বাংলাদেশে কোটিপতি বাড়ছে কেন
বাংলাদেশে কোটিপতি বাড়ছে কেন
বাংলাদেশে হঠাৎ করেই কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে গেঠে। শুধুমাত্র গত তিন মাসেই প্রায় তিন হাজার নতুন কোটিপতি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে কোটি টাকার ব্যাংক একাউন্টের সংখ্যা ১ লাখ ১৩ হাজার। যাদের মধ্যে ১ হাজার ৮২৪ জনের একাউন্টে ৫০ কোটি টাকার বেশি জমা আছে। অন্যদিকে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি লোকের একাউন্টে আছে মাত্র ৫ হাজার টাকারও কম। (বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক পরিসংখ্যান)
প্রতিবেদনের সময় ব্যাংকগুলোতে ১৬ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা জমা ছিল। এর মধ্যে কোটিপতিদের টাকার পরিমাণ ৭ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। তারমানের ব্যাংকে যতটাকা জমা আছে তার অর্ধেকই (৪৩.৩৩%) কোটিপতিদের টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত পাঁচ বছরে কোটি টাকা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
কোটিপতি কারা?
কোনও ব্যক্তি যদি তার সকল সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংকে কয়েক কোটি টাকা জমা রাখেন; অথবা কেউ লটারিতে এক কোটি টাকা জেতেন; তাহলে এই দুই ব্যক্তির কাউকেই কোটিপতি হিসেবে ধরা হবে না। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে তারাই কোটিপতি, যাদের কোটি বা তার বেশি পরিমাণ টাকার প্রবাহ আছে। তারমানে যে ব্যাক্তি কোটি টাকা লেনদেন করে, তাকে কোটিপতি বলা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুনে কোটি টাকা সম্পন্ন ব্যাংক একাউন্ট ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৪৫৭টি। যা ২০২৩ সালের জুনে বেড়ে দাড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি। তারমানে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৫ হাজার ৯৭টি। এর মধ্যে গত মার্চ মাসে কোটি টাকার একাউন্ট সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৬। সে হিসেবে মাত্র তিন মাসে কোটিপতি বেড়েছে তিন হাজার। কোটিপতি নয়, তবে বিপুল টাকা আছে এমন একাউন্টের সংখ্যাও কম নয়। ৫০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকাধারী একাউন্টের সংখা প্রায় দেড় লাখ (১ লাখ ৪২ হাজার ৫৯১ টি) এবং ৭৫ লাখ থেকে এক কোটি টাকার একাউন্টের সংখ্যা প্রায় ৭২ হাজার (৭১ হাজার ৯৪৭ টি)।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ব্যাংকে টাকা রাখার পরিসংখ্যান দিয়ে দেশে কোটিপতির প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা যাবে না। বাংলাদেশে প্রকৃত কোটিপতির সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ এগুলো শুধুমাত্র কোটি টাকা সম্পন্ন ব্যাংক একাউন্টের সংখ্যা। এমন অনেক কোটিপতি রয়েছেন যাদের ব্যাংকে হয়তো জমানো অর্থ নেই; কিন্তু দেশে ও দেশের বাইরে প্রচুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। যার পরিমাণ কোটি টাকারও অনেক বেশি। এছাড়া ব্যাংকে শুধু ব্যক্তি নয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এক কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছে। তাছাড়া একজন ব্যক্তিরই একাধিক ব্যাংকে একাধিক কোটি টাকার একাউন্ট থাকতে পারে। সে হিসেবে বাংলাদেশে কতজন কোটিপতির আছে, তার প্রকৃত চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায় না। এবং এ বিষয়ে আর কোন সঠিক পরিসংখ্যানও নেই।
কোটিপতির হিসেব
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। তার তিন বছর পর ১৯৭৫ সালে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। তবে দেশে কোটিপতির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০০৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে। ২০০৮ সালে কোটিপতি ছিল ১৯ হাজার ১৬৩ জন; ২০১৯ সালে কোটিপতি বেড়ে হয় ৮৩ হাজার ৮৩৯ জন। তারমানে সেই দশ এগারো বছরে কোটিপতি বেড়েছে ৬৪ হাজার ৬৭৬ জন। এরপর ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মাত্র চার বছরে আরো ২৯ হাজার ৭১৫ জন নতুন করে কোটিপতি হয়েছেন। ওয়েলথ এক্স নামের একটি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে বলা হয়েছিল, ৩ কোটি ডলার বা ৩০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক, বাংলাদেশে সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম দিকেই ব্যাংকে আমানত বেড়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই রেখেছে কোটিপতিরা।
কোটি টাকার উৎস
বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশে যেভাবে গুটিকয়েক মানুষ এমন দ্রুত কোটি টাকার হিসেব খুলে বসেছেন, তাতে তাদের অর্থের উৎস বা উপার্জনের উপায় নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোটিপতি হিসাবধারীদের বেশিরভাগই হয় ঋণখেলাপি, ঘুষখোর বা দুর্নীতিবাজ না হয় বিভিন্ন খাত থেকে অর্থ লুটেরা। যেমন: ব্যাংক থেকে লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা তুলে তারা পরিশোধ করছে না, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অর্থ চুরি করছে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করছে অথবা, ঠিকাদাররা এক টাকা পণ্যের খরচ ১০০ টাকা দেখিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশে অবৈধভাবে কোটিপতি হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই দুর্নীতির টাকা ব্যাংকে রাখেন না বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। কারণ ব্যাংকে টাকা রাখলে টাকার উৎসের প্রমাণ দিতে হয় এবং বছর বছর সেই টাকার করও পরিশোধ করতে হয়। তাই অবৈধভাবে অর্জিত কোটি কোটি টাকার বেশিরভাগ প্রতি বছর দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। টাকা পাচার করার কোন ব্যবস্থা না থাকলে, ব্যাংকে কোটিপতির সংখ্যা আরও বাড়ত বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। যারা অবৈধ টাকা বিদেশে পাচার করে না, তারা সরকারকে না জানিয়ে নামে বেনামে সম্পদ কেনে। দুর্নীতিবাজদের মধ্যে সাধারণত তাদের স্ত্রী, সন্তান এবং বাবা মায়ের নামে সম্পদ গড়ে তোলার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
তবে যেসব দুর্নীতিবাজ ব্যাংকে টাকা রাখে, তারা দুর্নীতির উৎস ঢাকতে নাম সর্বস্ব বিকল্প উপার্জনের পথ তৈরী করে। যেমন: একজন দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তা তার স্ত্রীর নামে একটি গরুর খামার করল। সেই খামার থেকে কোন টাকা আসুক বা না আসুক; পরবর্তীতে তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে যত টাকা কামাবেন, তার উৎস হিসেবে সেই গরুর খামার দেখানো হবে।
গত তিন মাসে কোটিপতির সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর মানুষের হাতে অস্বাভাবিক হারে অর্থ আসছে। আর সেকারণেই ব্যাংকে নতুন করে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে।
কোটিপতি বাড়া লাভ না ক্ষতি
এভাবে কোটিপতি বাড়তে থাকা অর্থনীতির জন্য ভালো নাকি খারাপ, তা বুঝতে হলে মোটাদাগে দুটি বিষয় খেয়াল করতে হবে। প্রথমত, কোটি টাকার প্রকৃত মূল্য কতো অর্থাৎ এক কোটি টাকার ক্রয়ক্ষমতা কতো। এবং দ্বিতীয়ত, এই কোটি টাকার ব্যাংক হিসেবের উৎস কী। অর্থাৎ কোন উৎস থেকে এই পরিমাণ আয় হয়েছে।
আগে লাখপতি মানেই বিশাল কিছু ছিল। এখন লাখ টাকায় কিছুই হয় না। ঠিক তেমনি কোটিপতি বাড়ার সাথে সাথে যদি মূল্যস্ফীতি বেড়ে, টাকার মান কমে যায়, তাহলে এই ধরনের কোটিপতি বাড়লে দেশের অর্থনীতিতে তেমন কোন লাভ হয় না। তাছাড়া বাংলাদেশের যেসব মানুষ ব্যাংকে কোটি টাকা জমা রেখেছে, সেই টাকা কি তারা উপার্জন করেছে নাকি অবৈধভাবে অর্জন করেছে; তার উপরেও অর্থনীতির লাভ ক্ষতি নির্ভর করে। যদি কারও বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ শিল্পে বিনিয়োগ করা হতো তাহলে গরিব মানুষদের কর্মসংস্থান হতো এবং সেই অর্থের সুফল সবাই পেত। কিন্তু অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীরা কর না দিয়ে, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করে, গরিব মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে, ঠিকাদারি করে লুটপাট চালানোর মত নানা উপায়ে সমাজের ক্ষতি করে। তাই এই টাকার দ্বারা সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষের কোন লাভ তো হয়ই না বরং দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাছাড়া বিনিয়োগ করার মত ভালো ব্যবস্থা এবং পরিবেশ নেই বলেই, মানুষ ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা জমাচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বিনিয়োগের সুযোগ কমে গেলেই মানুষ ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখে। ব্যাংকে টাকা ফেলে রাখা লোকসানের সামিল। কারণ বর্তমানে ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। সেকারণে ব্যংকে টাকা জমা রাখলে নির্দিষ্ট সময় পর এর মূল্য আরো কমে যায়।
আয়কর ও মাথাপিছু আয়
ব্যাংকে কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও, করদাতা বাড়েনি। সরকারী হিসেবে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। কিন্তু ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন বা TIN সার্টিফিকেট আছে ৭৩ লাখ লোকের। এর মধ্যে থেকে আয়কর দেন মাত্র ২৩ লাখ মানুষ।
নাগরিকদের সম্পদ ও আয়ের উপর যে কর আদায় করা হয়, তাকে বলে প্রত্যক্ষ কর। এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবার উপর যে কর আরোপ করা হয়, তাকে বলে পরোক্ষ কর। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর তিন ভাগের এক ভাগ এবং পরোক্ষ কর তিন ভাগের দুই ভাগ। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সম্পূর্ণ উল্টো। কোটিপতি বাড়ার সাথে সাথে প্রত্যক্ষ কর বেশি আসছে না। বরং দেশের সাধারণ ভোক্তারা বেশি বেশি পরোক্ষ কর দেয়ার ফলে, গরীবদের উপর চাপ আরো বাড়ছে।
অন্যদিকে সরকারী হিসেবে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লেও, বৈষম্যের কারণে সবাই এর সুফল পাচ্ছে না। দেশের জিডিপি বা মোট জাতীয় আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলার। বা প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকার সমান। সে হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে একজন নাগরিক প্রায় ২৮ হাজার টাকা আয় করেন। কিন্তু কারো মাসিক আয় ৫ হাজার টাকা এবং আবার কারো আয় কয়েক লাখ টাকা। তাই এই টাকার সুষম বন্টন তো হয়ই না, বরাং কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে বিপুল পরিমাণ টাকা বন্দী হয়ে আছে। সেকারণে মাথাপিছু আয়ের হিসেব দিয়ে দেশের মানুষের প্রকৃত অর্থণৈতিক অবস্থা যাচাই করা যায় না।
অর্থনৈতিক বৈষম্য
একদিকে ধনীদের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংেক জমা করা হচ্ছে, অন্যদিকে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে নিচ্ছেন। জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয় মেটাতে গিয়ে সঞ্চয় তো দূরের কথা, অতীতের সঞ্চয় ভেঙে খরচ করছেন সাধারণ মানুষ। ব্যাংকগুলোতে কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকার পরিমাণ উল্টো কমে গিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ছোট প্রতিষ্ঠান তেমন বাড়েনি। বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে একদিকে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি সংকটকে পুঁজি করে বাড়ছে কোটিপতিও। দেশের ব্যাংকগুলোতে একাউন্ট আছে প্রায় ১৪ কোটি ৬০ লাখ লোকের। তাদের মধ্যে ৯ কোটি ৫১ লাখ লোকের একাউন্টে মাত্র ৫ হাজার টাকাও নেই। এসব একাউন্টে গড়ে মাত্র এক হাজার টাকা জমা হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকে থাকা কোটি টাকার হিসাবের মাধ্যমে, দেশের মানুষের আয় ও সম্পদের বৈষম্যের স্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারিতেও একই ধরনের বৈষম্যের তথ্য দেখা গেছে। ২০১৬ সালে বৈষম্যের হার ছিল দশমিক ৪৬, এবং ২০২২ সালে হয়েছে দশমিক ৪৯। অর্থাৎ আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। এই সংখ্যা যতো ১-এর দিকে যাবে, বৈষম্য ততোই বাড়বে।