আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ
আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ
গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্প
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেড ২০১৭ সালে একটি গোপন চুক্তি করেছিল। এই চুক্তিটি গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। এই প্রকল্পের অধীনে ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করার জন্যই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শুরু থেকেই প্রকল্পটি বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছ থেকে নানা ধরনের সমালোচনা এবং বিরোধীতার শিকার হয়। কয়লা ভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যূত করার বিষয়টি ভারতীয়রা ভালোভাবে নেয়নি। সকল বাঁধা পেরিয়ে আদনি পাওয়ার লিমিটেড তাদের প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোষ্টে বাংলাদেশের সাথে আদানী গ্রুপের চুক্তি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে, গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্প নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের কর্পোরেট জালিয়াতি প্রকাশ করার পর, আদানি রাতারাতি ১০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ হারায়। তখন থেকে গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্প কেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাথে আদানির প্রতারণার বিষয়গুলো আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
আদানির সাথে চুক্তি
২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে বলা হয়, নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে যেন ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। সেসময় ভারতের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করার জন্য সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিও সই করা হয়। নরেন্দ্র মোদির সেই সফরের পর, ২৫ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য গৌতম আদানির সঙ্গে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে গোড্ডায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করা হয়। ওয়াশিংটন পোস্ট এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বিদ্যুৎ বিষয়ক চুক্তিটি প্রথমে বাংলাদেশ ও ভারতের ‘উভয়ের জন্য লাভজনক’ বলে মনে হলেও আসলে তা বাংলাদেশের জন্য ‘খুবই কম লাভজনক’।
ওয়াশিংটন পোস্ট বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে হওয়া ১৬৩ পৃষ্ঠার ‘গোপন চুক্তিপত্রে’র কপি সংগ্রহ করে, ৩ জন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে চুক্তিটি পর্যালোচনা করিয়েছে। সিডনিভিত্তিক জ্বালানি বিশ্লেষক টিম বাকলি চুক্তিটি পর্যালোচনা করে জানিয়েছেন, গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও, বাংলাদেশকে প্রতিবছর ৪০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্যাপাসিটি চার্জ বাবাদ আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করবে। বিদ্যুৎখাতের বৈশ্বিক মান অনুসাযী এই চার্য অনেক বেশি। টিম বাকলি আরো বলেছেন, বাংলাদেশে পাইকারি বিদ্যুতের যে বাজার মূল্য, তার চেয়েও পাঁচগুণ বেশি দামে আদানির কাছে থেকে বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ।
কয়লার দাম
আদানি গ্রপের সাথে চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কয়লার দাম নির্ধারণ। বাংলাদেশ সরকার কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে কয়লা জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বেশি হলেও, সরকার নির্দিষ্ট অর্থের বেশি টাকা প্রদান করে না। কিন্তু আদানির সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী পরিশোধ করবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে কয়লার দাম প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে। তারপরও কয়লা সরবরাহে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না, কারণ ভারতের ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড এবং ওড়িষ্যা রাজ্যে আদানির বিশাল বিশাল কয়লা খনি আছে। এমনকি ভারতে কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া ৬টি খনির মধ্যে ৪টি খনির ঠিকাদারিই পেয়েছে আদানির কম্পানি। শুধু তাই নয়, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে থাকা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কয়লাখনিও আদানি গ্রুপের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। আদানি গ্রুপের ওয়েবসাইট বলা হয়েছে, তারা নয় কোটি টন কয়লা উৎপাদন করতে পারে এবং আগামী ৩০ বছরে তারা ৩০০ কোটি টন কয়লা মজুদ করার সক্ষমতা রাখে। গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের তথ্যমতে, গৌতম আদানির কম্পানি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কয়লা খনির মালিক। ভারতে এত কয়লার মালিকানা থাকার পরও, আদানি পাওয়ার চুক্তিতে দেখিয়েছে যে, তারা পরিবেশগত কারণে প্রতি বছর ৭০ লক্ষ টন কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করবে। এত বিপুল পরিমাণ কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করলে স্বভাবতই তার দাম বেশি পড়বে। কিন্তু সেখানেও আদানি গ্রুপই লাভবান হবে। কারণ অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা বিদেশী কয়লার মালিকানাও আদানির। সেই বিদেশী কয়লা আবার খালাস করা হবে আদানির মালিকানাধীন সমুদ্র বন্দরে। এবং বন্দর থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত কয়লা পরিবহণও করা হবে, আদানি কম্পানির বানানো রেললাইন ব্যবহার করে।
ক্যাপাসিটি চার্জ
কয়লার প্রতিটি ধাঁপে আদানির প্রত্যক্ষ ব্যবসা থাকলেও, কয়লার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম ধরতে চায় ৪০০ ডলার। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রামপাল এবং বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে করা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার দাম পড়ছে প্রতি টন ২৫০ ডলারের মতো। কিন্তু আদানি প্রতি টন কয়লার যে দাম প্রস্তাব করেছে, তা রামপাল ও পায়রার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আদানির প্রস্তাব করা কয়লার দাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এ বিষয়ে আদানির একটি কারিগরি প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনা হবার কথা রয়েছে। বাংলাদেশী জ্বালানী বিশেষজ্ঞ এম তামিম বলেন, বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ ১৩-১৪ টাকা দাম, আদানির কাছ থেকে তা ২২ টাকায় কিনতে হবে। আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি হবার অযুহাতে বাংলাদেশ যদি আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ না কেনে, সেক্ষেত্রে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। ২৫ বছর আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিলে তার পরিমান দাড়াবে ১ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকারও অনেক বেশি। কয়লার দাম রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের আগের পর্যায়ে ফিরে গেলেও, অভ্যন্তরীণ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সরকারের যে পরিমাণ খরচ হত, তারচেয়ে অন্তত ৩৩ শতাংশ বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। জ্বালানী বিশেষজ্ঞ টিম বাকলি ওয়াশিংটন পোষ্টকে বলেছেন, আদানির সঙ্গে করা এই চুক্তিটি অবশ্যিই প্রতারণা।
বিদ্যুৎ পরিবহণ
আদানির গোড্ডা প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ১০৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আদানি হাই ভোল্টেজ লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত আসবে। এই পর্যন্ত বিদ্যুৎ পরিবহণ খরচও বহন করবে বাংলাদেশে। তারপর সীমান্ত থেকে আরো ২৯ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পরিবহণ করে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত করা হবে। গত বছর নভেম্বরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জানানো হয়েছিল যে, ২০২২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ভারতের ঝাড়খণ্ডের আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসা শুরু হবে। কিন্তু তারপর কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশের আসে নি। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কয়লা ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বর্তমানে সর্বোচ্চ চাহিদার তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের। সেক্ষেত্রে আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশের প্রয়োজনই হবার কথা নয়। আরেকটি হতাশার বিষয় হল, চুক্তির অর্থ মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হবে। যখন চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিল, তখন ১ মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৮১ টাকা, আর বর্তমানে ডলারের দাম প্রায় ১০৫ টাকার বেশি।
গোপন চুক্তি
আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে ভারত বাংলাদেশের সরকারী কর্তৃপক্ষও খোলামেলা আলোচনা করতে চায় না। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র আরিন্দম বাগচীকে এ বিষয়ে জানান, আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি একটি সার্বভৌম সরকারের সঙ্গে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এর সঙ্গে ভারত সরকারের কোন সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহি ইন্ডিয়া এনার্জি উইকে বলেছেন, আদানির সাথে বাংলাদেশের চুক্তিটি গোপনীয়। এই চুক্তির শুরু থেকে আদানি গ্রুপ বিভিন্ন তথ্য গোপন করে বাংলাদেশের সাথে প্রতারণা করে আসছে। ২০১৯ সালে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমিকে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে ভারত সরকার। এর ফলে আদনি পাওয়ার সব ধরনের শুল্ক-কর ছাড় পেয়ে যায় । চুক্তি অনুযায়ী, ৩০ দিনের মধ্যে বিষয়টি বাংলাদেশকে জানানোর কথা ছিল। কারণ শুল্ক-কর ছাড়ের কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লা আমদানি ব্যয় কমে যাবে। কিন্তু আদানি পাওয়ার বিষয়টি গোপন করে গেছে। সব মিলিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের করা বিদ্যুৎ চুক্তিটি বৈষম্য ও প্রতারণামূলক।