আমেরিকা কি সেন্ট মার্টিন দখল করবে
আমেরিকা কি সেন্ট মার্টিন দখল করবে
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন কে রক্ষায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশকিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল। নতুন নিয়ম অনুযায়ী নভেম্বর মাস থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও, সরকার ঘোষিত পর্যটন মৌসুমেও ভ্রমণ পিপাসুরা সেন্টমার্টিনে যেতে পারছেন না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা এবং কাজের মিল না থাকায়, শেখ হাসিনার উদ্ভাবিত একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নতুন করে আলোচনায় এসেছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পরও বলেছেন, সেন্ট মার্টিন আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করলে শেখ হাসিনা আরো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারতো। শেখ হাসিনার এমন বিতর্কিত মন্তব্যের জবাবে, মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছিল বাংলাদেশের সার্বভৌম এলাকা দখলের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোন আগ্রহ নেই।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সেন্ট মার্টিন নিয়ে নজিরবিহীন কড়াকড়ি আরোপ করা এবং পর্যটন কার্যত বন্ধ করে দেওয়ার পর; সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে এবার হয়তো সেন্ট মার্টিন সত্যি সত্যি আমেরিকাকে দিয়ে দেওয়া হবে। কথিত আছে যে আমেরিকা সেন্ট মার্টিন দখল করে এখানে একটি সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি
যুক্তরাষ্ট্র নিজেই বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হওয়া সত্তেও, তারা বৈশ্বিক নিরাপত্তার অযুহাত দিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। পৃথিবীর প্রায় ৮০টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭৫০টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে; সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাপানে ১২০ টি, জার্মানিতে ১১৯ টি এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭৩ টি মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে।
এসব ঘাটির মধ্যে অনেকগুলো আকারে বেশ ছোটো এবং অস্থায়ী। অস্থায়ী ছোট ঘাঁটিগুলো লিলি প্যাড নামে পরিচিত। এ ধরনের সামরিক ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রাখতে এবং মিত্রদের সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করে। লিলি প্যাড গুলো গড়ে তোলার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে বড় বড় ব্যয়বহুল ঘাঁটি স্থাপন না করেও যুক্তরাষ্ট্র তাদের সকল ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
সত্যিকার অর্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ঘাঁটিগুলো সারা পৃথিবীতে এমনসব কৌশলগত অবস্থানের তৈরি করেছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আর কোন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন না করলেও, তারা মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে আগ্রাসী হামলা চালানো অথবা হামলা প্রতিরোধ করার সক্ষমতা রাখে।
দিয়েগো গার্সিয়া
সেন্টমার্টিনের মতো ছোট এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সামুদ্রিক দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এ ধরনের সামুদ্রিক ঘাঁটির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দ্বীপ হলো: ভারত মহাসাগরে থাকা দিয়েগো গারসিয়া দ্বীপ, প্রশান্ত মহাসাগরে থাকা গুয়াম দ্বীপ এবং ওয়েক আইল্যান্ড। এছাড়া উত্তর আমেরিকার বাইরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র অঙ্গরাজ্য হাওয়াই দ্বীপুঞ্জ এবং জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপেও যুক্তরাষ্টের ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি রয়েছে।
এসব প্রত্যেকটি ঘাঁটির আকারই ভিন্ন ভিন্ন রকমের এবং প্রত্যেকটি সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা হয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে সেন্ট মার্টিনের সাথে সবচেয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ দ্বীপ হল দিয়েগো গার্সিয়া। কারণ এটিও একটি প্রবাল দ্বীপ। অন্যান্য দ্বীপগুলোতে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষে নিয়ম নীতি মেনে তৈরী করা হলেও, দিয়েগো গার্সিয়ার বিয়টি অত্যন্ত বিতর্কিত।
দিয়েগো গার্সিয়া ছিল মূলত একটি ব্রিটিশ ওভারসীজ টেরিটরি। এটি চ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ। অতীতে জাতিসংঘ এই দ্বীপটিকে স্বাধীনতা দেওয়ার নির্দেশ দিলেও, যুক্তরাজ্য তা না করে, একটি গোপন চুক্তির মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার জন্য দ্বীপটি লিজ দেয়। তারচেয়েও জঘন্য বিষয় হল, সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার আগে ব্রিটিশরা এই দ্বীপের সকল বাসিন্দাকে জোড় পূর্বক উচ্ছেদ করে, মরিশাসে নিয়ে যায়। এমন নৈসর্গিক সামুদ্রিক দ্বীপে বসবাসকারী স্বাধীন জনগোষ্ঠকে, মরিশাসে অত্যন্ত মানবেতন জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হয়।
ঘাঁটিতে কী থাকে?
দিয়েগো গার্সিয়া সবচেয়ে ছোট সামুদ্রিক দ্বীপে গড়ে তোলা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি। এই দ্বীপটির আয়তন প্রায় চার হাজার একর। কিন্তু সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আয়তন মাত্র দুই হাজার একরেরও কম। তারমানে সেন্ট মার্টিন আমেরিকার সবেচেয়ে ছোট সামুদ্রিক ঘাঁটির অর্ধেকেরও চেয়েও ছোট।
একটি দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক হাজার একর জমির দরকার হয়। কারণ একটি পূর্নাঙ্গ ঘাঁটি পরিচালনার জন্য দ্বীপে বিমান অবতরণের রানওয়ে, সমরাস্ত্র সংরক্ষণাগার, এবং প্রশিক্ষণ এলাকা সহ আলো বেশ কিছু জরুরী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়।
সামুদ্রিক ঘাঁটিতে বিমান অবতরণ ও উড্ডয়নের জন্য রানওয়ে থাকা আবশ্যক। সাধারণত একটি রানওয়ে প্রায় ৮ থেকে ১২ হাজার ফুট লম্বা হতে পারে। নৌবাহিনীর জাহাজ এবং সাবমেরিন রাখার জন্য উন্নত বন্দরের ব্যবস্থা থাকতে হয়। শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণ ও আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে উন্নত রাডার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকে। আকাশ প্রতিরক্ষা ও হামলার জন্য মিসাইল ও সমরাস্ত্র সংরক্ষণেরও জায়গা প্রয়োজন। সেইসথে সৈন্যদের থাকার জন্য ব্যারাক, চিকিৎসা কেন্দ্র, এবং বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হয়। সৈন্যসংখ্যা ঘাঁটির আকার ও কৌশলগত গুরুত্বের উপর নির্ভর করে কয়েক শত থেকে কয়েক হাজার সৈন্য থাকতে পারে।
সেন্ট মার্টিনে ঘাঁটি সম্ভব?
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ও সৈন্যদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য যে পরিমাণ জমির দরকার, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সেই পরিমাণ জমি নেই। তারচেয়েও বড় কথা হল সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি অত্যন্ত নাজুক একটি প্রবাল দ্বীপ। ফলে ভূসংস্থানগত দিক বিবেচনায় নিয়ে দ্বীপটি সামরিক ঘাঁট তৈরী করার জন্য মোটেও উপযোগী নয়। সেন্ট মার্টিনের মাটির উপরিভাগে বালু থাকলেও, এর মাত্র ৩ ফুট নিচেই রয়েছে প্রবাল ও শৈবালের স্তর। ফলে সামরিক ঘাঁটিতে যে ধরনের বিমান অবতরণ করে, তার ভার বহনের মত সক্ষমতা সেন্ট মার্টিনের নেই। বরং ভবিষ্যতে এই দ্বীপের অস্তিত্ব নিয়েই ভূতাত্ত্বিকরা শংকিত। তারচেয়েও বড় কথা হল সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মহীসোপানের গভীরতা এতটাই কম যে, এখানে বিমানবাহী রণতরী বা বড় যুদ্ধজাহাজ তো দূরের কথা, মাঝারি ও ছোট রণতরীও ভিড়তে পারবে না। সে কারণে এখানে আধুনিক নৌবন্দরও গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
শুধু সেন্ট মার্টিনের ভূতাত্তিক দিক থেকেই নয়, ভৌগলিক কৌশলগত দিক থেকেও সেন্ট মার্টিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মোটেও আকর্ষণীয় নয়। কারণ বঙ্গোপসাগরের দুই প্রান্তে চীন ইতোমধ্যেই তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। একদিকে শ্রীলংকার হাম্বানটোটা এবং অন্যদিকে মিয়ানমারের কায়ুকফায়ু গভীর সমুদ্রবন্দর চীনের মহাপরিকল্পনার আওতায় গড়ে তোলা হয়েছে। যার ফলে মার্কিন ঘাঁটিতে রসদ পাঠাতে এবং ডুবোজাহাজ বা যুদ্ধ জাহাজ বঙ্গোসাগরে ঢুকতে বা বের হতে গেলে দুই দিক থেকে চীনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
তাছাড়া চীনের দোরগোড়ার ফিলিপাইন এবং জাপান থেকেই যেখানে অ্যামেরিকা তাদের সামরিক ঘাঁটির আকার ছোট করে ফেলেছে। সেখানে সেন্ট মার্টিনের মত ছোট একটা দ্বীপ আমেরিকা কেন চাইবে? শুধু তাই নয়, চীনকে মোকাবেলা করার জন্য সেন্ট মার্টিনের চেয়েও অনেক সেরা কৌশলগত জায়গায় ইতোমধ্যেই একাধিক মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে।
১৯৮০-এর দশকেও বাংলাদেশের বামপন্থীরা সেন্ট মার্টিন কে ঘিরে একই ধরনের বিতর্ক তুলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধীতা করেছিল। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবেই সেন্ট মার্টিনে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলা সম্ভব নয় বলে, সেসময় এই বিতর্ক ধামাচাপা পড়ে যায়।
সত্যিকার অর্থে সেন্ট মার্টিনে ঘাঁটি তৈরী করে যদি যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হত, তাহলে তারা বহু আগেই ছলে বলে কৌশলে তা করে ফেলত। সেই সাথে দেশ বিক্রি করে দেওয়ার মত রাজনৈতিক দলেরও অভাব ছিল না বাংলাদেশে। সুযোগ থাকলে শেখ হাসিনাই সবার আগে এই প্রস্তাবে রাজি হত। শেখ হাসিনা নতুন করে এই কাল্পনিক বিতর্ক হাজির করে, রাজনৈতিকভাবে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে মাত্র। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা দেশ বিক্রি করে না। অথচ বহু আগেই থেকেই শেখ হাসিনা আপদমস্তক ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে বসে আছে।