মালদ্বীপ কেন ভারত বিরোধী

maxresdefault (12)
জীবনযাপন

মালদ্বীপ কেন ভারত বিরোধী

ভূমিকা

মালদ্বীপ এবং ভারতের ঐতিহাসিক বন্ধৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপের জনগণ ভারত বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। ইন্ডিয়া আউট, ইন্ডিয়ান মিলিটারি আউট স্লোগান মালদ্বীপের রাজপথে একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগে নির্বাচিত হওয়া মালদ্বীপের নতুন রাষ্ট্রপতি মোহম্মদ মুইজু ক্ষমতায় আসার পরই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, মালদ্বীপ থেকে তিনি ভারতীয় সেনাদেরকে বিতারিত করবেন। শুধু তাই নয় মালদ্বীপে ভারত বিদ্বেষ এতই বেড়ে গেছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির রাজধানীতে থাকা ভারতীয় দূতাবাসেও, মালদ্বীপের নাগরিকরা হামলা চালিয়েছে।

মালদ্বীপ কেন ভারত বিরোধী হয়ে উঠল ?

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

মালদ্বীপ ১৯৬৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন হবার পর দশ বছর দেশটি রাজতন্ত্র হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে মালদ্বীপের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মামুন আব্দুল গাইয়ুম। আব্দুল গাইয়ুম পর পর ছয় বার মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন এবং দীর্ঘ ৩০ বছর মালদ্বীপ শাসন করেছেন। ১৯৮৮ সালে আব্দুল্লা লুথুফি নামের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মামুন আব্দুল গাইয়ুম এর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায়। লুথুফি এই অভ্যুত্থানের জন্য শ্রীলংকার তামিল সশস্ত্র সেনাদল ভাড়া করেছিল। সেই ভাড়াটে সেনাদল মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ভবন সহ সমগ্র সরকারী দপ্তর দলখ করে নেয়। অভ্যুত্থানের সময় মামুন আব্দুল গাইয়ুম স্বপরিবারে নিরাপদ জায়গায় আত্নগোপন করেন। আত্ন গোপনে থেকে ক্ষমতাহারা রাষ্ট্রপতি মামুন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, শ্রীলংকা সহ বেশ কিছু বিদেশী দেশের কাছে মালদ্বীপের গনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সহায়তা চান। কোন দেশ সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। কিন্তু ভারতের কাছে সহায়তা চাওয়ার সাথে সাথে ভারত সরকার মালদ্বীপকে সহায়তা করতে রাজি হয়ে যায়। তখন ভারতীয় সেনাবাহিনী অপারেশন ক্যাকটাস নামে এক দুর্ধর্ষ অভিযান পরিচালনা করে, বিদ্রোহীদেরকে দমন করে এবং মামুন আব্দুল গাইয়ুম কে অবারো ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনে, মালদ্বীপের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। সেই থেকে মালদ্বীপে ভারতীয় প্রভাব বাড়তে থাকে।

অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট

২০১৮ সালে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ভারত, মালদ্বীপকে ১.৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্রদান করে। মালদ্বীপের মত একটি দেশের জন্য এটি অনেক বড় অংকের সহায়তা। কারণ দেশটির মোট জিডিরি পরিমাণ ৬.১৯ বিলিয়ন ডলার। সেখান ১.৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা মালদ্বীপের মোট জিডিপির প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। কিন্তু এই ধরনের সহায়তা ভারত নিঃস্বার্থভাবে করেছে, বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। এর পেছনে ভারতেরও অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে, মালদ্বীপে যত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেই সকল কাজের টেন্ডার ভারতীয় কম্পানিকেই দেওয়া হয়েছে। সাধারণত এই ধরনের চুক্তিভিত্তিক প্রকল্পে কাজ করা কম্পানিগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মুনাফা করে থাকে। তারমানে ভারতের টাকা আবার ভারতেই ফিরে গেছে, মাঝখানে তারা মালদ্বীপকে সহায়তা করে, দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।

ভারত-মালদ্বীপ বন্ধুত্ব

করোনা মহামারির পরবর্তী সময়ে মালদ্বীপের অর্থনীতি যাতে মুখ থুবড়ে না পড়ে, সেজন্যও ভারত ২০২০ সালে মালদ্বীপকে আরো ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছিল। এছাড়াও আরো বেশ কিছু ক্ষেত্রে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে ভারত সরকার মালদ্বীপকে সহায়তা করে এসেছে। এর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দেশটির অতীত সরকারগুলো বরাবরই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গেছে। মালদ্বীপ অতীতে কাশ্মির ইস্যুতে ভারতকে সমর্থন দিয়ে গেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত কে স্থায়ী সদস্য পদ দেওয়ার জন্য, মালদ্বীপ বরাবরই ভারতে পক্ষে ভোট দিয়েছে। শুধু তাই নয়, মালদ্বীপের সাবেক সরকারগুলো প্রকাশ্যে ইন্ডিয়া ফার্স্ট নীতি অকপটে স্বীকার করেছে। মালদ্বীপের জাতীয় আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে এবং সরকার পরিচালনার অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলী পর্যন্ত ভারতের সহায়তা ও পরামর্শে পরিচালিত হত।

মালদ্বীপ একটি ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ায় নিজেদের প্রয়োজনেই ভারতে সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হয়। মালদ্বীপের ৭০ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম ভারত থেকে আসে; মালদ্বীপের সরকারী কর্মকর্তারাও ভারতে প্রশিক্ষিত হয়। এসবের বাইরেও, দেশটির চাল ডাল থেকে শুরু করে অন্য সকল খাদ্যপণ্যের জন্যও মালদ্বীপ ভারতে উপর নির্ভরশীল।

সম্পর্কের অবনতি

মালদ্বীপের রাজনীতিতে ৯টি রাজনৈতিক দল সক্রিয় রয়েছে। এসব দলের মধ্যে শুধু মাত্র দুটি দল পালা বদল করে দেশটির ক্ষমতায় এসেছে। সবচেয়ে প্রভাবশালী দুটি দলের একটি হল, Maldivian Democratic Party বা MDP এই দলটি ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত। এবং আরেকটি হল Progressive Party of Maldives বা PPM এই দলটি চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত।

২০০৮ সালে ভারতপন্থী দল মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি নির্বাচনে জয় লাভ করার পর মোহাম্মদ নাশিদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। তার এক বছর পরই ২০০৯ সালে ভারত-মালদ্বীপ প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করা হয়। এই চুক্তির আসল উদ্দেশ্য ছিল, ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব কমানো। এই চুক্তির অধীনে ভারত মালদ্বীপের সীমানার মধ্যে ২৬ টি রাডার স্থাপন করার কথা, যাতে করে তারা চীনের কার্যক্রমের উপর নজরদারি করতে পারে। এছাড়াও অপারেশন পরিচালনার জন্য ভারত মালদ্বীপে একটি ছোট এয়ারফোর্স হেলিকপ্টার ঘাঁঠি তৈরী করেছিল। ভারত-মালদ্বীপ প্রতিরক্ষা চুক্তি সাক্ষর হওয়ার পর থেকেই চীনপন্থী তৎকালীন বিরোধী দল পিপিএম আন্দোলন শুরু করে। তারা জনগণকে বোঝাতে থাকে যে, এই চুক্তির মাধ্যমে মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আপস করা হয়েছে। তখন থেকেই দেশটির জনগণ ভারতের ব্যাপারে সন্দিহান হতে শুরু করে।

২০১০ সালে ভারতপন্থী সরকার মালদ্বীপের মালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়ন এবং সংস্কার প্রকল্পের কাজ দেয় ভারতীয় কম্পানি GMR কর্পোরেশনকে। এই চুক্তিটি ছিল মূলত Build–Operate–Transfer বা BOT কন্ট্রাক্ট। এধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে কোন সরকার একটি প্রাইভেট কম্পানিকে কোন অববকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব দেয়, কম্পানি নিজের টাকা খরচ করে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, এর পরবর্তী ২০ থেকে ৩০ বছরের জন্য কম্পানিটি সেই প্রকল্পের মালিকানা লাভ করে, এবং প্রকল্প পরিচালনা করে মুনাফা অর্জন করে। সবশেষে চুক্তির মেয়াদ সম্পন্ন হলে প্রকল্পটি আবার সরকারের হাতে হস্তন্তর করা হয়। মালদ্বীপের বিরোধী দল দেশের প্রধান বিমানবন্দর ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ তুলে এই চুক্তির বিরোধীতা করে; এবং দেশটিতে ভারতের অর্থনৈতিক শোষণের ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করতে থাকে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে, জিএমআর কম্পানিকে কাজ দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জনঅসেন্তাষের মুখে মোহাম্মদ নাশিদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ভারত বিদ্বেষের বিস্তার

২০১৩ সালের নির্বাচনে চীনপন্থী দল পিপিএম জয়লাভ করে এবং আব্দুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ইয়ামিন ক্ষমতায় আসার পর ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতাকর্মীদের দমন করতে শুরু করেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। মোহাম্মদ নাশিদ গ্রেফতার থেকে বাঁচতে ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নেয়। এর মাধ্যমে মোহাম্মদ নাশিদ যে ভারতের পুতুল সরকার পরিচালনা করত, সে বিষয়টি মালদ্বীপের জনগণের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

আব্দুল্লাহ ইয়ামিন ক্ষমতায় আসার পর চীনের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং কে  মালদ্বীপে আমন্ত্রণ জানায়। এবং তখন মালদ্বীপ চীনের বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্প এবং ভারত মহাসাগরে নজরদারি প্রকল্প জয়েন্ট ওশান অবজারভেশনে যোগ দেয়। এরফলে মালদ্বীপে চীনের শক্ত অবস্থান তৈরী হয়। এসবের বাইরেও আব্দুল্লাহ ইয়ামিন গোপনে মালদ্বীপের বেশ কিছু দ্বীপ বিক্রি করা সহ, নজির বিহীন দুর্নীতি করে। যার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। এর ফলে ২০১৮ সালের পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ আবারো ডেমোক্রাটিক দলকে নির্বাচিত করে। এবং ইব্রাহিম সলিহ নতুন প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ক্ষমতায় এসে চীনের সাথে করা মালদ্বীপের সকল চুক্তি বাতিল করে দেয়। এবং ভারতে সাথে আবারো সুসম্পর্ক তৈরী করে। এই সময়ের মধ্যেও মালদ্বীপে ভারতীয় গোয়েন্দা তৎপরতা সহ ভারত বিদ্বেষী হওয়ার মত বিভিন্ন বিষয় জনগণের সামনে আসতে থাকে।

২০২৩ সালের নির্বাচনের বহু আগে থেকে প্রোগ্রেসিভ পার্টি “ইন্ডিয়া আউট” ক্যাম্পেইন শুরু করে। ভারত কিভাবে মালদ্বীপের স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনা করছে, সেসব বিষয় জনগণের সামনে তুলে ধরাই ছিল এই ক্যাম্পেইনের মূল উদ্দেশ্য। মালদ্বীপের জনগণ এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমেই মূলত ভারতের উপর থেকে সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে ফেলে; এবং দেশে ভারত বিরোধী মনোভাব দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। এই ভারত বিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়েই বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোহম্মদ মুইজু ক্ষমতায় এসেছেন।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।