চাকা আবিষ্কারের গল্প
চাকা আবিষ্কারের গল্প
সূচনা
মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে কিছু কিছু আবিষ্কার এমন পরিবর্তন এনেছে, যা পুরো বিশ্বের চেহারাই বদলে দিয়েছে। চাকার আবিষ্কার তেমনই এক বিস্ময়কর উদ্ভাবন। আজ আমরা আধুনিক যানবাহন থেকে শুরু করে কারখানা, কৃষিকাজ, এমনকি জটিল যন্ত্রের কার্যক্রমেও চাকার ব্যবহার দেখছি।
ধারণা করা হয়, প্রায় ৫০০০ বছর আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় চাকার ব্যবহার শুরু হয়। প্রথম দিকে চাকা ছিল মূলত মৃৎ শিল্পের হাতিয়ার, এরপর চাকা ধীরে ধীরে পরিবহন এবং যান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে।
মানবসভ্যতার চাকা ঘোরানোর গল্প
সর্বপ্রথম চাকার আবিষ্কার হয়েছিল মূলত মৃৎশিল্প তৈরির কাজ সহজ করার জন্য। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৪০০০-৩৫০০ সালের মধ্যে মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় সর্বপ্রথম চাকার ব্যবহার শুরু হয়। তবে এসব চাকা পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো না। তখন মৃৎশিল্প তৈরিতে এসব গোলাকার চাকার মতো বস্তু ব্যবহার করত। এ সময়টাকে বলা হয় নবপলীয় যুগ। মানুষ এই সময়েই সর্বপ্রথম কাদা মাটিকে বিভিন্ন আকার-আকৃতি দিতে শেখে। তৎকালীন মৃৎশিল্পে ব্যবহৃত সেসব চাকাকে potter’s wheel বলা হয়।
সভ্যতার ক্রম বিকাশের ফলে প্রস্তর যুগে মানুষ ভারী ভারী পাথর দিয়ে অনেক স্থাপনা নির্মাণ করতে শুরু করে। কিন্তু ভারী বস্তু একস্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া অনেক কষ্টকর ছিল। ফলে মানুষ চিন্তা করতে শুরু করে, সহজে এবং কম পরিশ্রমে কিভাবে ভারি বস্তু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে সেই সমস্যা সমাধানে, মানুষ সমতল কাঠের তল ব্যবহার করে মালামাল পরিবহন শুরু করে। কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হয় না কারণ, এভাবেও ঘর্ষণের কারণে কোন বস্তু স্থানান্তরে অনেক কষ্ট হতো। সেই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে মানুষ এসব তলের নিচে সিলিন্ডার আকৃতির কাঠের গুড়ির ধারণা নিয়ে আসে। এভাবে সমতলের নিচে কাঠের গুড়ির ব্যবহারই, ধীরে ধীরে মানবসভ্যতাকে চাকা আবিষ্কারের দিকে ধাবিত করে। যা থেকেই পরবর্তীতে কাঠের চাকার ব্যবহার শুরু হয়।
তখন একখণ্ড কাঠকে গোলাকার আকৃতি দিয়ে, তার মাঝখানে ফুটো করে একটি কাঠের তক্তা লাগানো হয়। কাঠের চাকাটি এই তক্তার চারপাশে ঘুরতো। এই চাকা আবিষ্কারের ফলে পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হলেও, আরেকটি সমস্যা তৈরী হয়; আর তা হলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে কাঠ ক্ষয় হতে থাকে। আবার অনেক ভারী বস্তু পরিবহনের সময় এসব কাঠের চাকায় ফাটল ধরে ভেঙ্গেও যেতো।
প্রাচীন চীন ও তুর্কির মত যেসব এলাকায় কাঠের সংকট ছিল; সেখানে কাঠের পরিবর্তে পাথরের চাকা ব্যবহার করা হত। পাথরের চাকা অনেক ভারী হলেও বেশ টেকসই ছিল।
স্লোভেনিয়ায় আবিষ্কৃত লুবিয়ানা মর্শেস চাকা এখন পর্যন্ত পাওয়া পৃথিবীর প্রাচীনতম কাঠের চাকা। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবিয়ানার কাছে অবস্থিত একটি জলাভূমি অঞ্চলে এই চাকা পাওয়া গিয়েছে।
গ্রীসের নতুন চাকা
কাঠের সাধারণ চাকা ব্যবহারের পরবর্তী সময়ে, প্রাচীন গ্রিসে এক নতুন ধরনের চাকার আবিস্কার হয়। এই চাকাগুলো ছিল ইংরেজি H অক্ষরের মতো। অতিরিক্ত ভারের কারণে চাকার মধ্যে ফাটল ধরে যেন ভেঙ্গে না যায়, সেকারণে এসব চাকায় একটি কাঠের তক্তার পরিবর্তে একাধিক তক্তা ব্যবহার করা হত। দৃঢ়তা ও স্থিতিশীলতার জন্য এই ধরনের চাকা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যুদ্ধের রথ তৈরিতে এই চাকাকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পূর্বের কাঠের চাকার তুলনায় এগুলো যেমন টেকসই, তেমনই এর ভার বণ্টনও অনেক উন্নত ছিল। সেকারণে এসব চাকা বিভিন্ন যুদ্ধে গ্রিকদের নতুন শক্তির যোগান দেয়। এরপর অনেক দীর্ঘ সময় চাকার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে ইউরোপ, ভারত এবং চীনে বিভিন্ন ধরনের চাকার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। তারা চাকার মধ্যে স্পোক ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে চাকা একদিকে যেমন অনেক হালকা হয়, তেমনি গাড়ির গতিও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তখনও একটা বড় ধরনের সমস্যা থেকেই যায়, আর তা হলো চাকার ক্ষয়। তারও প্রায় ১০০০ বছর পর ব্রোঞ্জের আবিস্কার হলে চাকার উন্নয়নে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। তখন চাকার চারপাশে ধাতব আবরণ দেয়া শুরু হয়; যার ফলে চাকার স্থায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়।
লেদার বিয়ারিং ও জলচাকা
খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সালের দিকে ফ্রান্স ও জার্মানি তে, চাকায় বিয়ারিং এর ব্যবহার শুরু হয়। তারা চাকার বাইরের অংশ ও কেন্দ্রীয় অংশের মাঝে চামড়া ব্যবহার করে ঘর্ষণ কমানোর চেষ্টা করেন। সেই বিয়ারিং প্রযুক্তই আধুনিক বিয়ারিং প্রযুক্তির বিকাশে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে।
প্রায় ঠিক একই সময়ে ড্যানিশ নির্মাতারা চাকার অক্ষের চারপাশে কাঠের রোলার বা সিলিন্ডার ব্যবহার শুরু করেন। এই নকশাটি অক্ষ এবং চাকার মধ্যে সরাসরি ঘর্ষণ কমিয়ে চাকার ঘূর্ণয়নকে আরো মসৃণ করে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ উদ্ভাবন না হলেও ড্যানিশ নির্মাতাদের সেই প্রাথমিক প্রচেষ্টা প্রমাণ করে যে, আধুনিক সভ্যতা গড়ে তুলতে প্রাচীন ইঞ্জিনিয়াররা কতটা গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিসে যান্ত্রিক জলচাকা বা Water Wheel উদ্ভাবিত হয়। এগুলো মূলত সেঁচের কাজে ব্যবহার করা হত। শুধু তাই নয়, পানির প্রবাহকে যান্ত্রিক শক্তিতে রুপান্তর করে, সেসব চাকা দিয়ে শস্য পেষার কাজও করা হত। এসব চাকাকে বলা হত পেরাচোরা চাকা। এরপর দীর্ঘসময় ধরে চাকার আর তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আধুনিক চাকা
আঠারো শতকের সূচনা লগ্নে চাকায় বিয়ারিং এবং ধাতব এক্সেল এর ব্যবহার শুরু হয়। যার ফলে চাকার ঘর্ষণ কমিয়ে ব্যাপক গতি বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। ১৮৪৪ সালে চার্লস গুডইয়ার চাকার অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে ভলকানাইজড রাবার ব্যবহার করেন। যার ফলে নতুন এই চাকাগুলো মসৃণভাবে চলাচলের পাশাপাশি শক্তিশালী গ্রিপও প্রদান করে। ভলকানাইজেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাবারের স্থায়িত্ব, স্থিতিস্থাপকতা এবং তাপ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
১৮৮৮ সালে আয়ারল্যান্ডে John Boyd Dunlop নিউমেটিক টায়ার আবিস্কার করেন। যার ফলে চলাচল আরো আরামদায়ক হয় এবং একই সাথে চাকার স্থায়িত্বও অনেক বৃদ্ধি পায়। ডানলপের চাকাতেই প্রথম পুরু রাবারের শক্ত স্তরের পরিবর্তে, বাতাস দিয়ে ভরা টিউব ব্যবহার করা হয়। যা রাস্তার উঁচু-নিচু ঝাঁকুনি অনেক ভালো শোষণ করতে পারে।
ভবিষ্যতের চাকা
আধুনিক যুগেও চাকার বিভিন্ন ধরনের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আধুনিক চাকার একটি অন্যতম বিড়ম্বনা হল Puncture। এই সমস্যা দূর করার জন্য এমন এক ধরনের চাকা উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা কখনো Puncture হবে না। এধরনের চাকাকে বলা হচ্ছে Puncture-less tire।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতের যানবাহনে হয়ত কোন চাকাই থাকবে না। কারণ চাকার যত সমস্যাই সমাধান করা হোক না কেন, চাকার ঘর্ষণকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। সেকারণে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে চাকার বিকল্প প্রযুক্তি উদ্বাবনের কাজ চলছে। এর সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হল, চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরির মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভাসমান অবস্থায় ঘর্ষণহীন ভাবে চলা। অথবা হোভারক্রাফটের মতো বায়ুর শক্তিকে ব্যবহার করে ভাসমান গাড়ি কিংবা কোয়ান্টাম লেভিটেশনের মাধমে সুপারকন্ডাক্টর ব্যবহার করে যানবাহনকে স্থির ভাসমান রাখা। বিষয়গুলো শুনতে খুব অস্বাভাবিক আর অবাস্তব মনে হলেও, ইতোমধ্যেই এ ধরনের যানবাহন রয়েছে। ১৯৭০ এর দশকেই জার্মানির বিজ্ঞানীরা চাকা ছাড়া এমন এক ধরনের ট্রেন আবিষ্কার করেন, যাকে বলা হয় ম্যাগলেভ ট্রেন। এই পদ্ধতিতে চৌম্বক শক্তির মাধ্যমে রেললাইনের উপর শূণ্যে ভাসিয়ে ট্রেনকে অত্যন্ত দ্রুতি গতিতে সামনে এগিয়ে নেওয়া হয়। ২০০৩ সাল থেকে চীনে এ ধরনের ম্যাগলেভ ট্রেন ব্যাপক আকারে ব্যবহার শুরু হয়। ভবিষ্যতে হয়ত ব্যক্তিগত গাড়ির জন্যও এ ধরনের ব্যবস্থা তৈরী করা সম্ভব হবে। তখন হয়ত মানব সভ্যতার অন্যতম সেরা আবিষ্কার চাকা তার আবেদন হারিয়ে বিলুপ্তি দিকে ধাবিত হবে।