এই লাল গরু দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটাবে
এই লাল গরু দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটাবে
লাল গরু
ইহুদিরা পবিত্র আল আকসা মসজিদ ভেঙে এই জায়গায় ইহুদি মন্দির নির্মান করতে চায়। আর এই মন্দির নির্মাণের প্রথম পদক্ষেপ হল জেরুজালেমে একটি লাল গরু কুরবানী করা। এই গরু যেন তেন কোন গরু নয়। এটি বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন গরু; যার বিষদ বর্ণনা বাইবেলে দেওয়া আছে। এমনকি এই গরুর বৈশিষ্ট্য পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারাতেও বর্ণনা করা হয়েছে।
পশ্চিমা খ্রিষ্টানরাও চায়, ইহুদিরা যত দ্রুত সম্ভব এই লাল গরু কুরবানি করুক। সে কারণে সেই বহু কাঙ্খিত লাল গরু ইতোমধ্যে আমেরিকা থেকে ইসরায়েলে নিয়েও আসা হয়েছে। সেকারণে, একটি ভিডিও বার্তায় হামাসের মুখপাত্র জানিয়েছে, এই লাল গরু ইসরায়েলে নিয়ে আসাও ৭ অক্টোবরের হামলার একটি অন্যতম কারণ।
ইহুদি এবং খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায় মনে করে, এই লাল গরু কুবানির মধ্য দিয়ে মসিহের আগমন ঘটবে। খ্রিস্টানরা মসিহ বলতে ঈসা (আ) বোঝালেও, ইহুদিদের এই মসিহ হল দাজ্জাল।
টেম্পল মাউন্ট
পবিত্র জেরুজালেম শহরের আল আকসা মসজিদ পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং ইসলামের মত পৃথিবীর প্রধান তিন ধর্মের মানুষের কাছেই এই জায়গাটি অত্যন্ত পবিত্র। ইহুদিদের কাছে এই জায়গাটি টেম্পল মাউন্ট নামে পরিচিত। ইহুদিরা মনে করে, নবী সুলাইমান (আ) এই জায়গায় প্রথম ইহুদি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুচাদ নেজার জেরুজালেম দখল করার পর, সেই মন্দির ধ্বংস করে ফেলে। এরপর জুডেয়া সাম্রাজ্যের রাজা হেরোড দা গ্রেট একই জায়গায় আগের চেয়ে আরো বড় করে ইহুদি মন্দির পুনঃনির্মাণ করেন। পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্য যখন জেরুজালেম দখল করে নেয়, তখন সেই দ্বিতীয় ইহুদি মন্দিরটিও ধ্বংস করা হয়। সেই দ্বিতীয় ইহুদি মন্দিরেরই একটি দেয়াল এখনও টিকে আছে, যা ওয়েস্টার্ন ওয়াল নামে পরিচিত। বর্তমানে এই ওয়েস্টার্ন ওয়াল ইহুদিরদের উপাসনার জন্য সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত।
সকল ইহুদিই মনে করে তাদের তৃতীয় মন্দিরও ঠিক এই জায়গাতেই নির্মিত হবে। তবে মন্দিরটি কিভাবে নির্মিত হবে, তা নিয়ে ইহুদিদের মধ্যে মতভেদ আছে। একদল মনে করে, মসিহ আসার পর সরাসরি ইশ্বরের সহায়তায় এখানে ইহুদি মন্দির নির্মিত হবে। অন্য দলের দাবি, তাদের মসিহ আগমনের আগেই এখানে মন্দির নির্মাণ করতে হবে। ধারণা করা হয়, ইহুদিদের এই মসিহ দাজ্জাল তৃতীয় মন্দির থেকেই সমগ্র বিশ্বে অরাজকতা ছড়াবে।
ইহুদি দৈববাণী
ইহুদীরা মনে করে, দ্বৈববাণীর মাধ্যমে ইহুদিদেরকে তৃতীয় মন্দির নির্মাণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। ইহুদি বিশ্বাস মতে, প্রথমবার মন্দির ধ্বংস করার সময়ই, ইশ্বরের আত্না মন্দির ত্যাগ করেছিল। এবং যতদিন পর্যন্ত এখানে মন্দির পুনঃনির্মাণ করা না হবে, এবং যতদিন পর্যন্ত মসিহের আগমন না ঘটবে, ততদিন ইশ্বর এখানে ফিরে আসবে না। সেকারণে মন্দির নির্মাণের আগ পর্যন্ত ইশ্বরের সাথে ইহুদিদের একটি দূরত্ব থেকে যাবে। মন্দির নির্মাণের মাধ্যমে ইহুদিরা শুধু তাদের রাজত্বই প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, বরং এর সাহায্যে ইশ্বরের সাথেও তাদের সম্পর্ক দৃঢ় হবে। তাদের মতে, এই মন্দির নির্মিত হলে, তা শুধু ইহুদিদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির উাসনার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হবে।
হাজার বছর ধরে ইহুদিদের মন্দির নির্মাণের এই স্বপ্ন সম্পূর্ণ অধরাই রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর, বিশেষ করে ১৯৬৭ সালে ৬ দিনে যুদ্ধে ইহুদিরা টেম্পল মাউন্ট দখল করার পর তারা স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অনেক দূর এগিয়ে যায়।
আল আকসা ধ্বংসের পায়তারা
ইহুদিবাদী ইসরায়েল সরকার আল আকসা সহ জেরুজালেম শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর, একটি নীতিমালা তৈরী হয়েছিল যে, আল আকসায় শুধু মুসলিমরাই প্রার্থনা করতে পারবে এবং এখানে ইহুদিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। জাতি সংঘ এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনুযায়ীও আল আকসা মসজিদে শুধু মাত্র মুসলিমদেরই প্রার্থনার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এখানে মুসলিমদের নামাজ আদায়ে শুধু বাঁধা প্রদানই নয়, বরং ইহুদিদেরকে রাষ্ট্রীয় নিররাপত্তায় এখানে অরাজকতা তৈরীর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তারা যেহেতু মনে করে, তৃতীয় মন্দিরটি টেম্পল মাউন্টেই নির্মাণ করতে হবে, সেকারণে মন্দির নির্মাণের আগে তাদের প্রথম লক্ষ্য হল আল আকসা মসজিদ ধ্বংস করা।
বিগত প্রায় ৬০ বছর ধরে ইহুদিরা জেরুজালেম নিয়ন্ত্রণ করলেও, এতদিন আল আকসা মসজিদ ধ্বংস করার ব্যাপারে প্রকাশ্যে তাদের কোন কিছু করতে দেখা যায়নি। কিন্তু গোপনে তারা তাদের সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। মসজিদ ধ্বংস করে মন্দির নির্মানের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে দ্যা টেম্পল ইনস্টিটিউট। টেম্পল মাউন্ট ইনস্টিটিউট তাদের কাজের ব্যাপারে এতটাই অগ্রগামী যে, তারা তৃতীয় মন্দির নির্মাণের পাথর পর্যন্ত তৈরী করে রেখেছে। হীরার টুকরা দিয়ে এসব পাথর কাটা হয়েছে। কারণ ইহুদিদের মতে, এই মন্দিরের পাথর কোন ধাতব যন্ত্র দিয়ে কাটা যাবে না। মন্দিরের ভেতরে যে মূর্তি বসানো হবে, সেটিও তৈরী করা হয়ে গেছে। তাদের পরিচালিত টেম্পল মাউন্ট মুভমেন্ট পন্থীরা ইসরায়েল সহ সারা বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে গোপন আঁতাত গড়ে তুলেছে। মন্দির নির্মাণের তহবিল গঠন থেকে শুরু করে নকশা অনুমোদন পর্যন্ত সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এখন শুধু আল আকসা মসজিদ ভাঙার অপেক্ষা।
আল আকসা মসজিদ ভাঙা যাতে সহজ হয়, সেজন্য ইহুদিরা বহু আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। ইহুদিরা আল আকসা মসজিদের নিচে প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন খননের নামে, মসজিদের নিচে বহু ধাপে খনন করে রেখেছে; যাতে মসজিদটির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই খনন কাজের ফলে মসজিদের বেশ কয়েকটি দেয়াল এবং ছাদে ফাটল দেখা দিলে, মুসলিমরা তা সংস্কার করতে চায়। কিন্তু ইসরায়েলী সরকার মসজিদ সংস্কারের কোন অনুমতি দেয়নি। শুধু তাই নয়, ২০২৩ সালের নেতানিয়াহুর মন্ত্রীপরিষদ আল আকসা মসজিদের নিচে একটি সভার করেছে।
খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের সহায়তা করে কেন?
পশ্চিমা ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাও চায়, আল আকসা মসজিদ ভেঙে সেখানে ইহুদি মন্দির তৈরী করা হোক। কারণ তারা মনে করে, যিশু খ্রিষ্টের পুনরায় আবির্ভাব ঘটার একটি পূর্বশর্ত হল জেরুজালেমে ইহুদি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা। ইহুদিদের পক্ষে কাজ করা খ্রিষ্টানদের একটি সংগঠন হল ক্রাই ফর জায়ন। ক্রাই ফর জায়ন এবং টেম্পল মাউন্ট ইনস্টিটিউটের বন্ধুত্ব হল, এক ধরনের অপবিত্র মৈত্রী। কারণ উভয়েরই উদ্দেশ্য আল আকসা মসজিদ ভেঙে ইহুদি মন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মসিহের আগমন কে তরান্বিত করা। কিন্ত ইহুদি খ্রিষ্টান উভয় ধর্মের মসিহ আসলে সম্পূর্ন ভিন্ন দুই ব্যক্তি। ইহুদিরা মনে করে, যখন তাদের মসিহ আসবে, তখন সকল অ-ইহুদিরা ইহুদিদের অধীনস্থ হবে। অন্যদিকে, ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা মনে করে, মসিহ আসার পর তিনি সকল ইহুদিকে খ্রিষ্টান ধর্মে দিক্ষিত করবেন, অথবা মহিস সকল ইহুদিকে হত্যা করবেন।
দুই দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য মুসলিমদের পবিত্র মসজিদ আল আকসা ধ্বংস করা। সেকারণেই তারা একে অপরকে সাহায্য করছে। মুসলিমদের মধ্যে ফিলিস্তিনীরা আল আকসা মসিজের জিম্মাদার এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে রয়েছে। সেকারণে ইহুদি খ্রিষ্টান সম্মিলতভাবে প্রথমে ফিলিস্তিনীদেরকেই দমন করার প্রচেষ্টা শুরু করেছে।
লাল গরুর তাৎপর্য
ইহুদি খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুসলিমদের দমন করার এই প্রক্রিয়ায় লাল গরুর সম্পর্ক কি? ইহুদি ধর্ম মতে, তৃতীয় মন্দির ততক্ষন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না, যতক্ষণ না ইহুদিরা পবিত্র হচ্ছে। আর ইহুদিদের এই পবিত্র হবার জন্য এমন একটি গরু উৎসর্গ করতে হবে যা বেশ দুর্লভ। তারা মনে করে, ইশ্বর ইহুদি ধর্মের নবী মুসা (আ) এবং হারুন (আ) কে বলেছেন, এমন একটি নিখুঁত লাল গরু উৎসর্গ করতে হবে, যা কখনও কোন হাল চাষের কাজে ব্যবহৃত হয়নি।
পবিত্র কুরআনের দ্বিতীয় অধ্যায় সুরা বাকারার ৬৭ থেকে ৭৩ নম্বর আয়াতে; বনী ইসরাইল বা ইহুদিদের এই গরু সম্পর্কিত ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। সেকারণে ইহুদিরা এমন এক গরু খঁুজতে থাকে যার কোন সাদা বা কালো পশম থাকতে পারবে না। এটি সম্পূর্ণ লাল বকনা বাছুর হতে হবে। এই ধরনের গরু খুঁজে বের করা অত্যন্ত কঠিন। এমনকি জেনেটিক মডিফিকেশন বা জীণগত পরিবর্তনের মাধ্যমেও এই ধরনের গরু উৎপাদন করা সহজ বিষয় নয়। স্বাভাবিকভাবেই এমন দুর্লভ গরু ইসরায়েলের মত ছোট একটি দেশের মধ্যে খঁুজে বের করা মুশকিল।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের একটি খামারে এই ধরনের ৫টি বাছুরের সন্ধান পাওয়া যায়। ইসরায়েলের টেম্পল মাউন্ট ইনস্টিটিউট প্রায় ৫ লক্ষ ডলার বা সাড়ে ৫ কোটি টাকা খরচ করে এই বাছুরগুলোকে ইসরায়েলে নিয়ে যায়। বাছুরগুলোকে যখন ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন এগুলোর বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী বাছুরের বয়স ৩ বছর না হওয়া পর্যন্ত কুরবানী করা যাবে না। নয়। সেকারণে ইসরায়েলের একটি খামারে অতি গোপনে এদেরকে লালন পালন করা হয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে বাছুরগুলোর বয়স ৩ বছর পূর্ণ হবে। সেকারণে চলতি বছরেই ইহুদিরা এই বাছুর কুরবানী করতে পারে বলে, অনেকেই ধারণা করছেন।
গরু কুরবানীর প্রক্রিয়া
ইহুদিদের শুধু দুর্লভ এই গরু খুঁজে বের করাই প্রধান সমস্যা নয়। এই গরু কুরবানী করার জন্যও বেশ কিছু বিশেষ পদেক্ষেপ আছে। যেন তেন কোন ধর্ম যাযক বা পুরোহিত এই গরু কুরবানী করতে পারবে না। বরং এমন একজন ব্যক্তি এই গরু কুরবানী করার জন্য উপযুক্ত হবেন, যে সরাসরি মুসা (আ) এর ভাই হারুন (আ) এর বংশধর। টেম্পল মাউন্ট ইনস্টিটিউট ৯ জন পুরোহিতকে আগে থেকেই বাছাই করে রেখেছে, যারা এই বাছুর কুরবানী করার উপযুক্ত।
এই গরু আবার যেকোন জায়গায় উৎসর্গ করলেও হবে না। কুরাবানী করার জায়গাও নির্দিষ্ট করা আছে। টেম্পল মাউন্টের পূর্ব দিকে মাউন্ট অলিভের আশে পাশের এমন জায়গা থেকে গরুটি কুরবানী করতে হবে, যেখান থেকে পুরোহিত জবেহ করার সময় মসজিদুল আকসা খালি চোখে সরাসরি দেখতে পারে। মাউন্ট অলিভে এমন একটি জায়গা ইহুদিরা ১২ বছর আগেই কিনে রেখেছে।
তারমানে ইহুদিরা লাল গরুও পেয়ে গেেছ, জবেহ করার উপযুক্ত পুরোহিতও নির্বাচন করেছে এবং কুরবানী করার জায়গাও নির্ধারণ করতে পেরেছে। এখন তারা শুধু উপযুক্ত সময় আসার অপেক্ষা করছে।
লাল গরুটি কুরবানীর পর একে পুড়িয়ে ছাই বানানো হবে। এরপর সেই ছাই পানির সাথে মিশিয়ে, সেই পানি ইহুদিদেরকে পবিত্র করার কাজে ব্যবহার করা হবে। এই পবিত্রকরণের কাজটি সম্পন্ন হবার পরই ইসরায়েলের ইহুদিরা, ইশ্বরের কাছ থেকে তৃতীয় মন্দির নির্মাণের অনুমতি পাবে।