বয়স কমাচ্ছেন যে বিলিয়নিয়ার

maxresdefault (67)
প্রযুক্তি

বয়স কমাচ্ছেন যে বিলিয়নিয়ার

সূচনা
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বয়স কমানো বা বয়স ধরে রাখার জন্য বহু চেষ্টা করে আসছে। তবে বাস্তবে কি সত্যিই বয়স কমানো সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিপ্রেমীরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম ব্রায়ান জনসন। ব্রায়ান একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, যিনি নিজের শরীরকে ‘নতুন করে তরুণ’ করতে বছরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন।

বয়স কমাচ্ছে যে বিলিয়নিয়ার !

ব্রায়ান জনসন পরিচিতি
ব্রায়ান জনসন একজন সফল প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং গবেষক। তিনি ২০০৭ সালে Braintree নামে একটি মোবাইল পেমেন্ট প্রসেসিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। যা ২০১৩ সালে ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে PayPal কিনে নেয়। এই সাফল্যের পর তিনি মানবদেহের দীর্ঘায়ু নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত হন।

বর্তমানে ব্রায়ান জনসন Blueprint নামের একটি প্রকল্প চালু করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি বয়স কমানোর বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় বের করার চেষ্টা করছেন। জনসনের Blueprint প্রকল্পের বার্ষিক খরচ প্রায় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে তার বয়স কমানোর ব্যক্তিগত খরচ প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ২২ কোটি টাকার বেশি।

জনসনের প্রধান লক্ষ্য হলো মানুষের জীবদ্দশা দীর্ঘায়িত করা এবং শারীরিকভাবে তার নিজের শরীরকে ১৮ বছরের তরুণের মতো করে তোলা। তিনি নিজের শরীরকে একটি গবেষণাগারের মতো ব্যবহার করে নিয়মিত পরীক্ষা চালাচ্ছেন। তার মতে, যদি সঠিক খাবার, ব্যায়াম, ওষুধ এবং লাইফস্টাইল অনুসরণ করা যায়, তবে বয়স বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে ধীর করা সম্ভব। তিনি এমন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে চান, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে মানুষ বুড়িয়ে যাওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারবে এবং আরও দীর্ঘস্থায়ী ও সুস্থ জীবন উপভোগ করতে পারবে।

কিভাবে বয়স কমাতে চায়?
ব্রায়ান জনসনের বয়স কমানোর উদ্যোগ শুধুমাত্র ব্যায়াম বা স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি আধুনিক চিকিৎসা, প্রযুক্তি, জিনোমিক গবেষণা, স্টেম সেল থেরাপি, প্লাজমা ট্রান্সফিউশন, মেডিকেল স্ক্যানিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বিভিন্ন ধরনের ওষুধের মাধ্যমে তার শারীরিক কার্যক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।

তিনি প্রতিদিন নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনে খাদ্য গ্রহণ, শরীরচর্চা ও জীবনধারা অনুসরণ করেন। ক্যালোরি নিয়ন্ত্রিত ডায়েট, নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রোটিন ও শর্করা গ্রহণ এবং প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ব্যায়াম করা তার রুটিনের অংশ।

দীর্ঘায়ু ও সুস্থতার জন্য তিনি নিয়মিত জেনেটিক স্ক্যানিং করেন, যা তার ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য রোগ ও বার্ধক্যজনিত প্রভাব চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। স্টেম সেল থেরাপি ও প্লাজমা ট্রান্সফিউশন গ্রহণ করে তিনি শরীরের পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া সক্রিয় রাখেন। এমনকি এ জন্য তিনি নিজের ছেলের রক্ত থেকেও প্লাজমা নিয়েছেন।

মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে তিনি ব্রেন অপ্টিমাইজেশন প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন এবং নিউরোট্রান্সমিটার ভারসাম্য বজায় রাখতে বিভিন্ন ওষুধ ও ব্রেইন স্টিমুলেশন টেকনিক ব্যবহার করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে তিনি নিয়মিত তার ঘুমের মান পর্যবেক্ষণ করেন।

ত্বকের সৌন্দর্য ও স্থিতিস্থাপকতা ধরে রাখতে তিনি নিয়মিত লেজার ট্রিটমেন্ট ও কোলাজেন বৃদ্ধির থেরাপি গ্রহণ করেন।

জনসনের বিশ্বাস, এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সাহায্যে তিনি শুধুমাত্র নিজের বয়স কমাতে পারবেন না, বরং ভবিষ্যতে মানবজাতির জন্য দীর্ঘায়ুর নতুন দ্বার উন্মোচন করতে পারবেন। তবে, তার এই চেষ্টাগুলো কতটুকু কার্যকর হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন।

বয়স কমাতে কী কী করে?
জনসনের দৈনন্দিন রুটিন অত্যন্ত কঠোর। তিনি একেবারে নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া, ব্যায়াম এবং ঘুমের রুটিন মেনে চলেন।

ব্রায়ান প্রতিদিন ১০০টির বেশি সাপ্লিমেন্ট ওষুধ গ্রহণ করেন, যাতে শরীরের প্রতিটি কোষের কার্যকারিতা ঠিক থাকে। এতে বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং হরমোন নিয়ন্ত্রক ওষুধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অনেকের ধারণা এত পরিমাণ ওষুধই তার শরীরের স্বাভাবিক কার্যপ্রণালীতে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। তিনি প্রতিদিন খাবারের মাধ্যমে ১,৯৭৭ ক্যালরি গ্রহণ করেন, যা তার মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ওজন ও কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।

তার সকালের নাস্তায় প্রচুর সবুজ শাকসবজি ও উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ পানীয় থাকে, যা কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ সক্রিয় রাখতে তিনি প্রতিদিন তিন ঘণ্টা ব্যায়াম করেন, যার মধ্যে কার্ডিও, ভারোত্তোলন, যোগব্যায়াম এবং নমনীয়তা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত।

তিনি তার স্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থান বুঝতে প্রতিদিন অসংখ্য মেডিকেল পরীক্ষা করান। ব্লাড টেস্ট, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ফিজিক্যাল স্ক্যান এবং জেনেটিক এনালাইসিসের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ কতটা তরুণ রয়েছে তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন।

এই পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ। জনসনের এই জীবনধারা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কিছুটা চরম মনে হতে পারে, কারণ দীর্ঘ মেয়াদে এসব থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এখনো নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, অতিরিক্ত মেডিকেল হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক শারীরিক কার্যপ্রণালী ব্যাহত করতে পারে এবং ভবিষ্যতে বড় ধরনের শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

অস্বাভাবিক রকমের মেডিকেল থেরাপি, প্রচুর ওষুধ সেবন এবং কঠোর ব্যায়ামের কারণে ইতোমধ্যেই তার চেহারা কিছুটা বিকৃত হয়ে গেছে। সেকারণে ব্রায়ান তার ৪৬ বছর বয়সে শিশুদের মত চেহারা তৈরী করার আশায়, মুখমন্ডলের ত্বকের নিচে চর্বি প্রতিস্থাপন করেছে। আর এর ফলাফল দাঁড়িয়েছে ভয়াবহ।

বিজ্ঞান কী বলে, বয়স কমানো আদৌ সম্ভব?
বয়স কমানোর বিষয়ে বর্তমান বিজ্ঞান কোন একক সমাধানে আসতে পারেনি। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যালোরি নিয়ন্ত্রিত ডায়েট ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা মেনে চললে বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ধীর করা সম্ভব। তবে প্রকৃতপক্ষে বয়স পুরোপুরি কমিয়ে আনা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে এখনো কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, জিনোম সম্পাদনা এবং স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে ভবিষ্যতে এটি করা সম্ভব হতে পারে। তবে বর্তমান সময়ে এটি শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।

গবেষণা অনুযায়ী, বিভিন্ন গবেষণাগারে মলিকিউলার লেভেলে বয়স কমানোর পরীক্ষা চালানো হচ্ছে, তবে এখন পর্যন্ত মানুষের ক্ষেত্রে সফলতার হার অনেক কম। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, টেলোমেয়ার লেন্থিং এবং এপিজেনেটিক রিসেটিং-এর মাধ্যমেও বয়স কমানোর কিছু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তবে এটি এখনো তাত্ত্বিক পর্যায়ে রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ব্রায়ান জনসনের চরম স্বাস্থ্য রুটিন ব্যাপক আকারে মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে এবং তা উল্টো শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি মাত্রায় মেডিকেল ইন্টারভেনশন এবং অতিরিক্ত বায়োহ্যাকিং উল্টো শরীরের স্বাভাবিক জৈবিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।

তাছাড়া ব্রায়ান জনসন যে ধরনের জীবন যাপন করে, তা আসলে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জীবন নয়। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার আশায় যদি এ ধরনের চরম রুটিনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার আনন্দই মাটি হয়ে যাবে।

তবে ব্রায়ান জনসনই একমাত্র ব্যক্তি নন, পৃৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনী জেফ বেজোসও এমন এক প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, যাদের কাজ হল মানুষের বয়স কে থামিয়ে দেয়া। এই কম্পানির নাম অলটোস ল্যাব। অলটোস ল্যাবও মানব কোষের সহনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পুনযৌবন লাভের চেষ্টা করছে।

ব্রায়ান জনসনের প্রচেষ্টা হয়তো ভবিষ্যতে মানবদেহের বয়স বৃদ্ধির গতিকে ধীর করতে সাহায্য করতে পারে, তবে আপাতত এটিকে কেবলমাত্র একটি ব্যতিক্রমী গবেষণা হিসেবেই দেখা উচিত।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।