পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত উত্তেজনা

mqdefault_custom_2
জীবনযাপন

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত উত্তেজনা

ভূমিকা

পাকিস্তান ২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর রাতে, আফগানিস্তানের কাবুল ও পাকতিকা প্রদেশে বিমান হামলা শুরু করে। এই হামলার পর আফগান তালেবান বাহিনীও পাকিস্তানের সীমান্ত চৌকিগুলোতে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এরপরই শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরের সবচেয়ে তীব্র সংঘর্ষ, যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোলাগুলিতে উভয় পক্ষের প্রাণহানি ঘটে।

পাকিস্তানের দাবি, তারা আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করেছে এবং আফগান ভূমি ব্যবহার করে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি জঙ্গিদের হামলার জবাব দিয়েছে। অপরদিকে তালেবান প্রশাসনের অভিযোগ, পাকিস্তানই আগে তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে হামলা চালিয়েছে, যার প্রতিশোধেই আফগান বাহিনী পাল্টা অভিযান চালায়।

এই হামলা-পাল্টা হামলার পেছনে রয়েছে বহু বছরের সীমান্ত বিরোধ, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং সশস্ত্র বাহিনী সংক্রান্ত নিরাপত্তা ইস্যু। ফলে সাম্প্রতিক এই সংঘর্ষ কেবল একটি সীমান্ত লড়াই নয়; এটি দুই প্রতিবেশীর দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সামরিক টানাপোড়েনের সর্বশেষ রূপ।

পাকিস্তান-আফগানিস্তান উত্তেজনার কারণ কী ?

দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি বিরোধ

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার সীমান্তের আনুষ্ঠানিক নাম ডুরান্ড লাইন। ১৮৯৩ সালে দুই দেশের মধ্যে নির্ধারিত এই সীমানাকে আফগানিস্তান কখনো আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, কারণ এতে পশতুন জনগোষ্ঠী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসালেও তালেবান বারবার সেই বেড়া কেটে ফেলেছে।

নিরাপত্তা ইস্যুতেও দুই দেশের সম্পর্ক টানটান। পাকিস্তান অভিযোগ করছে, আফগান মাটিতে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী আশ্রয় পাচ্ছে এবং সেখান থেকেই তারা পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর এসব হামলায় দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। তালেবান অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

অন্যদিকে শরণার্থী ইস্যুতেও দুদেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। দীর্ঘদিন পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৩০ লাখ আফগানের মধ্যে যাদের কাগজপত্র নেই, তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করছে ইসলামাবাদ। এতে কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। উপরন্তু সীমান্ত বন্ধ ও বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় আফগানিস্তান অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে, যা দুই দেশের অবিশ্বাসকে আরও গভীর করেছে।

সাম্প্রতিক উত্তেজনার কারণ

সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ দেখা যায়; ১. সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ে বিরোধ, ২. সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে অনুপ্রবেশ, এবং ৩. উভয় দেশের কড়া রাজনৈতিক বক্তব্য।

প্রথমত, ডুরান্ড লাইনের বৈধতা নিয়ে মতভেদের কারণে সীমান্তে নতুন চৌকি বা বেড়া নির্মাণ নিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষ তৈরী হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চমন সীমান্তে আফগান বাহিনী নতুন তল্লাশি চৌকি গড়তে গেলে পাকিস্তানি রেঞ্জাররা বাধা দেয়, তার পরক্ষণেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। একইভাবে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তোর্খম সীমান্তেও চৌকি মেরামত নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয় এবং সীমান্ত বন্ধ হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান সম্প্রতি টিটিপি সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সীমান্তের ওপাড়ে বিমান হামলা বাড়িয়েছে, যা আফগানিস্তান তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে মনে করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা বড় ধরনের সংঘর্ষও এরকমই এক পাকিস্তানি বিমান হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ঘটেছে বলে তালেবানরা দাবি করছে।

তৃতীয়ত, দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা একে অপরকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করছেন। পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দিয়েছে “ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে,” আর আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পাল্টা বলেছে “আরও কঠোর জবাব” আসবে। এমন পাল্টা-পাল্টি বক্তব্যের ফলে সীমান্ত সংকটের সমাধান আরো কঠিন হয়ে পড়ছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলেছে, “আফগান ভূমি থেকে সন্ত্রাসবাদ চলতে থাকলে পাকিস্তান চুপ থাকবে না।” অন্যদিকে, আফগান তালেবান সরকারের মতে, পাকিস্তান নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যর্থতার দায় আফগানিস্তানের উপর চাপাচ্ছে।

সাম্প্রতিক ঘটনার বর্ণনা

গত ৯ অক্টোবর, আফগানিস্তানের কাবুল ও পাকতিকা প্রদেশে বিস্ফোরণ ঘটে। তালেবান সরকার একে পাকিস্তানি বিমান হামলা বলে অভিযোগ করে। ইসলামাবাদ তা স্বীকার না করলেও, তাদের নিরাপত্তা সূত্র জানায় এই হামলার লক্ষ্য ছিল তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেসউদ। এর প্রতিশোধ হিসেবেই আফগান বাহিনী সীমান্তে হামলা চালায় বলে দাবি করে কাবুল। ঘটনার পর পাকিস্তান তোর্খম, চমনসহ সব সীমান্ত পথ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়।

তার দুদিন পর, ১১ অক্টোবর রাতে আফগান তালেবান বাহিনী একযোগে পাকিস্তানের বাজৌর, কুররম, দির, চিত্রল, বেলুচিস্তানের আঙ্গুর আড্ডা ও বহরাম চাহ সীমান্ত পোস্টে আকস্মিক হামলা চালায়। মুহূর্তেই তারা কয়েকটি পাকিস্তানি সামরিক চৌকি দখল করে নেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোলাগুলি চলে, যা পরদিন সকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। পাকিস্তানি সেনারা ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে পাল্টা আক্রমণ চালায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফেরার পর এটিই দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সংঘর্ষ।

এই সীমান্ত সংঘর্ষে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয় পক্ষেই প্রাণহানি ঘটেছে। উভয় দেশই অপরপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা বাড়িয়ে বলছে। পাকিস্তান দাবি করেছে প্রায় ২০০ জন তালেবানকে হত্যা করেছে; আর তালেবান বলছে তারা পাকিস্তানের ৫৮ জন সেনাকে হত্যা করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানা যায় পাকিস্তানের ২৩ জন সেনা নিহত ও ২৯ জন আহত হয়েছে, আর আফগানের ৯ জন যোদ্ধা মারা গেছে।

দুই দেশের সীমান্ত সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনা এটিই প্রথম নয়। অতীতে ২০২২ এবং ২০২৩ সালেও সীমান্তে গোলাবর্ষণে বেশ কয়েকজন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হয়েছিল।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তান–আফগানিস্তান সীমান্তে সাম্প্রতিক সংঘর্ষ দক্ষিণ এশিয়া ও আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি করেছে। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো দ্রুত সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। ইরান বলেছে, উভয় পক্ষের শান্ত থাকা জরুরি; সৌদি আরব ও কাতারও সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের তাগিদ দিয়েছে এবং মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। এসব দেশ তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখলেও ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে।

ভারত পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সেই সাথে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির দিল্লি সফর পাকিস্তানের জন্য বাড়তি অস্বস্তি তৈরী করেছে। সংঘর্ষ চলাকালে মুত্তাকি ভারতে বসেই দাবি করেন যে “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে” আছে এবং সৌদি–কাতার মধ্যস্থতায় আলোচনা চলছে। পাকিস্তান প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছে, আফগান-ভারত ঘনিষ্ঠতাই তাদের জন্য নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।

আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘ উভয় দেশকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে পাকিস্তানের অভিযোগকে আংশিকভাবে সমর্থন করে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে টিটিপি জঙ্গিরা আশ্রয় নিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে পাকিস্তানের কার্যক্রমকে সমর্থন দিচ্ছে এবং তালেবানকে হুশিয়ারী দিচ্ছে। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়াও চেষ্টা করছে যেন এই অঞ্চলে সংঘাত বৃদ্ধি না পায়। কারণ এতে তাদের বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

সব মিলিয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো এখন পারস্পরিক অভিযোগ পেরিয়ে আলোচনায় বসার প্রতি জোড় দিচ্ছে। এতে শুধু দুই দেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাও বজায় থাকবে।

পাকিস্তান মূলত তাদের পারমানবিক অস্ত্র তৈরীর পর থেকে এই অঞ্চলে বিশেষ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে আছে। পাকিস্তানের মানুষ যখন দুবেলা দুমুঠো খেতে পারত না, সেই সময় তারা পারমানবিক অস্ত্র তৈরীর মত বিলাসিতা করেছিল। যদিও সেই প্রচেষ্টার কারণেই আজ পাকিস্তান শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক দেশে পরিণত হতে পেরেছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।