ইসরায়েলের সেনাবাহিনী কত বড়
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী কত বড়
ভূমিকা
সামরিক শক্তির দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর এক দেশ ইসরায়েল। তাদের সেনাবাহিনী Israel Defense Forces বা IDF নামেই অধিক পরিচিত। যারা জন্মের পর থেকেই যু্দ্ধে জড়িয়েছে এবং বড় বড় প্রায় সকল যুদ্ধে জয় লাভ করেছে। তবে নৈতিকতার দিক থেকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, জাতিগত নিধন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত মারাত্নক সকল ধরনের অভিযোগ রয়েছে। কোন ধরনের আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করা সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি সামরিক সহায়তা বাড়িয়েই চলেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা পাওয়া দেশগুলোর তালিকায় ইসরায়েলই রয়েছে সবার শীর্ষে।
এক নজরে ইসরায়েলী সেনাবাহিনী
ইসরায়েল একটি বিশাল সামরিক বাহিনী পরিচালনা করে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এর ২০২৩ সালের মিলিটারি ব্যালেন্স অনুযায়ী, ইসরায়েলের সেনা, নৌ এবং আধাসামরিক বাহিনীতে ১ লক্ষ ৬৯ হাজার ৫০০ জন সক্রিয় সামরিক কর্মী রয়েছে। এর বাইরে আরো প্রায় ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার রিজার্ভ সৈন্য আছে। যারা পশুর চেয়েও হিংস্র। সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের উত্তর গাজায় স্থল অভিযান পরিচালনার জন্য ইসরায়েল গাজা সীমান্তে প্রায় তিন লক্ষ সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে।
ইসরায়েলের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। একজন ইসরায়েলী নারীকে কমপক্ষে ২৪ মাস এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ৩২ মাস সেনাবাহিনীতে কাজ করা বাধ্যতামুলক।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ক্ষমতাধর। অতি আধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন সামরিক অস্ত্রে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী সুসজ্জিত।
ইসরায়েলের ট্যাংক আছে ২ হাজার ২০০ টি। তাদের আর্টিলারি বাহিনীতে আছে ৫৩০ টি অতি আধুনিক কামান। আকাশপথে হামলা পরিচালনার জন্য আছে ৩৩৯ টি যুদ্ধ বিমান। এগুলোর মধে ৩০৯ টিই ফাইটার গ্রাউন্ড এট্যাক জেট। যার মধ্যে ১৯৬টি F-16 Jet, ৮৩টি F-15 Jet এবং ৩০টি F-35 Jet। এর বাইরেও ১৪২ টি হেলিকপ্টার রয়েছে, যার মধ্যে ৪৩ টি Apache এট্যাক হেলিকপ্টার। ইসরায়েলের নৌ শক্তি হিসেবে আছে সাতটি যুদ্ধ জাহাজ এবং ৫টি সাবমেরিন। এর বাইরে বেশ কিছু টহল নৌযানও আছে।
এগুলোর বাইরেও ইসরায়েলর পারমানবিক অস্ত্র আছে, বলে ধারনা করা হয়। তবে ইসরায়েল পারমানবিক অস্ত্র থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইসরায়েলের কাছে ৭৫ থেকে ৪০০ টি পর্যন্ত পারমানবিক অস্ত্র থাকতে পারে।
আয়রন ডোম
আকাশ পথে শুধু আক্রমণ পরিচালনাই নয়, রকেট এবং মিসাইলের মত হামলার প্রতিরোধ করার মত কার্যকরী সক্ষমতাও রয়েছে ইসরায়েলের। ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থাটি Iron Dome হিসেবে পরিচিত। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রধানত দুটি ধাপে কাজ করে। প্রথমে আয়রন ডোমের রাডার শত্রুপক্ষের রকেট চিহ্নিত করে। এরপর সেই রকেট মাটিতে আঘাত হানার আগেই, আয়রন ডোমের ভেতর থাকা রকেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে গিয়ে শত্রুপক্ষের রকেট কে আকাশেই ধ্বংস করে দেয়।
২০০৬ সালে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধের সময় হিজবুল্লা অনেক রকেট হামলা চালিয়েছিল। তারপর থেকে ইসরায়েল এই ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে, এবং ২০১১ সাল থেকে আয়রন ডোম কার্যক্রম শুরু করে। এই প্রযুক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের যন্ত্রাংশ প্রদান করা সহ, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সার্বিক সহযোগীতা করেছে। এমনকি এই প্রযুক্তির উন্নয়নে শুধুমাত্র ২০২২ সালেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দেড় বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এর তথ্যমতে ইসরায়েলের আয়রন ডোম হামাসের রকেট হামলা ঠেকানো কাজে ৯০ শতাংশ সফলতা দেখিয়েছে। কিন্তু তারপরও ২০২৩ সালের অক্টোবরে আয়রন ডোম হামাসের হামলা ঠেকাতে পারল না কেন? এর উত্তর হিসেবে বলা হচ্ছে, আয়রন ডোমের সক্ষমতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুর্বলতা হামাস খুঁজে বের করতে পেরেছিল।
ইসরায়েলের মোট ১০ টি আয়রন ডোম যন্ত্র রয়েছে, যার একেকটির মধ্যে ৬০ থেকে ৮০ টি মিসাইল থাকে। এসব একেকটি মিসাইলের দাম প্রায় ৬৬ লাখ টাকারও বেশি। অতীতে ইসরায়েলে অল্প সংখ্যক মিসাইল হামলা হয়েছিল, তাই আয়রন ডোম সেগুলো ৯০ শতাংশ সফলতার সাথে আটকাতে পেরেছিল। কিন্তু এবার হামাস ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি রকেট ছুড়েছে। এর বিপরীতে আয়রন ডোম মাত্র এক হাজারেরও কম মিসাইল ধ্বংস করতে পেরেছে। তারমানে হামাস আয়রন ডোমের সক্ষমতার চেয়ে বেশি সংখ্যক রকেট ছুঁড়ে মারার কারণেই, আয়রন ডোম তা আর ঠেকাতে পারেনি।
সামরিক বাজেট
আন্তর্জাতিক সংঘাত এবং অস্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর তথ্য মতে, ২০২২ সালে ইসরায়েল তাদের সামরিক খাতে প্রায় ২৩.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। সে হিসেবে ইসরায়েলের মাথাপিছু সামরিক বাজেট ২ হাজার ৫৩৫ ডলার। যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাথা পিছু সামরিক বাজেট রয়েছে কাতারের। ২০২২ সালে ইসরায়েল তার মোট জিডিপির ৪.৫ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করেছে। জিডিপির অনুপাতে সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে ইসরায়েলের অবস্থান দশম।
ইসরায়েলের অস্ত্র কারা কেনে
ইসরায়েল নিজেও বিভিন্ন ধরনের উন্নত সমরাস্ত্র তৈরী করে। তবে তারা যে পরিমাণ অস্ত্র রপ্তানি করে তার তুলনায় অনেক বেশিআমদানি করে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৩৫ টি দেশ ইসরায়েল থেকে অস্ত্র কিনেছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েল প্রায় ৩.২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। ইসরায়েলে উৎপাদিত অস্ত্রের তিন ভাগের এক ভাগই কিনে নেয় ভারত। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক অতীতের চেয়ে অনেক বেশি জোড়দার হয়েছে। ২০১৮ সালের পর থেকে ভারত ইসরায়েলের কাছ থেকে ১.২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। ইসরায়েলী অস্ত্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রেতা হল আজারবাইজান, যারা ২৯৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। এরপরে ফিলিপাইন ২৭৫ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ২১৭ মিলিয়ন ডলার এবং ভিয়েতনাম ১৮০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ইসরায়েলের কাছ থেকে কিনেছে।
২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কেনে যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানী থেকে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকেই প্রায় ২.১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে ইসরায়েল এবং জার্মানী থেকে কিনেছে ৫৪৬ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা
ইসরায়েলের আঞ্চলিক সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির একটি মূল উপাদান। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি সামরিক সহায়তা পাওয়া দেশের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ইসরায়েল। ১৯৪৬ থেক ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রায় ২৬৩.৬ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা পাওয়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দেশ হল মিশর। তবে ইসরায়েল মিশরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন বেশি সামরিক সহায়তা পেয়েছে। বিগত ৭৭ বছরে মিশর পেয়েছে ১৫১.৯ বিলিয়ন ডলার।
এত এত টাকা সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রধান কারণ হল, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র হিসেবে কাজ করে। ইউএস কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিসের মতে, ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের তীব্র সমর্থণও এত বিপুল সহযোগীতার একটি প্রধান কারণ। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল তার প্রতিবেশী দেশ গুলোকে পরাজিত করার পর এবং পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা দখল করার পর থেকে ইসরায়েলে মার্কিন সহায়তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়, পরবর্তী দশ বছরের জন্য ৩৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তার চুক্তি সই করা হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে ২০২৩ সালে ইসরায়েলকে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার দিবে যুক্তরাষ্ট্র। এর অর্ধেক অর্থ খরচ করা হবে, ইসরায়েলের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করার কাজে। হামাস পরবর্তীতে হাজার হাজার রকেট হামলা করলেও যেন, ইসরায়েল সুরক্ষিত থাকে, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র সকল সহযোগীতা করবে।
হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর এক ঘন্টার মধ্যে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আয়রন ডোমের উন্নয়ন, এবং অন্যান্য সামরিক সহায়তা চায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন খুব দ্রুত ইসরায়েলকে সকল ধরনের সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা বিমানবাহী রণতরী এবং দুই হাজার মার্কিন সৈন্য সহ বিপুল সামরিক সহায়তা ইসরায়েলে পাঠিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, মার্কিন কংগ্রেসের অনুরোধে বাইডেন প্রশাসন আরো বেশ কিছু অর্থ ইসরায়েলের জন্য বরাদ্দ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সামরিক খাতে শুধুমাত্র সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তাই দেয় না; সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল সম্মিলিতভাবে বহু সামরিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া, সামরিক প্রযুক্তি উন্নয়ন গবেষণা এবং প্রতিরক্ষা প্রকল্প তৈরীর মত কার্যক্রম রয়েছে।
চোরে চোরে মাসতুতো ভাই
যুক্তরাষ্ট্রে The Leahy Law নামে একটি আইন আছে। এই আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র এমন কোন পক্ষকে সামরিক সহায়তা করতে পারে না, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের একাধিক ধারায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনী জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘন, তাদের প্রতি নির্বিচার গণহত্যা পরিচালনা, জাতিগত নিধন সহ বহু অভিযোগ থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি কঠোর হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো ইসরায়েলী হত্যাযজ্ঞে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে। যা বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ভন্ডামি আর দ্বিমুখী নীতির বহিঃপ্রকাশ। যদিও যুক্তরাষ্ট্র নিজেও ইরাক, আফগানিস্তান সহ বিশ্বের একাধিক অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের সাথে জাড়িত ছিল। ইউক্রেনে যে ধরনের অন্যায় করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে শত শত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, ফিলিস্তিনে তার চেয়েও বহুগুণ বেশি অপরাধ করা সত্ত্বেও ইসরায়েলকে তারা পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েলী বাহিনী বিদ্যালয়, শরনার্থী শিবির এমনকি হাসপাতালে পর্যন্ত হামলা চালায়। যা আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত। ইসরায়েলই বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা সকল ধরনের যুদ্ধাপরাধ করার পরও, আন্তর্জাতিকভাবে তাদেরকে কোন ধরনের জবাবদিহিতার সম্মুখিন হতে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গড়ে ওঠা উদ্ধত আগ্রাসী মনোভাব, ইসরায়েলের সামরিক শক্তির চেয়েও অনেক বড় ক্ষমতা হিসেবে দেখা হয়।