বড়দিন কি সত্যিই খ্রিষ্টানদের উৎসব

maxresdefault (12)
জীবনযাপন

বড়দিন কি সত্যিই খ্রিষ্টানদের উৎসব

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ক্রিসমাস বা বড়দিন। বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে ঘটা করে বড়দিন পালন করে। কারণ খ্রিষ্টানরা মনে করে, এই দিনে যিশু খ্রিষ্ট জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ধর্ম গ্রন্থের বর্ণানা এবং ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে, ২৫ ডিসেম্বর যিশু খিষ্ট্রের জন্মদিন হবার বিষয়ে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং ২৫ ডিসেম্বরের সাথে জড়িয়ে আছে অতীতের মূর্তিপুজারী প্যাগানদের নানান আচার অনুষ্ঠান। প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের বহু ইশ্বরবাদে বিশ্বাসী প্রকৃতি পুজারীরা প্যাগান হিসেবে পরিচিত।

ক্রিসমাস কে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন বলা হলেও, খ্রিষ্টের জন্মেরও বহু আগে থেকে ক্রিসমাস উৎযাপন করা হত। প্রাচীনকালে উত্তর গোলার্ধের মানুষ শীতকালে উইন্টার সলিস্টিস উৎযাপন করত। উইন্টার সলিস্টিস হল উত্তর গোলার্ধের সবচেয়ে ছোট দিন এবং সবচেয়ে দীর্ঘ রাত। সাধারণত ডিসেম্বরের ২২ তারিখ থেকে জানুয়ারির ৬ তারিখের মধ্যে উইন্টার সলিস্টিস এর সময় আসত। সেকারণে উত্তর গোলার্ধের মানুষ জাতি ভেদে এই সময়ের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দিনে উইন্টার সলিস্টিস পালন করত। আলাস্কা, কানাডা বা নরওয়ের মত উত্তর মেরুর আশে পাশের অঞ্চলগুলোতে শীতকালে খুব অল্প সময় দিনের আলো পাওয়া যায়। এমনকি এই সমস্ত এলাকায় শীতকালে প্রায় ২৪ ঘন্টাও রাতের অন্ধকার থাকতে পারে। তাই প্রাচীনকালে শীত মৌসুমে এসব এলাকার বহু লোক মারাতœক অসু¯’ হয়ে পড়ত এবং প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কেউ না কেউ মারা যেত। শীত শেষে আবারো যখন সূর্যের উদয় হত, তখন তারা সূর্যকে জীবনদায়ী শক্তিরূপে স্বাগত জানাত। সেই সাথে সূর্যের আগমন কে উৎযাপন করতে নানা ধরনের উৎসব আয়োজন করা হত। সর্ব উত্তরের দিকে আয়োজন করা হত, ফিস্ট অব দ্যা টুয়েলভ নাইটস, যা ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে শুরু হয়ে জানুয়ারির ৬ তারিখ পর্যন্ত চলত। প্রাচীন গ্রীসে ক্রিড়া এবং মদের দেবতা ব্যাকাসের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হত ব্যাকানালিয়া উৎসব। প্রাচীন রোমানরা তাদের সূর্যের দেবতা স্যাটার্নের নামে আয়োজন করত স্যাটরানালিয়া। রোমান সা¤্রাজ্যের উ”চ পদ¯’ কর্মকর্তা এবং রোমান সৈনিকেরা মিথরা নামের আরেকজনকে সূর্য দেবতা হিসেবে মানত। এই মিথরার জন্মদিন হল ২৫ ডিসেম্বর, তাই তারা এই দিনটিকে বছরের সবচেয়ে পবিত্র দিন মনে করত। এবং ২৫ ডিসেম্বরে তারা প্রকৃতি পুজার মাধ্যমে মিথরার জন্মদিন উৎযাপন করত।

ক্রিসমাস বা বড়দিনের গোপন ইতিহাস !


ক্রিসমাস বা বড় দিনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত দুটি প্রতীক হল ক্রিসমাস ট্রি এবং সান্তা ক্লজ। এই দুটি বিষয়ের সাথেও প্যাগানদের যোগসূত্র রয়েছে। প্রাচীনকালে উত্তর গোলার্ধের মানুষ একটি বিষয় খেয়াল করে যে, তীব্র ঠান্ডায়ও এক প্রজাতির গাছ সম্পূর্ণ সজীব থাকে। এই গাছের নাম ফার ট্রি। তারা মনে করতে শুরু করে এই গাছের মধ্যে জীবনদানকারী শক্তি আছে। তাই তারা নিজেদের বাড়িতে এই গাছ রাখতে শুরু করে। এবং এসব গাছের সাথে বিভিন্ন তাবিজ কবজ বেঁধে রাখত। অনেক সময় তারা ফার ট্রি উপর আলো জ্বালিয়ে রাখত অথবা এসব গাছে আগুন ধরিয়ে দিত। মনে করত এসব তাবিজ এবং ফার ট্রি তাদেরকে শীতের তীব্রতা এবং শীতকালের নানা ধরনের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে। সেখান থেকেই ক্রিসমাস ট্রির বিবর্তন ঘটে। অন্যদিকে সান্তা ক্লজের সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত গল্প হল, ক্রিসমাসে সান্তা ক্লজ লাল কোট পড়ে ব্যাগ ভর্তি উপহার নিয়ে প্রতিটি বাড়ির চিমনী দিয়ে ঘরে ঢোকে। তারপর বাড়ির ক্রিসমাস ট্রির নিচে অথবা মুজায় ভরে শিশুদের জন্য উপহার রেখে দিয়ে চলে যায়। এই সান্তা ক্লজের আসল নাম হল, সেন্ট নিকোলাস। প্রাচীনকালে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে নিক, নিকল বা নিকার শব্দ দ্বারা এক রাক্ষস কে বোঝানো হত। তাকে বলা হত ডেমন অব নর্থ বা উত্তরের রাক্ষস। জার্মানীতে এর নাম ছিল পালজ নিকল; যার অর্থ লোমশ শয়তান। তৎকালীন সময়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং জার্মান অঞ্চলে, এই নিকোলাসের কথা বলে শিশুদের ভয় দেখানো হত। শীতকালে বাবা মায়েরা তাদের শিশু সন্তানদের বলত, তুমি যতি বাইরে যাও, তাহলে রাক্ষস নিক বা নিকোলাস এসে তোমাকে ব্যাগে ভরে নিয়ে যাবে। কোন কোন অঞ্চলে এই রাক্ষস কে বলা হত, প্রিন্স অব ডার্কনেস, অর্থাৎ অন্ধকারের রাজপুত্র। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই নিকোলাস, গ্রীক দেবতা ব্যাকাস এবং রোমান দেবতা স্যাটার্ন এবং মিথরা সবাইকে উপস্থাপন করতে একই ধরনের চিত্র অঙ্কন করা হত। এই সবগুলো চরিত্র বোঝাতে শিল্পীরা লম্বা দাড়িওয়ালার এক প্রতিকৃতি আঁকতেন। যার সাথে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সান্তা ক্লজের হুবহু মিল পাওয়া যায়। এছাড়াও ক্রিসমাসের প্রতিটি আয়োজনে শুধু সান্তা ক্লজের কথা বলা হয়, অথচ তথাকথিত যার জন্মদিনের উপলক্ষ এই আয়োজন, সেই যিশুর নামও নেওয়া হয় না। এর মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিকভাবে রাক্ষস হিসেবে পরিচিত এক চরিত্রকে গৌরবান্বিত করা হয়। এছাড়া সান্তা নামের মধ্যে আরো একটি রহস্য লুকিয়ে আছে। আর তা হল, সান্তা শব্দের অক্ষরগুলো সামান্য পুনবিন্যাস করলে পাওয়া যায় সাতান, যার অর্থ শয়তান।


রোমান সা¤্রাজ্যের প্রথম দিকে প্যাগান ধর্মের চর্চা বহুল প্রচলিত ছিল। প্যাগান রোমান সা¤্রাজ্যে ২৫ ডিসেম্বরকে মিথরার জন্মদিন হিসেবে ঘটা করে পালন করা হত। কিš‘ রোমানরা খ্রিষ্টান হবার পরে এই আয়োজন তো আর চালিয়ে যেতে পারে না। তখন তারা ২৫ ডিসেম্বরকে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন ধার্য করে নেয়। এরপর শুধু প্যাগান নাম বদলে খ্র্রিষ্টান হিসেবে আবারো সেই আগের চর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। তৎকালীন সময়ে চার্চও জানত যে তারা প্রচলিত প্যাগান উৎসবটি বাতিল করতে পারবে না। তাই চার্চ বিষয়টিকে আত্তীকরণ করে। অবশেষে চতুর্থ শতকে রোমান চার্চ ২৫ ডিসেম্বর কে যিশুর জন্মদিন হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। তখন অতীতের ফার ট্রি বাড়ির আঙিনার বদলে তারা ঘরের ভেতরে যাপন করতে শুরু করে। সেই সাথে আগের তাবিজ কবজের বদলে, তারা আপেল ঝুলিয়ে দেয়। যা কালক্রমে ক্রিসমাস ট্রি অর্নামেন্টে পরিণত হয়। কালক্রমে ফ্রান্সের নটর ডেম ক্যাথিড্রাল এবং ইংলান্ডের সলসবারি ক্যাথিড্রালে এই আয়োজনকে বলা হত ক্রাইস্ট মাস। যা পরবর্তীতে মানুষের মুখে মুখে হয়ে যায় ক্রিসমাস। মধ্যযুগের চার্চ অব ইংল্যান্ড তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বিশুদ্ধবাদী খ্রিষ্টান ধারার চর্চা করত। তারা খুব ভালো মতই বুঝতে পারে যে, ক্রিসমাসের নামে সরাসরি প্যাগান রীতিনীতির চর্চা হ”েছ। তাই ১৬৪৭ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডে ক্রিসমাস উৎযাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।


প্রাচীন কালের প্যাগান উৎসবের সাথে ক্রিসমাসের সামঞ্জস্য কে, নিতান্তই কাকতালীয় মনে করে বিষয়টি যদি বাদও দিয়ে দেই। এবং ধরে নেই যে, ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন তাহলে সমস্যা কোথায়? গমস্যা হল, খ্রিষ্টান ধর্মের কোথাও যিশু খিষ্টের জন্মের তারিখ উল্লেখ নেই। ধর্মগ্রš’ এবং একাধিক ঐতিহাসিক পন্ডিতের গবেষণায় দেখা যায়, খ্রিষ্টান ধর্মের যিশু খ্রিষ্ট, ইসলামে ধর্মে যাকে ঈসা (আ) নামে সম্বোধন করা হয়, তিনি আসলে শীতকালে জন্ম গ্রহণ করেননি। বরং বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, যিশু গ্রীষ্মকালে জন্মেছিলেন। খ্রিষ্টান বর্ণনা মতে, মাতা মেরি একটি ভেড়ার আস্তাবলে যিশু খ্রিষ্ট কে প্রসব করেছিলেন; এবং যিশুর জন্মের সময় ভেড়ার পাল বাইরে বিচরণ করছিল। কিš‘ ফিলিস্তিন অঞ্চলে শীতকালে রাতের বেলা ভেড়ার পাল বাইরে রাখা হয় না। সে বিবেচনায় অনেকে মনে করেন যিশু বসন্ত কালে জন্মেছিলেন। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মের বর্ণনায়, মরিয়ম (আ) এর যখন প্রসব বেদনা ওঠে, তখন একজন ফেরেশতা এসে তাঁকে শহরের বাইরে নির্জন ¯’ানে চলে যেতে বলেন। নির্জন ¯’ানে গিয়ে মাতা মরিয়ম (আ) তিনি একটি খেজুর গাছ এবং পানির উৎস খুঁজে পান। পবিত্র কুরআনে সুরা মরিয়ামের ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ অতঃপর ফেরেশতা তাকে নিম্নদিক থেকে আওয়ায দিলেন যে, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পায়ের তলায় একটি নহর জারি করেছেন। আর তুমি নিজের দিকে খেজুর গাছের কান্ডে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার উপর সুপক্ক খেজুর পতিত হবে। ” (সুরা মরিয়াম; আয়াতে: ২৪,২৫) সাধারণত খেজুর পাকে গ্রীষ্মকালে মরুভ‚মির তীব্র গরমে। তারমানে এখান থেকেও ধারণা পাওয়া যায় যে, ঈসা (আ) বা যিশু খ্রিষ্ট শীতকালে জন্ম গ্রহণ করেননি। তাহলে শীতকালে কে জন্মগ্রহণ করেছিল, যার কারণে ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস উৎযাপন করা হয়?


বর্তমানে যে ক্রিসমাসের রেওয়াজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, তা শুরু হয়েছিল আমেরিকায়। ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধ করে আমেরিকানরা স্বাধীনতা অর্জন করার পর, তারা সকল ব্রিটিশ রীতিনীতি পরিহার করে। এমনকি অতীতে ক্রিসমাসের ছুটির ঘোষনা সরাসরি বিট্রিশ রাজার কাছ থেকে আসত বলে, আমেরিকা স্বাধীন হবার পর একটানা ৬৭ বছর তারা ক্রিসমাসের ছুটিও পালন করেনি। একটা সময় আমেরিকানরা ভাবতে শুরু করে, সমগ্র দেশ একত্রিত হবার মত, তাদের কোন বাৎসরিক ছুটির দিন নেই। তখন তারা ইংল্যান্ডের ক্রিসমাস থেকে আলাদা, এবং সম্পূর্ণ ধমীয় প্রভাব মুক্ত নতুন ক্রিসমাস উৎসবের সূচনা করে। পরবর্তীতে আমেরিকানদের ক্রিসমাস প্রথাই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে ক্রিসমাস এমনিতেও আর কোন ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ক্রিসমাস উৎযাপনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধরন হল, নাইট ক্লাব অথবা বারে মদ পান করে নাচানাচি এবং উন্মত্ত রাত্রি জীবন উপভোগ করা। পশ্চিমাদের এসব অন্ধ অনুকরণে, বাংলাদেশের মত দেশে ডিজে পার্টি আয়োজন করাই ক্রিসমাস উৎযাপনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। আচার অনুষ্ঠান যাই হোক না কেন, বর্তমানে ক্রিসমাসে আর যিশু কে স্মরণ করা হয় না। এই যদি হয় নবীর জন্মদিন পালনের আয়োজন, তাহলে তা আর যাই হোক ধর্মীয় উৎসব হতে পারে না।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।