তেলের বদলে পানি দিয়ে চলবে গাড়ি !

maxresdefault (7)
জীবনযাপন

তেলের বদলে পানি দিয়ে চলবে গাড়ি !

জাপানি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটা এমন এক গাড়ি তৈরী করছে, যার জ্বালানী হবে পানি। তারমানে তেলের বদলে এখন থেকে পানি দিয়েই গাড়ি চলবে। এই গাড়ির ফুয়েল ট্যাংেক যেমন পানি দেওয়া হয়, তেমনিভাবে এর এক্সোস্ট পাইপ থেকেও পানিই বের হয়।

টয়েট কিভাবে পানি দিয়ে ইঞ্জিন চালাবে, সেটাই একটি বড় প্রশ্ন। টয়োটা কি সাধারণ পানির মধ্যে এমন কোন উপাদান খুঁজে বের করেছে, যা অন্যান্য বড় বড় কম্পানি আবিষ্কার করতে পারেনি? নাকি টয়োটার নতুন ওয়াটার পাওয়ার্ড ইঞ্জিনে লুকিয়ে রয়েছে আসল রহস্য?

তেলের বদলে পানি দিয়ে চলবে গাড়ি !

ইলেকট্রিক কারের ধোকা

পৃথিবীর অন্যান্য গাড়ি কম্পানিগুলোর মত টয়োটা শুধু বাজারের চাহিদা অনুযায়ী গাড়ি উৎপাদন করে না। তারা সবসময় নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবনের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়। টয়োটা বরাবরই পরিবেশ বান্ধব গাড়ি উৎপাদন করতে চেয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে সারা বিশ্ব যখন যানবাহন থেকে সৃষ্ট বায়ু দূষণ কমানোর বিষয়টি নিয়ে ভাবছিল; তখন টয়োটা তার অন্যান্য প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে, বানিজ্যিকভাবে বিশ্বের প্রথম হাইব্রিড ইলেকট্রিক কার বাজারে ছাড়ে। Toyota Prius মডেলের সেই গাড়ির উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশ দুষণ কমানোত ভূমিকা রাখা। অনেকেই মনে করে, ৯০ এর দশকে টয়োটা প্রিয়াস সফল না হলে, ২০০০ সালের শুরুর দিকে টেসলা এতটা সম্ভাবনাময় যাত্রা শুরুই করতে পারত না।

সারা বিশ্বের যখন টয়োটা প্রিয়াস অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, সেসময় টয়োটা তাদের এই গাড়ির এমন কিছু বিষয় অনুধাবন করে, যা তাদের মূল লক্ষ্য পূরণে ব্যার্থ। ইলেকট্রিক গাড়ি রাস্তায় চলার সময় কোন ধরনের দূষণ ঘটায় না ঠিকই; কিন্তু যে বিদ্যুৎ দিয়ে এসব গাড়ি চার্য করা হয়, সেই বিদ্যুৎ কিন্তু কয়লা, গ্যাস বা তেল এর মত জীবাশ্ন জ্বালানী পুড়িয়েই উৎপাদন করা হয়। তারমানে ইলেকট্রিক যানবাহন রাস্তায় চলার সময় প্রত্যক্ষভাবে পরিবেশের ক্ষতি না হলেও; পরোক্ষভাবে তা প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতিই করছে।

এরচেয়েও আরেকটি মারাত্নক বিষয় হয়, ইলেকট্রিক গাড়িতে যে ব্যাটারি থাকে, সেগুলোও লিথিয়াম, কোবাল্ট বা নিকেলের মত দুর্লভ ধাতু থেকে বানানো হয়। এবং এসব ধাতু খনি থেকে উত্তোলন করে একটি গাড়ির জন্য ব্যাটারি তৈরী করতে এত পরিমাণ জীবাশ্ন জ্বালানী পোড়াতে হয় যে, তা দিয়ে দুটি সম্পূর্ণ গাড়িই তৈরী করা যায়। এছাড়াও একটি ইলেকট্রিক গাড়ি কাঁচামাল থেকে শুরু করে, সম্পূর্ণ গাড়ি হিসেবে প্রস্তুত হয়ে শোরুমে আসা পর্যন্ত ১৫ টন কার্বণ ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। এত পরিমাণ কার্বণ-ডাই-অক্সাইড প্রতি বছর প্রায় ২২ হাজার লোকের স্বাস্থ্যঝঁুকি তৈরী করতে পারে। শুধুমাত্র একটি ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদনই এতটা ক্ষতিকর, সেখানে যদি পৃথিবীর সকল গাড়ি ইলেকট্রিক ভেইকেল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, তাহলে তা পৃথিবীর জন্য মারাত্নক হুমকি বয়ে আনবে।

এসব কারণে টয়োটা বুঝতে পারে যে, পরিবেশ বান্ধব গাড়ি উৎপাদনে তারা আসলে সফল হতে পারেনি। উল্টো ইলেকট্রিক কার উৎপাদন করতে গিয়ে পৃথিবীর বহুমূল্যবান দুর্লভ ধাতুগুলোও অপচয় হচ্ছে। সেকারণেই টয়োটা তাদের ইলেকট্রিক গাড়ি বানানোর পরিকল্পনা বাদ দেয়। এবং তাদের সাধারন জ্বালানী িনর্ভর গাড়িগুলো আরো উন্নত করার দিকে মনোযোগ দেয়।

হাইড্রোজেন কারের ঝুঁকি

টয়োটা পরিবেশ বান্ধব গাড়ি উৎপাদনের প্রচেষ্টার এক পর্যায়ে অনুধাবন করে যে, নতুন ধরনের গাড়ি উদভাবনের চেয়ে নতুন জ্বালানীর খুঁজে বের করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জীবাশ্ন জ্বালানী ভিত্তিক সকল ধরনের ফুয়েলে কার্বণের বিক্রিয়া ঘটিয়ে শক্তি উৎপাদন করা হয়; যার থেকে মূলত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্বণ-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। কিন্তু কার্বণের পরিবর্তে যদি জ্বালানী হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহার করা যায়, তাহলে বায়ু দূষণের কোন প্রশ্নই ওঠে না। ৯০ এর দশকেই হাইড্রোজেন কারের গবেষণা সম্পন্ন হলেও, এ ধরনের গাড়ি বাজারে আসে ২০১৪ সালে। Toyota Mirai হল টয়োটার প্রথম হাইড্রোজেন ভিত্তিক হাইব্রিড কার। এ ধরনের গাড়িকে বলা হয় Fuel Cell Electric Vehicles কার। কারণ এ ধরনের গাড়িতে হাইড্রোজেন দিয়ে বিদু্যৎ উৎপাদন করা হয় এবং সেই বিদ্যুৎ দিয়ে ইলেকট্রিক মোটর ঘুরিয়ে গাড়ি চালানো হয়।

কিন্তু গাড়িতে জ্বালানী হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের বেশ কিছু অসুবিধা আছে। হাইড্রোজেন খুবই দাহ্য একটি গ্যাস। গাড়ির সিলিন্ডারে যখন হাইড্রোজেন সংকুচিত অবস্থায় থাকবে, তখন দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। হাইড্রোজেন সিলিন্ডার সম্বৃদ্ধ গাড়ি চলমান একেকটি টাইমবোমার মত। এরকম কয়েকটি গাড়ি যদি ঢাকার রাস্তায় জ্যামে আটকে যায়, এবং কোন কারণে তা বিষ্ফোরিত হয়, তাহলে তা পারমানবিক বোমার মত ভয়াবহ বিষ্ফোরণ ঘটাতে পারে। সেকারণে টয়োটা তাদের হাইড্রোজেন পাওয়ার্ড ইঞ্জিন নিয়েও সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারে না।

ওয়াটার কারের ধারণা

টয়োটা তাদের সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব গাড়ি উৎপাদনের চেষ্টায় অটল থাকে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে যে, জীবাশ্ন জ্বালানী বাদ দিয়ে যদি অন্য কোন উপাদান দিয়ে কার্যকরভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তাহলে হাইড্রোজেনই ব্যবহার করতে হবে। সেকারণে টয়োটা আবারো তাদের হাইড্রোজেন ইঞ্জিন নিয়ে গবেষণা শুরু করে। আবারো শূণ্য থেকে শুরু করার বদলে, তারা পুরনো সমস্যা সমাধান করার প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়। সাধারণত বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন দাহ্য হয়। কিন্তু হাইড্রোজেনকে যদি অন্যকোন উপাদানের সাথে মিশিয়ে অবিশুদ্ধ অবস্থায় গাড়ির ফুয়েল ট্যাংকে রাখা হয়, তাহলেই আর বিষ্ফোরণের সম্ভাবনা থাকে না। আর অবিশুদ্ধ অবস্থায় হাইড্রোজেনের কোন অভাব নেই। কারণ পানিতেই হাইড্রোজেনের প্রাচুর্য রয়েছে। আর এখান থেকেই জন্ম নেয়, ওয়াটটার ইঞ্জিন গাড়ির মূল অনুপ্রেরণা।

অতীতেও আরো বেশ কয়েকজন পানি দিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেসব গাড়ি মূল ধারার বানিজ্যিক গাড়িতে পরিণত হতে পারেনি। ১৯৮০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান জ্বালানীর দাম থেকে বাঁচতে, স্ট্যানলি মেয়ার্স নামের এক উদ্ভাবক জ্বালানী তেলের বদলে পানি দিয়ে চলে এমন গাড়ি তৈরী করেছিলেন। সেই গাড়ি মাত্র চার লিটার পানি দিয়ে ১৮০ কিলোমিটার চলতে পারত। কিন্তু যখনই মেয়ার তার আবিষ্কার প্রচার করতে শুরু করেন, তখনই একাধিক তেল কম্পানি তাকে হুমকি দিতে থাকে। ১৯৯৮ সালে তিনি পানি দিয়ে চলা এই গাড়ি বানিজ্যিক প্রচলনের জন্য কিছু বিনিয়োগকারীর সাথে কথা বলার সময়, রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। তার চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হল, স্ট্যানলি মেয়ার্স এর মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে, তার উদ্ভাবিত সেই গাড়ি এবং এর যাবতীয় নকশা তার বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, সেই ডিজাইন থাকলে ইলেকট্রিক গাড়ি কখনও এতটা জনপ্রিয়ই হত না।

অতীতেও আরো অনেকেই পানি দিয়ে গাড়ি চালানোর মত কাজ করেছে। কিন্তু সেসব মডেলের গাড়ির কোনটিই মোটেও টেকসই ব্যবস্থা ছিল না। বেশ কয়েকবার চলার পর সেসব গাড়ির সমস্যা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু গাড়ি অত্যন্ত বিষাক্ত গ্যাসও উৎপাদন করত।

টয়োটার ওয়াটার ইঞ্জিন

টয়োটা কিভাবে পানি দিয়ে গাড়ি চালাবে, তার পূর্ণাঙ্গ মডেল টয়োটা এখনও প্রকাশ করেনি। সাধারণত হাইড্রোজেন গাড়ির ফুয়েল স্টেশনে পানিকে ভেঙে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা হয়, এরপর সেই হাইড্রোজেন গ্যাস গাড়ির ফুয়েল ট্যাংকে ভরা হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইলেকট্রোলাইসিস। ইলেকট্রোলাইসিস এর মাধ্যমে হাইড্রোজেন তৈরীর প্রক্রিয়াকে টয়োটা এমন একটি যন্ত্রের মধ্যে নিয়ে এসেছে যে, তা গাড়ির ফুয়েল ট্যাংক এবং ইঞ্জিনের মাঝে স্থাপন করা যায়। এরপর ফুয়েল ট্যাংক থেকে ইঞ্জিনে যাওয়ার পথেই, পানি থেকে হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়। যার ফলে গাড়িতে সরাসরি হাইড্রোজেন সংরক্ষণ করার ঝুঁিকও থাকল না, আবার একই সাথে হাইড্রোজেন দিয়ে গাড়িও চালানো সম্ভব হল।

টয়োটার এই ওয়াটার পাওয়ার্ড ইঞ্জিন বর্তমানেও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র একটি প্রটোটাইপ মডেলই তৈরী করা হয়েছে। তাই তাদের পানি দিয়ে চলা গাড়ি সত্যিকার অর্থে কিভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কিত সঠিক ধারণা অন্য কারো কাছে নেই। কিন্তু অন্যান্য গবেষকেরা বলছেন, টয়োটার এই ইঞ্জিন বাস্তবায়নে দুই ধরনের সমস্যা থাকতে পারে। প্রথমত এই ইঞ্জিন এর কর্যপ্রণালী অনেকটা Perpetual Motion এর মত মনে হয়। পার্পেচুয়াল মোশন হল এমন এক ধরনের আনুমানিক যন্ত্র, যাতে একবার গতি সঞ্চার করা হলে, বাহ্যিক কোন শক্তির উৎস ছাড়াই, তা অবিরাম চলতে থাকে। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের মেশিন সম্ভব নয়।

আরেকটি ধারণা হল, টয়োটার ওয়াটার পাওয়ার্ড ইঞ্জিন যে পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করবে, পানিকে ভেঙে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করতেই তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি খরচ হয়ে যাবে। তারমানে গাড়ি চালাতে যে পরিমাণ শক্তির দরকার হবে, টয়োটার পানি চালিত ইঞ্জিন হয়ত ওই পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করতে পারবে না।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইলেকট্রোলাইসিস প্রক্রিয়ার ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্যক্ষমতা উন্নতি করা সম্ভব হয়েছে। যার ফলে হয়ত টয়োটার ওয়াটার পাওয়ার্ড ইঞ্জিন স্বপ্ন পূরণের যাত্রায় আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে। সেই সাথে পরিবেশ বান্ধব গাড়ি তৈরীর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে, অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের গাড়ি শিল্প আমূল বদলে যাবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।