ট্রাম্প কি গ্রীনল্যান্ড দখল করবে

maxresdefault (63)
জীবনযাপন

ট্রাম্প কি গ্রীনল্যান্ড দখল করবে

ভূমিকা

আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প গ্রীনল্যন্ড কিনতে চাওয়ার পর থেকেই, দ্বীপটি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড কিনতে চায় কেন ?

গ্রীনল্যান্ড পরিচিতি

উত্তর আটলান্টিক ও আর্কটিক মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত একটি বিশাল দ্বীপ গ্রীনল্যান্ড। এই দ্বীপের ইনুইট আদিবাসীরা গ্রিনল্যান্ডকে ডাকে ‘কালালিত নুনাত’নামে। বরফে আচ্ছাদিত এই দ্বীপটি ডেনমার্কের অধীনে থাকা একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল।

গ্রিনল্যান্ডকেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বীপ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যদিও দ্বীপের সংজ্ঞা মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বীপ হল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া একটি মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বীপের তকমাটি অর্জন করে নিয়েছে গ্রিনল্যান্ড।

সাদা বরফে ঢাকা এই দ্বীপের নাম গ্রিনল্যান্ড হওয়ার পেছনে রয়েছে মজার এক ইতিহাস। ৯৮৫ সালে নরওয়ের এক হত্যা মামলার আসামী, ভাইকিং নাবিক এরিক দ্য রেড আইসল্যান্ড থেকে নির্বাসিত হয়ে এই দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে আকর্ষণ করে এই দ্বীপে নিয়ে আসা। সেকারণে এরিক দ্য রেড খুব চতুরভাবে দ্বীপটির নাম রাখে গ্রিনল্যান্ড। তার ধারণা ছিল, সবুজ, উর্বর ভূমি মনে হলে মানুষ এখানে বসতি স্থাপনের জন্য আগ্রহী হবে। এই কৌশল অনেকটা কাজও করেছিল। গ্রীনল্যান্ড নাম শুনেই কিছু ভাইকিং পরিবার এখানে এসে বসতিও স্থাপন করে; যদিও পরবর্তীতে তারা কঠিন জলবায়ু এবং খাদ্যসংকটের কারণে এখানে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।

গ্রীনল্যান্ডের পরিবেশ

গ্রীনল্যান্ডের আয়তন ২১ লক্ষ ৬৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আয়তনে এই দ্বীপটি বাংলাদেশের চেয়ে ১৫ গুণ বড়। তবে মজার ব্যাপার হল গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অধীনে থাকলেও, দ্বীপটি ডেনমার্কের মূল ভূখন্ডের চেয়ে ৫০ গুণ বড়। গ্রিনল্যান্ড যেহেতু একটি দ্বীপ তাই এর কোন প্রতিবেশী দেশ নেই। তবে এর সবচেয়ে নিকটবর্তী দেশ হল কানাডা।

গ্রিনল্যান্ডের ভৌগলিক অবস্থান উত্তর মেরুর কাছাকাছি হওয়ায়, এখানে সূর্যের দেখা পাওয়া সহজ নয়। প্রতিদিন মাত্র ৩ ঘন্টার সামান্য একটিু কম বা বেশি সময় গ্রিনল্যান্ডে দিন থাকে। তবে গ্রীষ্মকালে টানা দুই তিন মাস নিরবচ্ছিন্ন দিনের আলো থাকে; যাকে বলে হয় মিডনাইট সান বা নিশীথ সূর্য।

এখানকার শীতকাল বা শৈত্যপ্রবাহকাল খুব দীর্ঘ সময়ের হয়ে থাকে। শীতকালে গোটা গ্রিনল্যান্ড জুড়ে সবসময় প্রচন্ড ঠান্ড ও অন্ধকারাচ্ছন্ন এক পরিবেশ বিরাজ করে। শীত বা গ্রীষ্ম দুই ঋতুতেই এখানে বরফ পড়তে থাকে। গ্রীষ্মকালে গ্রীনল্যান্ডের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১৩/১৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌছায়। এবং শীতকালে এখানকার স্বাভাবিক তাপমাত্রা হল মাইনাস ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তবে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যেতে পারে।

গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা স্থায়ী বরফের স্তরে ঢাকা রয়েছে এবং কোন কোন যায়গায় এই বরফের পুরুত্ব ৩ কিলোমিটারেরও বেশি। গ্রিনল্যান্ডে জমে থাকা এই বরফ সমগ্র পৃথিবীর ৬.৭ শতাংশ মিঠা পানি ধারণ করে আছে। গ্রিনল্যান্ডের এই সমস্ত বরফ যদি গলে যায়, তাহলে পৃথিবীর সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ২৩ ফুট বৃদ্ধি পাবে। আমাদের পৃথিবীর সামগ্রিক তাপমাত্রা মাত্র ২ থেকে ৩ ডিগ্রী বাড়লেই, গ্রিনল্যান্ডের সমস্ত বরফ গলে যাবে। ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে গ্রিনল্যান্ডের বরফ অনবরত গলেই চলেছে।

গ্রীনল্যান্ডের জনসংখ্যা

গ্রীনল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর নুক। এটিই গ্রীনল্যান্ডের রাজধানী। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী নুক শহরের জনসংখ্যা মাত্র ১৭ হাজার ৩৬ জন। বিশাল দ্বীপের এই ছোট্ট নগরীকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট রাজধানী।

অতিরিক্ত শীতের কারণে গ্রীনল্যান্ডে বেশিরভাগ কৃজিকাজ করা হয় গ্রীনহাউজ পদ্ধতিতে। শাক সবজি উৎপাদন এবং মাছ চাষই হল গ্রিনল্যান্ডের প্রধান কৃষি। তবে অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা খাদ্য পণ্যের মাধ্যমেই মূলত এ অঞ্চলের মানুষের খাবার চাহিদা পূরণ করা হয়।

অত্যন্ত ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে এতবড় দ্বীপে মানব বসতি খুবই কম। বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ১৫ গুণ বড় হলেও, গ্রিনল্যান্ডের জনসংখ্যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় ৩ হাজার ভাগের ১ ভাগ মাত্র। সমগ্র গিনল্যান্ড জুড়ে ৫৭ হাজারেরও কম লোক বসবাস করে।

গ্রিনল্যান্ডে বসবাসকারীদের ৮৮ শতাংশই ইনুইট জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। গবেষণা থেকে জানা যায়, ইনুইটরা সর্বপ্রথম গ্রীনল্যান্ডে প্রবেশ করে খ্রীস্টপূর্ব ২ হাজার ৫০০ সালে। তারও বহু বছর পর ইউরোপিয়ানরা এখানে বসবাস করতে আসে। ইউরোপীয়ানদের মধ্যে নরওয়েজিয়ান ও আইসল্যান্ডের বাসিন্দারা গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে বসবাস করত। তাই গ্রীনল্যান্ডের অনেক বাসিন্দা নরওয়েজিয়ান গ্রীনল্যান্ডারস নামে পরিচিত।

ট্রাম্পের গ্রীনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব

১৩ শতাব্দীর শুরুর দিকে নরওয়ে গ্রিনল্যান্ড দখল করে। সেসময় নরওয়ের সাথে চুক্তি করে ডেনমার্কও গ্রিনল্যান্ডের উপর অধিকার ফলাতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে, গ্রিনল্যান্ডকে কিংডম অব ডেনমার্কের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৯ সালে ডেনমার্ক পার্লামেন্ট গ্রীনল্যান্ড দ্বীপকে পূর্ণ শাসন করার অনুমতি দেয়। তবে ২০০৮ সালের এক গণভোটে গ্রীনল্যান্ড স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলনে জয়ী হয় এবং ২০০৯ সালে গ্রীনল্যান্ডবাসীরা নিজেদের সরকার গঠন করে। বর্তমানে গ্রীনল্যান্ডের নিজস্ব প্রধানমন্ত্রী থাকলেও, এখনও পর্যন্ত রাজ্যটির হেড অব স্টেট এর দ্বায়িত্ব পালন করছেন ডেনমার্কের রাজা দশম ফ্রেডরিক।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবার পর, ২০১৯ সালে  গ্রিনল্যান্ড দ্বীপটি কেনার আগ্রহ পোষণ করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেসময় গ্রিনল্যান্ডের মালিক দেশ ডেনমার্কের কাছে, প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপনের আগেই ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেট ফ্রেডেরিকসেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই আগ্রহ কে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছিলেন। তখন থেকেই গ্রীনল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে আসছে, দ্বীপটি ব্যবসা করার জন্য উন্মুক্ত, তবে বিক্রির জন্য নয়।

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর, ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারো গ্রিনল্যান্ড কেনার জোড়ালো প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এবার ট্রাম্প সরাসরি ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের সাথে ফোনালাপে গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেন। ডেনমার্ক যদিও গ্রিনল্যান্ড বিক্রি করতে চায় না; তবুও তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক চাপের ভয়ে, এ বিষয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। সাম্প্রতিক আরেক প্রশ্নোত্তর পর্বে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, গ্রীনল্যান্ডের বাসিন্দারাও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকতে চায়।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রিনল্যান্ড কিনতে চাওয়া ট্রাম্পই প্রথম ব্যক্তি নন। ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ১০ কোটি ডলারে গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তারও আগে অন্য দেশের কাছ থেকে পুরো রাজ্য কিনে নেওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে যুক্তরাষ্ট্রের। ১৮০৩ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে লুইজিয়ানা এবং ১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা রাজ্য কিনেছিল মার্কিনীরা।

গ্রীনল্যান্ড কেন গুরুত্বপূর্ণ

উপর থেকে দেখতে গ্রিনল্যান্ড কে বরফে ঢাকা একটি বিরান ভূমি মনে হলেও; বিস্তৃর্ণ এই বরফের নিচে রয়েছে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। বেশ কিছু দুর্লভ ও মূল্যবান খনিজ সম্পদ, বিশুদ্ধ পানি ও বরফ, মাছের মজুদ, সামুদ্রিক খাবার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আকরিক লোহা, সিসা, দস্তা, হিরা, সোনা, ইউরেনিয়াম এবং তেল গ্যাস সহ নানা মূল্যবান সম্পদে ভরপুর গ্রিনল্যান্ড। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের কারণেই, যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপটি কেনার বিষয়ে উঠেপড়ে লেগেছে।

প্রাকৃতিক সম্পদের পর গ্রিনল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল দ্বীপটির কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থান। আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলতে থাকার কারণে, রাশিয়া বেশ কয়েক বছর যাবতই এই অঞ্চলের সমুদ্রপথের কার্যকর ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রও এখানে তারদের উপস্থিতি জানান দিতে চায়। যদিও থুলে এয়ার বেস নামে একটি মার্কিন বিমান ঘাঁটি ১৯৪৩ সাল থেকেই গ্রীনল্যান্ডে রয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত এই বিমান ঘাঁটি ন্যাটো জোটের অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থুলে এয়ার বেস কে পিটুফিক মহাকাশ ঘাঁিটতে পরিণত করেছে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের Space Force বা মহাকাশ বাহিনীর অধীনে এই মহাকাশ প্রতিরক্ষা স্থাপনাটি পরিচালিত হচ্ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে গ্রিনল্যান্ডের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে; আর সেই সাথে উন্মুক্ত হচ্ছে সম্ভাব্য খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য। নাসার বিজ্ঞানীরা বিগত কয়েক বছরের গ্রীষ্ম মৌসুমে গ্রিনল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বড় বরফ গলার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। দ্বীপটির বরফ গলার ফলে ভবিষ্যতে ভূমি ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অপার সম্ভাবনাও উন্মোচিত হবে।  

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।