মসজিদুল হারাম বিশ্বের সবচেয়ে দামি ভবন
মসজিদুল হারাম বিশ্বের সবচেয়ে দামি ভবন
ভূমিকা
যদি প্রশ্ন করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি ভবন কোনটি তাহলে, আমাদের অনেকেরই হয়তো সবার আগে মাথায় আসবে দুবাই এর বুর্জ খলিফা, চীনের সংহাই টাওয়ার কিংবা আমেরিকার ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর মত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন গুলোর কথা।
কিন্তু সত্যিকার অর্থে এইসব ভবন নির্মাণের খরচের চেয়েও অনেক বেশি; প্রায় শতগুণ বেশি অর্থ খরচ করা হয়েছে ইসলাম ধর্মের প্রধান উপাসনালয় মসজিদুল হারাম নির্মাণে।
পবিত্র কাবা শরীফের চারদিকে যে মসজিদ টি রয়েছে, সেটিই মসজিদ আল হারাম নামে পরিচিত। এই একটি ভবনে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ একত্রিত হতে পরে। প্রতিবছর হজ্জের মৌসুমে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানব সমাবেশ ঘটে, মসজিদুল হারামে।
বিশ্বের সবচেয়ে দামি ভবন
সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত মসজিদুল হারাম, ইসলামের পবিত্রতম স্থান এবং বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য হজ ও ওমরাহ পালনের কেন্দ্রবিন্দু।
মুসলিমদের কাছে পবিত্র কাবা শরীফ এবং মসজিদুল হারাম অমূল্য সম্পদ। ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রীয় এই মসজিদের মূল্য, মুসলিমরা টাকার অংকে বিচার করে না।
তবে যুক্তরাজ্যের দ্যা স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার ‘হোমস অ্যান্ড প্রোপার্টি’ বিভাগের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মক্কার মসজিদুল হারাম বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্থাপনা। হোমস অ্যান্ড প্রোপার্টির প্রকাশনা মূলত বিশ্বের শীর্ষ আবাসন ও সম্পত্তি, বাড়ির দাম, এবং অভ্যন্তরীণ সজ্জার বাজার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ফিচার করে থাকে।
বিশ্বের শীর্ষ দশটি ব্যয়বহুল ভবন সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে তারা দেখতে পায়, পবিত্র মসজিদুল হারামের নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের অন্য যে কোন ভবনের নির্মাণ ব্যায়ের চেয়ে অনেক বেশি।
‘হোমস অ্যান্ড প্রোপার্টি’ এর তথ্য অনুযায়ী, মসজিদুল হারামের নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ইউরো বা ১০০ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১২ লক্ষ ১৫ হাজার কোটি টাকা। মজার বিষয় হল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যায়বহুল ভবনও মসজিদুল হারামের ঠিক পাশেই অবস্থিত।
মক্কা ক্লক টাওয়ার নামে পরিচিত আবরাজ আল বায়িত টাওয়ার এর নির্মাণ ব্যায় প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ লক্ষ ৮২ হাজার কোটি টাকা। এই ভবনটি উচ্চতায় বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ভবন হলেও, নির্মাণ ব্যায়ের দিক থেকে এটি বুর্জ খলিফার চেয়েও এগিয়ে রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থিত বর্তমান পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফা নির্মাণ করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার বা ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বুর্জ খলিফা বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন হলেও, এর নির্মান ব্যায় পৃথিবীর অন্যান্য সর্বোচ্চ ভবনের তুলনায় কিছুটা কম। পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন সাংহাই টাওয়ার এর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ২.৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এবং যুক্তরাষ্ট্রে থাকা পৃথিবীর ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ভবন ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৩.৯ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
তারমানে মক্কা ক্লক টাওয়ার ছাড়া, পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবনগুলোর কোনটিই নির্মান করতে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়নি। সেখানে মসজিদুল হারাম নির্মাণের খরচ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে খরচের বিচারে বিশ্বের অন্যান্য ব্যয়বহুল ভবনগুলো মসজিদুল হারামের ধারে কাছেও নেই।
মসজিদুল হারামের ইতিহাস
মসজিদুল হারামের নির্মাণ ব্যয় নিয়ে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার, আর তা হল মসজিদটি নির্মাণের জন্য যে ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচের কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে ২০১১ সালের পর থেকে এই ভবনের সংস্কার ব্যয় মাত্র। সর্বপ্রথম যখন থেকে এই স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয়েছে, তখন থেকে এর নির্মাণ ব্যয় হিসেব করা অসম্ভব। কারণ যে কাবা ঘরকে কেন্দ্র করে মসজিদুল হারাম নির্মাণ করা হয়েছে, ইসলামের বর্ণনা মতে সেটি পৃথিবীর প্রথম ঘর এবং প্রথম ইবাদতের জায়গা।
এই কাবা ঘর বহু বার বহু ধাপে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বর্তমান কাবা ঘরের অস্তিত্ব শুরু হয়েছে খিষ্টপূর্ব প্রায় ২ হাজার ১৩০ সালের দিকে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে, মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ) একত্রে কাবা নির্মাণ করেছিলেন।
অতীতে পবিত্র কাবাকে কেন্দ্র করে একটি খোলা স্থানই ছিল মসজিদ। বিভিন্ন সময়ে একটু একটু করে মসজিদুল হারামের নির্মাণ চলতে থাকে। তবে ৬৯২ সালে সর্বপ্রথম, ছাদসহ দেয়াল দিয়ে মসজিদটি ঘিরে দেয়া হয়। তার পরেও বহু ধাপে মসজিদের উন্নয়ন চলতে থাকে। ১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় সেলিম এর আমলে মসজিদের সমতল ছাদের বদলে ক্যালিগ্রাফি সম্বলিত গম্বুজ ও নতুন স্তম্ভ স্থাপন করা হয়।
তবে মসজিদুল হারাম সংস্কারের সবচেয়ে সেরা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে। এই সময়ের মধ্যেই সাফা ও মারওয়াকে মসজিদুল হারামের মূল দালানের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে মসজিদে হারামের মোট আয়তন ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার ৮০০ বর্গমিটারেরও বেশি। তবে বর্তমান সময়েও প্রতিনিয়ত মসজিদুল হারামের উন্নয়ন কাজ অব্যাহত রয়েছে এবং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
কেন এত খরচ হল
মসজিদুল হারাম সংস্কারের এত উচ্চমূল্যের পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া সম্প্রসারণ প্রকল্পে নতুন প্রার্থনা হল, বর্ধিত তাওয়াফ এলাকা, উন্নত এস্কেলেটর, লিফট ও ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা এবং আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছে।
মক্কার জমির দাম পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম। মসজিদুল হারামের চারপাশের জমির প্রতি বর্গমিটারের মূল্য ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ সৌদি রিয়াল যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৯ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। নতুন করে মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য এই জমি অধিগ্রহণে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে।
হজ ও উমরার জন্য প্রতি বছর কয়েক কোটি মানুষ এখানে আসে, ফলে হাজিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ স্ক্যানার ও সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম, লক্ষাধিক ক্যামেরা এবং ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তি এবং স্বয়ংক্রিয় ভেন্টিলেশন ও আগুন প্রতিরোধী ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে।
এখানে ব্যবহৃত অধিকাংশ প্রযুক্তিই শুধু মাত্র এই মসজিদের জন্য বিশেষভাবে উদ্ভাবন করা হয়েছে। মসজিদুল হারামেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ও বিস্তৃত মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম। যার মাধ্যমে প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত আজান ও সালাতে আওয়াজ সম্প্রচার করা হয়।
মসজিদুল হারামে বিশ্বের সর্বোচ্চমানের স্থাপত্য ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত মার্বেল, গ্রানাইট এবং কার্পেট অত্যন্ত ব্যয়বহুল। মসজিদের কিছু অংশে বিশুদ্ধ সোনার প্রলেপ ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে স্বর্ণ দিয়ে তৈরী পবিত্র কাবার গিলাফ প্রতি বছর নতুন করে তৈরি করা হয়, যার মূল্য প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৬৫ কোটি টাকা।
মসজিদুল হারামের মেঝে
মক্কার মরুভূমির পরিবেশের মাঝে গড়ে ওঠার কারণে, মসজিদুল হারামে অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। তবে তারচেয়েও আশ্চর্যের বিষয় হল, মসজিদুল হারামের মেঝে। এই মসজিদের মেঝে এমন মার্বেল দিয়ে আচ্ছাদিত যার বিশেষ তাপ শোষণ ক্ষমতা রয়েছে। ফলে প্রখর রোদে খোলা আকাশের নিচে কাবার চারপাশে তাওয়াফ করার সময়ও পায়ের তলায় বেশ ঠান্ডা অনুভূত হয়।
মসজিদের মেঝে ছাড়াও দেয়াল, স্তম্ভ এবং অন্যান্য অংশে ব্যবহৃত মার্বেলও উচ্চমানের। ইতালির ক্যারেরা অঞ্চল থেকে আনা বিশ্বের অন্যতম সেরা মার্বেল মসজিদের প্রধান মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রিসের থ্যাসোস দ্বীপ (Thassos Island) থেকে আনা অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সাদা মার্বেল মসজিদের ভেতরের দেয়াল ও স্তম্ভে ব্যবহার করা হয়েছে। তুরস্কের মুগলা (Mugla) অঞ্চল থেকে আনা মার্বেল সাফা-মারওয়া এলাকায় ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া ভারত, ব্রাজিল ও সৌদি আরবের স্থানীয় কিছু গ্রানাইট মসজিদের ভিত্তি ও স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে এই ভবনের প্রতিটি কোনায় ব্যবহৃত সর্বোচ্চ মানের নির্মাণ সামগ্রী এবং সর্বাধুনিক উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে মসজিদুল হারাম বিশ্বের সবচেয়ে দামি ভবনে পরিণত হয়েছে।