তাবলীগ জামাত দ্বন্দ্ব

maxresdefault (46)
কি কেন কিভাবে

তাবলীগ জামাত দ্বন্দ্ব

ভূমিকা

বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামী আন্দোলন তাবলীগ জামাত বেশ কয়েক বছর ধরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ভারতের তাবলীগ জামাতের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তাবলীগ জামাতের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়।

তারপর থেকে তাবলীগের সবচেয়ে বড় সম্মেলন বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে, বাংলাদেশে তাবলীগের দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যকার উত্তেজনা একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব কেন ?

বিশ্ব ইজতেমা

তাবলীগ জামাত একাধারে একটি সংগঠন এবং আন্দোলনের নাম। বিশ্বব্যাপী ইসলামের বার্তা প্রচার করা এবং মানুষ কে আল্লাহর পথে ডাকা এই সংগঠনের প্রধান কাজ। তবে তাবলিগ জামাত অমুসলিমদের বদলে, মুসলমানদের ভেতরেই সবচেয়ে বেশি ইসলামের দাওয়াত প্রচার করে। কারণ তারা মনে করে, মুসলমানদেরকেই আগে প্রকৃত ইসলামের চর্চা করতে হবে।

তাবলীগ জামাত তাদের কার্যক্রমের দিক থেকে ব্যাপক সক্রিয় হলেও, পরিচালনা গত দিক থেকে সংগঠনটি  দাপ্তরিক কার্যক্রমের খুব একটা ধার ধারে না। এর অন্যতম একটি কারণ হলো তাবলীগের অধিকাংশ কার্যক্রমই মসজিদভিত্তিক। তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় মসজিদগুলোকে বলা হয় মারকাজ।

ধারণা করা হয় বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ২০০ টি দেশে আনুমানিক প্রায় ৮ কোটি লোক তাবলিগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাবলীগ জামাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হল ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ। ভারতের তাবলীগ জামাতের কেন্দ্র হল নিজামুদ্দীন মারকাজ, পাকিস্তানের কেন্দ্র রাইবেন্ড মারকাজ এবং বাংলাদেশের কেন্দ্র কাকরাইল মারকাজ।  

তাবলীগের সদস্যদের বলা হয় সাথী। তাবলিগ জামাতের সাথীদের একত্রিত হওয়ার জন্য প্রায়ই বিভিন্ন সম্মেলন বা ইজতেমার আয়োজন করা হয়। অধিকাংশ ইজতেমাই হয়, বিভিন্ন অঞ্চল এবং দেশে কে কেন্দ্র করে। তবে সারা বিশ্বের তাবলিগের সাথীরা যাতে একত্রি হতে পারেন, সেজন্য বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে এই সমাবেশ নিয়মিত আয়োজিত হয়ে আসছে।

বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তাবলীগ জামাতের সদস্যদের অধিকাংশই রয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায়। সেকারণে এই অঞ্চলের সাথীরাই ইজতেমায় সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করেন। তবে বাংলাদেশ বিশ্ব ইজতেমার স্বাগতিক দেশ হবার কারণে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সমাবেশে যোগ দেন।

একটা সময় ইজতেমায় লোক সমাগম এতটা বেড়ে যায় যে, টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরবর্তী ১৬০ একর জায়গায়ও সবার স্থান সঙ্কুলান করা সম্ভব হয় না। এরফলে ২০১১ সাল থেক বিশ্ব ইজতেমা দুই ধাপে আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন থেকে দুই ধাপে তিনদিন করে মোট ছয়দিন এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তখন প্রথম ধাপে নির্বাচিত ৩২ টি জেলা এবং পরের ধাপে বাকি ৩২ টি জেলার সাথীরা ইজতেমায় অংশগ্রহণ করত।

তবে পরবর্তীতে পরিচালনাগত সুবিধার বদলে তাবলিগ জামাতের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিশ্ব ইজতেমা দুই ধাপে অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে। অন্তবর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবারও দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। ৩১ জানুয়ারি প্রথম পর্ব এবং ৭ ফেব্রুয়ারি ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে।

বর্তমান উত্তেজনা

বর্তমান তাবলীগ জামাতে বিভক্তি তৈরী হয়েছে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ নেতা ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির কারণে। তার অনুসারীরা সাদপন্থী এবং বাংলাদেশে তার বিরোধীরা জুবায়ের পন্থী হিসেবে পরিচিত। যদিও তাবলীগের সক্রিয় সাথী নয় এমন বহু আলেমও মাওলানা সাদ এর বক্তব্যের বিরোধীতা করেন। সামগ্রিকভাবে তাদেরকে সাদ বিরোধী ওলামা মাশায়েখ বলা হয়।

মাওলানা সাদ এর বিতর্কিত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সাল থেকে সাদপন্থী এবং জুবায়ের পন্থীরা আলাদা আলাদা দুই ধাপে ইজতেমা আয়োজন করতে শুরু করে। অতীতে মাওলানা সাদ কান্ধলভি নিয়মিত ইজতেমায় আসতেন এবং আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করতেন। কিন্ত বিরোধিতার কারণে সাদ কান্দালভি ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে ইজতেমায় আসতে পারছেন না।

গত ৫ নভেম্বর সাদবিরোধী ওলামা মাশায়েখরা ঢাকায় সমাবেশ করে সাদপন্থীদের নিষিদ্ধসহ নয় দফা দাবি পেশ করেন। সমাবেশে সাদবিরোধীরা ঘোষণা করেন যে তারা একটি একক ইজতেমা চান, যেখানে সাদ কান্দালভির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ থাকবে এবং বাংলাদেশে তাবলীগের কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থীদের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। সাদপন্থীরাও এর বিরুদ্ধে কর্মসূচি গ্রহণ করলেও, পরবর্তীতে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় তারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন।

যেহেতু কাকরাইল মসজিদ বাংলাদেশ তাবলীগ জামাতের কেন্দ্র, তাই কাকরাইল মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়াটা উভয় পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ন। প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিগত সাত বছর ধরে, সাদপন্থিরা দুই সপ্তাহ এবং জুবায়েরপন্থিরা চার সপ্তাহ করে পর্যায়ক্রমে কাকরাইল মসজিদে অবস্থান করে আসছিলেন। জুবায়েরপন্থিদের দাবি, তারা সংখ্যায় বেশি হওয়ার কারণে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাকরাইল মসজিদের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে তারা। তবে সরকারের বিব্রত হওয়ার আশঙ্কায় তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, আগের মত সমঝোতার ভিত্তিতেই পালাক্রমে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

সাদপন্থীরা অভিযোগ করেন যে, সাদ কান্দালভির কিছু বক্তব্য, যেমন ধর্মীয় শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ না নেওয়া এবং ওয়াজ ও মিলাদের জন্য টাকা গ্রহণ না করার পরামর্শ, কওমি মাদ্রাসার আলেমদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া কওমি মাদ্রাসা-ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বিশ্ব ইজতেমায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার করার জন্যই তাবলীগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছে। তবে হেফাজতের নেতারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সাদ কান্দালভি নবী-রাসুলদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, সেকারণেই তিনি ইজতেমায় আসার অযোগ্য। তাছাড়া হেফাজতের নেতারা প্রশ্ন রাখেন, পাকিস্তানে তো হেফাজতে ইসলাম নেই, তাহলে মাওলানা সাদ কে কেন পাকিস্তানেও যেতে দেওয়া হয় না?

তবে বাংলাদেশের সাদপন্থীরা এখনও যে কোন মূল্যে মাওলানা সাদ কে ইজতেমায় নিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাওলানা সাদ আসলে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরী হবার আশঙ্কায় বিগত কয়েক বছর ধরেই তাকে  ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অতীতে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, মাওলানা সাদ ইজতেমার জন্য ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেনও, কিন্তু তাকে আবার বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়েছে।

তাবলিগ জামাতে বিভক্তির কারণ

তাবলিগী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি তাবলিগ জামাতের প্রথম আমির হিসেব দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। তার মৃত্যুর পর মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভি তাবলিগ জামাতের আমির নিযুক্ত হন। তাঁর পর মুহাম্মদ এনামুল হাসান কান্ধলভি তাবলীগের তৃতীয় আমির হিসেবে দ্বয়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তাবলিগ জামাতে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তা মূলত তাবলিগের তৃতীয় আমির মাওলানা এনামুল হাসান এর মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয়েছিল।

তৎকালীন আমির মাওলানা এনামুল হাসান ইন্তেকালের ২ বছর আগে ১৯৯৩ সালে তাবলিগের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি মসলিশে শুরা গঠন করেছিলেন। এই শুরা কমিটিতে ভারতের নিজামুদ্দিনে ৫ জন, পাকিস্তানের ৪ জন এবং বাংলাদেশের ১ জন সদস্য ছিলেন। সেই ১০ জন শুরা সদস্যের মধ্যে বয়স ও অভিজ্ঞতায় সবার ছোট ছিলেন মাওলানা সাদ কান্ধলভি।

অন্যান্য মুরুব্বিরা বেশ বয়স্ক হবার কারণে, মাওলানা সাদ একাই বেশ কিছু দায়-দায়িত্ব পালনের সুযোগ লাভ করেন। পরবর্তীতে বয়স্ক শুরা সদস্যরা পর্যায়ক্রমে ইন্তেকাল করতে থাকেন। কিন্তু তাদের ইন্তেকালের পর মাওলানা সাদ নতুন কোনো শুরা সদস্য নিয়োগ করতে দেননি।

২০১৫ সালে পাকিস্তানের লাহোরের রাইবেন্ডে ইজতেমা চলার সময়, ১৩ সদস্য বিশিষ্ট “আলমী শুরা”বা বৈশ্বিক পরিচালনা পর্ষদ গঠনের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু  মাওলানা সাদ সেসময়ও শুরা গঠনের বিরোধীতা করেন। পরবর্তীতে একসময় তিনি নিজেকে সারা বিশ্বের তাবলিগ জামাতের আমির হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর নাতি। তাই সেসময় তার আমির হবার বিষয়ে তেমন কোনো আপত্তি আসেনি।

পরবর্তীতে ২০১৬ সালে তাবলিগের মূল কেন্দ্র নিজামুদ্দীন মারকাজে আলমী শুরা গঠনের বিষয়টি নিয়ে সর্ব প্রথম দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে সমস্যা আরো জটিল হতে থাকে যখন মাওলানা সাদ কান্ধলভি বেশ কিছু বিতর্কিত বক্তব্য প্রদান শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কুরআন, হাদিস, ইসলাম, নবি-রাসুল ও নবুয়ত এবং মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।

এক পর্যায়ে তাবলীগের কয়েকজন মুরুব্বী এবং আলেম, মাওলানা সাদ এর বিরুদ্ধে কোরআন-সুন্নাহর ভুল বিশ্লেষণ করার অভিযোগ এনে তাবলিগ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ঘোষণা করেন। তার বিতর্কিত বক্তব্য প্রত্যাহার করার জন্য ওলামায়ে দেওবন্দসহ বিশ্বের আলেম-ওলামারা অনুরোধ করেন। এর ফলশ্রুতিতে তিনি বার বার তার বক্তব্য প্রত্যাহার করেও, আবারো সেই আগের বয়ান গুলো চালিয়ে যেতে থাকেন।

তখন তাবলিগের মুরব্বি, শুভাকাঙ্খী এবং আলেম-ওলামারা মাওলানা সাদ এর ইসলামের শরিয়ত থেকে ছিটকে পড়া এবং তাবলিগ জামাতে ফেতনা ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে মাওলানা সাদ এর অনুসারীরা “এতায়াতি” নাম ধারণ করে এবং অপরদিকে আলেম-ওলামাদের পক্ষের লোকজন “আলমি” নাম ধারণ করলে; তাবলিগ জামাতের দুটি পক্ষ দাড়িয়ে যায়। বর্তমানে দুই পক্ষই প্রতিপক্ষের সমর্থন আদায় না হওয়া পর্যন্ত একে অপরকে বয়কট করার ঘোষণা দিয়েছে।

তাবলিগ জামাত শুরু থেকেই দেওবন্দি আন্দোলনের একটি শাখা হিসেবে বিবেচিত হত। তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস নিজেও দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র ছিলেন। অতীতে তাবলীগের সকল আমির সহ মুরুব্বীরা দারুল উলুম দেওবন্দের ফয়সালার উপরে কোন ধরনের কোন কথা বলতেন না। সেই দেওবন্দের ওলামায়ে কেরামও মাওলানা সাদ সাহেবের আপত্তিকর ধারণা এবং বক্তব্যগুলোকে একাধিকবার শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।