তৈরী পোষাক খাতের সঙ্কট
তৈরী পোষাক খাতের সঙ্কট
চীনের পর বাংলাদেশই বিশ্বের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। মূলত সস্তা শ্রমের কারণেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। দেশের ৪ হাজারেরও অধিক কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক তৈরী পোশাক শিল্পে কাজ করে। এই শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী।
বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮৪ দশমিক ৫ শতাংশই আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে হয়। বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ১৬ শতাংশ আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা পোশাক শ্রমিকরা নায্য মজুরি পায় না। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির বাজারে, সামান্য বেতন দিয়ে জীবন ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠছে। সেকারণে বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে পোশাক শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে।
মজুরি বাড়ানোর দাবি
সর্বশেষ ২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ঠিক করা হয়েছিল আট হাজার টাকা। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকেই বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছিলেন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। এই দাবির প্রেক্ষিতে নতুন মজুরি কাঠোমো নির্ধারণের জন্য গত এপ্রিলে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। গত অক্টোবরে বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা দাবি করেন। অন্যদিকে, কারখানা মালিকদের পক্ষ থেকে ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব আসে। মালিকপক্ষের এই মজুরি প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ২৩ অক্টোবর গাজীপুরের কয়েকটি কারখানায় আন্দোলন শুরু করেন শ্রমিকরা। পরবর্তীতে এটি মিরপুর, আশুলিয়া, সাভারসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের সাথেও সংঘর্ষ হয় শ্রমিকদের। সবমিলে এই বিক্ষোভে তিন জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
মালিকপক্ষের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে গত ৭ই নভেম্বর মূল মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করে বাংলাদেশ সরকার। মজুরি বৃদ্ধির এই ঘোষণাকে শ্রমিকদের একটা পক্ষ মেনে নিলেও আরেকটি পক্ষ তা মেনে নেয়নি। বরং বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে তারা। পোশাক শ্রমিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাতে গোনা কিছু শ্রমিকের বেতন ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বাকিদের বেতন বেড়েছে ২৫ শতাংশেরও কম। ফলে বেশির ভাগ শ্রমিক মনে করছেন, তারা সরকার এবং মালিক পক্ষের কাছ থেকে প্রতারণার শিকার হয়েছে।
শ্রম আইনের ১৩ ধারা
আন্দোলনের পরিস্থিতির মধ্যে, শ্রমিকরা কারখানায় এসে হাজিরা দিয়ে, আবারো আন্দোলনে চলে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩ এর ১ ধারা প্রয়োগের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩ এর ১ ধারায় বলা আছে, “কোন প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা বা বিভাগে বে-আইনী ধর্মঘটের কারণে মালিক উক্ত শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন, এবং এরূপ বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকগণ কোন মজুরী পাইবেন না।”
শ্রমিকপক্ষ মনে করছে কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে সংকট আরও বাড়বে। বিজেএমইএ নেতারা বলছেন, ইতোমধ্যে যে মজুরি ঠিক করা হয়েছে, সেটা দিতে গিয়েই মালিকরা হিমশিম খাবে। পোশাক শিল্পমালিকেরা বলছেন, এই মজুরি বৃদ্ধির ফলে তাঁদের উৎপাদন ব্যয় অন্তত ৫ থেকে ৬ শতাংশ বেড়ে যাবে। এর ফলে তাঁদের মুনাফার পরিমাণ কমবে। কারণ, মোট ব্যয়ের প্রায় ১০ থেকে ১৩ শতাংশই মজুরি খাতে ব্যয় হয়।
বেশি দামে দিবে বৈশ্বিক ক্রেতারা
পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর পর বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের দাম বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক ক্রেতাদের সংগঠন আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার (এএএফএ)। বিশ্বখ্যাত পোশাক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম, গ্যাপসহ বিশ্বের এক হাজারেরও বেশি ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার এসোসিয়েশন বা AAFA এর সদস্য।
AAFA এর পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের পোশাক কেনার ক্ষেত্রে তারা বাড়তি ৫ থেকে ৬ শতাংশ উৎপাদন ব্যয় বহন করবে। এছাড়াও সংগঠনটি প্রতিবছর বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি পর্যালোচনা করারও আহবান জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর পরও বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি এশিয়ার অন্যান্য তৈরি পোশাক উৎপাদক দেশগুলোর চেয়ে যথেষ্ট কম। বেতন বাড়ানোর পর বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি দাঁড়াবে ১১৩ ডলার, যেখানে ভিয়েতনামের শ্রমিকদের মাসিক মজুরি ২৭৫ ডলার এবং কম্বোডিয়ার শ্রমিকদের মাসিক মজুরি ২৫০ ডলার।
মজুরি সমস্যার সমাধান না হলেও, বিশ্লেষকেরা বলছে পোশাক খাতের এ চলমান সংকট দ্রুতই কেটে যাবে। কারণ এই আন্দোলনের ফলে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষকেই লোকসান গুনতে হচ্ছে। সেকারণে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এরকম আন্দোলনের পরিস্থিতি বেশি দীর্ঘ হয় না।