মিয়ানমার কি ভেঙে যাবে
মিয়ানমার কি ভেঙে যাবে
ভূমিকা
মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাস খুবই জটিল। দেশটির সামরিক বাহিনীর নাম তাতমাদো। মিয়ানমার স্বাধীন হবার পর থেকে প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই তাতমাদো বাহিনী দেশটি শাসন করেছে। মিয়ানমার দেশটি বহু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বাসস্থান। এসব গোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা এবং ঐতিহাসিক পরিচয় রয়েছে। এসব নৃ তাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্য থেকে বেশ কিছু সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছে, যারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিয়ানমার থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী একে অপরের বিরুদ্ধে এবং দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়মিত যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। সেকারণে মিয়ানমারের এই অস্থিরতা, বর্তমান বিশ্বে চলমান সবচেয়ে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এতদিন পর্যন্ত, স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে ভালোভাবেই নিয়য়ন্ত্রণে রাখেতে পেরেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি বৃহৎ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনী থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স নামে একটি সামরিক জোট গড়ে তুলেছে। এই জোট মিয়ানমারের শান রাজ্যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলা চালিয়ে, দেড় শতাধিক সেনাঘাঁঠি এবং মিয়ানমার চীন সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ও সড়কগুলো দখল করে নিয়েছে। এরপর থেকে সমগ্র মিয়ানমার জুড়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলা শুরু করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট কয়েকদিন আগে সতর্ক করে বলেছে, এভাবে চলতে থাকলে মিয়ানমার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
রাজনৈতিক ইতিহাস
মিয়ানমারের প্রাচীন নাম বার্মা। অতীতে বার্মা বহু রাজবংশের অধীনে পরিচালিত একাধিক সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ১৮৮৬ সালে এংলো-বার্মা যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা বার্মা দখল করে, একে ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশ ঘোষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপান বার্মা দখল করে রেখেছিল। পরবর্তীতে মিয়ানমারের জাতির পিতা হিসেবে পরিচিত অং সান এর নেতৃত্বে, ১৯৪৮ সালে বার্মা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু অং সান দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই হত্যার স্বীকার হন। স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি মাত্র ১৪ বছর স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারায় চলতে পেরেছিল। কিন্তু সেসময় মিয়ানমার সরকার, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহের মুখে পুরো দেশের উপর নিয়ন্ত্রন রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল।
১৯৬২ সালে তাদামাদো জেনারেল নে উইন দেশের অখন্ডতা বজায় রাখার অযুহাতে, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এবং এরপর থেকে শুরু হয় মিয়ানমারের দীর্ঘ সামরিক একনায়নতন্ত্রের ইতিহাস। নে উইন এর সরকার Burma Socialist Programme Party বা BSPP নামে এক দলীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে। তার প্রায় ২৬ বছর পর ১৯৮৮ সালে দেশের জনগণ সমারিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশের ছাত্র এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি জানায়। কিন্তু সামরিক শাসকেরা হাজারের বেশি মানুুষকে হত্যা করে নৃশংসভাবে এই বিক্ষোভ দমন করে। তৎকালীন সেই বিক্ষোভের সময় মিয়ানমারের জাতির পিতার কন্যা অং সান সুচি অত্যন্ত প্রভাবশালী বিরোধী নেতা হিসেবে উঠে আসেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি National League for Democracy বা NLD প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮৯ সালে সামরিক বাহিনী এক নতুন অধ্যায় সূচনা করার জন্য, দেশটির বার্মা নাম পরিবর্তন করে মিয়ানমার রাখে। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে সুচির দল নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু তাদমাদো বাহিনী তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে, উল্টো সুচিকে গৃহবন্দী করে। এরপর আরো ২১ বছর সম্পূর্ণ সামরিক শাসন চলার পর, দেশের মধ্যে বহু আন্দোলন আর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১০ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেওয়া হয়। সুচির দল এনএলডি ২০১০ সালের নির্বাচন বর্জন করে। কারণ বিগত ২১ বছরের মধ্যে প্রায় ১৫ বছরই অং সান সুচি গৃহবন্দী ছিলেন। এবং সামরিক বাহিনীর উপর তার দলের আস্থা ছিল না। কারণ অতীতে তার দল জয়লাভ করলেও তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। ২০১১ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারের মাধ্যমে মিয়ানমারে আংশিক গণতন্ত্র চালু করা হয়। এরপর ২০১৫ সালে মিয়ানমারের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সমগ্র দেশজুড়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনেও সুচির এনএলডি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। এবং অং সান সুচি স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে মিয়ানমারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ বহু বিষয়ে সামরিক বাহিনীর ব্যাপক প্রভাব রয়ে যায়। ২০২০ সালের পরবর্তী নির্বাচনেও এনএলডি পুনরায় জয়লাভ করে। কিন্তু সুচির দল নতুন মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আগেই জেনারেল মিন অং হ্লাইং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা দখল করে নেয়। বিগত নির্বাচনে দুর্নীতির অভিযোগ এনে অং সান সুচি এবং তার সরকারের প্রেসিডেন্ট সহ বহু সরকারী কর্মকর্তা, রাজনৈতিক কর্মী এবং গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের গ্রেফতার করা হয়। এই সামরিক অভ্যুত্থান বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত নিন্দিত হয়। দেশের জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানালে, তাতমাদো বাহিনী বরাবরের মতই নৃশংসভাবে বিক্ষোভ দমন করে।
এরপর থেকে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক ধারার নেতারা বুঝতে পারে যে, সামরিক বাহিনীর সাথে শান্তিপূর্ণ আলোচনা বা প্রতিবাদে কোন কাজ হবে না। তাদেরকে শুধুমাত্র সামরিকভাবেই প্রতিহত করা সম্ভব। গণতন্ত্রপন্থীরা পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে National Unity Government বা NUG নামে একটি বিকল্প ছায়া সরকার গঠন করে। ক্ষমতাচ্যূত সংসদ সদস্য, সুশীল সমাজের অংশীজন এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এই সরকারে অংশ নেয়। সামরিক জান্তা এই বিকল্প সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং এদেরকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দেয়। ন্যাশনাল ইউনিটি গর্ভনমেন্ট বা এনইউজির অধীনে People’s Defence Force বা PDF নামে একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। জান্তা সরকারের আগ্রাসন থেকে দেশের জনগণকে বাঁচাতে এই বাহিনী কাজ করছে।
বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী
মিয়ানমার একটি বহু জাতির দেশ। এ দেশে বামার, কাচিন, কারেন, শান, রাখাইন, চীন, মোন সহ আরো বহু নৃগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। এসব জাতীর লোকেরা, মিয়ানমারের ৭টি রাজ্যের ১৪টি প্রদেশে বাস করে। যাদের বেশ কয়েকটি প্রদেশ বিগত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছে। এদের দমন করতে গিয়ে দেশটির সেনাবাহিনী বহুমুখী গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে।
মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী বামার। তারা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে দেশের অধিকাংশ ক্ষমতাধর জায়গাগুলো রয়েছে বামারদের দখলে। ব্রিটিশ আমল থেকেই দেশটির সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো বঞ্চিত হয়ে আসছিল। তখন থেকেই দেশের নৃ তাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো একটি বৈষম্যহীন সমাজের লক্ষ্যে সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে সংখ্যাগুরু বামারাও নানাভাবে তাতামাদো বাহিনীর জুলুম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
মিয়ানমারে স্বায়ত্বশাসন চাওয়া বা স্বাধীনতা কামী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে, Karen National Union বা KNU, United Wa State Army বা UWSA, Kachin Independence Army বা KIA, Arakan Army বা AA, Shan State Army বা SSA, Ta’ang National Liberation Army বা TNLA এবং Myanmar National Democratic Alliance Army বা MNDAA সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন বা KNU হল মিয়ানমারের সবচেয়ে পুরনো সশস্ত্র গোষ্ঠী। এরা মিয়ানমারের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে কারেন জাতির জন্য স্বায়ত্বশাসন চায়। কেএনইউ এবং তাতমাদোর মধ্যে চলা যুদ্ধ, পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ জাতিগত সংঘাত হিসেবে বিবেচিত।
ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী। মিয়ানমারের শান রাজ্যে ওয়া জনগোষ্ঠীর জন্য ওয়া আর্মি আধা স্বায়ত্বশাসন পরিচালনা করে।
কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্টস আর্মি বা KIA মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের কাচিন রাজ্যে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিস্তৃত স্বায়ত্বশাসন দাবি করে।
আরাকান আর্মি মূলত রাখাইন রাজ্যে রাখাইনদের প্রতিনিধিত্ব করে। এরাও নিজেদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার আরো বাড়ানোর জন্য সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
শান স্টেট আর্মি বা SSA শান গোষ্ঠীর বিভিন্ন বিদোহী দলগুলোকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছে। এরাও শান রাজ্যে নিজেদের জন্য পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন দাবি করে।
তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চল এবং শান প্রদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এরা দেশটির সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত, অনুন্নত তাং জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে।
মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক এলায়েন্স আর্মি শান রাজ্যে চীনের সীমান্ত ঘেঁষা কোকাং অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী। অতীতে এরাই সর্বপ্রথম সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধবিরতির চুক্তি করেছিল।
এসব গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘ সময় ধরে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের প্রধান সেনাবাহিনীর তুলনায় এদের শক্তিমত্তা নিতান্তই ঠুনকো। সেকারণে এতদিন পর্যন্ত মনে করা হত, এরা হয়ত কখনই তাতমাদো বাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে না।
ব্রাদারহুড এলায়েন্স
সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারজুড়ে গৃহযুদ্ধ আরও ব্যাপক মাত্রায় পৌছায়। আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনার ডেমোক্রাটিক এলায়েন্স আর্মি এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আমি একত্রিত হয়ে Three Brotherhood Alliance নামে একটি সামরিক জোট গড়ে তোলে। গত অক্টোবরের ২৭ তারিখে ব্রাদারহুড এলায়েন্স শান রাজ্যে তাতমাদো বাহিনীর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন আক্রমণ চালায়। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তারা এর নাম দেয় অপারেশন ১০২৭। সম্মিলিত হামলার ফলে ব্রাদারহুড তাতমাদো বাহিনীর দেড় শতাধিক সামরিক ঘাঁটি দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স মান্দালয় থেকে চীন পর্যন্ত প্রধান সড়কেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই সড়ক মিয়ানমারের প্রধান অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে বিবেচিত। সেনাবাহিনীও হারানো এলাকাগুলো পুনঃদর্খল করতে আকাশ থেকে নির্বিচার বোমা বর্ষণ করছে। কিন্তু তাতে তারা খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না।
এতদিন পর্যন্ত একক ভাবে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো লড়াই করার তারণে তারা সামরিক বাহিনীর সাথে পেরে উঠছিল না। কিন্তু সম্মিলিতভাবে হামলা চালানোর ফলে তারা তাতমাদো বাহিনীকে খুব সহজেই কাবু করতে পেরেছে। ব্রাদারহুড এলায়েন্স ছাড়াও মিয়ানমারের বিকল্প সরকারের বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস বা PDF এই যুদ্ধে একাত্বতা প্রকাশ করেছে। এছাড়া অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও, শান স্টেট আর্মির মত দল গুলো অস্ত্র সরবরাহ করে সাহায্য করেছে। অপারেশন ১০২৭ সফল হবার পর থেকে শান অঞ্চলের বাইরেও এই যুদ্ধ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
চীনের ভূমিকা
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ব্যাপক সমালোচনার শিকার হলেও, প্রতিবেশী দেশ চীন দীর্ঘদিন ধরেই তাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে পাশে ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক মাসে চীন জান্তা সরকারের উপর ব্যাপক হতাশ হয়েছে। মিয়ানমারের শান স্টেট অনলাইন স্ক্যাম বা প্রতারণার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে বহু চীনা নাগরিকদেরকে পাচার করে এনে, দাশের মত বন্দী করে, তাদের দিয়ে অনলাইনে প্রতারণা করানো হয়। যাদের মূল টার্গেট চীনা নাগরিকরা। অনলাইনে প্রতারণার মাধ্যমে তারা প্রতিবছর প্রায় কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করে। এসব অনলাইন স্ক্যাম সেন্টারগুলো সামরিক সরকারের আত্নীয় স্বজন বা কাছের লোকজন পরিচালনা করে থাকে। সেকারণে জান্তা সরকার এগুলো বন্ধের ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ নিচ্ছিল না।
এছাড়াও চীন ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল যে, মিয়ানমারের ভেতর জান্তা সরকারের অবস্থান খুব দ্রুতই দুর্বল হয়ে আসছে, সেকারণেও তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে গোপনে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাদারহুড এলায়েন্স তাতমাদো বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করার জন্যও, চীনের অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল ছিল। উপর দিয়ে চীন এমনভাব দেখাচ্ছে যেন, তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা বলছে, চীনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এতবড় হামলা সম্পর্কে চীন আগে থেকে জানত না, তা কিছুতেই হতে পারে না।
মিয়ানমার কি ভেঙে যাবে?
বর্তমানে চলমান এই সামরিক ব্রিদ্রোহের একটাই উদ্দেশ্য; আর তা হল, মিয়ানমারে চীরদিনের মত সামরিক শাসন বন্ধ করা। কিন্তু সামরিক শাসনের অবসান হবার পর দেশটির ভবিষ্যৎ কি হবে, তা কেউ বলতে পারে না। কারণ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই বাহিনীগুলোর সবার উদ্দেশ্য এক নয়।
সম্প্রতি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিস্তৃত অঞ্চল হারানোর পর, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে সতর্ক করেছেন যে ‘মিয়ানমার কয়েক ভাগ হয়ে যেতে পারে’। তিনি মিয়ানমারের জনগণকে সামরিক বাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। কিন্তু মিয়ানমারের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের বেশির ভাগই সেনাবাহিনীর পরাজয়ে অত্যন্ত খুশি। কারণ সামরিক বাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদী জনগোষ্ঠীদের দমনের নামে দেশ জুড়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন এবং বিস্তৃত জনপদে অগ্নিসংযোগের মত ঘৃণ্য কর্মকান্ডকে নিয়মিত বিষয়ে পরিণত করেছে। দেশের জনগণের খাজনার টাকা দিয়ে কেনা অস্ত্র, তাতমাদো বাহিনী তাদেরই জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করতে ব্যবহার করছে। বর্তমানেও সাধারণ মানুষের বসতি ও স্থাপনায় তারা ভয়াবহ বিমান হামলা করছে। তাদের এই শুদ্ধি অভিযানে হাজারো মানুষ নিহত হয়েছে এবং সাত লাখের বেশি মানুষকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। যাদের অনেকেই প্রাণের ভয়ে পার্শবর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
প্রতিটি দেশের সেনাবাহিনী, তাদের দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। মিয়ানমারের তাতমাদো বাহিনীর কাজই যেন, নিজের দেশের মানুষকে হত্যা করা।
ন্যাশনাল ইউনিটি সরকারের পরিকল্পনা মতে, মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকারের অবসান হলে, অং সান সুচির নেতৃত্বে একটি ঐক্যবদ্ধ মিয়ানমার প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে এই প্রস্তাব খুব একটা পছন্দনীয় নয়। কারণ তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন এবং কেউ কেউ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার যে পতন হতে চলেছে, তা অনেকটাই নিশ্চিত। কিন্তু তাতমাদো বাহিনীতে খুব সহজেই সম্পূর্ণ শেষ করা যাবে না। পরাজয় নিশ্চিত জেনে জান্তা সরকার আগের চেয়ে আরো ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে চাইবে। সেনা শাসনের অবসান হওয়ার পরও দেশটির বিবাদমান পক্ষগুলো মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা খুব একটা সহজ বিষয় নয়। তখন যেহেতু তাতমাদোর মত বৃহৎ কোন কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী থাকবে না। তাই বিভিন্ন অঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা করাটাও খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়।