নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা ভেঙে যায় কেন

maxresdefault (59)
জীবনযাপন

নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা ভেঙে যায় কেন

সূচনা

নতুন বছরের শুরুতেই আমরা নতুন করে জীবন সাজানোর প্রতিজ্ঞা করি। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, আর্থিক সঞ্চয়, সম্পর্কের উন্নতি কিংবা ধূমপানের মতো আসক্তি দূর করার মত নানা বিষয় নিয়ে আমরা আশাবাদী হয়ে উঠি।

নতুন বছরের শুরুতে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য প্রতিজ্ঞা করাটা New Year’s Resolutions নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হলো, গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা জানুয়ারি মাস শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে যায়।

নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা ভেঙে যায় কেন ?

নিউ ইয়ার রেজোলিউশন

New Year’s resolutions বা নতুন বছরে নতুন প্রতিজ্ঞার ধারণা কিন্তু একেবারে নতুন বিষয় নয়। বিশ্বের প্রথম লিখিত রেজোলিউশন পাওয়া যায় আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে। তৎকালীন প্রাচীন বাবিলিয়ান সভ্যতার লোকেরা, নতুন বছরে তাদের ফসল কাটা উৎসব, দেবতাদের প্রতি নতুন প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে শুরু করত। তাদের অন্যতম জনপ্রিয় প্রতিজ্ঞা ছিল ঋণ শোধ করা এবং ধার করা জিনিস ফেরত দেয়া।

প্রাচীন রোমানরা তাদের দেবতা জ্যানুস-এর প্রতি সম্মান জানিয়ে নতুন বছরের পরিকল্পনা করত। জ্যানুস ছিল দুই-মুখওয়ালা দেবতা, যে অতীত এবং ভবিষ্যৎ একসঙ্গে দেখতে পারত। এই রোমান দেবতা জ্যানুস এর নাম থেকেই জানুয়ারি মাসের নামটি এসেছে।

প্রায় প্রতি বছর জনপ্রিয় রেজোলিউশনের তালিকায় থাকা প্রথম তিনটি প্রতিজ্ঞা হল: ওজন কমানো, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, এবং অর্থ সঞ্চয় করা। মজার ব্যাপার হলো, এগুলোই সবচেয়ে দ্রুত ভঙ্গ হয়! গবেষণায় দেখা গেছে, যারা রেজোলিউশন গ্রহণ করে, তাদের মধ্যে ৮০% মানুষ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তা ছেড়ে দেয়।

পুরুষেরা রেজোলিউশন নিয়ে মহিলাদের তুলনায় কম সিরিয়াস। তবে পুরুষরা যদি এ ব্যাপারে অন্যকারো সাথে প্রতিযোগিতা করে, সেক্ষেত্রে পুরুষদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল শিশু-কিশোররা রেজোলিউশন ধরে রাখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সফল। কারণ তারা ছোট লক্ষ্য ঠিক করে এবং তা অনুসরণ করতে বেশি আগ্রহী থাকে।

প্রতিজ্ঞা ভাঙে কেন

নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা বা রেজোলিউশন অনেকেই নেয়, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এর মূল কারণগুলো হলো: ১. অবাস্তব লক্ষ্য নির্ধারণ ২. পরিকল্পনার অভাব ৩. অভ্যাস তৈরির জটিলতা ৪. আগ্রহের ক্ষয় ৫. পরিবর্তনের ভয় ৬. ফলাফলের অভাবে হতাশা এবং ৭. পর্যাপ্ত সমর্থনের অভাব।

নতুন বছরের শুরুতে মানুষ উদ্দীপিত থাকে। নতুন কিছু শুরু করার প্রতি একটি প্রাথমিক উত্তেজনা কাজ করে, যাকে “হানিমুন পিরিয়ড” বলা হয়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর সেই উদ্দীপনা কমে যায় এবং অভ্যাস ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ইচ্ছাশক্তি আর কাজ করে না। একটি নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে ধৈর্য এবং ধারাবাহিকতার প্রয়োজন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ দীর্ঘমেয়াদে ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না।

অনেকেই বড়, অবাস্তব এবং অস্পষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে। যেমন, “আমি স্বাস্থ্যবান হব” বা “আমি ভালো ছাত্র হব”। কিন্তু এর জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ থাকে না। যখন লক্ষ্য খুব বড় মনে হয়, তখন তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে এবং মানুষ চেষ্টা বন্ধ করে দেয়। সেকারণে লক্ষ্য গুলো স্পষ্ট হতে হবে; যেমন: “আমি তিন মাসে ১০ কেজি ওজন কমাব” বা “প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা পড়াশোনা করব।”

শুধু ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অভ্যাস ধরে রাখা সম্ভব নয়। অভ্যাস তৈরি করতে সিস্টেম বা একটি পরিবেশ তৈরি করতে হয় যা অভ্যাসকে সহজ এবং স্বাভাবিক করে তোলে। ইচ্ছাশক্তি যখন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তখন অভ্যাসও হারিয়ে যায়।

নতুন অভ্যাস মানে পুরনো রুটিন পরিবর্তন করা। কিন্তু মানুষের মন অজান্তেই পরিবর্তনকে প্রতিরোধ করে। যখন নতুন অভ্যাস পুরনো স্বভাবের সঙ্গে সংঘর্ষ তৈরী করে, তখন তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন আপনার হয়ত প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে শুয়ে শুয়ে ফেসবুক চালাতে ভালো লাগে; এর বিপরীতে ঘুমানোর আগে প্রতিরাতে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা আপনার জন্য অনেক কঠিন বিষয়।

মানুষ দ্রুত ফলাফল আশা করে। কিন্তু বাস্তবে অভ্যাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে দেখা যায়। কয়েকদিন বা সপ্তাহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না দেখলে মানুষ হতাশ হয়ে পরিকল্পনা ছেড়ে দেয়। তাছাড়া একটি নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে এমন একটি পরিবেশ দরকার যা সেই অভ্যাসকে সমর্থন করে। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ মানুষ এমন পরিবেশে থাকে যেখানে নতুন অভ্যাস গড়ে তোলার সুযোগ অনেক কম। সেই সাথে পরিবার বা বন্ধুদের সহযোগিতা এবং ইতিবাচক পরিবেশের অভাবও প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

সমাধান কী

নতুন বছরের পরিকল্পনা দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে, বেশ কিছু বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। যেমন: ১. ছোট ছোট অভ্যাস তৈরী ২. সহজ লক্ষ্য নির্ধারণ ৩. ধারাবাহিকতা বজায় ৪. পরিচয় বদলানো ৫. পরিবেশ বদলানো এবং ৬. নিজেকে পুরষ্কৃত করা।

আমরা যখন বড় কোন লক্ষ্য নির্ধারণ করি, তখন তা বাস্তবায়ন করার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। বড় লক্ষ্য না রেখে দৈনন্দিন ছোট পদক্ষেপগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। জাপানিজরা উন্নত জীবন অর্জনের জন্য কাইজেন নামে একটি দর্শন চর্চা করে। এটি এমন একটি উপায়, যার মাধ্যমে আপনি প্রতিদিন মাত্র ১% উন্নতি করলে, বছর েশষে আপনার কমপক্ষে ৩৭ গুণ উন্নতি হবে। এটি “Compound Effect” বা “1% Rule” নামেও পরিচিত।

প্রতিজ্ঞা করার সময় আমরা প্রায়ই ভাবি, “আমি এটা করব,” কিন্তু কীভাবে তা করব, তার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করি না। পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিজ্ঞা কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য শুধু ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করা ভুল।

ইচ্ছাশক্তি সময়ের সঙ্গে কমে যেতে পারে। তাই এটি ধরে রাখতে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা দরকার, যা নতুন অভ্যাসকে সমর্থন করে। নতুন অভ্যাস মানে পুরনো অভ্যাস পরিবর্তন। কিন্তু আমাদের মন প্রায়ই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে নিজের কাছে আপনার পরিচয় পরিবর্তন করাটাও হতে পারে কার্যকরী সমাধান। উদাহরণস্বরূপ, “আমি ধুমপান ছেড়ে দেব” বলার চেয়ে “আমি ধুমপান করি না” বলে নিজেকে পরিচিত করা বেশি কার্যকর।

নতুন অভ্যাস বা লক্ষ্য অর্জন করতে সময় এবং ধৈর্য দরকার। অনেকেই দ্রুত ফলাফল আশা করে, যা না পেলে হতাশ হয়ে প্রতিজ্ঞা ছেড়ে দেয়। নতুন প্রতিজ্ঞা মানে জীবনে নতুন কিছু আনতে হবে, যা অনেকের জন্য কঠিন মনে হয়। পরিবার বা বন্ধুদের সহযোগিতা এবং ইতিবাচক পরিবেশের অভাবও প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

নতুন বছরের রেজোলিউশন সাধারণত ব্যর্থ হয় কারণ এগুলোর পেছনে মানুষের গভীর উদ্দেশ্য বা ব্যক্তিগত মূল্যবোধ জড়িত থাকে না। যেকোনো বড় লক্ষ্য পূরণের জন্য আমাদের ‘কেন’ (Why) স্পষ্ট থাকা উচিত। আমি কেন আমার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চাই, তার যদি সুনির্দিষ্ট এবং সঠিক উত্তর আমার কাছে না থাকে, তাহলে যে কোন ধরনের আত্ন-উন্নয়নের প্রতিজ্ঞা অবশ্যই ব্যার্থ হবে।

সবমিলিয়ে নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নের জন্য বেশ কয়েকটি মূল বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, যেমন বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করা, জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন আনা এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।

নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা

নতুন বছরে নিজেকে পরিবর্তন করার মতো সাধারণ কিছু বিষয় আমরা গ্রহণ করতে পারি। যেমন:

১. আলসেমি ত্যাগ করা – প্রয়োজনীয় কাজ সময়মতো না করে পরে করার প্রবণতা ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করে।

২. অপর্যাপ্ত ঘুম – রাতে দেরি করে ঘুমানো এবং পর্যাপ্ত সময় না ঘুমানো মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

৩. অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার – সোশ্যাল মিডিয়ায় অযথা সময় নষ্ট করা প্রোডাকটিভিটি এবং মানসিক স্থিতিশীলতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।

৪. নিজেকে সময় না দেওয়া – নিজের মানসিক ও শারীরিক চাহিদাকে ভালোভাবে বোঝা কিংবা নিজেকে উন্নত ব্যক্তিতে পরিণত করতে নিজেকে সময় দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৫. নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ত্যাগ করা – নিজের এবং আশপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সবসময় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা, ব্যক্তিত্ব এবং সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৬. পরিকল্পনা ছাড়া দিন শুরু করা – দিনের কাজের জন্য পরিকল্পনা না করা বা অগোছালো জীবনযাপন সময় এবং প্রোডাকটিভিটি নষ্ট করে।

৭. অন্যদের তুলনায় নিজেকে বিচার করা – নিজের সাফল্য বা জীবনকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করার অভ্যাস, আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে এবং অযথা মানসিক চাপ তৈরি করে।

৮. সিগারেট, অ্যালকোহল বা অন্যান্য আসক্তি ত্যাগ করা – তামাক, অ্যালকোহল বা পর্নোগ্রাফির মত অন্য কোনো ক্ষতিকারক আসক্তির প্রতি নির্ভরশীলতা, শারিরীক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

সাধারণভাবে এই বিষয়গুলো আমাদের জীবন থেকে বাদ দিলে, আমরা নতুন বছরে আরো সুন্দর একটি জীবন লাভ করতে পারি।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।