ব্রিটেনের নতুন রাজা
ব্রিটেনের নতুন রাজা
ব্রিটিশ রাজবংশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে অপেক্ষায় ছিলেন প্রিন্স চার্লস। দীর্ঘ ৭০ বছর অপেক্ষার পর তিনি রাজা হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। রাজা তৃতীয় চার্লস সিংহাসনে বসার পর শুধু ব্রিটেনের নয়, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, পাপুয়া নিউ গিনি সহ কমনওয়েলথভুক্ত ৫৪ দেশের মধ্যে ১৪ টি দেশের রাষ্ট্র প্রধান হলেন।
ব্রিটেনের নতুন রাজার আসল নাম চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ। রাজা/রানী হিসেবে আবির্ভূত হবার পর, অনেক শাসকই নতুন নাম ধারণ করে, যা তাদের প্রকৃত নাম থেকে আলাদা। তিনি রাজা হবার পর সর্ব প্রথম যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেগুলোর মধ্যে তার নাম নির্ধারণ একটি। প্রিন্স চার্লস কিং চার্লস দ্যা থার্ড বা রাজা তৃতীয় চার্লস হিসেবে পরিচিত হতে চান। যদিও অতীতে চার্লস নামধারী রাজাদের ইতিহাস ব্রিটিশ রাজবংশের কাছে খুব একটা সুখকর না। রাজা প্রথম চার্লস কে রাষ্ট্রদ্রোহীতার জন্য মৃত্য্রুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। এরপর কিছু দিনের জন্য রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়েছিল। রাজা প্রথম চার্লসের ছেলে দ্বিতীয় চার্লসও ১১ বছর নির্বাসনে ছিলেন। এরপর তিনি আবার রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু তার নারী ঘটিত কেলেঙ্কারির জন্য তিনি কুখ্যাত ছিলেন। বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লসের জীবনেও বহু সমালোচিত এবং বিতর্কিত ঘটনা রয়েছে। তার সামনের দিন গুলো কেমন যায় সেটাই দেখার বিষয়। যদিও বর্তমান রাজতন্ত্র পুরোটাই আলঙ্কারিক, তাই তার সিদ্ধান্তে বা কর্মকান্ডে, জনজীবনে তেমন কোন প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। রাজা তৃতীয় চার্লস শুধু সিংহাসনের উত্তরাধিকারই লাভ করেননি, তিনি তার মায়ের সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পদেরও উত্তরাধিকারী হয়েছেন। সব মিলিয়ে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ডের ব্যক্তিগত সম্পদ রেখে গেছেন। বিশ্বের শীর্ষ ধনী রাজকীয় ব্যক্তির তালিকায় প্রয়াত রানীর অবস্থান ছিল ১২ তম।
রাজা চার্লসই প্রথম ব্রিটিশ রাজকীয় ব্যক্তি যিনি পারিবারিক অঙ্গনের বাইরে লেখা পড়া করেছেন। ছোট বেলায়ই তাকে স্কটল্যান্ডের একটি বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। এরপর তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে ইতিহাসের উপর পড়ালেখা করেন। ১৯৭০ সালে তিনিই প্রথম রাজ পরিবারের সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তিনি ৭ বছর সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। প্রথমে তিনি ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্সে পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর রয়েল নেভিতে হেলিকপ্টার চালানো শেখেন। সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজকীয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত প্রিন্সেড ডায়না কে রাজা তৃতীয় চার্লস ১৯৮১ সালে বিয়ে করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে প্রিন্সেস ডায়নার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পরে এবং ১৯৯৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ডায়নার মৃত্যুর পর রাজা তৃতীয় চার্লস ব্যাপক সমালোচিত হন এবং সমগ্র ব্রিটেনে সবচেয়ে অজনপ্রিয় রাজকীয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে তিনি ক্যামিলা পার্কার কে বিয়ে করেন। এই ক্যামিলা পার্কার এখন ব্রিটেনের কুইন কনসোর্ট হবেন। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী রাজার স্ত্রী সরাসরি রানী হতে পারেন না। তাকে বলা হয় কুইন কনসোর্ট, বাংলায় যাকে বলা যায় সঙ্গী রানী। ঠিক একই রকমভাবে রানীর স্বামীও রাজা হতে পারেন না। সেক্ষেত্রে তার উপাধি আরো ছোট। রানীর স্বামী হলেও তাকে প্রিন্স হিসেবেই থাকতে হয়। যেমন সদ্য প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলা পার্কার কুইন কনসোর্ট হিসেবে বিখ্যাত কোহিনূর হীরা সম্বলিত মুকুট পরিধান করবে। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত হীরা, যা ব্রিটিশরা ভারত থেকে লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লসের নানী সর্বশেষ এই মুকুট পরিধান করেছিল।
রাজা তৃতীয় চার্লস সবচেয়ে বেশি বয়সে ব্রিটেনের ক্ষমতায় আসা রাজা। ১৯৪৮ সালে জন্মের পরই তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারের তালিকায় দ্বিতীয় নম্বরে চলে আসেন। তার আগে ছিল তার মা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের বাসভবন বাকিংহাম প্যালেসে জন্মগ্রহণ করা প্রথম রাজ শিশু হলেন রাজা তৃতীয় চার্লস। তার জন্মের পরই ধারণা করা হয়েছিল, এই শিশু হয়ত তার ৫০/৬০ বছরে ব্রিটেনের রাজা হবেন। কারণ তখন সিংহাসনে ছিলেন তার নানা, এরপর তার মা রাজত্ব করতে করতে তার বয়স অনেক হয়ে যাবে। কিন্তু সিংহাসন পাবার জন্য তাকে ধারনার চেয়েও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল। মাত্র ৯ বছর বয়সে তাকে প্রিন্স অব ওয়েলস উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ সিংহাসনের পরবর্তী পুরুষ উত্তরাধিকারীদেরকে এই উপাধি দেওয়া হয়। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় প্রস্তুতি নিয়ে রাজা হিসেবে ক্ষমতায় আসলেও, তার করোনেশন বা রাজ্যাভিষেক এখনই হচ্ছে না। কারণ প্রথা অনুযায়ী, রাজ পরিবার এখন সদ্য প্রয়াত রানীর মৃত্যুর শোক পালন করবে। কয়েক মাস এই শোক পালন করার পর, অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং মহা জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন রাজার সিংহাসন আরাহনের অনুষ্ঠান পালন করা হবে। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার বাবা মারা যাবার ১৬ মাস পর করোনেশন পেয়েছিলেন। অতীতে ব্রিটিশ রাজাদের রাজ্যাভিষেকের বিষয়টি অত্যন্ত গোপনে আয়োজন করা হত। তখন শুধু মাত্র রাজ পরিবারের উচ্চ পদস্থ কিছু লোক এবং সমাজের কতিপয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি রাজা/রানীর করোনেশন প্রত্যক্ষ করার আমন্ত্রন পেত। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্য অভিষেকেই সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে। বহু পরিকল্পনা, কঠোর অনুশীলন এবং তৎকালীন সময়ের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে, বিবিসি সেই রাজকীয় অনুষ্ঠান টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। এর ফলে প্রথমবারের মত সাধারণ জনগণ করোনেশন উপভোগ করার সুযোগ পায়। এবারের নতুন রাজার রাজ্য অভিষেক হতে যাচ্ছে এমন এক সময়ে যখন ভিজুয়্যাল মিডিয়া এক অনন্য উচ্চতায় পৌছেছে। কিন্তু রাজা তৃতীয় চার্লস তার করোনেশন খুব বেশি জাঁকজমক করতে চায় না। বলা হচ্ছে এবারের রাজ্য অভিষেক অনুষ্ঠান হবে খুব সংক্ষিপ্ত এবং তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল।
রাজা তৃতীয় চার্লস এখন থেকে কিছু অনন্য সুযোগ সুবিধা পাবেন। আর তা হল, দেশের বাইরে ভ্রমণ করতে তার কোন পাসপোর্ট লাগবে না। এবং গাড়ি চালানোর জন্যও তার কোন ড্রাইভিং লাইসেন্সের দরকার নেই। কারণ ব্রিটেনের জনগণের পাসপোর্ট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স রাজার নামেই ইস্যু করা হয়। তিনিই যেহেতু রাজা, তাই তার কাগজপত্র ইস্যু করবে কে? রাজা হবার পর থেকে তার দুটি জন্মদিন পালন করা হবে। রাজা তৃতীয় চার্লসের প্রকৃত জন্ম দিন নভেম্বরের ১৪ তারিখে। শীতকাল হবার কারণে এই সময় রাজার জন্ম দিনে প্যারেড আয়োজন করা কষ্টকর হবে। তাই গ্রীষ্মকালে উৎযাপনের জন্য তার আরেকটি জন্মদিন নির্ধারণ করা হবে। ব্রিটেনের রাজা হবার কারণে রাজা তৃতীয় চার্লস কোন ভোট দিতে পারবেন না। এমনকি তিনি কোন নির্বাচনে প্রার্থীও হতে পারবেন না। তার রাজনৈতিক দ্বায়িত্বের মধ্যে রয়েছে, রাজা হিসেবে তাকে সম্পূর্ন নিরপেক্ষ থাকতে হবে, সংসদ অধিবেশনে তাকে সূচনা বক্তব্য দিতে হবে এবং নিয়ম অনুযায়ী প্রধান মন্ত্রীর সাথে তাকে প্রতি সমপ্তাহে একবার সাক্ষাত করতে হবে। রাজা তৃতীয় চার্লস বিভিন্ন জনসেবামূলক কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করার জন্য তিনি অনেক কাজ করেছেন। রাজা তৃতীয় চার্লস ২০০৭ সালে বিশ্বের রেইনফরেস্ট বা বন সংরক্ষণের জন্য প্রিন্স রেইনফরেস্ট প্রজেক্ট নামে দাতব্য এবং জনসচেতনতার ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেন। তার অবদানের জন্য তার নামে ইকুয়েডরের এক বিলুপ্ত প্রজাতির গেছোব্যাঙের নামকরণ করা হয়। ব্যাঙের নাম রাখা হয় হাইলোসকার্টিস প্রিন্সচার্লেসি Hyloscirtus princecharlesi।