বিদ্যুৎ গ্রিড কি এবং ব্ল্যাক আউট কেন হয়
বিদ্যুৎ গ্রিড কি এবং ব্ল্যাক আউট কেন হয়
জতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে, সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা সহ দেশের ৩২ টি জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দেশ জুড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিঘিœত হওয়াকে বলা হয় ব্লাক আউট। সাম্প্রতিক বিপর্যয় টি আসলে ব্লাক আউট ছিল না, জাতীয় গ্রিড আংশিক বন্ধ হয়ে গেলে, তাকে বলা হয় ব্রাউন আউট। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পর থেকে জাতীয় গ্রিড এবং ব্লাক আউট কথাটা আমরা বার বার শুনছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের অনেকেরই হয়ত পরিষ্কার ধারনা নেই। জাতীয় গ্রিড কী এবং এ সম্পর্কিত নানা বিপর্যয় সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।
বিদ্যুৎব্যবস্থায় গ্রিড অত্যন্ত স্পর্শকাতর অঙ্গ। গ্রিডের মাধ্যমেই মুলত বিদ্যুৎ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহণ করা। সহজ ভাবে বলতে গেলে, গ্রিড হল বিদ্যুৎ পরিবহনের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। বিদ্যুৎ সরবরাহের ধরন এবং চাহিদার উপর গ্রিডের আকার নির্ভর করে। কোন একটি দেশ বা একাধিক দেশ; এমনকি একটি সম্পূর্ণ মহাদেশের বিদ্যুৎ পরিবহণের জন্যও গ্রিড তৈরী হতে পারে। সাধারণত বেশ কয়েকটি উপাদান যুক্ত হয়ে গ্রিড গড়ে ওঠে। যেমন: ১. পাওয়ার স্টেশন ২. ইলেকট্রিক্যাল সাবস্টেশন ৩. ইলেকট্রিক পাওয়ার ট্রান্সমিশন এবং ৪. ইলেকট্রিক পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন। পাওয়ার স্টেশনগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাথে জড়িত। এগুলোকে লোকালয় থেকে দূরে স্থাপন করা হয়। ইলেকট্রিক সাবস্টেশন গুলো গ্রিডে বিদ্যুৎ প্রবাহের ভোল্টেজ আপ ডাউন নিয়ন্ত্রন করার জন্য কাজ করে। গ্রিডের বিদ্যুৎকে অনেক দূরবর্তী স্থানে পরিবহণ করার জন্য ইলেকট্রিক পাওয়ার ট্রান্সমিশন কে কাজে লাগানো হয়। এবং বৈদ্যুতিক গ্রিডের সর্বশেষ ধাপের কার্যকরী উপাদান হল ইলেকট্রিক পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন। এই অংশে বিদ্যুতের ভোল্টেজকে কমিয়ে এনে, গ্রাহকের ব্যবহারের উপযোগী করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে, গ্রাহকের কাছ পৌছানো পর্যন্ত, বিদ্যুৎ পরিবহণ এবং বিতরণের যে নেটওয়ার্ক তৈরী হয়, তাকেই গ্রিড বলা হয়। উত্তর আমেরিকার দেশ গুলোতে এই নেটওয়ার্ক কে বলা হয় পাওয়ার গ্রিড। এবং ব্রিটেন ও অতীতে ব্রিটিশ শাসিত দেশলোতে যেমন, নিউজিল্যান্ড, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমারে এই নেটওয়ার্ক ন্যাশনাল গ্রিড নামে পরিচিত।
বাংলাদেশে একমাত্র বিদ্যুৎশক্তি সঞ্চালন নেটওয়ার্ক হল জাতীয় গ্রিড। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ বা পিজিসিবি নামের একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান এই গ্রিড পরিচালনা করে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিতরণ এবং সঞ্চালনের উন্নয়নের স্বার্থে ১৯৯৬ সালে সরকারী এই কম্পানি গড়ে তোলা হয়েছিল। বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশের পিজিসিবি র অধীনে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তবে বাংলাদেশে চারটি অফগ্রিড এলাকা রয়েছে। দ্বীপ উপজেলা সন্দীপ, হাতিয়া, কুতুবদিয়া, আশুগঞ্জ এবং পার্বত্য অঞ্চলের ২৬ টি উপজেলা জাতীয় গ্রিডের বাইরে রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার সরকারী বেসরকারী পাওয়ার প্লান্টে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, তা জমা করে রাখার কোন সুযোগ নেই। তাই বিদুৎ উৎপাদনের সাথে সাথে তা জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিড দুইভাগে বিভক্ত। ১. পশ্চিমাঞ্চল গ্রিড এবং ২. পূর্বাঞ্চল গ্রিড। যমুনা নদীর ওপারে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয় পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডের মাধ্যমে। এবং যমুনা নদীর এপারে ঢাকাসহ বাকি জেলায় পূর্বাঞ্চল গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয়। পূর্বাঞ্চল গ্রিডে, পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডের চেয়ে তিন গুণ বেশি বিদ্যুৎ সররাহ করা হয়।
বিদ্যুৎ গ্রিড নানা কারণে বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটতে পারে। অতি পুরোনো ও জরাজীর্ণ সঞ্চালন লাইন সম্বলিত গ্রিডে, তার ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হলে, গ্রিডের সার্কিট পুড়ে বিপর্যয় ঘটতে পারে। সঞ্চালন লাইনে যদি ছিদ্র তৈরী হয়, তা থেকেও স্পার্ক করে বা স্ফুলিঙ্গ বের হয়ে গ্রিড বন্ধ হতে পারে। এছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ফ্রিকোয়োন্সিতে হেরফের হলেও গ্রিড বিকল হয়ে যেতে পারে। এমনকি সঞ্চালন লাইনে কোনো পাখি বসলে কিংবা কোনো গাছ বা গাছের ডালপালা ভেঙে পড়লেও গ্রিড বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিদ্যুৎ গ্রিডের বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের ফলে বিভিন্ন রকমের ভোগান্তি হতে পারে। যেমন, ১. লোড শেডিং ২. ব্রাউন আউট এবং ৩. ব্লাক আউট। জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি হলে, গ্রিডের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে কোন অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। একেই লোডশেডিং বলা হয়। কিন্তু কখনও যদি গ্রিডের প্রবাহে অস্বাভাবিক তারতম্যের কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন এলাকার বিদ্যুৎ প্রবাহ বিঘিœত হয়, তখন তাকে ব্রাউন আউট বলে। একইভাবে অনিচ্ছাকৃতভাবে পাওয়ার গ্রিড বিপর্যস্ত হয়ে, যদি দেশের সমস্ত পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ বা নষ্ট হয়ে যায়, তখন তাকে বলে ব্লাক আউট। গ্রিড যদি ১ সেকেন্ডের জন্যও বিপর্যস্ত হয়, তাহলেও এটি চালু করতে অনেক সময় লাগে। পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ হয়ে ব্লাক আউট ঘটলে, সারা দেশে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় চালু করতে প্রায় ১৬ ঘন্টা থেকে এক দিন সময় লাগতে পারে। আর যদি কোন ব্লাক আউটে দেশের সকল পাওয়ার প্লান্ট নষ্ট হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে সর্ম্পূর্ণ গ্রিড পুনরুদ্ধার করতে ২ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
বিদ্যুতের মত পদার্থ বিজ্ঞানের বহু উপাদান আমরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করছি। কিন্তু এসব বিষয় সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। পাদার্থ বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর সব অবদান আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করেছে। বিভিন্ন শক্তির উৎস উদ্ভাবন, অভিনব সব নতুন যন্ত্র আবিষ্কার কিংবা নতুন তত্ত্বের সাহায্যে মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করাই পদার্থ বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। পদার্থ বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের অজানা বিষয়গুলো যদি এক জায়গায় পাওয়া যেত, তাহলে কেমন হত? আমাদের জন্য ঠিক সেই কাজটিই করেছে ঞযব জড়ুধষ ঝপরবহঃরভরপ চঁনষরপধঃরড়হং কর্তৃক প্রকশিত উরপঃড়হধৎু ড়ভ চযুংরপং বা পদার্থ বিজ্ঞানের বাংলা অভিধান। এই অভিধানে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এসএসসি এবং এইচএসসি পর্যায়ের সিলেবাস অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের চিত্র সহ বর্ণনা আছে। শিক্ষার্থীদের পদার্থ বিজ্ঞানে জড়তা কাটাতে বইটি দারুণ কাজে আসবে। এসএসসি এবং এইচএসসি সহ বিজ্ঞানের প্রতিটি শিক্ষার্থী এবং বিজ্ঞান মনস্ক সবার কাছে বইটি থাকা উচিত। পদার্থ বিজ্ঞানের বাংলা অভিধান বইটি কিনতে চাইলে ডেসক্রিপশন এবং পিন কমেন্টে দেওয়া লিংক ক্লিক করে ঞযব জড়ুধষ ঝপরবহঃরভরপ চঁনষরপধঃরড়হং এর ওয়েবসাইট থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
আবার মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক;
বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিড বন্ধ হয়ে বিদ্যুৎ বিপর্যয় বিরল কোন ঘটনা নয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশে অসংখ্যবার নানা মাত্রার ব্লাক আউট হয়েছে। তবে সাম্প্র্রতিক বছর গুলোতে গ্রিড বিপর্যয় খুব একটা দেখা যায়নি। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে সর্বশেষ ব্লাক আউটের মত ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছিল। সেসময় দেশের দুটি গ্রিডই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেবছর নভেম্বরের ১ তারিখ সকাল সাড়ে ১১ টা থেকে, নভেম্বরের ২ তারিখ মধ্যরাত পর্যন্ত, টানা ১৫ ঘন্টা সারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। এই বিপর্যয়টি বিশ্বের অনেক বড় ও ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয় গুলোর মধ্যে অন্যতম। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১ মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশে দুইবার বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দিলে রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিডের পূবাঞ্চলে বিপর্যয় দেখা দিলে, রাজধানী ঢাকা সহ, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, বিভাগের ৩২ টি জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কোন কোন এলাকায় ৮ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় বিদ্যুৎ ছিল না। এই আংশিক ব্লাক আউট বা ব্রাউন আউটে, চিকিৎসা, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং এবং শিল্পোৎপাদন সহ বহু জরুরী সেবা বিঘিœত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পরিবহনের সময় বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটেছিল। তবে বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে পিজিসিবি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। যদিও তারা আগের মাসের বিপর্যয়ের তদন্ত প্রতিবেদন এখনও প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন অবকাঠামো বেশ পুরানো। সেজন্য বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়ে গেছে। সয়ংক্রিয় গ্রিড না থাকায় বিপর্যয়ের উৎস খুঁজে পেতেও অনেক দেরি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জাতীয় গ্রিডের মানোন্নয়ন করা না হলে, ভবিষ্যতে আরো বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে ইলেকট্রিক গ্রিড আধুনিকীকরণের ফলে, কম্পিউটারের সাহায্যেই গ্রিডের সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। জাতীয় গ্রিড উন্নত করার আগেই, পারমানকি বিদ্যুতের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও তেজষ্ক্রিয়তা ঝুঁকির জন্য পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে।