ফিলিস্তিন কেন সবচেয়ে দুর্ভাগা অসহায় দেশ

maxresdefault (36)
কি কেন কিভাবে

ফিলিস্তিন কেন সবচেয়ে দুর্ভাগা অসহায় দেশ

ইসরায়েল রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ করেছে। জাতিসংঘের ১৯৩ টি সদস্য দেশের ১৬৫ টি দেশই ইসরায়েলকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। অথচ এই ভূখন্ডের যারা প্রকৃত মালিক, সেই ফিলিস্তিনীরা আজও স্বাধীন দেশ হিসেবেই আত্নপ্রকাশ করতে পারেনি। জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যের ১৩৮ টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, ফিলিস্তিন এখনও পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য নয়। অথচ একশ বছর আগে ফিলিস্তিন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশ। ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিনের মানচিত্র ছিল এরকম। আর বর্তমানে ফিলিস্তিনের মানচিত্র এমন। দখলদার ইসরায়েলী বাহিনী, আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রানবন্ত একটি দেশকে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করেছে। ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিন দখলের মধ্যদিয়ে, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় তৈরী হয়েছে।

ফিলিস্তিন কেন সবচেয়ে দুর্ভাগা দেশ ?

ফিলিস্তিনী সঙ্কটের শুরু

অটোমান সাম্রাজের আমলে, ফিলিস্তিনি সমাজ বিংশ শতকের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামাজিক উন্নতির শীর্ষে আরোহন করছিল। সেসময় ফিলিস্তিনের জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই ভালো ছিল যে, মৌলিক চাহিদা পূরনের বাইরেও, বিলাসি দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারের মত সামর্থ্য ছিল তাদের। অটোমান সাম্রাজ্যের আমল থেকেই ফিলিস্তিনীরা তাদের রাজনৈতিক অধিকার সচেতন ছিল। এমনকি অটোমান সংসদের নিম্নকক্ষে ফিলিস্তিনীদের প্রতিনিধিও ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, অন্যান্য আরব দেশগুলোর মত, ফিলিস্তিনীরাও ভেবেছিল এবার হয়ত তাদের দেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু ঔপনিবেশিক দখলদার ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের উপর তাদের অন্যায় কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয়। ফিলিস্তিনের প্রতিবেশি অন্যান্য আরব দেশগুলো যখন ইউরোপীয় বর্বরদের কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল। সেসময় ফিলিস্তিনীদের মাথায় আরেক চিন্তার বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। জায়নবাদী ব্রিটিশরা ইহুদীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হবে। ব্রিটিশদের অন্যায় প্রতিশ্রুতি শুধু ফিলিস্তিনের সামাজিক অগ্রগতিই হুমকির মুখে ফেলেনি, বরং ফিলিস্তিনীদের মাতৃভূমিই বিলীন করে দিয়েছে।

স্বাধীনতার চেষ্টা এবং আরব কংগ্রেস

ফিলিস্তিনীরা ব্রিটিদের অধীনে আসার পর থেকেই, স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। যে আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল জেরুজালেম। ১৯১৯ সালে স্থানীয় প্রভাবশালী মুসলিম এবং খ্রিস্টানরা মিলে আরব-ফিলিস্তিন কংগ্রেস গঠন করে। তারা ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করে নিজেদের স্বাধীনতা দাবি করে। অনেক অভিজাত ব্যবসায়ী ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি, ন্যাশনাল ডিফেন্স পার্টি সহ বিভিন্ন দলে যুক্ত হয়ে, স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করতে থাকে। অন্যদিকে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের দখল পাওয়ার পর থেকে, ফিলিস্তিনকে একটি বিরানভূমি হিসেবে উপস্থাপন করে। যাতে করে তারা বিশ্ববাসীকে বলতে পারে যে, ফিলিস্তিনের জনমানব শূণ্য এলাকায় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আরব বিশ্বে ব্রিটিশ সহ সকল ইউরোপীয় দখলদারদেরকে উৎখাত করতে, ১৯৩১ সালে ফিলিস্তিন বিশ্ব ইসলামিক কংগ্রেস আয়োজন করে। ২৫ টি আরব দেশের প্রায় ১৫০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এ ধরনের মহাসম্মেলন তৎকালীন সময়ে ছিল খুবই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। দশ দিন ব্যাপী চলা বিশ্ব ইসলামিক সভার একাধিক কমিটি থেকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার মধ্যে অনেক গুরত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও ছিল। ইসলামি পন্ডিতরা সিরিয়া, লেবানন, মরক্কো, লিবিয়া সহ আরব অঞ্চলে ব্রিটিশ, ফ্রান্স এবং ইতালির মত ঔপনিবেশিক দেশ গুলোর বর্বরতার তীব্র সমালোচনা করেন। সারা বিশ্বে মুসলিম পন্ডিতদের এই সম্মেলনের আলোচনা হতে থাকে। ফিলিস্তিনীরা যে কতটা রাজনৈতিক সচেতন ছিল, এই মহাসম্মেলনই তার প্রমাণ। সেই কংগ্রেস থেকে মসজিদুল আকসা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলারও পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।

ইসরায়েলের জন্ম

অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ ছিল মুসলিম ও খ্রিস্টান। তখন এই অঞ্চলে ইহুদী ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিন্তু ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন দখলের পর থেকে বানের জলের মত ইহুদী এই অঞ্চলে আসতে শুরু করে। বৃটিশদের সহযোগিতায় ৩০ বছরের মধ্যে ইউরোপের প্রায় ৬ লাখ ইহুদি ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে। ইহুদিরা যেন এই অঞ্চলে তান্ডব চালাতে পারে, সেজন্য ব্রিটিশদের সহায়তায় “হাগানাহ” নামে ইহুদিদের এক জঙ্গী সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করা হয়। ফিলিস্তিনী জনগণের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদেরকে বিতাড়িত করাই ছিল হাগানাহ বাহিনীর কাজ। ফিলিস্তিনের সকল সম্পদ লুট করার পর, ব্রিটিশরা যখন দেখে যে এখান থেকে পাওয়ার মত আর তেমন কিছুই নেই; তখন তারা জাতি সংঘকে বলে যে, ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যেতে চায়। এর প্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করার প্রস্তাব পাশ হয়। এবং জেরুজালেম যেহেতু তিন ধর্মের পবিত্র জায়গা, তাই জেরুজালেমকে একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক অঞ্চল হিসেবে আলাদা রাখার কথা বলা হয়। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার মাত্র চার ভাগের একভাগ হওয়া সত্ত্বেও, উড়ে এসে জুড়ে বসা ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডের ৫৭ শতাংশ অঞ্চল দিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনীরা জনসংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও, তাদেরকে নিজেদের মাতৃভূমির মাত্র ৪৩ শতাংশ অঞ্চল দেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়, জাতিসংঘের আরেকটি চূড়ান্ত ভন্ডামি হল, প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা অনির্ধারিত রাখা হয়; যাতে করে ভবিষ্যতে ইহুদিরা তাদের সীমানা আরো বাড়াতে পারে। এভাবে জাতিসংঘের একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাবের মাধ্যমে, ফিলিস্তিনীদেরকে ঠকিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সকল ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়।

জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের পর থেকে ইহুদী সন্ত্রাসীদের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যায়। ইহুদী জঙ্গি সন্ত্রাসবাদী দলগুলো জোর-জবরদস্তি করে মুসলমানদের বাড়ি-ঘর ও ধন-সম্পত্তি দখল করে নিতে থাকে। জাতিসংঘে প্রস্তাবটি পাশ হওয়ার পর মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ১৭ হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনী মুসলিমকে হত্যা করা। ১৯৪৮ সালের ১৪ ই মে ইহুদীদের নেতা ডেভিড বেনগুরিয়ন ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই ঘোষণার সাথে সাথে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বৃটেন ইসরাইলকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

ফিলিস্তিনের মানচিত্র

জাতিসংঘের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ইসরায়েল স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ফিলিস্তিনীরা তাদের জন্য নির্ধারিত ভূমির মালিকানাটুকুও পায়নি। এমনকি তারপর থেকে ফিলিস্তিনের নিজস্ব মানচিত্র বলেও কিছু ছিল না। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হবার পর, সাত লক্ষেরও বেশি অসহায় ফিলিস্তিনী নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে, প্রতিবেশী দেশ গুলোতে আশ্রয় নেয়। এই ঘটনাকে তারা “নাকবা” নামে উল্লেখ করে, যার অর্থ “বিপর্যয়”। নাকবার সময় ইসরায়েলীরা ফিলিস্তিনের শহর-গ্রাম মিলিয়ে প্রায় ৭৭৪ টি এলাকা দখল করে নেয়। যার মধ্যে ৫৩১ টি এলাকা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। এতে প্রায় ১৫ হাজার হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনী মারা যায়।

অন্যায়ভাবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে মিশর, ইরাক, জর্ডান, লেবানন এবং সিরিয়া সম্মিলিতভাবে ইসরায়েল আক্রমণ করে। যা ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধে উল্টো ইসরায়েলই লাভবান হয়, তারা ফিলিস্তিনের বাকি অঞ্চলগুলোও দখল করে নেয়। যে অংশটুকু তারা দখল করতে পারেনি সেসব এলাকা মিশর এবং জর্ডান ভাগাভাগি করে নেয়। গাজা উপত্যকা মিশরের অধীনে আসে আর জর্ডান পায় পশ্চিম তীর। এই অঞ্চলটি জর্ডান নদীর পশ্চিম পাশে অবস্থিত হবার কারণে, জায়গাটি পশ্চিম তীর হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে ১৯৫৬, ৬৭, ৭৩ এবং ৮২ সালে আরবদেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের আরও বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে। এসব যুদ্ধেও ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। তবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছয় দিনের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত এই যুদ্ধে, ইসরায়েল সিরিয়ার গোলান মালভূমি, জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং মিশরের কাছ থেকে গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল এবং মিশর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি সই করে। এর মাধ্যমে মিশর আবার তার হারানো জায়গা ফিরে পায়।

ইসরায়েলী স্যাটেলমেন্ট

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের যেসব অঞ্চল দখল করেছিল, সেসব জায়গায় ইহুদি বসতি গড়ে তুলতে শুরু করে। এসব বসতি ইসরায়েলি স্যাটেলমেন্ট হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেম সহ পশ্চিম তীর এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি স্যাটেলাররা জমি দখল করেই চলেছে। ইসরায়েল পুরো দেশটাই যদিও অবৈধ; তবুও এই অবৈধ দেশকে স্বীকৃতি দেওয়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীও ইসরায়েলি স্যাটেলমেন্টগুলো সম্পূর্ণ বেআইনী। ২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেমের ১২ টি সহ, সমগ্র পশ্চিমতীরে ১৪৪ টি ইসরায়েলী স্যাটেলমেন্ট আছে। এর বাইরেও ইসরায়েলী সরকারের অনুমোদন ছাড়া আরো প্রায় ১০০ টি স্যাটেলমেন্ট ইসরায়েলের সন্ত্রাসী দখলদার জনগণ নিজেরাই গড়ে তুলেছে। এগুলোকে হিব্রু ভাষায় বলা হয় মাহাজ। যার অর্থ দখল।

ইসরায়েল সরকার স্যাটেলমেন্টগুলোতে বসবাস করার জন্য ইহুদিদেরকে উৎসাহিত করে। অনেকেই ধর্মীয় কারণে এসব বিচ্ছিন্ন জায়গায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। অনেকে আবার সস্তায় বাড়ি পেয়ে এসব জায়গায় যায়। কেউ কেউ আবার ইসরায়েলের মানচিত্র বড় করার জন্য, নিজে নিজে উৎসাহী হয়ে মাহাজ গড়ে তোলে। ছোট খাট পাড়া মহল্লার আকার থেকে শুরু করে, বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্প, এমনকি রীতিমত উপশহরের আকারেও ইসরায়েলি স্যাটেলমেন্ট  রয়েছে। সবগুলো স্যাটেলমেন্ট মিলিয়ে প্রায় সাত লাখেরও বেশি ইসরায়েলি স্যাটেলার সরাসরি ফিলিস্তিনী অঞ্চলগুলোতে বাস করে। দিন দিন এইসব স্যাটেলারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

ইসরায়েলীরা নিজেরা সীমা লঙ্ঘন করতে করতে ফিলিস্তিনীদের সমস্ত জায়গা দখল করে িনচ্ছে, উল্টো আবার সেসব জায়গায় ফিলিস্তিনীদের প্রবেশ ঠেকানোর জন্য এরকম উঁচু উঁচু দেয়াল তুলে দিয়েছে। ইসরায়েল এসব দেয়ালকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করে। বিষয়টা অনেকটা এরকম যে, চোর একটি বাড়িতে চুরি করে, বাড়ির মালিককেই ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এরপর ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলছে, বাড়ির মালিক, চোরের নিরাপত্তা নষ্ট করছে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম

ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার আন্দোলন সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৬৪ সালে সকল ফিলিস্তিনী সংগঠনকে একত্রিত করে প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা PLO গঠন করা হয়। ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে নিজেদের স্বাধীন দেশ গড়ে তোলার আন্দোলন শুরু করে PLO। ১৯৬৫ সালে PLO এর অধীনে থাকা ফাতাহ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। ফিলিস্তিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই ফাতাহ দলের প্রধান। 

১৯৭৪ সালের দিকে জাতিসংঘ PLO কে ফিলিস্তিনীদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু অনেক ফিলিস্তিনী মনে করে PLO খুব বেশি নমনীয় সংগঠন। সেকারণে ১৯৮৭ সালে একদল ফিলিস্তিনী একটি সশস্ত্র সংগঠন তৈরী করে, যার নাম হামাস। ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী দেশ লেবাননেও একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে উঠেছিল, যার নাম হিযবুল্লাহ। হিযবুল্লাহ এবং হামাস একসাথে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরদ্ধে কাজ করার অনেক নজির রয়েছে। ২০২৩ সালে ইসরায়েলে রকেট হামলাও হামাস এবং হিযবুল্লা যৌথভাবে পরিচালনা করেছে।

ইসরাইলী আগ্রাসন সহ্য করতে করতে অবশেষে ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনীরা শুরু করে “প্রথম ইন্তিফাদা” যার অর্থ “জেগে ওঠা”। ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন বা পিএলও র নেতা ইয়াসির আরাফাত প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত কোন ভূখন্ডই তাদের দখলে ছিলনা। এরপর থেকে বিশ্বের ১৩৮ টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আরব দেশগুলোর বাইরে ভারতই প্রথম দেশ যারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে ফিলিস্তিন এখনও পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে একটি অ-সদস্য পর্যক্ষেক রাষ্ট্র হিসেবে রেখেছে।

১৯৯৩ সালে PLO প্রধান ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রাবিন অসলো শান্তি চুক্তি সই করে। এর মাধ্যমে বোঝাপোড় হয়েছিল যে, ইসরায়েল ফিলিস্তিন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে িনবে এবং ফিলিস্তিনীরা স্বশাসনের আংশিক অধিকার পাবে। বিনিময়ে, ফিলিস্তিন ইসরায়েলকে বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিবে। এই চুক্তির জন্য দুই নেতা শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার লাভ করে। কিন্তু দুই পক্ষের কট্টরপন্থী কেউই অসলো চুক্তি মেনে নিতে পারেনি। যার ফলে ইসরায়েলী নেতা রাবিন কে এব ইহুদি সন্ত্রাসী গুলি করে হত্যা করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনীরাও ইয়াসির আরাফাতের তীব্র বিরোধিতা করে। তবে সেই অসলো চুক্তির ফলেই ফিলিস্তিনিরা এখনও পশ্চিম তীরে নিজেদের স্বায়ত্বশাসন পরিচালনা করে। শান্তি চুক্তির পরও ইসরায়েলের আগ্রাসন চলতে থাকলে, ২০০০ সালে ফিলিস্তিনীরা “দ্বিতীয়  ইন্তিফাদা” শুরু করে।

গাজা এক উন্মুক্ত কারাগার

২০০৫ সালে হামাস এবং ফাতাহ এর মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। হামাস দাবি করে ফাতাহ অনেক বেশি উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করে; যা দিয়ে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের নির্বাচনে হামাস জয় লাভ করে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো যেহেতু হামাস কে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে মনে করে। তাই পশ্চিমারা বলে যে, হামাস ফিলিস্তিনের ক্ষমতা দখল করলে, পশ্চিম তীর এবং গাজায় অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে। এমন পরিস্তিতিতে হামাস এবং ফাতাহ এর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শেষমেষ পশ্চিম তীর ফাতাহ এর নিয়ন্ত্রণে আসে এবং হামাস এর অধীনে আসে গাজা। তখন থেকে হামাস কে দুর্বল করার জন্য, ইসরায়েল গাজা উপত্যকাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে ফেলে। মাত্র ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৬ থেকে ১২ কিলোমিটার প্রস্থের সামান্য এই জায়গাটুকুর মধ্যে প্রায় ২৪ লাখ ফিলিস্তিনী গাদাগাদি করে বাস করে। ২০০৬ সালের মধ্যে গাজা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়। ইসরায়েল এখানকার বাসিন্দাদের গাজার বাইরে যাওয়ার সকল পথ বন্ধ করে দেয়। সেই সাথে গাজায় বোমা হামলা, অত্যাচার, হত্যা একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়। ইসরায়েল গাজার বিদ্যুৎ, পানি এবং খাবার সরবার সহ সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে, এই অঞ্চলে আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ি মানবিক সঙ্কট তৈরী করেছে।

তারপর থেকে গাজা মূলত জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু বর্বর ইসরায়েল মাঝে মাঝে এসব আন্তর্জাতিক সাহায্যও গাজায় পৌছাতে দেয় না। বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ইসরায়েল গাজার মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের নিরাপত্তা লঙ্ঘন করে; এবং নিরস্ত্র নিরাপরাধ মানুষের উপর বোমা হামলা চালিয়ে মানবতা বিরোধী অপরাধ করছে। যা আন্তর্জাতিক আইনের অনেক বড় লঙ্ঘন। কিন্তু বিশ্ব মানবতার মুখোশধারী আমেরিকা সহ পশ্চিমা ভন্ড দেশগুলো ইসরায়েলের ঘনিষ্ট বন্ধু। তাই গাজার মুসলিমদের উপর এসব অত্যাচার পশ্চিমারা ইসরায়েলের অপরাধ হিসেবেই দেখে না। উল্টো গাজার অসহায় মানুষগুলোর কাছে পৌছানো ত্রাণ সহায়তাও বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

ইসরায়েল গাজার সাথে দশকের পর দশক ধরে যা করছে, তা যে কোন বড় যুদ্ধের চেয়েও মারাত্নক অপরাধ। সাম্প্রতিক সময়ে গাজা থেকে হামাস ইসরায়েলের উপর যে হামলা করেছে, তা শুধুমাত্র নিরাপরাধ গাজাবাসীর প্রতিরোধের একটি অংশ। দশকের পর দশক ধরে চলা ভয়াবহ মানবতা বিরোধী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার বদলে, গাজার নিরীহ মানুষকে দমন করার জন্য আমেরিকা ইসরায়েলকে বিপুল অর্থের সামরিক সহায়তা করে। যে টাকা খরচ করে ইসরায়েলকে যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করা হয়, তার সামান্য একটি অংশ খরচ করলেও, গাজায় পিতা-মাতা হারা শিশুদের দিনের পর দিন অনাহারে থাকতে হত না।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।