দিয়ে এমিরেটস বিমান না কিনে, কম্পানির প্রসারের জন্য মার্কেটিয়ে খরচ করে এবং লাভজনক বিমান রুটগুলোর পরীক্ষা চালাতে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে ভাড়া করা দুটি বিমান থেকে আজকে তারা সবচেয়ে আধুনিক ২৬২ টি বিমানের এক বিশাল বহর গড়ে তুলতে পেরেছে।
বর্তমান সময়েও বৈশ্বিক প্রতিযোগীতা থেকে এগিয়ে থাকতে, এমিরেটস প্রতিনিয়ত তাদের কার্যক্রম বাড়িয়ে চলছে। সেই সাথে বিমান পরিসেবাকে যতটা আধুনিক করা সম্ভব তার সবই করার চেষ্টা করছে। বিমান বহরে সবচেয়ে নতুন এবং সবচেয়ে আধুনিক বিমান যুক্ত করার জন্য এমিরেটসের আলাদা সুনাম রয়েছে। Airbus A380, Boeing 777 এবং সবচেয়ে জ্বালানী সাশ্রয়ী Boeing 787 Dreamliner সহ জনপ্রিয় সকল মডেলের নতুন নতুন বিমান রয়েছে এমিরেটসের। নতুন বিমানে জ্বালানীর খরচ পুরনো বিমানের তুলনায় অনেক কম হয়। সেই সাথে নতুন বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের খরচও হয় কম। তাছাড়া যাত্রীরাও নতুন বিমানে ভ্রমণ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।
গ্রাহক সেবা
এমিরেটস এয়ারলাইন প্রথম থেকেই গ্রাহক সেবার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ তারা মনে করে, কোন গ্রাহক তাদের সেবায় মুগ্ধ হলে, তারা আবারো এমিরেটসে ভ্রমণ করবে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একেকটি ফ্লাইটের অধিকাংশ যাত্রীই জীবনে প্রথমবার বিমান ভ্রমণ করে। এরকম যাত্রীরা এমিরেটসের ফ্লাইট উপভোগ করলে, তারা অবশ্যই নিজেরা এমিরেটসের রিটার্নিং কাস্টমার হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও এই এয়ারলাইনে ভ্রমণ করতে পরামর্শ দিবে। সেকারণেই এমিরেটস যাত্রীদের সেরা অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করে। এমিরেটসের কিছু কিছু বিমানে প্রাইভেট রুম, বিজনেস ক্লাসের যাত্রীদের জন্য বিমানে গোসল করার সুবিধা এবং আলাদা বার আছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে এমিরেটস বিশ্বমানের লাউঞ্জ সার্ভিস প্রদান করে।
রুট নেটওয়ার্ক
এমিরেটস এয়ারলাইন নিয়মিত তাদের বিমান পরিসেবার রুট বাড়িয়ে চলেছে। যেসব রুটে বিমান পরিচালনা করা খানিকটা কম লাভজনক, সেসব গন্তব্য থেকে অন্যান্য বিমান সংস্থা সরে আসলেও, এমিরেটস অনেকটা সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে সেসব জায়গায়ও তাদের কার্যক্রম বাড়াচ্ছে। এত বিস্তৃত জনসংখ্যার কাছে সহজলভ্য হওয়ার জন্যই এমিরেটসের যাত্রী সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু তাই নয়, যেসব জায়গায় এমিরেটস সরাসরি যায় না, সেসব গন্তব্যের জন্য এমিরেটস অন্যান্য আঞ্চলিক বিমান সংস্থাগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে ফ্লাইট পরিচালনা করে। উইনাইটেড এয়ারলাইন, এয়ার কানাডা, ব্যাংকক এয়ারওয়েজ, চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনস, জাপান এয়ারলাইনস, কোরিয়ান এয়ার, সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজ, থাই এয়ারওয়েজ সহ ২৮ টি বিদেশী বিমান সংস্থার সাথে এমিরেটসের চুক্তি রয়েছে। ১১৬ টি বিমান পরিবহণ সংস্থার সাথে এমিরেটসের ইন্টারলাইন এগ্রিমেন্ট রয়েছে। এর মাধ্যমে যাত্রীরা আলাদা আলাদা ভাবে বিমানের টিকেট কেনার বদলে, কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই একসাথে একাধিক কম্পানির বিমানে বুকিং দিতে পারে। এখানেই শেষ নয়, এমনকি জার্মানী, স্পেন এবং ফ্রান্সের রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথেও এমিরেটসের চুক্তি রয়েছে। এমিরেটসের বিমানে নির্দিষ্ট গন্তেব্য পর্যন্ত যাওয়ার পর, বাকিপথ তাদের চুক্তিবদ্ধ পার্টনারদের ট্রেনে করেও যাত্রীরা ভ্রমণ করতে পারবে। এভাবেই এমিরেটস বিশ্বব্যাপী তাদের সেবা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে অধিক সংখ্যক যাত্রী আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে।
উদ্ভাবনী মার্কেটিং এবং ব্র্যান্ডিং
এমিরেটসের সফলতার পেছনে, তাদের উদ্ভাবনী মার্কেটিং এবং ব্র্যান্ডিং কৌশলও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এমিরেটস তাদের বিজ্ঞাপনে সবসময় বিলাসিতা, নতুনত্ব এবং আতিথেয়তাকে প্রাধান্য দেয়। ব্রান্ডের প্রচারণার জন্য এমিরেটস বড় বড় স্পন্সরশিপের পেছনে প্রচুর অর্থ খরচ করে। সেকারণে তাদের “ফ্লাই এমিরেটস” স্লোগানটি একটি জনপ্রিয় আইকনে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে আর্সেনাল এবং রিয়াল মাদ্রিদের মতো ফুটবল ক্লাবের সাথে হাই-প্রোফাইল চুক্তি এবং বিভিন্ন বড় বড় খেলাধুলার আসরের স্পনসরশিপ এমিরেটসকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে অতি পরিচিত এক নামে পরিণত করেছে। এমিরেটস তার গ্রাহকদের সাথে আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল মার্কেটিং চ্যানেলগুলোকেও সমানতালে ব্যবহার করছে।
দুবাই নিয়মিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবের আয়োজন করে। এমিরেটসের ফ্লাইটে দুবাইয়ের এসব উৎসব এবং পর্যটনের সুযোগ সম্পর্কে যাত্রীদের জানানো হয়। এর মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরা দুবাই সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে পারে। একদিকে এমিরেটস বিশ্বের ধনী পর্যটকদের দুবাইয়ে নিয়ে আসছে, অন্যদিকে দুবাইয়ে গড়ে ওঠা পর্যটন ব্যবস্থা এবং ইভেন্টগুলো এমিরেটসের বিমান ব্যবসাকে চাঙা করছে।
খরচ কমানোর ব্যবসায়িক মডেল
এমিরেটস এয়ারলাইন্স কৌশলে এমন একটি ব্যবসায়িক মডেল বাস্তবায়ন করেছে, যা অত্যন্ত দক্ষতা সাথে খরচ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের পদ্ধতির মধ্যে বিমানের ব্যবহার, কার্যকরী রুট প্লানিং এবং জ্বালানি খরচ নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপপূর্ণ। জ্বালানি খরচ নিয়ন্ত্রনে এমিরেটস যে পদ্ধতি ব্যবহার করে, তাকে বলা হয় Fuel Hedging। ফুয়েল হেজিং অনেকটা জ্বালানীর ইন্সুরেন্সের মত কাজ করে। এর মাধ্যমে জ্বালানি খরচ কে একটি নির্দিষ্ট দামে বেঁধে দেয়া হয়। যেমন আজকে যে তেলের দাম ৩০ ডলার, হঠাৎ করে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মত কোন কারণে সেই ৩০ ডলারে তেলের দাম বেড়ে ৬০ থেকে ৯০ ডলার হয়ে যেতে পারে। তেলের দাম যদি রাতারাতি ১০০ থেকে ২০০ শতাংশ বেড়ে যায় তাহলে, এয়ারলাইন কম্পানিগুলোকে বিপুল পরিমাণ লোকসানের মধ্যে পড়তে হয়। সেকারনে ফুয়েল হেজিং এর মাধ্যমে এয়ার লাইন কম্পানি ৩০ ডলারের তেল স্বাভাবিক সময়েও ৪০ ডলার দিয়ে কেনে। যখন তেলের দাম ৮০ ডলার হবে তখনও তারা সেই ৪০ ডলারই দিবে; আবার তেলের দাম যদি কমে ১০ ডলারে নেমে আসে, তাহলেও এয়ারলাইন কম্পানি তেলের দাম হিসেবে ৪০ ডলারই পরিশোধ করবে। এভাবে ফুয়েল হেজিং এর মাধ্যমে এমিরেটস তাদের জ্বালানী খরচ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করে।
বিভিন্ন এয়ারলাইন কম্পানিগুলোতে পাইলট, কেবিন ক্রু সহ কর্মীদের ধর্মঘটের কারণে মাঝে মাঝে পরিসেবা বন্ধ থাকে। এর ফলে বিমান কম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ লোকসানের শিকার হয়। এবং যাত্রীরা অগ্রীম টিকেট কাটতে ভয় পায়। কিন্তু এমিরেটস এর কর্মীদের ধর্মঘট তো দূরের কথা, কোন ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন করারও সুযোগ নেই। বিষয়টি শুনতে খানিকটা অমানবিক হলেও, তারা আগে থেকেই কর্মদেরকে উচ্চ মানের প্রশিক্ষণ এবং তুলনামূলক বেশি বেতন প্রদান করে। এর ফলে এমিরেটসের কর্মীদের ধর্মঘটে যাওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। এবং যাত্রীরা নিশ্চিন্তে অগ্রিম টিকেট বুক করতে পারে।
এছাড়া, এমিরেটস বুকিং এবং চেক-ইন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ এবং গ্রাহক পরিষেবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন এবং অটোমেশন গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে কম জনবল দিয়েই অনেকটা নির্ভুলভাবে অধিক গ্রাহককে সেবা দেওয়া সম্ভব।
অর্থনৈতিক মন্দা থেকে শুরু করে মহামারির মত কঠিন পরিস্থিতিতে অন্যান্য বিমান সংস্থা যখন দেউলিয়া হয়ে গেছে, এমিরেটস তখনও তাদের ব্যবসা ভালোভাবেই চালিয়ে গেছে। করোনা মহামারির সময় এমিরেটস তাদের যাত্রীবাহী বেশ কিছু বিমানকে পণ্যবাহী বিমানে রূপান্তর করেছিল। এর মাধ্যমে তারা বিপুল পরিমাণ লোকসান থেকে বেঁচে যায়।
দুবাই বিমান বন্দর
এমিরেটস এয়ারলাইনের সফলতার পেছনে বিশেষ অবদান রেখেছে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে, দুবাই সরকার এই বিমান বন্দরকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম এভিয়েশন হাব হিসেবে গড়ে তুলেছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে প্রথম দিকে রয়েছে। ২০১৪ সালে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরকে অতিক্রম করে দুবাই বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর হিসেবে উঠে আসে। টানা পাঁচ বছর বিমানবন্দরটি তালিকার শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছিল।
দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক যাত্রী পারাপার হয়। প্রতিদিন ৬ টি মহাদেশের প্রায় ২ লক্ষাধিক যাত্রী ও ২০০ টনের বেশি মালামাল পরিবহন করে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। প্রতিমাসে বিমান বন্দরটি ব্যবহার করে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ যাত্রী বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করে। বছরে প্রায় ৯ কোটি যাত্রী এই বিমান বন্দর ব্যবহার করারও রেকর্ড আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের যাত্রী সংখ্যা ১২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই চার কোটি ১৬ লক্ষ যাত্রী এই বিমান বন্দর ব্যবহার করেছে। ইউরোপ থেকে ভারত এবং চীন সহ সমগ্র এশিয়া অঞ্চলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা বিমানগুলোর অধিকাংশই দুবাইয়ে যাত্রা বিরতি করে। বর্তমানে দুবাই এর অর্থনীতির ১৫ থেকে ২০ শতাংশই আসে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে।
বিস্তৃর্ণ এলাকার দূরবর্তী ফ্লাইটগুলো দুবাইয়ে যাত্রাবিরতি করার কারণে, তুলনামূলক ছোট্ট একটি শহর দুবাইয়ে এত লোকের আগমন ঘটে। শুধু ভৌগলিক কারণেই দুবাই এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, এর জন্য তারা রীতিমত পরিকল্পনা করে, নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছে। বিমান পরিসেবায় একেকটি ফ্লাইটের ট্রানজিটের কারণে, বিমান কর্তৃপক্ষকে বহু টাকা গুনতে হয়। দুবাই কর্তৃপক্ষ তাদের বিমান বন্দরে পর্যাপ্ত সুবিধা রাখার পরও, নানা উপায়ে এই ট্রানজিটের খরচ বহুগুণ কমিয়ে এনেছে। ফলে দুবাই এর আশেপাশে একাধিক বিমান বন্দর থাকলেও, বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলো ট্রানজিট গ্রহণের ক্ষেত্রে দুবাইকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
চার্টার বিমান
সাম্প্রতিক সময়ে এমিরেটস তাদের বিমান পরিবহণ সেবায় চার্টার বিমান সার্ভিসও চালু করেছে। এমিরেটসের চার্টার বিমানগুলোতে মাত্র চার জন যাত্রী আরোহন করতে পারে। দুবাইয়ের ধনী ব্যক্তিরা আশে পাশের দেশে ভ্রমণ করতে চাইলে এমিরেটসের এসব ছোট বিমানও ভাড়া করতে পারবে। তবে শুধুমাত্র দুবাই এর আল মাকতুম বিমান বন্দর থেকে GCC ভুক্ত দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এই বিমানগুলো ভাড়া করা যাবে। GCC বলতে Gulf Cooperation Council বোঝায়। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত মিলে এই কাউন্সিল গড়ে তোলা হয়েছে। এধরনের নানা অভিনব ব্যবসায়িক কৌশল গ্রহণ এবং যাত্রীবন্ধব মনোভাবের কারণে এমিরেটস পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম লাভজনক এভিয়েশন কম্পানিতে পরিণত হয়েছে।