মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আসলে কি বোঝায়
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আসলে কি বোঝায়
ভূমিকা
“মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” কথাটি আমরা হর হামেশাই শুনে থাকি। সমাজের বিভিন্ন ধরনের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কথা বলে। কিন্তু কোথাও এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না।
ঐতিহাসিক পটভূমি
উপমহাদেশে ব্রিটিশদের শাসন থেকে বাঁচতে এই অঞ্চলের মানুষ মুসলিম লীগ কে সমর্থন করেছিল। যে মুসলিম লীগের হাত ধরে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনে আমরা নিরাপত্তা খুঁজেছিলাম; কিন্তু পরবর্তীতে সেই রাষ্ট্রই আমাদেরকে গোলামে পরিণত করে। উপমহাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সর্বক্ষেত্রে শোষণ অার বঞ্চনার শিকার হচ্ছিল। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস। সেই বঞ্চনা থেকে বাঁচতেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা শুধুমাত্র একটি সার্বভৌম ভূখন্ড বা মানচিত্রের জন্য হয়নি। স্বাধীনতার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ শুধুমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চায়নি, এদেশের মানুষ চেয়েছে মুক্তি। শাসকের শোষণ থেকে মুক্তি, মানবাধিকারের বঞ্চনা থেকে মুক্তি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক মুক্তি। সেকারণেই আমাদের সেই যুদ্ধকে ভালোবেসে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’। সেই মুক্তির পেছনে থাকা কিছু আদর্শ, মূল্যবোধ আর বুকভরা স্বপ্নের মিশেলে তৈরী হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
যে আদর্শগুলো ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিমূর্ত প্রতীক আমাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল তারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্র হল মুক্তি, বাঙালিত্ব, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও মানবাধিকার।
মুক্তি
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মত বাঙালির বঞ্চনাবোধের প্রকাশ ঘটে। ৬০ এর দশকে সেই বঞ্চনার কারণেই প্রথমদিকে স্বাধীকারের দাবি ওঠে। পরবর্তীতে মুহুর্মুহু আন্দোলন শুধু স্বাধীনতা নয়, বরং প্রকৃত মুক্তি সংগ্রামে পরিণত হয়। এই মুক্তি মানে মানুষের সার্বিক বিকাশের মুক্তি।
বাঙালিত্ব
ভারত ভাগের আগে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে বাঙালি সত্ত্বার আবেগ ততটা ছিল না, যতটা তারা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবার পর বোধ করেছে। পাকিস্তানের সাথে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে জাতিগতভাবে বাঙালি পরিচয়টাই মূখ্য হয়ে ওঠে। ৫২‘র’ ভাষা আন্দোলন থেকে ৬০ এর দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিগতভাবে বাঙালিত্বকে প্রতিষ্টা করা হয়।
গণতন্ত্র
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম একটি শক্তিশালী দিক ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়ার জন্য নানা ধাপে বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে। সর্বশেষ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করার পরও, আওয়ামীলীগকে সরকার পরিচালনা করতে না দিয়ে, বাঙলার মানুষকে গণতন্ত্রের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। প্রকৃত অর্থে সেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই মুক্তিযুদ্ধে লাখো বাঙালী জীবন বিসর্জন দিয়েছে।
অসাম্প্রদায়িকতা
উমহাদেশ ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। পাকিস্তানীরা ধর্মের মত পবিত্র বিষয়কে তাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। কিন্তু বাঙালিরা ধর্মকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামো হিসেবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করেছিল।
বৈষম্যবিলোপ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভিন্নধর্মী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হতে থাকে। আমাদের অঞ্চল সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও, এখানকার জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে তার সামান্যই ব্যয় করা হত। সব মিলিয়ে দুই পাকিস্তানের সিংহভাগ সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু পরিবার এবং গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফা দাবিতে বৈষম্য ঘোচানোর বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। সেই থেকে বৈষম্যবিলোপ স্বাধীনতার আকাঙ্খার অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়।
মানবাধিকার
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর েথকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় পর্যন্ত পুরোটা সময়ই মূলত মানবাধিকার অর্জনের লড়াই। রাজনৈতিক অধিকার আদায়, নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চার অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার সহ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু পাকিস্তানীরা বরাবরই এই অঞ্চলে মানবাধিকারকে ভূলুন্ঠিত করেছে। সেই হিংস্র অপচেষ্টার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৭১ সালে ৯ মাস জুড়ে চালানো নির্বাচিত গণহত্যার মাধ্যমে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হিসেবে যে আদর্শ আর মূল্যবোধ কাজ করেছিল, সেই আদর্শগুলোই মূলত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতার সংগ্রামের দীর্ঘপথ পরিক্রমায় আমরা যে বিষয়গুলোর প্রতিবাদ করেছি, যেমন বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছি, তার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পার করলেও, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনেক মৌলিক বিষয় এখনও অধরা রয়ে গেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সার্বিক মুক্তি, দেশ পরিচালনায় প্রকৃত গণতন্ত্র, রাষ্ট্রীয়ভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ, সমাজিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং নাগরিক জীবনে মানবাধিকার নিশ্চিত করাই হল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।