হামাসের সুড়ঙ্গ কি ধ্বংস করা সম্ভব
হামাসের সুড়ঙ্গ কি ধ্বংস করা সম্ভব
ভূমিকা
ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ইসরায়েল হামাস কে নির্মূল করতে গিয়ে, গাজায় নির্বিচার গণহত্যা আর জাতিগত নিধন চালিয়ে যাচ্ছে। গাজা অঞ্চলের মাটির নিচে গড়ে তোলা হামাসের বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করাই ইসরায়েলের মূল টার্গেট। এসব সুড়ঙ্গের ভেতরেই হামাস তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখে এবং ইসরায়েলের বোমা হামলা থেকে বাঁচতে সুড়ঙ্গগুলো হামাসের বাঙ্কার হিসেবে কাজ করে। ধারণা করা হয়, হামাসের প্রায় ১ হাজার ৩০০ টি সুড়ঙ্গ আছে।
ইসরায়েল চায় হামাসের সাথে সাথে এসব সুড়ঙ্গ পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলতে। কিন্তু হামাসের এই সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক বিশ্বের অনেক বড় বড় শহরের পাতাল রেল নেটওয়ার্কের চেয়েও বিস্তৃত। তাই ইসরায়েল হামাসের সুড়ঙ্গ সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের দ্বিমত রয়েছে। হামাস আর তাদের সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে গিয়ে, সমগ্র গাজাবাসীকেই হয়ত শেষ করে দিবে ইসরায়েলী হায়েনার দল।
সুড়ঙ্গ নির্মাণ
গাজার মাটির নিচে সুড়ঙ্গ নির্মান শুরু হয়েছিল ২০০১ সাল থেকে। তবে গাজায় হামাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পর, ২০০৭ সাল থেকে বহু সুড়ঙ্গ গড়ে উঠতে থাকে। সেসময়টাতে ইসরায়েল হামাস কে জব্দ করতে, গাজার উপর কঠোর অবরোধ আরোপ করেছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে ইসরায়েল এবং মিশর থেকে গাজায় পণ্য পরিবহন ও মানুষের আসা-যাওয়ার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সেসময় গাজায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যাপক সঙ্কট দেখা দেয়। পণ্য ঘাটতি কমানোর জন্য, মিশর সীমান্তে প্রায় আড়াই হাজার সুড়ঙ্গ গড়ে উঠেছিল। এসব সুড়ঙ্গ বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য, তেল এবং অস্ত্র চোরাচালানের জন্য ব্যবহার করা হত।
২০১০ সালের পর থেকে ইসরায়েল তাদের সীমান্ত ব্যবহার করে, আগের চেয়ে বেশি পণ্য গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেয়। তখন থেকে চোরাচালানের জন্য মিশরের সীমান্তবর্তী সুড়ঙ্গের গুরুত্ব অনেক কমে যায়। মিশর কিছু সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে ফেলে এবং বেশ কয়েকটি বন্যার পানিতে তলিয়ে দেয়। সুড়ঙ্গগুলোর বানিজ্যিক চাহিদা কমে যাওয়ার পর থেকে, হামাস সহ অন্যান্য সশস্ত্র দলগুলো ইসরায়েলী বাহিনীর উপর প্রতিশোধমূলক হামলার জন্য, নতুন করে সুড়ঙ্গ খুড়তে শুরু করে। যা শুধুমাত্র হামাসের সদস্যরাই ব্যবহার করতে পারে। গাজার সাধারণ জনগণ এখানে প্রবেশ করতে পারে না।
সুড়ঙ্গের ধরন
গাজার সুড়ঙ্গগুলো সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে একশ ফুট গভীরে খনন করা হয়। মাটির এত নিচে একদমই আলো থাকার কথা নয়, তাই টানেলের ভেতরে বিদ্যুৎ সংযোগ এবং আলোর ব্যবস্থা করা হয়। সুড়ঙ্গের উপরের মাটি যেন ধ্বসে না পড়ে, সেজন্য কংক্রিটের ছাদ ও দেয়াল তৈরি করা হয়। সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথগুলো সাধারণ ঘরবাড়ি, মসজিদ, স্কুল কিংবা জনসমাগমপূর্ণ এলাকার মধ্যে রাখা হয়। এর কারণ হল কারা সুড়ঙ্গের ভেতরে যাচ্ছে আর কারা বের হচ্ছে, তা যেন সহজে চিহ্নিত করা না যায়।
কিছু কিছু সুড়ঙ্গ গাজা থেকে শুরু হয়ে, ইসরায়েলের ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে। এসব আন্তঃসীমান্ত টানেলগুলো একবার ব্যবহার করার উপযোগী করে তৈরী করা হয়। কারণ এগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলে একবার হামলা পরিচালনা করলেই, ইসরায়েলী ডিফেন্স ফোর্সেস বা আইডিএফ সুড়ঙ্গগুলো চিহ্নিত করে ধ্বংস করে ফেলে। কিন্তু যেসব সুড়েঙ্গে হামাসের নেতারা লুকিয়ে থাকে, সেসব সুড়ঙ্গ অনেক বেশি উন্নত। কারণ সেখানে কমান্ড এবং কন্ট্রোল সেন্টার গড়ে তুলতে হয়। তাছাড়া পরিবহণ ও যোগাযোগের জন্য তৈরী করা সুড়ঙ্গগুলোতে রেল ট্রাক এবং অক্সিজেন এর বিশেষ ব্যবস্থাও থাকে। কিছু কিছু সুড়ঙ্গ গোলাবারুদ এবং অস্ত্র মজুদ রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক র্যান্ড কর্পোরেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালে নাগাদ হামাসের সুড়ঙ্গ তৈরির জন্য ৯০০ জন লোক দিনরাত কাজ করেছে। একেকটি সুড়ঙ্গ তৈরি করতে গড়ে প্রায় তিন মাস সময় লাগে এবং প্রায় এক কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়। ধারণা করা হয় সুড়ঙ্গ খোড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পরামর্শ নেওয়া হয়েছে ইরান ও উত্তর কোরিয়া থেকে।
আইডিএফ ২০১৪ সালে ‘অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ’ নামে এক অভিযান চালায়। বিমান ও স্থল আক্রমণের সমন্বয়ে সাজানো ওই অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিল হামাসের সুড়ঙ্গ। সেই অভিযানে প্রায় ৩২টি সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে ইসরায়েল, যার মধ্যে ১৪টি সুড়ঙ্গ গাজা থেকে ইসরায়েল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
টানেল নেটওয়ার্ক কত বড়
হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা মুশকিল। ইসরায়েল একে বলে গাজা মেট্রো। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেট্রোরেলের আদলে গাজা শহরের মাটির নিচে এই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। প্রায় এক হাজার ৩০০টির মত সুড়ঙ্গের সমন্বয়ে হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। অতীতে হামাস দাবি করেছিল জালের মত ছড়িয়ে থাকা এসব সুড়ঙ্গ প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। অথচ সমগ্র লন্ডন শহরের আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোর দৈর্ঘ্য ৪০০ কিলোমিটার। ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের গাজার নিচে ৫০০ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ থাকার মানে, শহরের একাধিক প্রান্ত থেকে একাধিক লাইনের মাধ্যমে এই টানেল নেটওয়ার্ক সংযুক্ত।
২০২১ সালে ইসরায়েলী ডিফেন্স ফোর্সেস বা আইডিএফ হামাসের ১০০ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ ধ্বংস করেছিল। তখন হামাস বলেছিল যে, আইডিএফ তাদের সুড়ঙ্গের মাত্র ৫ শতাংশ ধ্বংস করতে পেরেছে।
সাম্প্রতিক হামলার সময়ও হামাস সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে থাকতে পারে। ইসরায়েলের কাফার আজা নামের একটি জায়গার কাছে টানেলের মুখ বের হওয়ার কথা জানা গেছে। হামাস যেন ইসরায়েল সীমান্তের নিচ দিয়ে কোন সুড়ঙ্গ খুঁতে না পারে, সেজন্য ইসরায়েল সরকার গাজা সীমান্তে এন্টি টানেল সেন্সর সহ ভূগর্ভস্থ দেয়াল নির্মান করেছিল। কিন্তু হামাস আধুনিক প্রযুক্তিকে ফাঁকি দিয়ে এরও বহু নিচ দিয়ে এসব সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে।
সুড়ঙ্গ সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব?
গাজার এসব টানেল নেটওয়ার্কের কারণে ইসরায়েলের সেনা ও গোয়েন্দা প্রযুক্তি অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সেকারণেই মূলত তারা গাজা সীমান্তে স্থল অভিযান পরিচালনা করতে চায়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এখানে ইসরায়েলীদের জন্য অনেক ঝুঁকি অপেক্ষা করছে। হামাস ইচ্ছাকৃতভাবে আইডিএফ সেনাদের টানেলে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে, তারপর পুরো টানেল উড়িয়ে দিতে পারে।
মাটির নিচে হামাসের সুড়ঙ্গ খঁুজে বের করা কোন সহজ কাজ নয়। এসব সুড়ঙ্গের ভেতর রেডিও সিগনাল কাজ করে না। ড্রোন বা জিপিএস দিয়েও সুড়ঙ্গের ভেতরের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা বা পখ খঁুজে বের করা অসম্ভব। তারপরও ইসরায়েলীরা হামাসের সুড়ঙ্গ যদি খুঁজেও পায়, তাহলেও সেগুলো ধ্বংস করা অনেক বেশি কষ্টকর। অতীতে ইসরায়েল বিমান থেকে বোমা ফেলে সুড়ঙ্গ ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিমান থেকে ফেলা বোমা, মাটির এত গভীরে গিয়ে সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে পারে না। তখন আইডিএফ এমুলসা নামের একধরনের জেলের মত বিস্ফোরক দিয়েও চেষ্টা করেছে। কিন্ত একেকটি সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে প্রায় ৯ থেকে ১১ টন বিস্ফোরক দরকার হয়। যা সুড়ঙ্গের ভেতরে নিয়ে যাওয়া বিশাল চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে টানেল ধ্বংসের জন্য বিমান থেকে বাঙ্কার বিধ্বংসী বোমা ফেলা হতে পারে। এসব বোমা বিষ্ফোরিত হওয়ার আগে মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করে, এবং তারপর বিম্ফোরিত হয়। ঘনবসতিপূর্ণ গাজায় এ ধরনের বোমা ব্যবহার করলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভবনা রয়েছে।
বর্তমানে ইসরায়েলের রিমোট কন্ট্রোল গ্রাউন্ড রোবট রয়েছে। এসব রোবট পেতে রাখা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু এই রোবট অতীতে সুড়ঙ্গের ভেতর আটকে যাওয়ার রেকর্ড আছে। এমন পরিস্থিতিতে কোন সেনাকে গিয়েই রোবট ফিরিয়ে আনতে হবে। একজন অভিজ্ঞ আইডিএফ সৈনিক বলেন, এসব সুড়ঙ্গে মাত্র দেড়শ মিটার দৌড়ানো, মরুভূমিতে এক মাস দৌড়ানোর সমান কঠিন। ইসরায়েলী বাহিনী হামাসের সুড়ঙ্গ ধ্বংস করার জন্য, নিজেরাও এই ধরনের সুড়ঙ্গ তৈরী করে, তার ভেতরে প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইসরায়েল হামাসের পুরো টানেল নেটওয়ার্ক কখনই ধ্বংস করতে পারবে না। এটা অনেকটা অবাস্তব। টানেল ধ্বংস করতে গিয়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিন উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইসরায়েলী সেনাপ্রধান ঘোষণা দিয়েছিল, হামাস যেখান থেকে প্রস্তুতি নেয়, পরিকল্পনা করে আর হামলা চালায়, সেই সমস্ত জায়গায় তারা প্রবেশ করবে। এবং হামাসের প্রত্যেক কমান্ডার, সৈনিক ও অবকাঠামোকে ধ্বংস করবে। কিন্তু বাস্তব হলো, মাটির নিচে বিস্তৃত কয়েকশো কিলোমিটার সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে কয়েক সপ্তাহ বা মাস নয়; বরং কয়েক বছর সময় লাগবে।
ইসরায়েলের সন্ত্রাসী বাহিনী
ইসরায়েল হামাস কে সন্ত্রাসী বাহিনী অাখ্যা দিয়ে, হামাস কে নিধনের নামে নিরস্ত্র গাজা বাসীর উপর নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে। পৃথিবীর সকল সন্ত্রাসী সংগঠনের কর্মকান্ড যদি এক পাল্লায় রাখা হয়, আরেক পাল্লায় ইসরায়েলের সন্ত্রাসী কার্যক্রম; তাহলে ইসরায়েলের সন্ত্রাসী তৎপরতাই বেশি হবে। আমেরিকা এক বছরে আফগানিস্তানে যত বোমা ফেলেছে, ইসরায়েল মাত্র দশ দিনে তারচেয়ে বেশি বোমা গাজার ফিলিস্তিনীদের উপর ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, ইসরায়েল যত বোমা হামলা চালিয়েছে, তা হিরোশিমায় ফেলা পারমানবিক বোমার চার ভাগের এক ভাগ। সে হিসেবে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী সংগঠন।