যে ভুলে মুরগীর ইতিহাস বদলে গেল!
যে ভুলে মুরগীর ইতিহাস বদলে গেল!
ভূমিকা
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি খাদ্য মুরগির মাংস। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে মুরগি পাওয়া যায়। মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য প্রতি সেকেন্ডে প্রায় দুই হাজার মুরগি জবাই করা হচ্ছে; প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫ থেকে ১৭ কোটি মুরগি মানুষের খাদ্যে পরিণত হয়। এবং মানুষের খাওয়ার জন্য বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি মুরগির দরকার হয়।
এসব পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় বিশ্বব্যাপী মুরগি কতটা জনপ্রিয় খাবার। কিন্তু মানুষের জনপ্রিয় খাবার হতে গিয়ে মুরগিকে অত্যন্ত কষ্টকর এবং সংক্ষিপ্ত একটি জীবন অতিবাহিত করতে হয়।
মুরগির ইতিহাস
সারা বিশ্বব্যাপী মুরগি ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও; সর্বপ্রথম মুরগির উৎপত্তি হয়েছিল আমাদের এই অঞ্চলেই। গবেষকরা ধারণা করেন, ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীনের এলাকাগুলোতে আজ থেকে প্রায় দশ হাজার ৫০০ বছর আগে বন্য পরিবেশে মুরগি বিচরণ করত। এরপর প্রায় আট হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম বন্য পরিবেশ থেকে মুরগিকে গৃহস্থালির প্রাণী হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করে। মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের Red Junglefowl নামে পরিচিত এক প্রজাতি থেকে আধুনিক মুরগির উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
প্রথমে মানুষেরা বুনো মুরগি শিকার করত এবং তাদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত। সময়ের সাথে সাথে মানুষ বুঝতে পারে যে এই প্রাণীগুলোকে গৃহস্থালির আশেপাশে রাখা সম্ভব এবং সেখান থেকে নিয়মিত ডিম ও মাংস পাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে বুনো মুরগিরাও সহজে খাবার পাবার আশায় মানুষ-অধ্যুষিত গ্রাম বা বসতিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। এভাবেই মুরগি ও মানুষ ধীরে ধীরে কাছাকাছি আসতে শুরু করে।
গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে মুরগি বংশবৃদ্ধি করতে করতে; হাজার বছরের ব্যবধানে গৃহপালিত মুরগির মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য বিকশিত হতে শুরু করে। এর ফলে একসময় বুনো প্রজাতির মুরগির সাথে গৃহপালিত মুরগির বেশকিছু পার্থক্য দেখা দেয়। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ১ হাজার ৬০০ টিরও বেশি প্রজাতির মুরগি রয়েছে। শত শত বছর ধরে প্রাকৃতিকভাবে এবং মানুষ কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে এসব মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছে।
প্রথমদিকে মুরগি মানুষের গ্রামের বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াতো এবং নিজে থেকেই খাবার খুঁজে খেত। মধ্যযুগের পর থেকে মানুষ মুরগি পালনকে একটি নিয়মিত ব্যবসায়িক চাষাবাদ হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করে। ১৮০০ সালের দিকে শিল্প বিপ্লবের সময় মানুষ বাণিজ্যিকভাবে বৃহৎ পরিসরে মুরগি চাষ শুরু করে। এসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে মুরগির দ্রুত বৃদ্ধি এবং ডিম উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। সেই সাথে মুরগির খাবার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং প্রজনন ব্যবস্থারও উন্নয়ন করা হয়।
ব্রয়লার মুরগির উত্থান
বুনো পরিবেশ থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনের যাত্রা পর্যন্ত বহুপথ অতিক্রম করলেও, তখনও পর্যন্ত মুরগি বিশ্বব্যাপী এতটা জনপ্রিয় খাবারে পরিণত হয়নি। কারণ অতীতে মানুষ শুধুমাত্র ডিম উৎপাদনের জন্য মুরগি পালন করত; এবং কালে ভদ্রে মাংস খাওয়ার জন্য মুরগি জবাই করত। মুরগির মাংস মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এসেছে অনেক পরে। মূলত মানুষের দুইটি ভুলের কারণে মুরগির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যায়।
বিংশ শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ডেলাওয়্যার প্রজাতির মুরগির সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল। এরা খুব ধীর গতিতে বৃদ্ধি পেত; এবং এদের প্রধানত ডিম উৎপাদনের জন্য চাষ করা হতো। কিন্তু একটা সময় মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিজ্ঞানীরা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এমন প্রজাতি তৈরির চেষ্টা করছিলেন।
একবার একটি ব্রিডিং প্রোগ্রামে ভুলবশতঃ ক্রস-ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে এক বিশেষ ধরনের মুরগি তৈরি হয়, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। এই মুরগিগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেত এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বড় ও ভারী হয়ে উঠত। এটিই হল বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রয়লার (Broiler) মুরগির সূচনা। আমেরিকার হোয়াইট কর্নিশ এবং প্লিমাউথ রক জাতের মুরগির সঙ্কর ঘটিয়ে ব্রয়লার মুরগি উদ্ভাবন করা হয়েছিল।
অল্প সময়ে মাংস উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত হওয়ায় ব্রয়লার মুরগির জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এই ধরনের মুরগি মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাজারজাত করার উপযোগী হয়ে ওঠে। ফলে, ফাস্ট ফুড ইন্ডাস্ট্রি এবং অন্যান্য খাবার সরবরাহ চেইনগুলোতে এর চাহিদা বেড়ে যায়। ব্রয়লার মুরগির এই বৈশিষ্ট্য বানিজ্যিক উৎপাদনের জন্য আদর্শ হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় খামার গড়ে ওঠে, যেখানে একসাথে লক্ষ লক্ষ ব্রয়লার মুরগি পালন করা শুরু হয়।
মুরগির বানিজ্যিকীকরণ
ব্রয়লার মুরগির দ্রুত উৎপাদন এবং বিপুল মাংস সরবরাহের ক্ষমতা ফাস্ট ফুড শিল্পে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। তবে ব্রয়লার মুরগির বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল আরেকটি ভুলের কারণে।
আমেরিকার ডেলাওয়্যার অঙ্গরাজ্যের একটি গ্রামে সিসিলি লং স্টিল নামের এক গৃহবধু তার পরিবারের বাড়তি উপার্জনের জন্য মুরগি পালন করতেন। সিসিলি ১৯২৩ সালে ডেলাওয়্যারের ড্যাগসবরো শহরের মুরগি বিক্রেতা জনাব ভার্নন স্টিনের কাছে ৫০ টি মুরগি কেনার জন্য চিঠি লেখে। গৃহবধূ সিসিলির পরিকল্পনা ছিল আগামী এক বছরে সে ওই ৫০ টি মুরগি লালন পালন করবে। কিন্তু ভার্নন স্টিন ভুল করে ৫০ টির জায়গায় ৫০০ টি মুরগি পাঠিয়ে দেয়। সিসিলি এতগুলো মুরগি দেখে অত্যন্ত রেগে যায়। কারণ তার ছোট্ট বাড়ির চারপাশ মুরগিতে গিজ গিজ করছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তার মনে এক জেদ চেপে বসে; সে বাড়তি মুরগিগুলো ফেরত না দিয়ে সবগুলো মুরগি পালার সিদ্ধান্ত নেয়। গৃহবধু সিসিলির সেই সিদ্ধান্ত পৃথিবীতে মুরগির ইতিহাসই চিরতরে বদলে দেয়।
সিসিলি ১৮ সপ্তাহ ধরে মুরগিগুলো পরিচর্যা করে। ৫০০ টির মধ্যে ১১৩ টি মুরগি বিভিন্ন সময় মারা যায়। সিসিলি বাকি ৩৮৭ টি মুরগি জবাই করে মাংস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। সেবার ব্যবসা করে সিসিলির প্রচুর মুনাফা হয়; ফলে পরের বছর সে ১ হাজার মুরগি পালতে শুরু করে। তার ব্যবসা এতটাই ফুঁলে ফেঁপে ওঠে যে, ১৯২৮ সালের মধ্যে সিসিলি একসাথে প্রায় ৩০ হাজার মুরগি পালন করার সক্ষমতা অর্জন করে। সেকারণে সিসিলিকে বলা হয় আধুনিক মুরগি শিল্পের জনক।
সিসিলির এই সাফল্যে অনুপ্রানিত হয়ে, প্রথমে তার প্রতিবেশীরা এরপর ক্রমান্বয়ে সমগ্র ডেলাওয়্যারের কৃষকরা মুরগি পালন শুরু করে। ১৯২৮ সালে শুধুমাত্র সিসিলির এলাকাতেই প্রায় ৫০০টি মুরগির খামার গড়ে উঠেছিল। তার কিছু দিন পরে ভিটামিন এ এবং ডি আবিষ্কার হওয়ার ফলে, মুরগির মৃত্যুর হারও অনেক কমে যায়। এবং সেইসাথে ইনকিউবেটরের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে ডিম থেকে মুরগি বাচ্চা ফুটানোর পদ্ধতির আবিষ্কৃত হওয়ার পর, ব্রয়লার মুরগি সারা বিশ্বের দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে।
সোনালী মুরগির ইতিহাস
বিশ্বায়নের ধারায় ১৯৫৪ সাল থেকেই বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পোল্ট্রি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তবে ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের পোল্ট্রি খুব একটা অগ্রগতি দেখেনি। ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে মাংস উৎপাদনের জন্য ব্রয়লার মুরগি এবং ডিম উৎপাদনের জন্য লেয়ার মুরগি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে বাংলাদেশের মাংসের বাজারে আরেকটি মুরগি খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যা পাকিস্তানী কক হিসেবে পরিচিত। পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অবশ্য একে সোনালী মুরগি নামে ডাকে। অনেকটা দেশী মুরগির মতো স্বাদ এবং বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই মুরগি বাংলাদেশের বাজারে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষক ডাঃ আব্দুল জলিল আম্বর ১৯৮৭ সালে দেশের আমিষের চাহিদা মেটাতে ও দেশী মুরগির মাংসের স্বাদ ফিরিয়ে আনতে সোনালী মুরগি উদ্ভাবন করেছিলেন। পরবর্তিতে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জনাব শাহ জামালের তত্বাবধানে জাতটি আরো উন্নত করা হয়।
আমেরিকার রোড আইল্যান্ড রেড এবং মিশরের ফাউমি জাতের মুরগির সঙ্কর ঘটিয়ে সোনালী মুরগির জাত উদ্ভাবন করা হয়েছিল। অতীতে রোড আইল্যান্ড মুরগির জাতটি মালয়েশিয়া অঞ্চল থেকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এবং ফাউমি মুরগি প্রায় কয়েকশত বছর ধরে মিশরের নীল নদ ও তার আশেপাশের অঞ্চলে চাষ করা হত। সোনালী মুরগির জাত উন্নতকরণের গবেষণার সময়, কিছু নমুনা মিশরের বদলে, পাকিস্তান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। আর সেকারণেই সোনালী মুরগির পিতা-মাতা যথাক্রমে আমেরিকান এবং মিশরীয় হওয়া সত্তেও এরা পাকিস্তানী মুরগি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
আধুনিক মুরগি শিল্প
অতীতে মানুষ মূলত গরু, ছাগল, ভেড়া এবং শুকরের মাংস বেশি খেত। মুরগির মাংস সেই তুলনায় খুব কমই খাওয়া হত। তবে কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং, পোপাইস এর মত বিশ্বের বড় বড় ফাস্ট ফুড চেইনগুলো মুরগির মাংস দিয়ে তৈরী বেশ কিছু খাবার জনপ্রিয় করে তোলার পর থেকে; সারা বিশ্বে মুরগির মাংস মহামারির মত ছড়িয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের কোন কোন দেশে মুরগির মাংসের চাহিদা প্রায় ২০০% পর্যন্ত বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই সাথে পাল্লা দিয়ে প্রানী হিসেবে মুরগির দুর্ভোগও বেড়েছে অনেক। অতীতে একটি মুরগি প্রকৃতিতে কয়েক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারত। কিন্তু বর্তমান বানিজ্যিক পদ্ধতিতে চাষ করা মুরগির গড়ে মাত্র ৪২ দিন বাঁচে। তাদের এই স্বল্পস্থায়ী জীবনও কাটে অত্যন্ত কষ্টে। কারণ মুরগির সাথে এখন আর কোন প্রানী হিসেবে নয়, বরং মেশিনে উৎপাদিত পণ্যের মত আচরণ করা হয়।
বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত বেশ কয়েক প্রজাতির মুরগির প্রতিদিন প্রায় ৫০ গ্রাম করে ওজন বাড়ে। কিন্তু সেই সাথে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং পা গুলো শক্তপোক্ত ভাবে গড়ে ওঠে না। যার কারণে এসব মুরগি নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতায় ভোগে। বাজার থেকে আমরা যেসব মুরগি কিনে খাই এদেরকে দেখতে শারীরিকভাবে বেশ বড়সড় মনে হলে প্রকৃতপক্ষে এরা আসলে শিশু।
অতীতে ম্যাকডোনাল্ডস অন্ধকারে মুরগি চাষ করতো; কারণ অন্ধকারে চাষ করা মুরগিগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে জবাই করার মত ওজন অর্জন করতো। সেই মুরগিগুলো তাদের জীবদ্দশায় কখনো সূর্যের আলোই দেখেনি। এমনিতেও সারা পৃথিবীতে যেসব মুরগি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়, এরা মাত্র ১০ বর্গ ইঞ্চি জায়গার মধ্যে তাদের পুরো জীবনটা কাটিয়ে দেয়। সত্যিকার অর্থে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা অধিকাংশ মুরগি শারীরিকভাবে অত্যন্ত অসুস্থ। আমরা এদের না খেয়ে ফেললে, এরা এক সময় অসুস্থতাই মারা যেত।
মানুষ তার খাদ্য হিসেবে মাংসের চাহিদা মেটানোর জন্য মুরগির সাথে যে ধরনের আচরণ করছে, তা শুধু অমানবিকই নয়; রীতিমত নৃশংসতা।