আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ভেঙে পড়ছে কেন
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ভেঙে পড়ছে কেন
ভূমিকা
বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মানুষ শুধু মহাকাশেই পৌছে যায়নি, বরং মহাকাশে নিয়মিত বসবাসও করছে। পৃথিবীর বাইরে মানুষের একমাত্র বসতি হল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। যা Intenational Space Station বা ISS নামে অধিক পরিচিত।
এটি মূলত একটি গবেষণাগার। ভবিষ্যতে মহাশূন্যের আরো গভীরে অভিযান পরিচালনার জন্য যে ধরনের জ্ঞানের দরকার, সেসব বিষয়ের গবেষণা করা হয় আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে। ২০০০ সালে এই গবেষণাগারটি তৈরীর সময় ধারণা করা হয়েছিল, এটি হয়ত ১৫ বছর টিকবে। কিন্তু ইতোমধ্যেই গবেষণাগারটি প্রায় ২৪ বছর ধরে চলছে। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং অংশীদার দেশগুলোর আগ্রহের কারণে এর মেয়াদ বারবার বৃদ্ধি করা হয়েছে।
২০৩০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ব্যবহৃত হওয়ার কথা থাকলেও, ইতোমধ্যেই বেশ কিছু ত্রুটির কারণে স্টেশনটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ৫০টি স্থানে ফাটল খুঁজে পাওয়া গেছে, যার মধ্যে চারটি বেশ বড় ধরনের। এর ফলে মহাকাশ স্টেশনের বাতাস বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার মত মারাত্নক ঝুঁকিও তৈরী হচ্ছে।
মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন মহাশূন্যে মনুষ্য নির্মিত সবচেয়ে বড় স্থাপনা। পৃথিবীতে বিভিন্ন খন্ডে এই স্টেশন নির্মান করে, মহাকাশে নিয়ে এগুলোকে জোড়া দেওয়া হয়েছে। মহাকাশ স্টেশনের একেকটি খন্ড বা মডিউল তৈরী করা হয়েছে এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার একাধিক দেশের সহায়তায়। মডিউলগুলোকে পৃথিবী থেকে মহাকাশের নির্মান স্থলে পৌছানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছে ৩ ধরনের রকেট। রকেটগুলো হল আমেরিকান স্পেস শাটল, রাশিয়ান প্রোটন রকেট ও রাশিয়ান সয়ুজ রকেট। এই রকেটগুলো আবিষ্কার না হলে, মাহাকাশ স্টেশন কখনই নির্মান করা সম্ভব হত না। রকেটগুলো ব্যবহার করে মহাশূন্যে ভাসমান এই মানব দূর্গ নির্মান করতে ১৩ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। এই স্টেশন নির্মানের শুরুটা হয়েছিল আমেরিকান ও রাশিয়ান দুটি স্টেশন কে মহাকাশে সংযুক্ত করার মাধ্যমে।
আমেরিকান এবং রাশিয়ান দুটি মহাকাশ স্টেশনকে সংযুক্ত করার ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই। এটি ছিল Apollo-Soyuz Test Project (ASTP), যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রথম যৌথ মহাকাশ মিশন। মার্কিন অ্যাপোলো মহাকাশযান ১৫ জুলাই ১৯৭৫ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়। একই দিনে সোভিয়েত সয়ুজ মহাকাশযানও উৎক্ষেপণ করা হয়। দুই দিন পর ১৭ জুলাই, মহাকাশে দুটি মহাকাশযানকে একসাথে সংযুক্ত করা হয়।
২০০০ সাল পর্যন্ত একের পর এক এই স্টেশন উন্নয়নের কাজ চলতে থাকে। পরবর্তীতে ২০০০ সালের নভেম্বরের পর থেকে মহাকাশচারীরা নিয়মমিতভাবে এখানে বসবাস করতে শুরু করে। এরপর থেকে এখনও পর্যন্ত মহাকাশ স্টেশন কখনও জনশূণ্য হয়নি।
বর্তমানে মহাকাশ স্টেশনটির দৈর্ঘ্য একটি ফুটল মাঠের চেয়েও বড়, এবং এর ভেতরের পরিসর ৬ বেডরুমের একটি বাসার সমান। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রতি ঘন্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। এই গতিতে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে আইএসএস এর সময় লাগে মাত্র ৯২ মিনিট।
মহাকাশ স্টেশন তুলনামূলক পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে প্রদক্ষিণ করে। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আইএসএস পৃথিবীর আরো কাছাকাছি চলে আসে। যদি কোন ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে এটি প্রচন্ড গতিতে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করবে, আর সাথে সাথে এর বাইরের আবরণে সৃষ্টি হবে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। এ ধরনের মারাত্নক দূর্ঘটনা রোধ করতে, নির্দিষ্ট সময় পর পর, বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্যে স্টেশনকে ঠেলে উপরের দিকে পাঠানো হয়। যাতে করে, স্টেশন তার নিজস্ব কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে পারে।
মহাকাশ স্টেশনে বসবাস
সার্বক্ষণিকভাবে ৬ জন নভোচারী মহাকাশ স্টেশনে অবস্থান করে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল, এমনসব বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণা করা, যা শুধুমাত্র মহাশূন্যেই করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে সাধারণত প্রত্যেক নভোচারীর অবস্থানের সময় হল ৬ মাস। কিন্তু কোন কোন আইএসএস কর্মীকে প্রায় বছরখানেক এখানে থাকতে হয়। দীর্ঘ সময় পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে মানব শরীরে কি কি ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তাদের উপর সেসব পরীক্ষা করা হয়।
বর্তমানে ১৫ টি দেশ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তাদের গবেষণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করে। এখানে কাজ করা দেশগুলো হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, জাপান এবং ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সির অধীনে থাকা ১১ টি দেশ।
বহু দেশের দক্ষ গবেষকদের অংশগ্রহণের কারণে, প্রকৃত পক্ষেই এটি একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণাগারে পরিণত হয়েছে। তিন দশকের বেশি সময়ে প্রায় সাড়ে তিনশ জনেরও বেশি নভোচারী এই মহাকাশ স্টেশনে কাজ করেছেন। অতীতে মহাকাশ স্টেশন থেকে ফিরে আসার সময় ২ টি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নভোচারী মারা যায়।
মহাকাশ স্টেশনে ফাটল
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে মহাকাশচারীরা দ্রুত তা মেরামত করার চেষ্টা করেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে স্টেশনটিতে ছিদ্র ও ফাটলের মাত্রা অনেক বেড়েছে। যে কোন যানবাহনের মতই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণে এসব সমস্যা তৈরী হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের রাশিয়ান অংশেই মূলত সবচেয়ে বেশি ফাটল দেখা যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ৫০টি স্থানে ফাটল খুঁজে পেয়েছেন রাশিয়ার প্রকৌশলীরা। যার মধ্যে বড় ধরনের চারটি ফাটল চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে মহাকাশ স্টেশনে থাকা নভোচারীরা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন। ফাটল মেরামতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ও রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা রোসকসমস।
ISS এ ফাটলের ফলে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে, তারমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হল কিছু ফাটল িদয়ে বাতাস বের হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ১.৭ কেজি বাতাস বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, কোন ফাটল দিয়ে এই বাতাস বের হচ্ছে, সেটিই চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
যে চারটি বড় ধরনের ফাটল রয়েছে, সেগুলো আপাতত বন্ধ করা হলেও পুরোপুরি দুর্ঘটনার আশঙ্কা মুক্ত নয়। সেকারণে মহাকাশ স্টেশনে থাকা রাশিয়ার কম্পার্টমেন্টের একটি অংশ সম্পূর্ন বন্ধ করে ফেলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ১১ জন নভোচারী স্পেস স্টেশনে বসবাস করছে। নাসা বলছে আপাতত তারা নিরাপদে আছেন। কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করা মহাকাশ স্টেশনে, তাদেরকে আর বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
মহাকাশ স্টেশনের অবসান
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ইতেোমধ্যেই তার নির্ধারিত কার্যকালের চেয়ে ১০ বছর অতিরিক্ত ব্যবহৃত হচ্ছে। সেকারণে একে দ্রুত সময়ের মধ্যে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই কাজটি করার জন্য নাসা, ইলোন মাস্কের কম্পানি স্পেস এক্সের সাথে চুক্তি করেছে।
স্পেস এক্স এমন এক মহাকাশ যান তৈরী করবে, যার সাহায্যে মহাকাশ স্টেশনকে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া হবে। একে যদি সফলভাবে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে সরানো না যায়, তাহলে স্টেশনটি পৃথিবী পৃষ্ঠে আছড়ে পড়বে। কিন্তু মহাকাশ স্টেশন কে অবসরে পাঠানোর কাজটি খুব একটা সহজ হবে না।
ভবিষ্যতের আরো উন্নত মানববাহী মহাকাশ প্রকল্প Artemis Program বা Gateway বাস্তবায়ন হতে ধারণার চেয়ে বেশি সময় লাগছে। সেকারণেই এক প্রকার বাধ্য হয়ে মেয়াদউত্তীর্ণ এই স্টেশনকে এখনও টিকিয়ে রাখা হয়েছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই গবেষণাগারটি ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের পরে হয়ত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন কে বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে। তখন বেসকারি কম্পানি গুলো এখানে গবেষণা পরিচালনার সুযোগ পাবে। এছাড়া মহাকাশ পর্যটনে ধনী ব্যক্তিরা মহাকাশে ঘুরতে গেলে ISS কে তাদের হোটেল হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। যার মাধ্যমে টাকা খরচ করে যে কেউ মহাকাশে কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে আসতে পারবে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের অবসানের পর, রাশিয়া তাদের নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন তৈরী করবে। এছাড়া চীন ইতোমধ্যে Tiangong Space Station নামে নিজস্ব একটি মহাকাশ স্টেশন ২০২১ সালেই মহাকাশে পাঠিয়েছে। এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের অার্টেমিস মিশনের মাধ্যমে সরাসরি চাঁদের বুকে মানব বসতি গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। এবং চাঁদের কক্ষপথেই তারা একটি নতুন মহাকাশ স্টেশন তৈরী করবে।