সেন্টমার্টিনে পানি সংকট
সেন্টমার্টিনে পানি সংকট
বাংলাদেশের পর্যটন আকর্ষণগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সেরা জায়গা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ পর্যটক এই দ্বীপে ভ্রমণ করেন। কিন্তু স্বগীয় এই দ্বীপে ভয়াবহ এক সমস্যা দেখা দিয়েছে। দ্বীপের চারদিকেই পানি, কিন্তু দ্বীপে খাবার পানির ব্যাপক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পানিতেই যাদের জীবন, সেই সেন্ট মার্টিন বাসী সুপেয় পানির অভাবে ভীষণ কষ্টে জীবন যাপন করছে।
প্রায় একশ ত্রিশ বছর আগে থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নিয়মিত মানব বসতি শুরু হয়েছে। বর্তমানে দ্বীপটিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ স্থায়ীভাবে বাস করে। দ্বীপের জনঘনত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে পানির ব্যবহারও বেড়ে গেছে। জীবন ধারণের জন্য মাথাপিছু যে পরিমাণ পানি দরকার, সেন্ট মার্টিনের মানুষ সেই পরিমাণ পানি পাচ্ছে না। কারণ দ্বীপটির ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির মজুদ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। সাগরের মাঝখানে অবস্থান করায় প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে দ্বীপের মিঠা পানির উৎসের সাথে সামুদ্রিক লোনা পানি মিশে যাচ্ছে। ফলে দ্বীপের অনেক জায়গায় গভীর নলকূপ থাকলেও, সেখান থেকে আর মিঠা পানি পাওয়া যাচ্ছে না। সেন্ট মার্টিনের পানিতে লবণাক্ততার পাশাপাশি রয়েছে আর্সেনিক এবং অয়রনের সমস্যা। ফলে খাবার পানির জন্য দ্বীপজুড়ে রীতিমতো হাহাকার চলছে। সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে। অনেকে পুকুরের পানি ও লবণযুক্ত পানি পান করতেও বাধ্য হচ্ছেন। দ্বীপের তিনটি এলাকা ডেইলপাড়া, কোনাপাড়া ও ছেড়াদিয়ায় মূলত সুপেয় পানি পাওয়া যেত। কিন্তু কয়েক মাস ধরে এই অঞ্চলগুলোর টিউবওয়েল দিয়ে লবণাক্ত পানি বের হচ্ছে। নিয়মিত লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে রোগব্যাধিও ছড়িয়ে পড়ছে। তারপরও এসব একেকটি টিউবওয়েলের পানি গড়ে প্রায় ৫০০ টিরও বেশি পরিবারের লোক ব্যবহার করে। ফলে আংশিক পানযোগ্য এসব পানি সংগ্রহের জন্যও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মিঠা পানির চাহিদা শুধু মানুষের নয়, গাছপালা ও জীবজন্তুরও প্রয়োজন। তাই বলা যায় মিঠা পানির অভাবে সেন্ট মার্টিনের সমগ্র জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে।
সেন্ট মার্টিনে সুপেয় পানির অভাবই একমাত্র হুমকি নয়। এই দ্বীপের আশে পাশের সামুদ্রিক পানিও মারাতœক দূষিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট সেন্টমার্টিনের পানিতে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার ভয়াবহ পরিমাণ উপস্থিতি পেয়েছে। সেন্টমার্টিনে নির্দিষ্ট কোনও সুয়ারেজ লাইন নেই। দ্বীপের বাসিন্দা এবং পর্যটকদের মলমূত্র সরাসরি সমুদ্রে অথবা প্রাকৃতিক জলাধারে গিয়ে মিশছে। যেসব পাইপের মাধ্যমে মানব বর্জ্য ছাড়া হয়, সেগুলো বিভিন্ন ধাপে সমুদ্রে প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত বসানো হয়েছে। অনেক সময় জাহাজগুলোও জেটিতে এসে তাদের সুয়ারেজের লাইন সাগরে ছেড়ে দেয়। ফলে ভয়াবহ দূষণ তৈরী হয়েছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চারদিকে। সাধারণত সাগরের ১০০ মিলিলিটার পানিতে ১০ ইউনিট ফিকাল কলিফর্ম পাওয়া গেলে, তাকে দূষিত বলে ধরা হয়। কিন্তু সেন্ট মার্টিনের সৈকতে পানিতে ২৮০ ইউনিট পর্যন্ত দূষিত পদার্থ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ সেন্ট মার্টিনের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ২৮ গুণ বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, পর্যটন মৌসুমে দূষনের পরিমাণ ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। সেন্টমার্টিনের চারপাশের সৈকতের মধ্যে জেটি এবং সৈকতের উত্তর ও পশ্চিম মাথায় সবচেয়ে বেশি দূষণের প্রমাণ মিলেছে। এবং সবচেয়ে কম দুষণ হয়েছে দ্বীপের গলাচিপা এলাকায়। গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন, ব্যাকটেরিয়া ঘটিত এই দুষণ জনস্বাস্থ্য ও সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে।
সাগরের বুকে পানির সঙ্কট সমাধান করা সহজ নয়। কারণ সমুদ্রের পানি ফুটিয়ে বিশুদ্ধ করা যায় না। সমুদ্রের পানিতে সাড়ে তিন শতাংশ লবণ থাকে, যা মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এই পানি ফুটালে অনেক পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, এবং আরো বেশি লবণ তলানী হিসেবে নিচে পড়ে থাকে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুপেয় পানির সমস্যা সমাধান করার উপায় হল, সি ওয়াটার রিভার্স ওসমোসিস। তবে এইভাবে পানি বিশুদ্ধ করণ অনেক ব্যয়বহুল। এ ধরনের একটি প্লান্ট স্থাপন করতে বেশ কয়েক কোটি টাকা খরচ হতে পারে। সেই সাথে সিওয়াটার ডি স্যালিনেশন প্লান্ট সামুদ্রিক জীব, বিশেষ করে মাছের জন্য ক্ষতিকর। সবমিলিয়ে সেন্ট মার্টিনে যে পানির সমস্যা তৈরী হয়েছে, তা হয়ত খুব সহজে সামাধান হবে না।