সুদানে গণহত্যা
সুদানে গণহত্যা
ভূমিকা
বর্তমানে সুদানে এক মারাত্মক গৃহযুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধের একদিকে আছে দেশটির সেনাবাহিনী Sudanese Armed Forces বা SAF এবং অন্যদিকে আছে মিলিশিয়া বাহিনী Rapid Support Forces বা RSF। এই দুই দলের ক্ষমতা ভাগাভাগি ও সম্পদের নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্ব থেকেই মূলত, সুদানে আবারো গ্রহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।
স্বৈরশাসনের পতন ও ক্ষমতার শূন্যতা
১৯৮৯ সালে ওমর আল-বাশির একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর তিন দশকেরও বেশি সময় তিনি সুদান শাসন করেছেন। তাঁর শাসনকালে দেশজুড়ে দুর্নীতি, দমননীতি ও অর্থনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছায়। সেকারণে ২০১৯ সালে ওমর আল-বাশিরও আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। তার পতনের পর থেকেই সেনাবাহিনী ও বেসামরিক নেতৃত্ব মিলে সুদানে এক অস্থায়ী যৌথ শাসন ব্যবস্থা শুরু হয়। কিন্তু এখানেই তৈরি হয় সংঘাতের বীজ। কারণ স্বৈরশাসক বাশিরের সময় দেশটির সেনাবাহিনীর বাইরেও আরেকটি শক্তিশালী মিলিশিয়া বাহিন গঠন করা হয়েছিল। এখন সেনাবাহিনী এবং মিলিশিয়া দুই পক্ষই নিজেদেরকে সুদানের আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
দারফুর যুদ্ধ ও RSF এর উত্থান
সুদানের বর্তমান গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি ভালোভাবে বুঝতে হলে, দারফুর যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হবে।
সুদানের দারফুর অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে আরব ও অআরব আফ্রিকান জাতিগোষ্ঠীর মিশ্র বসতি। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জনগণ অভিযোগ করছিল যে, আরব সম্প্রদায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রিয় সরকার দারফুর প্রদেশের মানুষদের উন্নয়ন, শিক্ষা ও প্রশাসনিক পদ থেকে বঞ্চিত করছে। এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচারের ফলেই দারফুরের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
সেই থেকে ২০০৩ সালে, কেন্দ্রীয় সরকার বনাম স্থানীয় দুটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়। তখন Sudan Liberation Army বা SLA এবং Justice and Equality Movement বা JEM নামের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল।
সেসময় সুদানের সরকার বিদ্রোহীদের দমন করতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি জানজাওয়িদ নামে এক মিলিশিয়া গোষ্ঠীও গঠন করে। সরকারী মদদপুষ্ট এই জানজাওয়িদ মিলিশিয়ারা, বিদ্রোহীদের দমনের নামে একের পর এক গ্রাম ধ্বংস করতে শুরু করে। যা এক সময় জাতিগত নিধন বা “গণহত্যা”-য় রূপ নেয়। জাতিসংঘের হিসেবে, ২০০৩ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দারফুর যুদ্ধে প্রায় ৩ লাখ মানুষ নিহত হয় এবং ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।
সেই গণহত্যা ঘটানো জানজাওয়িদ প্যারামিলিটারি ফোর্স পরবর্তীতে Rapid Support Forces বা RSF নামে আত্নপ্রকাশ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে RSF বিপুল সম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র অর্জন করে এবং আন্তর্জাতিক স্বর্ণ বাণিজ্যেও প্রভাব বিস্তার করে। ফলে তাদের আর্থিক ও সামরিক সক্ষমতা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
স্বৈরাচার ওমর আল-বাশিরের পতনের পর RSF-এর প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো অস্থায়ী সরকারের উপ-প্রধান হন। তখন তিনি দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার কারণে, তার RSF কে একটি স্বতন্ত্র বাহিনী হিসেবেই রাখতে চান। কিন্তু সুদানের মূল ধারার সেনাবাহিনী তখন চিন্তু করে, একটি দেশে কখনও দুটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকতে পারে না। তাই সেনাবাহিনী বনাম মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে শুরু হয় তুমুল উত্তেজনা।
২০২৫ সালের ভয়াবহ সহিংসতা
সুদানের রাজধানী খার্তুমে দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ২০২৩ সালেই বর্তমান গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। ২০২৫ সালের শেষের দিকে উত্তর দারফুরের শহর এল-ফাশের হয়ে ওঠে সুদানের গৃহযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ কেন্দ্র। শহরটি দীর্ঘদিন ধরে সরকারি বাহিনী SAF-এর নিয়ন্ত্রণে ছিল, এবং এটিই ছিল পশ্চিমাঞ্চলে তাদের শেষ শক্ত ঘাঁটি। অপরদিকে, RSF বহু মাস ধরে শহরটিকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। খাদ্য, পানি, ও চিকিৎসা সরবরাহ বন্ধ করে পুরো এলাকাকে এক প্রকার মৃত্যুকূপে পরিণত করেছিল তারা।
দীর্ঘ ১৮ মাসের অবরোধের পর ২০২৫ সালের অক্টোবরে RSF অবশেষে এল-ফাশের দখল করে নেয়। শহরে প্রবেশের পর শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, RSF সদস্যরা নারী ও শিশু সহ প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। সেই সাথে বেশ কিছু নির্দিষ্ট জাতি গোষ্ঠীর মানুষদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। অনেক এলাকা সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং অসংখ্য মানুষ পালাতে গিয়ে পথেই নিহত হয়েছে।
সবমিলিয়ে বলা যায়, সুদানের স্বৈরশাসকের পতনের পর, দেশটিতে তৈরী হওয়া রাজনৈতিক শূণ্যতা পূরনের জন্য; দেশের সেনাবাহিনী এবং অতীতের স্বৈরাচার সরকারের মদদে গড়ে ওঠা মিলিশিয়া বাহিনীর ক্ষমতার দ্বন্দের কারণেই মূলত সুদানে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।